বনানী কবরস্থানের মহান অতিথি
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ১৫ মে, ২০১৬, ০৫:২৭:১২ বিকাল
নানু আমি যথা সময়ে খবর পাইনি, যার কারনে আপনার জানাজায় সময় মত হাজির হতে পারিনি। সর্বদা আপনার সাথে-পাশে থেকেছি কিন্তু মৃত্যুর সময়তো পারলাম না, এমন কি জানাজার নামাজেও অংশগ্রহণ করতে পারিনি। তাই দুঃখে আমার হৃদয়খানা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। নানু আপনার কবর জিয়ারত করতে এসে অতীত দিনের কত কথাই না মনে পড়ছে, মনে হয় বুক ফেঠে রক্ত বের হবে। নানু! আপনি সেই পাকিস্থান আমলের এম, এ, পাশ করা শিক্ষিত মহিলা। কত গুনীজন-বুদ্ধিমান পরামর্শের জন্য আপনার শরনাপন্ন হত, তার কোন হিসেব নাই। সেজন্য আমরা নাতী-নাতনী হিসেবে যথেষ্ট গর্ববোধ করতাম। নানু, আজ থেকে আপনার আদুরে নাতীর গর্ব করার আর কেউ রইল না......।
সদ্য এম, বি, বি, এস পাশ করা ডা. তানিম। ইন্টার্নী শিপের কারনে মফস্বলে থাকতে হয়েছে; যার ফলে ফোন পাওয়ার পরও, যোগাযোগ সমস্যার কারনে, প্রিয় নানীর জানাজায় যথাসময়ে অংশগ্রহণ করতে পারে নি।
গতকাল বিকালে তানিমের নানী মোহমেনা খাতুন মারা গেছেন। তার স্বামী প্যারালাইসিকে আক্রান্ত হয়ে বহু দিন বিছানায় পরে আছেন। শারীরিক অসুস্থতা হেতু স্বামীর অবস্থাই ছিল বেশী সঙ্গীন কিন্তু মারা গেলেন মোটামুটি সুস্থ, স্ত্রী মোহমেনা খাতুন! শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রী দুজনই পাকিস্থান আমলেই সরকারী বড় চাকুরিজীবি ছিলেন। দুই ছেলে দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েছেন, আরো উচ্চতর ডিগ্রী ও চাকুরীর সুবাদে তারা সস্ত্রীক ইতালী ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, সেখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন। চার কণ্যাকেও উচ্চতর ডিগ্রী পাইতে দিতে মোহমেনা খাতুন ভূল করেননি। কন্যারাও সর্বোচ্চ ডিগ্রীর অধিকারীণী এবং সবাই শিক্ষা পেশায় নিজেদের ব্যস্থ রেখেছেন। ভাগ্যিস তিনি চার কণ্যাকে দেশের বড় বড় কর্মকর্তাদের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন; নতুবা বিপদে-মুসিবতে তাদের দেখার জন্য দেশে কাউকে পাওয়া যেতনা! টাকা থাকত ব্যাংকে; আর কাগজ আর ডায়রীতে টাকার হিসেব করে, নিজেদের উপোস থাকতে হত।
মোহমেনা খাতুন অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে রাজধানীর অভিজাত এলাকার বাড়ীতে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। ছেলে-মেয়েদের নিজের ইচ্ছেমত শিক্ষিত করেছেন, মানুষ বানিয়েছেন। তারা নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, মোহমেনা খাতুন ও স্বামী মিলে সংসার চালাতে অর্থের কোন সমস্যা ছিলনা। বাজার তরি-তরকারী ফ্রিজ থেকে শেষ হবার উপায় ছিলনা, মেয়েদের কোন একজন এসে তা পূর্ন করে দিয়ে যেত। ঘরে ছিল দু’জন কাজের বুয়া আকেকজন দারোয়ান কাম কেয়ার টেকার। চাকুরীর পেনশনের টাকাটা তাদের প্রয়োজনেই লাগতনা। ব্যাংকেই গচ্ছিত ছিল, মাসে মাসে প্রচুর টাকা সূদ বাবদ জমা হত; তবুও খাওয়ার কেউ ছিলনা। যৌবনে টাকা পয়সা যথেচ্ছ ব্যবহার করার সুযোগ থাকলেও পৌঢ়ত্বে যখন গায়ে বল থাকেনা, তখন টাকাও নিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও পরিহাস করে। এদের হয়েছিল সেই দশা। পুত্র ও পরিজন প্রবাসে থাকে এবং সেখানে সবাই চাকুরী করে। তাই খবর পাওয়া মাত্র তারা ছুটি ম্যানেজ করতে পারেনি; অধিকন্তু ছেলেরাও মায়ের লাশ ফ্রিজে রাখার জন্য সায় দেয়নি!
মায়ের মৃত্যুর পর কণ্যারা কিছুক্ষণ নিরব কান্নাকাটি করেছিল। নাতি-নাতনীরা জীবনে কোন কারনে কখনও কাঁদতে হয়নি বলে, কান্নার অভ্যাস তাদের আগে থেকেই ছিলনা। অন্তরে নানীর জন্য প্রচন্ড ব্যথা লাগলেও, ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় বসে এভাবে ভিখিরির মত হাউ-মাউ করে বিলাপ করতে বিব্রতবোধ করছিল! অগত্যা বাড়ির দারোয়ান মনু মিয়ার পরামর্শকেই কণ্যারা ঠিক বলে মেনে নিলেন। চতুর মনু মিয়া মৃত বাড়ীতে কান্না করার জন্য পাঁচ ঘন্টার জন্য, জনা বিশেক মহিলা ভাড়া করে নিয়ে আসলেন! অবশেষে ভাড়া করা মহিলাদের হৃদয় বিদারক কান্নার আওয়াজে শহরের এই ধন্যাঢ্য অভিজাত এলাকার আশে পাশের মানুষ জানত পারল, এ বাড়ীতে কেউ মারা গিয়েছে!
সন্ধার মধ্যেই খবর হয়ে যায় মোহমেনা খাতুনের মৃত্যু সংবাদ। সে আমলের উচ্চ শিক্ষিত এবং বড় কর্মচারী বলে তাঁর সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ীদের অনেকে দেশের বড় বড় পদে সমাসীন ছিলেন। তার এককালের সহকর্মী, স্বামীর সহকর্মী, কন্যা ও তাদের স্বামীদের সহকর্মী, শুভাকাঙ্খী মিলে প্রচুর মানুষ জানাজায় শরীক হল। মৃত্যুর পর লাশ দীর্ঘক্ষন ঘরে রাখা ঠিক নয় ইসলাম ধর্মের বিধান হলেও, শহুরে জীবনে ইচ্ছা করলেও লাশ দীর্ঘক্ষন ঘরে রাখাই কষ্টকর হয়। সন্ধ্যা বেলায় জানাজায় প্রচুর মানুষ হল; মেয়ের স্বামীরা শাশুড়ীর জন্য দোয়া ও মাফ চাইল। কেউ কেউ তার লাশের সামনে বর্নাঢ্য কর্মময় জীবনের স্মৃতিচারণ করলেন। শহরের গন্যমান্য ব্যক্তিরা এই জানাজায় হাজির ছিলেন বলে মোহমেনা খাতুনকে যথারিতী ভাগ্যবতী নারী হিসেবে বর্ননা করলেন; রাত্রিবেলাতেই যথাযোগ্য মর্যাদায় লাশ দাফন করা হল।
মোহমেনা খাতুনের স্বামী প্যারালাইসীসে আক্রান্ত বোধশক্তিহীন এক ব্যক্তি, যেন এক জীবন্ত লাশ। যৌবনে তার আদেশ পালন করার জন্য হাজারো ব্যক্তি একপায়ে খাড়া হয়ে থাকলেও। আজ তিনি ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোন কিছুই করতে পারলেন না। নিজের ইচ্ছা, বাসনা, অভিযোগ জানানোর নূন্যতম ক্ষমতাও টুকুও তার নাই। স্ত্রীকে শেষ বারের মত ঘর থেকে বের করার সময় তিনি চোখে তাকিয়ে দেখেছেন কিন্তু বোধশক্তিহীন দেহের কল-কব্জাগুলো অচল থাকায়, শেষ যাত্রাতেও প্রিয়তম স্ত্রীকে বিদায় কথাটি উচ্চারণ করতেও নিজের জিহ্বা আড়ষ্ট ছিল! ভাগ্য কখনও মানুষের সাথে সাথে চরম পরিহাস করে। কদাচিৎ স্বামী-সন্তান পৃথিবীতে জীবিত থাকার পরও স্ত্রীর জন্য কোন উপকারে আসেনা; মোহমেনা খাতুনের শেষ যাত্রায় সে কথাই যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। তার চেয়ে বরং অপরের ছেলেগুলোই বেশী উপকারে আসল, যাদেরকে তিনি নিজের কণ্যাদের বিয়ে দিয়ে জামাই হিসেবে আপন করেছিলেন। মৃত্যু বড় অপ্রিয় সত্যি! তাকে মানতেই হয়, ফলে নিঃসঙ্গ জীবনের বাকী দিনগুলো মোহমেনা বেগমের স্বামীকে, ব্যস্থ নগরীর বিশাল বাড়ীতে কবরের নিস্তব্ধতা নিয়ে একাকী বসবাস করতে হবে!
কাক ঢাকা ভোরে, কবরস্থানের গেইটে কয়েকটি দামী গাড়ী এসে থামল। গেইটে গাড়ী থামার আগেই, বেশ কয়েকজন যুবক আগে থেকেই তথায় উপস্থিত ছিলেন। তারা দামী গাড়ীর আগন্তুক বৃন্দের উদ্দেশ্যে স্যার স্যার বলে দৌঁড়ে গেলেন। বুঝা গেল, এই গাড়ির যাত্রী সকল কোন সাধারন মানুষ নন, নিশ্চয়ই শহরের কোন না কোন প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা হবেন।
চারজন কর্মকর্তা সস্ত্রীক বাচ্চাসহ গাড়ী থেকে নামলেন। তাদের মধ্যে একজনকে বেশী ভূমিকা পালনকারী হিসেবে মনে হল; তিনিই প্রশ্ন করলেন, হুজুর কোথায়? আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের একজন বললেন, স্যার! হুজুর রেডি আছে। এই ব্যক্তি সাহেবের অফিসের পি, এস। ততক্ষনে হুজুর সাহেব হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির। হুজুর এসে সালাম দিয়ে সম্মান জানালেন।
সাহেব বললেন হুজুর, আমার শাশুড়ির জন্য দোয়া, তাহলীল যা করা লাগে; সব করবেন। যাতে আমার শাশুড়ী পরজগতে শান্তিতে থাকতে পারে। আপনি জানেন তো আমার শাশুড়ী কিন্তু নামকরা মহিলা ছিলেন? হুজুর, জ্বি সাহেব! আমি আপনার পি, এ’র কাছে বিস্তারিত শুনেছি। স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা বিগত রাত্রিতে সবাই মিলে তিন খতম কোরআন পড়েছি। এক লক্ষ বার তাহলীল পড়েছি। সাহেব বললেন, যা যা করা লাগে আপনি করবেন; টাকাটা সমস্যা নয়, আমি চাই আমার শাশুড়ী পরকালে গিয়েও যেন শান্তিতে গৌরব নিয়ে থাকতে পারে। পাঠকেরা ভুল বুঝবেন না, দায়িত্বশীল এই সাহেব হলেন সরকারী বড় কর্মকর্তা এবং মোহমেনা খাতুনের প্রথম কণ্যার স্বামী।
আরেকজন সাহেব গেইট পেরিয়ে সবাইকে নিয়ে কবরস্থানের দিকে রওয়ানা হলেন। তার সাথেও সাহায্যকারী ব্যক্তি আছেন। হুজুর যথারিতী তাদের সাথে সাথেই আসলেন। সাহেব বললেন দোয়া করে দিতে। হুজুরের সাথে কয়েকজন আসলেন, তাদের সবার মাথায় টুপি থাকলেও কাউকে পেশাদারী হুজুর বলে মনে হল না। যাক, হুজুর খুবই আবেগ সহকারে আল্লাহর কাছে দোয়া করে দিলেন। হুজুরের সাথে আসা মানুষেরা বিদেহী আত্মার জন্য আল্লাহর কাছে কান্না করে দোয়া চাইলেন। ভাড়া করা হুজুরদের কলিজা উজার করা কান্নার পানি দেখে, মৃত মোহমেনা খাতুনের কণ্যারাও নিজেদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না! তারাও আজ হৃদয় উজাড় করে কাঁদলেন। অবশেষে দীর্ঘক্ষন দোয়া করে হুজুর তার মোনাজাত শেষ করলেন।
সাহেব হুজুরকে প্রশ্ন করলেন, হুজুর আমার শাশুড়ির জন্য আর কি কি করতে হবে? হুজুর যথারিতী জানালেন দোয়াই হল মৃত ব্যক্তির একমাত্র সম্বল। আর দোয়া পাওয়ার সহজ উপায় হল; দান-সদকা করা, গরীব-মিসকিন-ফকিরকে খাওয়ানো। সাহেবের স্ত্রী তথা মৃতের কণ্যা বলে উঠলেন, বাসায় ফকির-মিসকিন খাওয়ানো তো বিরাট বিশ্রী ব্যাপার! বাসায় ফকির ঢূকতে দিলে, তাদের উৎপাতে বিতিকিচ্ছিরী দশা হবে, যা হয়েছিল গতবার হক সাহেবের বেলায়। তার চেয়ে বরং অফিসের পিয়ন আমজাদকে দায়িত্ব দিলে, সে তার মত করে ফকির-মিসকিন জোগাড় করে কোথাও বসিয়ে খাওয়াইয়া নিবে। সাহেব বললেন, ভেরী নাইস! উত্তম প্রস্তাব। এই সাহেব হলেন সরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং মোহমেনা খাতুনের দ্বিতীয় কণ্যার স্বামী।
সূদর্শন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশেই, কাগজ কলম হাতে, এক চটপটে যুবক। মুখে সুন্দর ইংরেজীতে যেন খই ফুটছে। তিনি সাহেবকে বুঝাচ্ছেন কোন রংয়ের পাথরের উপর কি রংয়ের প্রলেপ পড়লে তা উজ্জ্বল ও দৃষ্টি নন্দন লাগবে! তিনি হলেন গ্রেভ ডিজাইনার তথা কবর স্থপতি সুমন চৌধুরী। বহু কবরের ডিজাইন করে তার কনসালটেন্ট ইতিমধ্যে সুনাম অর্জন করেছেন। তিনি সাহেবকে বুঝাচ্ছেন, দেশের ঐ নামকরা ব্যক্তির কবর ডিজাইন করার কাজ তিনি পেয়েছিলেন, ঐ যে ঐখানে ওনার কবর। ঐ যে গাছের নীচের সুন্দর ফলকযুক্ত কবরটি দেখছেন, গত সপ্তাহে তা আমরাই করেছি। সাহেব এতক্ষন এতসব খেয়াল করে দেখেন নি, সবেমাত্র ধাতস্থ হলেন। চারিদিকে নজর বুলিয়ে দেখলেন, বাহারী ধরনের বহু রকমের কবর এই গোরস্থানে। একটির চেয়ে অন্যটি সুন্দর! প্রতিটি কবরের নান্দনিক ডিজাইন হৃদয়াঙ্গম করার জন্য অনেক্ষন তাকিয়ে থাকতে হয়! এধরনের কারুকাজ করা কবরের সংখ্যাও কোন অংশে কম নয়। কবরের আকৃতি, ধরন, কারুকার্য দেখে সহযেই বুঝা যায়; যে মৃত ব্যক্তি সমাজের কত উঁচু স্থানে সমাসীন ছিলেন। কবরের গায়ে মৃত ব্যক্তির নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ, দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে তার পদবী, খেতাব কোনটাই বাকী নাই। কোন কোন কবরে ডিজাইনারের নাম, আর্টিষ্টের নাম ও যোগাযোগের ঠিকানা উল্লেখ আছে। তিনি তাজ্জব হয়ে দেখলেন প্রতিটি কবরে ফুটে আছে নানা রঙ্গের গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়া সহ রঙ্গ-বেরঙ্গের ফুল। স্নিগ্ধ সকালে প্রচুর প্রজাপতি ও মৌমাচির আনাঘোনা বেড়েছে। এত সুন্দর মায়াবী পরিবেশ রাজধানীর বুকে তিনি ইতিপূর্বে কখনও অবলোকন করেননি! তিনি মুখ ফুটেই বলে বসলেন, এই কবরস্থানের প্রতিটি ব্যক্তিই মহা ভাগ্যমান ও মহান অথিতী! কত শান্তিতে নিবিড় পরিবেশে তারা ঘুমাচ্ছেন। আহা কত শান্তির ঘুমে অচেতন, এই কবরস্থানের প্রতিটি মৃত ব্যক্তিই মহা ভাগ্যবান! দামী টাইলস, এনামেল পেইন্ট, রঙ্গিন ইট, মার্বেল পাথরের নাম ফলক, দীর্ঘস্থায়ী সাদা সিমেন্টের আস্থরনের মাধ্যমে, সর্বোচ্চ প্রযুক্তির, আকর্ষনীয় আকৃতির আরেকটি নতুন কবর বাধাই করার অগ্রিম অর্ডার সুমন চৌধুরী পেয়ে গেলেন। এই সাহেব হলেন পদস্থ কর্মকর্তা ও মোহমেনা খাতুনের তৃতীয় মেয়ের স্বামী।
গম্ভীর চেহারার যথেষ্ট ব্যক্তিত্ববোধ সম্পন্ন ব্যক্তিটি অবশেষে মুখ খুললেন। তিনি প্রতিবাদ করলেন সব যদি আপনারাই করে ফেলেন তাহলে আমি করব কি? আমাকেও এ ব্যাপারে একটু ভূমিকা রাখতে দেন? সবাই জানবে আপনারাই সব করেছেন, আমার নামতো কোথাও থাকবেনা! বড় মেয়ে সাথে সাথেই তার কথায় বাধা দিলেন। আমরা কিন্তু যা যা করতে চেয়েছি তুমি কিন্তু তাতে শেয়ার করতে পারবে না। এ সমস্থ কাজে শেয়ার করলে তোমার আমার কারো ইজ্জত থাকবেনা। তার চেয়ে বরং তুমি ৪ দিনের অনুষ্ঠান, চল্লিশা এগুলো করতে পার। ভদ্রলোক খুবই পেরেশান হলেন; চারদিন, চল্লিশা এগুলোতে সেই পুরানা সমস্যা। কাঙ্গাল ডাক, বখাটে কাঙ্গালকে লাঠিপেটা কর, পাহাড়াদার লাগাও, এটা ওটা কত কি? তাছাড়া কাঙ্গালী ভোজ করাতে গেলে, কখনও দূর্নাম ছাড়া সুনাম হয়না। ভদ্রলোকের পাশে দাঁড়ানো স্ত্রী খুবই পেরেশানীর সহিত বললেন, আপনারা আগে ভাগে সবাই সহজগুলো বাছাই করে নিলেন। আর আমার জন্য কঠিন কাজ গুলো রেখে দিলেন! যাক একাজ আমাদের দিয়ে হবেনা। তার চেয়ে বরং আমরা মায়ের মৃত্যু সংবাদ বড় বড় সংবাদ পত্রে ও টিভিতে প্রকাশ করব। শহরের কোন নামকরা হলে তাঁর জীবন চরিত নিয়ে শোক অনুষ্ঠান করব। নামকরা বুদ্ধিজীবিরা তাতে বক্তব্য রাখবেন। ফলে দেশের মানুষ মায়ের কথা জানতে পারবে! এই ঘোষনায় অন্য মেয়েরা চোখ কপালে তুলল, চিন্তা করতে লাগল এই কথাটি তাদের মাথায় আসল না কেন! মৃত ব্যক্তির স্মরনে এই ধরনের আধুনিক অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা তাদের স্বামীদের মাথায় না আসার কারণে স্বামীদের বোকা বলে তিরস্কার করলেন। শেষোক্ত এই ব্যক্তিটি হলেন মোহমেনা খাতুনের চতুর্থ কণ্যার স্বামী।
হঠাৎ বড় মেয়ের স্বামীর নজরে পড়ল শাশুড়ীর কবরের দু’পাশের দুটি পুরোনে কবরের খোদাই করা নামের উপর। নামগুলো যেন পরিচিত মনে হচ্ছে! হ্যাঁ ঠিকই তো, বাংলাদেশের দুটো নামকরা ব্যক্তির কবর ওগুলো। একদা জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে তাদের সাথে হাত মেলাতে পারাটাই বিরাট সৌভাগ্য ও সম্মানের ব্যাপার ছিল। আজ তাদের কবরের পাশেই শাশুড়ীর কবর হয়েছে। সহসা তিনি পিএ-কে বললেন, কনসালটেন্ট অফিস থেকে দেশসেরা এই মৃত ব্যক্তিদের; জীবিত আত্মীয়দের ফোন নম্বর সংগ্রহ করতে। তাদের কাছে এ সংবাদ পৌছে দিতে হবে যে, তাদের পিতা-মাতার পাশে পরম আত্মীয়ের মত আমাদের শাশুড়ীও শুয়েছেন! আহা! আমার শাশুড়ি জীবনে বেঁচে থাকতেও যেভাবে সম্মানীত ছিলেন, মৃত্যুর পরেও একই সম্মান নিয়ে শায়িত হলেন। এই দৃশ্যে সবাই আবেগে আপ্লুত হলেন। মনে গর্ববোধ করলেন, নামী গোরস্থানের মহান ব্যক্তিদের মধ্যে, নিজেদের আপন জনকে সামিল করতে পেরে!
সুদর্শন যুবক একটি কামরাঙ্গার চারা নিয়ে হাজির; তার ইচ্ছা এটা মৃতের মাথা বরাবর রোপন করতে হবে। ডিজাইনার বলল, এই গাছের চারা রোপিত হলে ডিজাইনে ব্যাঘাত হবে, ফলে কবরের সৌন্দর্য্যহানী হবে। যুবক বললেন, কবরের সুন্দরের চেয়ে এই গাছ অনেক উত্তম। এটাতে প্রচুর ফল ধরবে; সে ফল মানুষ খাবে, পাখি খাবে, সে কারণে কবরে সবার আত্মা শান্তি পাবে। তাই এটা রোপন করতেই হবে। সাত সকালে যুবকের এই বাড়াবাড়ি সবার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হল। এক মহিলা বলে উঠল, তুমি এখন যথেষ্ট বেয়াড়া হয়ে গিয়েছ! তোমার এ ধরনের আচরনে আমরা সামাজিক ষ্টাটাস হারিয়ে ফেলব বলে ভয়ে আছি। উচ্চতর লেখাপড়ায় মানুষ সভ্য হয় অথছ তুমি মৌলবাদীদের পাল্লায় পড়ে গোঁড়া হয়েছ! আর্শ্চয্য! অবিশ্বাস্য!
যুবক বললেন, ঠিক আছে কামরাঙ্গার চারা লাগাব না তবে আপনাদের সবাইকে আমার সাথে মুনাজাত ধরতে হবে। অগত্যা সবাই মোনাজাত ধরলেন। যুবক মোনাজাত শুরু করলেন, “আল্লাহ তুমি কবরের সকল বাসিন্দাকে মাফ কর। হে আল্লাহ, আমি জানি উপস্থিত এরা মৃত ব্যক্তির আত্মার জন্য যা যা করছে, তা তোমার কাছে পছন্দনীয় হবেনা। তুমি আমাদেরকেও মাফ করো। আমি আগামী মাস থেকে ডাক্তারী প্রাকটিস শুরু করব, আজীবন প্রতিদিন দু’জন গরীব রোগীকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দিব। সে সব সেবার বরকত তুমি এই কবরস্থানের সকল বাসিন্দা ও আমার এই প্রিয়জনকে দিয়ে দিও। তুমি আমার এই ওয়াদা পালন করার তৌফিক দিও.......আমীন”। সবাই যুবকের এই ধরনের মুনাজাতে নিজেদের অপমানিত বোধ করলেন! কেননা যুবকটি ইতিমধ্যে মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ে অধঃপতনে গেছে! এই অধঃপতিত যুবক চতুর্থ মেয়ের ছেলে ডা. তানিম।
(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
বিষয়: বিবিধ
৩১৬০ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
০ মোহমেনা খাতুনের ছেলেরাও হয়ত তার মেয়ে জামাইদের মত শশুরবাড়িতে সেরকম সার্ভিস দিচ্ছে । তার ছেলের বউয়েরা স্বামীদেরকে সেখানে এংগেজ করিয়ে রেখেছে , বাবা মাকে দেখতে আসাতে ঝামেলা পাকাচ্ছে যেমনটা উনার মেয়েরা করাচ্ছে তাদের জামাইদেরকে দিয়ে।
মেয়েরা স্বামীদেরকে তাদের বাবা মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নেয় , নিজের বাবা মায়ের জন্য খাটায় । এটা আমাদের সমাজের সবাই জানলেও ভয়ে মুখ খুলে না । পাছে বউ/বউ মা সংসারে আগুন লাগায় । দোষ করে মেয়েরা , ছেলেকে বাবা মায়ের প্রতি দ্বায়িত্ব পালন করা থেকে সরিয়ে নেয় স্ত্রীরাই । আর আমাদের সমাজের ট্রেন্ড হল ছেলেদেরকে দোষী বানানো । এটা না করলে স্ত্রীদের কাছে যে উত্তম হওয়া যাবে না !
মেয়েদের(স্ত্রীদের) এরকম হীন মানসিকতার জন্য বাবা মায়েরা সাফার করে । মারা যাবার সময় ছেলদেরকে আসতেও দেয় না ।
এক মাত্র নেক আমল, নেক সন্তানের দোয়া, সাদাকায়ে জারিয়াই আখিরাতের পাথেয়।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের দুনিয়াতে থেকে আখিরাত অর্জন করার তাওফীক দান করুক।
সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া।
বান্দা যা ভোগ করে সেটা তার দু হাতের কামাই। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। সঠিক বুঝ দান করুন।
বাস্তবতার আলোকে সুন্দর লিখাটির জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন