আমার মায়ের শিক্ষা ও একটি বে-আকল মুরগী

লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ৩১ মার্চ, ২০১৩, ০৯:৫৭:৩৩ রাত



আমার কোন বোন নাই, আমি বিরাট গৃহস্থ পরিবারের ছোট সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠেছি। কয়েকজন চাকর-চাকরানী থাকার পরও আমাকে পরিবারের কিছু কাজ করতে হত। অনেক গুলো কাজের মধ্যে হাঁস-মুরগীর দেখা-শোনা ও তাদের খবর রাখা। বিকাল বেলায় ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য কিছুটা সুযোগ মিলত। গড়ে ৫ টি মুরগী ও ৫ টি হাঁস ডিম দিত। দিনে ১০ টি করে ডিম সংগ্রহ করে তা যত্নের সহিত যথাযথ স্থানে রাখাই আমার অন্যতম দায়িত্বের একটি। গৃহস্থালি কাজে যাতে আমি মনোযোগী থাকি সেজন্য মা আমাকে পরিপূর্ণ দায়িত্ব অনুভূতি শিক্ষা দিয়েছেন। আমাকে বাহিরের চাষের কাজেও মনোনিবেশ করতে হতো। দুধের গরু ব্যতীত, ৬ টি হালের বিপরীতে ১২টি গরু সর্বদা চাষাবাদে নিয়োজিত থাকত। কামলাদের জন্য খানা, ধূমপানের জন্য বিড়ি সাপ্লাই দেওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে ছিল। বিড়ি ব্যতীত কামলারা কাজ করত না, তাই আবুল বিড়ি ও দেয়াশলাই বিরাট প্যাকেটে কিনে রাখতে হত। আমার বাবা ছুটির দিনে কখনও বিলে কিছুক্ষণ আটকিয়ে রাখতেন, যাতে মনোযোগ সহকারে হাল চাষ কিভাবে হয়, তা যাতে অবলোকন করি। একদিন পিছনের হালটি দক্ষতার সহিত চালিয়ে বাবাকে উৎফুল্ল করে দিয়েছিলাম! তিনি খুশীতে জমিনের কাদা সহ আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন! তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর অবর্তমানে আমি তাঁর কৃষি-খামারের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারব।

বাড়ী থেকে দুই মাইল দূরে আমাদের একটি খামার বাড়ি ছিল, সকল প্রকারের ফলের গাছে সৃজিত ছিল বাগানটি। ফুলের প্রতি দুর্বলতা দেখে মা-বাবা খামারের দিকে আমার আকর্ষণ বাড়াতে প্রায় ৫০ শতাংশ জায়গায় আমার জন্য একটি বিরাট ফুলের বাগান বানিয়ে দেন। মৌসুমের নতুন শাক-সবজি প্রথমেই আমাদের ক্ষেত-খামারে উৎপাদিত হত। বাড়ির পাশের জমির পেঁপে, ক্ষেতের নানাবিধ শাক-সবজি, বাগানের কলা-পেয়ারা-কাঁঠাল, নিজেদের জমির চাল, গৃহ পালিত হাঁস-মুরগীর ডিম সহ নানাবিধ দ্রব্য বাজারে বিক্রি হত। আমাদের উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির জন্য বাজারে স্থায়ী একটি জায়গা ছিল। ক্লাস ফাইভের বয়সেই জিনিষপত্র বিক্রি করার পদ্ধতি রপ্ত করেছিলাম আবার টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় বাজার করার নিয়ম রীতি আমার মেঝ ভাই থেকেই শিখেছিলাম। পুরো বছরের বাজার খরচ, মেহমান, ঈদ, মীলাদুন্নবী সহ যাবতীয় ব্যয়ভার আমার মা ক্ষেত খামারের টাকা দিয়েই সারতেন! বাবার পকেটের টাকার দরকার হতোনা। তারপরও মাসের শেষে অনেক টাকা মায়ের হাতে জমা থেকে যেত। মা ছিলেন ধনী পরিবারের বড় কন্যা তবে খুবই প্রাজ্ঞ, বুদ্ধিমতী ও পরিশ্রমী। কোন মাটিতে কি ফসল ফলবে মাটি দেখেই তিনি বলতে পারতেন। বহু মানুষ বুদ্ধি নিতে আসতেন। সকল প্রকার পিঠা তৈরিতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মেহমান আসলে খুবই খুশী হতেন, মেহমান ব্যতীত কোন ওয়াক্ত খানা বাদ পড়ত না। সাহায্য চেয়ে কেউ ফেরত যেত না, আমার স্কুলের সহপাঠীদের কেও তিনি পরিপূর্ণ মেহমান দারী করতেন। তরকারী রান্না করতেন খুবই সুস্বাদু করে। অনেকের বিশ্বাস করতেন তার হাত লাগলেই তরকারী এমনিতে সুস্বাদু হয়ে যায়। বড় বড় অনুষ্ঠানের রান্নায় মুরুব্বীরা মায়ের পরামর্শ নিতেন।

কৃষিনির্ভর পরিবার কতটা সুখী ও সমৃদ্ধশালী হতে পারে, আমাদের পরিবারটি ছিল অন্যান্য দশ পরিবারের মত একটি আদর্শ। ঘরে ঘরে কৃষি কাজ আর সন্ধ্যা হতেই ছাত্রদের পড়ার চিৎকারে পুরো গ্রাম তেতে উঠত। গৃহীনীরা ঘর সাজাতে হাতের কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাত। বাবা প্রতি মাসে একটি করে ছাগল বিক্রি করে দিতেন এতে করে কলেজ পড়ুয়া বড় ভাইয়ের পুরো মাসের খরচটাই জুটে যেত। এই টাকাতেই তিনি রাজার হালতে থাকতেন। তিনি বাড়ি আসলে বাবাকে সাধ্যমত সহযোগিতা করতেন। রাখালেরা উৎপাদিত সামগ্রী কাঁধে করে বাজারে নিয়ে যেত, বাজার যাচাই করে আমি তা বিক্রি করে দিতাম এবং মায়ের দেওয়া ফর্দ অনুযায়ী বাজার করে বাড়ী ফিরতাম। তখনকার সময়ে চাষের কাজে হাত লাগাতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন উচ্চ শিক্ষিত ছাত্র লজ্জাবোধ করতেন না। তাই আমরাও ভাবতাম, কৃষি কাজও করতে হবে, আবার লেখাপড়াও চালাতে হবে, এভাবেই সুন্দর জীবন বানাতে হয়। তাই এসব কাজ দায়িত্ব নিয়ে করতাম, কখনও লজ্জাবোধ করতাম না। স্কুলের সারদেরকেও দেখতাম লাঙল চালাতে, বীজ রোপণ করতে।

মায়ের আদেশ মত বাজার থেকে কিনতে হত লবণ, পান-সুপারি ও কেরোসিন। পরিবারের প্রয়োজন মত ক্ষেতে সরিষা, মরিচ, হলুদ, ধনিয়া, উৎপাদিত হত। উপহার হিসেবে কলস ভরা মিঠা পাওয়া যেত। উপহার মিলত পাশের চা বাগানের তাজা সুঘ্রাণ চা পাতা। যার কারণে বছরের শেষ দিকে কিছু দিনের জন্য বাজার থেকে চিনি, তৈল, ঘি কেনা লাগত। কাপড় ছাড়া অন্য কিছুর জন্য পরিকল্পনা করা লাগত না। শিক্ষা এবং উন্নত চিকিৎসা ছাড়া কাউকে শহরে যাওয়া লাগত না! ঘরে হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল থাকার কারণে গোশত, ডিম, দুধের অভাব থাকত না। মা ইলিশ মাছ খেতে পছন্দ করতেন, কম মূল্যে বরফ দেওয়া ইলিশ পাওয়া যেত। প্রতিদিন ইলিশ মাছ খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে বলতাম, ‘আমরা তো অত গরীব হই নাই যে, প্রতি ওয়াক্তে ইলিশ মাছ খেতে হবে’! মা বলতেন, এর চেয়ে সেরা কোন মাছ নাই, ‘প্রাচুর্য আছে বলে অবজ্ঞা করোনা’। খালে বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। হাই স্কুল জীবনে কখনও মা অনুরোধ করতেন আজকে ফুটবল খেলতে না গিয়ে ঘণ্টা খানেক মাছ ধরার জাল নিয়ে ঘুরে আস। ঘণ্টা খানেকের প্রচেষ্টায় দেড়-দুই কেজি ছোট মাছ ধরা যেত।

ও হ্যাঁ! আমি একটি বে আকল মুরগীর কথা লিখতে বসেছিলাম! বর্তমান সময়ের দেশের করুণ অবস্থা ও জনগণের বীভৎস পরিণতি দেখে, অতীতের সুন্দর দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলাম!

আমার মায়ের কয়েকটি নির্বাচিত মুরগী ছিল, তাদের কয়েকটিকে দিয়ে ডিমে তা দেওয়া হত। বাকী গুলোকে দিয়ে শুধু ডিম পারানোতে ব্যস্ত রাখত। তাদের মধ্যে একটি মুরগী, মা হবার প্রচণ্ড বাসনা ছিল। আগেই বলেছি ডিম গুলো আমি সংগ্রহ করে অন্যত্র গুছিয়ে রাখতাম। একটি মুরগী অনবরত কয়েক দিন ডিম দিয়ে, শেষের একটি ডিমের উপর তা দেবার বাসনায় বসে থাকত। আমি যখন সে ডিমটিও নিয়ে যেতাম, তখন সে ডিমের খোঁজে রান্না ঘরে ঢুকে পড়ত। রান্না ঘরের কোনায় রক্ষিত গোল আলুকে ডিম মনে করে, সে আলুতেই তা দেওয়া শুরু করে। আলু পচে যাবার ভয়ে, মা বললেন মুরগী টাকে ঘরের বাহিরে রেখে আস। তা বারবার করতে থাকলাম, মুরগীও নাছোড় বান্দা সে ও ততবার আলুতে তা দেবার জন্য ঘরে ঢুকে পড়ত। অতঃপর আলু গুলো বস্তায় আবদ্ধ করা হল। কিছুক্ষণ পরে মুরগীটি ঘরের চৌকির নিচে ‘কচুর ছড়া’ আবিষ্কার করল। অবশেষে সে গুলোকে ডিম ভেবে যথারীতি তা দেওয়া শুরু করল। তাকে যতই ঘরের বাহির করি, কোন এক সময় ঘরে ঢুকে কচু গুলোতে তা দিতে বসে যায়। অবশেষ বিরক্ত হয়ে মাকে বললাম,

মুরগীটির যেহেতু মা হবার বড় ইচ্ছে, অন্তত একটি বার তাকে সুযোগ দেওয়া হউক।

মা বললেন, মানব জাতির মাঝে যেভাবে আকল দার মানুষ আছে, আবার বে-আকল মানুষও আছে। ঠিক তেমনি এই মুরগীটিও একটু বে আকল প্রকৃতির! যদিও সে একটু বেশী পরিমাণে ডিম দিয়ে থাকে। তবুও বে আকলীর কারণে তাকে সে সুযোগ দেওয়া যাবেনা!

মাকে প্রশ্ন করলাম, মানুষের আকল-বে আকল হয়ত মানুষের জন্য প্রয়োজন। তবে মুরগী আকলদার হলেই বা মানুষের কি উপকার! আর বে আকল হলেই বা কি ক্ষতি?

মা বললেন, মুরগীর আকল বে আকল দিয়ে হয়ত সকল মানুষের কোন সমস্যা নাই। ‘তবে একজন গৃহস্থের পারিবারিক ও সাংসারিক কাজে একটি বে-আকল মুরগীর চরিত্রও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়’! তিনি আরো বললেন, ‘শুধু মুরগী কেন! হাঁস, গরু, ছাগলও যদি বে আকল হয় তাতেও সংসারের সমস্যা আছে’।

মা কে বললাম, মানুষ বে আকল হলে সমস্যা হয় বুঝলাম কিন্তু মুরগী বে আকল হলে কি সমস্যা একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?

মা বললেন, দেখ এই মুরগীটি খানা খাবার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর সমানে বিরক্ত করতে থাকে। যেখানে সেখানে পায়খানা করে হাঁটা চলার পথ বরবাদ করে। অন্যান্য মুরগীদের সকাল বিকাল দুই বেলা খানা দেওয়া হয়। অতিরিক্ত খানা বাড়ির আশে পাশের ঝোপ-জঙ্গল ও ঝুর ঝুরে মাটি উল্টিয়ে আহরণ করে থাকে। এতে গৃহস্থের উপর চাপ কম পড়ে, তাছাড়া উৎপাতও হয়না। এই মুরগীটি ঘরের তৈরি খানা খেতে বিরক্ত করে ছাড়ে। এই মুরগীর মা’ও ছিল এই প্রকৃতির।

এখন যদি এই মুরগীর বাচ্চা হয়, সে তার বাচ্চাদের নিয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে, খানার জন্য বিরক্ত করবে, চিৎকার করতে থাকবে, বাচ্চাদের স্বাবলম্বী করবে না অধিকন্তু তার বাচ্চারাও মা-নানীর মত বে আকলই হবে। কেননা মা বে-আকল হলে সন্তানও বে আকল হবে, এটাই দুনিয়ার নিয়ম।

তিনি আরো বললেন, এই দেখ তুমি তিন দিন ধরে একটি মুরগীর অভ্যাস বদলাতে সকাল সন্ধ্যায় পিছনে লেগে আছ! যদি তাদের সংখ্যা দশটি হয়, তখন কেমন লাগবে?

আমি বললাম, এই মুরগীর মা হবার কোন দরকার নাই। কেননা বাড়ীতে মেহমান আসলে সে বারবার মেহমান দের কক্ষে হানা দিতে চায়। শুধু এই একটি মুরগীকে পাহারা দিতেই একজন বাচ্চার হাতে ছড়ি ধরিয়ে দিয়ে মেহমানদের দরজায় পাহারা বসাতে হয়। যদি তার বাচ্চারা সাথে যোগ হয়, তাহলে সমস্যা আরো প্রকট হবে অধিকন্তু দিনের বেলা বাদ দিয়ে রাত্রেই মেহমান দারী করতে হবে।

মা আজ বেঁচে নেই, গ্রামীণ জীবনের নিভৃত পল্লীতে বসেও তিনি তাঁর সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তার আশে পাশের উপকরণ দিয়ে শিখিয়ে আমাদের মানুষ করেছেন। আজ ব্যক্তি জীবনে তাঁর উপদেশ গুলো অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হতে দেখি। শিখার যেমন শেষ নাই, শিক্ষার উপকরণেরও শেষ নাই; তবে পুরো দুনিয়াতে শিক্ষার্থীর বড় অভাব! সবাই শিখাতে চায়, শিক্ষক হতে চায়, কেউ শিখতে চায়না। তাইতো কাণ্ডারি হবার যোগ্যতা হারিয়ে, দেশ আজ শিক্ষিত বে-আকল মানুষ দিয়ে ভরে যাচ্ছে।

বিষয়: বিবিধ

১০৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File