দৈনন্দিন জীবনে শিষ্টাচার পালনের গুরুত্ব
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০২:২৩:২৯ দুপুর
দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবন বলতে আমরা বুঝি সকালে ঘুম থেকে উঠে রাত্রে বিছানায় যাওয়া পর্যন্ত, সজ্ঞানে-সচেতন মনে সকল প্রকার কাজকর্ম, কথাবার্তা, চাল-চলন, আচার-আচরণের পুরো সমষ্টিই ব্যবহারিক জীবন। কোন জাতির ব্যবহারিক জীবন কেমন হবে সেটা তাদের ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, কৃষ্টি-ললিত কলা ও সমাজের বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। যাদের জন্য কোন দিক নির্দেশনা থাকেনা, তারা দুনিয়ার দৃশ্যমান উপকরণ থেকেই এসব গ্রহণ করে। তবে, মুসলিম সমাজে মুসলমানদের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবন কেমন হতে হবে; সেটার বর্ণনা ও প্রয়োগ রীতি কোরআন-হাদিসের পাতায় পাতায় বর্ণনা করা আছে।
দৈনন্দিন ব্যাবহারিক জীবনে কিভাবে কথা বলতে হবে, কিভাবে সম্মান জানাতে হবে, কিভাবে কাজ করতে হবে, কিভাবে জীবনাচরণ পরিচালনা করতে হবে; সেভাবে শিক্ষা, সংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য, আদান-প্রদান কিভাবে হতে হবে, রাসুলুল্লাহ (সা) এসব তাঁর সারা জীবনে নিজে পালন করে, অন্যকে অনুসরণ করার তাগিদ দিয়েছেন। কাজ-কর্ম ও জীবন সম্পাদনে সবার নিকট গ্রহণীয় চরিত্রকেই বাংলায় ‘শিষ্টাচার’ বলে। আরবি ও উর্দু ভাষায় শিষ্টাচারকে আদব, তমিজ এবং ইংরেজিতে ‘ম্যানার’ হিসেবে বলা হয়। আমাদের দেশে বে-আদব, বে-তমিজ, বে-আক্কেল, নন-সেন্স, শব্দগুলো শিষ্টাচার বিহীন মানুষকে চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়। কুরআনের ভাষায় উত্তম শিষ্টাচারের মাধ্যমে সংঘটিত কাজকে আমলে সালেহ তথা সৎ কাজ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
শিষ্টাচার বিহীন কাজকে মানুষ গুরুত্ব দেয় না। এমনকি শিষ্টাচার বিহীন মানুষকে সবাই ঘৃণা করে। শিষ্টাচার বিহীন কোন কাজ জনজীবনে ভাল ও উপকারী হওয়া স্বত্বেও মানুষ সেগুলো ভালভাবে গ্রহণ করেনা। কদাচিৎ ভাল কাজ প্রতিষ্ঠাকারীকেও মানুষ ঘৃণা করে।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কখনও শিষ্টাচার শিখা যায়না, তবে এসব মূল্যবান স্থানে শিষ্টাচার প্রয়োগ ও অন্যের ভাল শিষ্টাচার দেখার সুযোগ ঘটে যায়। স্কুল-কলেজ, সমাজ-সংসার, মসজিদ-মক্তব ও অনুষ্ঠান উত্তম শিষ্টাচার প্রয়োগের মূল ক্ষেত্র। এখানে একজনকে দেখে দশ জনে শিখে। শিষ্টাচার অর্জন করতে হয় ধীরে ধীরে। তা শিখতে হয় পিতা-মাতা, পরিবার, সমাজ, ব্যক্তিগত শিক্ষক কিংবা আদর্শবান কোন প্রতিষ্ঠান থেকে।
সমাজে মূর্খ ব্যক্তিকে বে-তমিজ আচরণ করতে দেখলে, সাধারণ মানুষ তা হালকা ভাবে গ্রহণ করে কিন্তু শিক্ষিত মানুষ বে-তমিজ হলে তাকে চরমভাবে ঘৃণা করে। একজন অশিক্ষিত সন্তানের কারণে পিতা-মাতা মন্দ কথা শোনে না; বরং মন্দ শুনতে হয় বে-তমিজ, বে-আদব সন্তানের কারণে! আর বে-আদব যদি শিক্ষিত হয় তাহলে মানুষ তার উপর ত্যক্ত-ক্ষিপ্ত হয়; অনেক সময় তার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে গালি দেয়! শিষ্টাচার বহির্ভূত শিক্ষিত মানুষের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে, তাদের হাতেই সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে অসভ্যতা ভর করে।
স্কুল-কলেজের গণ্ডি মাড়ানো হয়নি কিংবা সমাজের অশিক্ষিত-নিরক্ষর মানুষকে অনেকেই মূর্খ মানুষ বলে মনে করেন! মূলত: এটি একেবারেই ভুল ধারনা। কোটি টাকায় নির্মিত বাড়ীতে লাখ টাকার রংয়ের কাজ না করালে সেটি যেমন আকর্ষণহীন হয়ে পড়ে। সেভাবে উচ্চ শিক্ষিত মানুষের আচরণে যদি সুন্দর শিষ্টাচার না থাকে। সে মানুষটির বিরাট একাডেমিক ডিগ্রীও আলোহীন হয়ে পড়ে। কম মূল্যের ঘর যদি গোছালো, পরিপাটি ও পরিছন্ন থাকে, সেটি কিন্তু আকর্ষণীয় হয়। সেভাবে অশিক্ষিত মানুষের আচরণ যদি উত্তম ও দৃষ্টিনন্দন হয় তিনি অশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষিত মানুষের চেয়েও বেশী গ্রহণ যোগ্য হয়।
আর মূর্খ হল সেই ব্যক্তি, যার জীবন-চরিত্রে উত্তম স্বভাবের গন্ধ নাই, সুন্দর শিষ্টাচারের বালাই নাই, আচরণে সৌন্দর্য নাই, ব্যবহারে নম্রতা নাই, চলনে ভদ্রতা নাই, মুখে মিষ্টি ভাষা নাই; তারা সবাই মূর্খ! হোক তিনি উচ্চ শিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর। আরবিতে এই মানুষগুলোকে জাহেল তথা অন্ধ বলে।
ইসলাম ধর্মে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে সকল প্রকার মঙ্গল সাধনের লক্ষ্যে উত্তম শিষ্টাচারকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। ইসলামে শিষ্টাচার শুধু ব্যক্তি বা সমাজ জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব জাতীয় জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই সম্প্রসারিত হয়েছে। একটি জাতি যদি সত্যিকার অর্থে শিষ্টাচারী না হয়, সে জাতির বৈষয়িক উন্নতি কখনও সম্ভব নয়। এক সময় মুসলিম জাতি নেতৃত্বে বলীয়ান হয়ে সারা দুনিয়ার ওপর প্রভুত্ব করেছিল। মুসলমানদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে সফল যোগ্যতার পিছনে শিষ্টাচার বিরাট কাজ করেছিল দেখতে পেয়ে; সম্রাট নেপোলিয়ন তার প্রতিটি জনসভায় মানুষকে উন্নত শিষ্টাচার অর্জন করার তাগিদ দিতেন।
আজকের দিনেও মুসলমানেরা অন্য জাতীর চেয়ে নৈতিক চরিত্রে বেশী বলীয়ান কিন্তু শিষ্টাচারে একেবারেই পশ্চাৎপদ! তাই আজ তারা অবহেলিত ও লাঞ্ছিত। পাশ্চাত্য জগত নৈতিকতার বিচারে মুসলমানদের বহু পিছনে অবস্থান করছে কিন্তু দৃশ্যমান বস্তুগত শিষ্টাচারে অগ্রসর। তাই তারা সারা দুনিয়াতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। মানুষ তাদের আচরণ পছন্দ করছে, তাদের নিকট থেকে শিক্ষা নিতে চাচ্ছে। পাশ্চাত্য জগতে সুন্দর শিষ্টাচার প্রয়োগের কারণেই এই সফলতা হাসিল করতে সক্ষম হয়েছে। মানব জীবনে শিষ্টাচার এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যে, কোন খারাপ বৈশিষ্ট্যের মানুষের শিষ্টাচার যদি সুন্দর হয়, তাকেও চোখ বন্ধ করে গ্রহণ করে।
প্রবাসে বাংলাদেশের মানুষেরা কাজে দক্ষ, কঠোর পরিশ্রমী, নিরলস ও ভদ্র হবার পরও তাদের গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন অধঃ মুখি হচ্ছে। অথচ দরিদ্র ফিলিপাইনের মানুষেরা নৈতিক চরিত্রে মানহীন কিন্তু শিষ্টাচারে আমাদের চেয়ে অগ্রসর, তাই তাদের গ্রহণ যোগ্যতা উত্তরোত্তর বাড়ছে। আজকের দিনে মধ্যপ্রাচ্য সহ সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশীরা ঘৃণিত হচ্ছে শুধু বিশ্রী খাসিয়তের কারণেই। আমাদের শিষ্টাচার যদি এখনও সুন্দর করা যায় তাহলে, দেশের দুর্দিন আমাদের জন্য সুদিনে পরিণত হতে বেশী সময় লাগবে না। আমাদের দেশে প্রতি বছর শত শত ডাক্তার তৈরি হচ্ছে কিন্তু সব ডাক্তার মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে! কেননা তাদের চরিত্রে শিষ্টাচারের দিকটা কিছুটা দুর্বল। অন্যদিকে মানুষ দলে দলে ভারতে যাচ্ছে চিকিৎসা করতে! সেখানে সেরা চিকিৎসার ব্যাপারটা যতটা না গুরত্বপূর্ন, রোগীরা তার চেয়ে বেশী মূল্য দিচ্ছে ভারতীয় ডাক্তার-নার্সদের সুন্দর ব্যবহারকে।
আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “আল্লাহ্ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন ততক্ষণ করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে জাতির লোকেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা না করে”। মূলত: কোরআনে নিজের অবস্থা পরিবর্তনের যে কথা বলা হয়েছে, তা মানুষকে উত্তম শিষ্টাচারী হবার জন্যই তাগিদ দিয়েছে। কেননা শিষ্টাচার অর্জন ও প্রয়োগ মানুষের ইচ্ছা শক্তির উপরই নির্ভর করে। দুনিয়াতে একদা মুসলমানদের দৈনন্দিন চরিত্র দেখেই অন্য জাতি তাদের প্রতি আগ্রহী হয়েছে এবং দুনিয়াতে নেতৃত্ব দিয়েছে। আজ তারা অনেকাংশেই সেই চরিত্র খুইয়েছে। ভাগ্য নির্মাণে আল্লাহর কোরআনের এই সুস্পষ্ট ঘোষণা স্বত্বেও মুসলিম জাতি আজ ভাগ্য বিড়ম্বিত।
শিষ্টাচারী মানুষকে বাংলায় বলা হয় ব্যক্তিত্ব-বান, ইংরেজিতে পারসোনালিটি। দামী পোশাক, বিদেশী মোবাইল, উচ্চমূল্যের আসবাব পত্রের ব্যবহার, ইংলিশে কথার খই ফুটানো কিংবা শরীর বাঁকিয়ে নানা ধরনের সেলফি তুলে স্ট্যাটাস দিলে কোনদিন ব্যক্তিত্ব বাড়ে না। উপরন্তু এসব ব্যক্তিত্ব হানির কারণ ঘটতে পারে। বাংলাদেশের গর্ব নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুস বাংলাদেশী খাদি কাপড়ের ফতুয়া গায়ে চড়িয়েই পুরো দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছেন। না, এত কম দামী পোষাকে ওনার ব্যক্তিত্ব কমেনি বরং দিন দিন বাড়ছে।
তাই জাতী-ধর্ম ও দেশের স্বার্থে সবাইকে ব্যবহারিক জীবনে উত্তম শিষ্টাচার অর্জন ও সাথে সাথে তা প্রয়োগের অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। যে সমস্ত শ্রমিক-কর্মজীবী প্রবাসে যেতে ইচ্ছুক তাদেরকে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে একটি আচরণের গাইড দেওয়া উচিত। সরকারকে শুধু রেমিটেন্স আহরণের গেইটের না তাকিয়ে প্রবাসীদের শিষ্টাচারী হবার জন্য দেশ থেকেই উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্কুল-কলেজের পাঠ্য বই, টিভি-মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম জাতিকে শিষ্টাচারী করতে উৎসাহ জানাতে হবে। সর্বোপরি আদর্শ নাগরিক হতে হলে, আন্তর্জাতিক মানের সম্মান পেতে হলে, উত্তম শিষ্টাচার অর্জনের লক্ষ্যে শ্রেণী কক্ষেই পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে ছাত্ররাই প্রথম শিষ্টাচারী ব্যক্তি হিসেবে বের হবে। নতুবা সামনের দিনে প্রতিযোগিতা মূলক বিশ্বে টিকে থাকার লড়াইয়ে আমরা আরো বেশী পিছিয়ে পড়ব, আরো অগ্রহণযোগ্য হব। পবিত্র কোরআনে নির্দেশ এসেছে এভাবে, ‘সেই লোকদের ছাড়া যারা ঈমান এনেছে ও শিষ্টাচারের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করে তাদের জন্য রয়েছে অশেষ প্রতিফল’। ত্বীন-৬।
বিষয়: বিবিধ
১৯১৪ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাযাকাল্লাহ খায়ের।
সঠিক বলেছেন। একজন লোকের যোগ্যতা মানুষ বুঝেনা যতক্ষন না তার সুন্দর শিষ্টাচার গোচরীভূত হয়। এটাই মূল অংশ। রসূল(সঃ)বলেন আখিরাতে বেশীরভাগ (সত্যপন্থী) মানুষই মুক্তি পাবে সুন্দর আচরনের কারনে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন