স্মৃতি, শিশুর সরল প্রশ্ন ও আমার অসহায়ত্ব

লিখেছেন লিখেছেন ফজলে এলাহি মুজাহিদ ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:০০:১৮ রাত

মেয়েটার ক্ষতির কোন চিন্তাই মাথায় এলো না; বরং সন্তানের মাকে নিয়ে ছিল সবটুকু ভয়। বার বার এমন সব সমস্যার কথা জেনেছি যে, নিজেও শংকিত হয়ে পড়েছিলাম। অপারেশন থিয়েটারে যাবার প্রাক্কালে এমন ভাবে বিদায় নিচ্ছিলো যেন এই বুঝি শেষ দেখা। মনটা আরো ছোট হয়ে পড়েছিল। দারুন উৎকণ্ঠায় প্রতিটি মুহূর্ত যেন দীর্ঘ প্রহর। কিন্তু দেখলাম, চিন্তায়, ক্লান্তিতে অথবা আল্লাহর রহমতে অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিছুটা সময় মাত্র, তবুও মাথাটা হালকা হলো যেন।

অপেক্ষা করছিলাম, কখন ডাকবে। ডাক এলো, ভেতরে গেলাম, শিশুদের জন্মোপরের প্রাথমিক অবস্থা রিপোর্ট করার বাংলাদেশী ডাক্তার জানালেন, বাচ্চার অবস্থা ভালো না। তবে বাচ্চার মা ভালো আছেন। তখনো মনে স্থান দেইনি, অনুমতি নিয়ে কানে আযান শোনালাম। জানিনা, মা আমার শব্দ শুনতে পেয়েছিল কি না। নিদারুন এক হেঁচকি তাকে যেন সংজ্ঞাহীন করে রেখেছিল তাকে। তবুও আশাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আনন্দিত হবার চেষ্টা করলাম। না! ডাক্তার আমাকে আতংকের কথা শোনাতে লাগলেন। ধীরে ধীরে পায়ের তলার মাটিও যেন নরম হতে থাকলো। আমি দেয়াল ধরে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করতে থাকলাম।

তারপর অনেক, অনেক দীর্ঘ আটটি দিন কেটে গেল। ডাক্তারের ডাক এলো, মেয়ে আমার তার মায়ের কোলে এলো, হাসপাতালের বিভিন্ন নিয়মনীতির কাগজপত্র এলো, আমার মেয়েটি আমারও কোলে এলো, তবে বরফ-শক্ত তার দেহ! সাদা কাফনে মোড়ানো তার সাজ! চিরদিনের জন্যই এলো আর চলে গেলো হৃদয়ের একটি অতি আকাংখিত অংশ। আমি খালি হাতেই ফিরে এলাম আমার সাজানো(?) নীড়ে।

ভূমিকার স্মৃতিগুলো টানলাম যার কারণে, সে আমার বড় মেয়ে। পাঁচ ছেড়ে ছয়-এর মাঝামাঝিতে চলছে মাত্র। চিন্তাগুলো দারুন সরল। প্রশ্নগুলোও তদ্রূপ। সম্পর্কে হিসাব-নিকাষও আকর্ষনীয় সরল। আপনি তার জন্য যা নিয়ে আসবেন, সে অনুযায়ী 'মামা' বা 'দাদা/নানা' যুক্ত হয়ে তার সাথে সম্পর্কিত হবেন। যেমন, কেউ চকলেটমামা, কেউ ফুলমামা, কেউবা বিমানআন্টি আবার কেউ কেউ অবশ্য কালানানা, কালাদাদা ইত্যাদি নামও পেয়েছেন।

হৃদয়ের যে অংশটিকে চিরতরে মাটিচাপা দিয়ে আসতে হয়েছিল, তাকে যখন তার বোনের সামনে এনেছিলাম, সে জানতে চাইলো: আপু উঠেনা কেন? সবাই বললো: সে ঘুমাচ্ছে। এখন বড় মেয়ের বয়স সাত ছুঁই ছুঁই করলেও এখনো বাকী কবরস্থানের পাশ দিয়ে বাবার গাড়ীতে চড়ে যাওয়ার সময় নিয়মিত তার আপুর জন্য কবরের দো'আ পড়ে। হাত নেড়ে নাম ধরে বিদায় জানায়। ব্যস্ততায় আমরা ভুলে গেলেও সে কখনোই ভোলেনি। মাঝে মাঝে স্বগতঃই বলে, সেদিন (যেদিন আমরা তাকে তার আপুকে দেখিয়েছিলাম) যদি আপুকে জোরে জোরে ডেকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে এখন আপু আমাদের সাথে থাকতো।

কখনো বলে: বাবা, আপুকে নিয়ে আসো না কেন? চল, আমিসহ গিয়ে কবর ভেঙ্গে নিয়ে আসি। তারপর আর কখনো যেতে দেব না।

জামাকাপড় কিনলে দু'একটি তার আপুর জন্য রেখে দিতে চায়। আমরা জোর করে নিরস্ত করি।তার মাকে বলে: আম্মু, আপুর জন্য যে জামা কিনেছো তা তুলে রাখো, কাউকে দিবে না।

এভাবেই চলে যায় দিন, মাঝে মাঝে দারুন অসহায় হয়ে পড়ি তার প্রশ্নবানে। কেবলি মনে হয়-

শিশুদের নিষ্পাপ-সরল প্রশ্নগুলোই বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন!

যারা মিথ্যা বলতে পারি, তারা মিথ্যা দিয়েই বুঝিয়ে দেই।

যারা এড়িয়ে যেতে চাই, তারা ধমক দিয়ে থামিয়ে দেই।

আর যারা দু'টোর কোনটাই পারি না, তারা অতি দুর্বল, আয়তনে ক্ষুদ্র এবং তাদেরই লালিতদের নিকট দারুন অসহায় হয়ে পড়ি।


www.fazleelahi.com থেকে পড়ুন।

বিষয়: বিবিধ

১২৭৯ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

340564
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০৩:২২
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:৫০
282016
ফজলে এলাহি মুজাহিদ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
340586
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ১০:৩৩
আবু জান্নাত লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ভাইয়া, এতদিন ক্লিয়ার হলাম, আপনি আমাদের প্রিয় আপুনির প্রাণপ্রিয় স্বামী, মানে আমাদের দুলাভাই।

ইস! কাছে পেলে না, কান মলা দিতাম। Rolling on the Floor Rolling on the Floor

হায়াত মাওত মহান রব নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, তাতে মানুষের কোন হাত নেই, তাই রবের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়াই ইবাদুর রহমানের বৈশিষ্ট, মুজাহিদ ভাই ও লায়লা আপুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইল। জাযাকাল্লাহ খাইর

০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুর ০১:৫৭
282036
ফজলে এলাহি মুজাহিদ লিখেছেন : মন্তব্য পড়ে তো শ্বশুর বাড়ীর লোকজন মনে হচ্ছে :Thinking
ভালো লাগলো মন্তব্য। ধন্যবাদ পড়ার এবং দো'আ করার জন্য।
340591
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ১০:৪৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : মর্মস্পর্সি লিখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহতায়লা আপনাদের উপর রহম ও সবর দিন।
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০২:৪৭
282193
ফজলে এলাহি মুজাহিদ লিখেছেন : মর্ম স্পর্শ করতে পেরেছে জেনে আনন্দ বোধ করছি। জাযাকাল্লাহ্ খায়ের।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File