সাহেব আলী পেশকার, এখন মিলিওনার
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ১৪ মে, ২০১৬, ০১:২৪:৪২ দুপুর
অবশেষে নোয়াখাইল্যা বুদ্ধি ধরে, সাহেব আলী’র পেশকারীর চাকুরীটা হয়ে গেল। পেশকারী কি ধরনের জিনিষ, কার কাছে কখন তা পেশ করা হয়? কোথায় কিভাবে পেশ করতে হবে? মাথা মুণ্ডু কিছুই জানেনা সাহেব আলী। তার কাছে পেশকারীর বাস্তব কোন প্রশিক্ষণ না থাকলেও; ২৮০০ টাকা বেতন স্কেলের পেশকারীর সরকারী চাকুরীটা সাহেব আলীর বড় প্রয়োজন ছিল।
দীর্ঘদিন পরে সাহেব আলীর সাথে যখন দেখা করতে যাই, ততক্ষণে আদালত থেকে বিচারক চলে গিয়েছিল। তবে মনে হল সাহেব আলীর আদালত সবে মাত্র শুরু হয়েছে। জনা পঞ্চাশেক মানুষকে ঠেলে, বহু কষ্টে পেশকার সাহেবের ছোট্ট টেবিলের সামনে উপস্থিত হই। পেশকার সাহেব মাথা নিচু করে বিরাট একটি খাতায় অনবরত লিখে যাচ্ছিলেন; কারো দিকে তাকাবার একটি মুহূর্ত ফুসরৎ তার ছিলনা।
নাম ধরে ডাক দিলাম।
পাশে দণ্ডায়মান পেশকারের সাহায্যকারীরা প্রশ্ন করল, ‘কি সমস্যা আপনার’?
বললাম, ‘ওনার সাথে কথা বলতে চাই’?
সাহায্যকারীই উত্তর দিল. ‘প্রতি প্রশ্নে পঞ্চাশ টাকা, সময় মাত্র দুই মিনিট’।
তাদের বললাম, ‘তিনি আমার বন্ধু’।
সাথে সাথে উত্তর দিল, ‘তাহলে বাসায় যান, এটা অফিস, শত শত মানুষ বাহিরে অপেক্ষা করছে’!
মেট্রোপলিটন আদালতের এই ব্যস্ততায় নাকি সালাম দেওয়া ও নেওয়া দুটোই বারণ! অগত্যা সাহেব আলীকে আরেকবার জোড় গলায় ডাক দিলাম! আমার সামনে উপবিষ্ট, লিখায় ব্যস্ত ও তন্ময় সাহেব আলীর কানের পাশ দিয়ে, আমার কণ্ঠের ব্যর্থ শব্দ হারিয়ে গেল! ততক্ষণে আমার ধার্য দুই মিনিট শেষ! পিছনের মানুষ সামনে আসার ঠেলাঠেলিতে অবশেষে পেশকারের সামনের জায়গাটি অন্য জনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম!
সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবেই হোক সাহেব আলীর সাথে দেখা করবই। কক্ষের একটি ফাঁকা যায়গায় অপেক্ষা করতে রইলাম এবং ঘটনাগুলোর দিকে চোখ রাখলাম। একজন পঞ্চাশ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আগামী কাল আমার মামলার তারিখটা কি ঠিক আছে’? সাহেব আলী তার সামনে রক্ষিত, তারই হাতে লেখা বালামটি দেখে বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিক আছে’।
এতটুকু সহযোগিতা মূলক কথার জন্য পঞ্চাশ টাকা আয়! আরেকজন অনুরোধ করল ‘আমার মামলা খানি ১৫ তারিখের বদলে ২৫ তারিখের আদালতে তুলতে চাই’। তিনি একশত টাকা দেওয়া মাত্র সাহেব আলী, তারই হাতের লিখা আমলনামা সদৃশ খাতা থেকে ১৫ তারিখের সময়টি কলমের একটানে কেটে মাসের ২৫ তারিখের ঘরে লিখে নিলেন। দেখলাম! এই সহযোগিতায় তার ১০০ টাকা উপরি আয় হয়েছে! অন্য জন অনুরোধ করল তার মামলা খানি চলতি মাসের ২৭ তারিখে আদালতে উঠার দিন ধার্য ছিল। তিনি জরুরী সমস্যার কারণে তা ১৫ তারিখে তুলতে চান। কিছুক্ষণ আগে ১৫ তারিখের কর্তন ঘরে, এই ব্যক্তির নাম লিখে দিলেন! এই বাবদ সাহেব আলীর ২০০ টাকা আয় হল!
সাহেব আলীকে সহযোগিতা করার জন্য ছয় জন শক্ত সামর্থ্য ব্যক্তি পাশেই দাঁড়িয়ে! তারা টাকা সংগ্রহ করছে, সাহেব আলীকে লিখতে সহযোগিতা করছে এবং সংগৃহীত টাকা সাহেব আলীর প্যান্টের পকেটে ঈমানদারির সাথে ঢুকিয়ে দিচ্ছে!
প্রবাসের কষ্টকর ও ত্যক্ত জীবনের এক সুযোগে দেশে ফিরে সাহেব আলীকে বিয়ের দাওয়াত দিতে এসে তার চেয়ারের সামনে দাড়িয়ে আছি আধা ঘণ্টার বেশী সময় ধরে। সে যে তার বালামের দিকে সকাল থেকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে আছে; সেটা দেখে ফেরেশতা আজরাইল (আঃ) কথা মনে পড়ল। কোন প্রাণীর রূহ সংহারের নির্দেশ কখন হাজির হয়, সেটা দেখার জন্য তিনি বিরতীহীন ভাবে বালামে তাকিয়ে থাকেন। পরিচিত কারো সাথে চোখাচুখি হলে চক্ষু লজ্জায় তার নিকট থেকে ঘুষ নিতে পারবে না, সে লজ্জায় সাহেব আলীর চোখ বালাম থেকে উঠে না, সেটা অল্পক্ষণ পরেই বুঝে নিয়েছি। তাই গায়ে-গতরে উৎকৃষ্ট, চোখ-জিহব্বার পর্দা নাই, এমন কয়েকজনকে নকিবের মত তার চেয়ারের পাশে নিয়োগ দিয়েছে। নকিবের মত। গায়ে সে ধরনের কয়ো সে জন্য অতিরিক্ত কয়েকজনকে নিয়োগ দিয়েছে।
প্রবাসে অধিক আয় করার একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে। তবে প্রতি মিনিটে অর্থ আয় করার এমন দেশীয় চাকুরী আমি ইতিপূর্বে কোনদিন চোখে দেখিনি, কানে শুনিনি! আদালত পাড়ায়, দিনে- দুপুরে হাজার হাজার মানুষকে সাক্ষী রেখে, জাতির জন্য এই উপকারের নমুনা দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম! পীরের খাঁটি মুরিদ হিসেবে দেখেছি, মুরীদের নিকটি থেকে পীরেরা নগদ টাকা নিচ্ছেন আর দোয়া করছেন। কিন্তু নিজেরা ঠেলাঠেলি করে, নিজের পকেটের টাকা, ইজ্জতের সহিত অন্যের পকেটে ঢুকিয়ে দেবার এই সিষ্টেম নিজের চোখে দেখতে পেরে চোখ দুটোকে ধন্যবাদ দিলাম। প্রবাদে আছে, ‘মানুষের কিছু কর্ম দেখলে, ঈশ্বর পর্যন্ত নাকি তাজ্জব বনে যান’। মানুষের এই প্রকাশ্য চৌর্য কর্ম কোন পর্যায়ে আছে, সেটা ভাবতেও গা শিউরে উঠে।
সাহেব আলীর সাথে দেখা করার সুযোগের অপেক্ষায় থাকলাম! ইত্তবসরে একটু অতীতে ফিরে গেলাম।
একটি শার্ট, একটি পেন্ট, দুটি লুঙ্গি, আধা জোতা আধা স্যাণ্ডেল মার্কা চটি নিয়ে আমাদের মেসে, আমারই কক্ষে উঠেছিলেন; অসহায় এক যুবক। যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, ফর্সা চেহারার, প্রখর মেধার অধিকারী এ যুবকের সাথে পরিচিত হলে, যে কারো বন্ধুত্ব হবেই! সুন্দর আচরণ, বিদ্যা প্রতিভা ও কলেজের নামকরা ছাত্র হিসেবে পেয়ে, আমার প্রিয় বন্ধুদের তালিকায় তার নামটি সহজে যোগ হয়েছিল।
সাহেব আলী পিতার দ্বিতীয় সন্তান, তিন ভাই ও দুই বোন। বড় ভাই পিতার জীবদ্দশায় প্রেমের বিয়েতে ঘর জামাই হিসেবে নিজেকে শ্বশুর বাড়ীর স্বেচ্ছা কর্মী হিসেবে নিয়োজিত করেছেন। ঠিক সে সময় তার পিতা মারা যান। তাদের আয়ের কোন পথ ছিলনা, পিতার গচ্ছিত কোন সম্পদ ছিলনা, চাষাবাদ যোগ্য জমি ছিলনা, বিক্রি করার মত পিতৃ পদত্ত কোন তৈজস-পত্রও ঘরে ছিলনা। পৈত্রিক ঘরখানিই ছিল তাদের একমাত্র সম্বল।
পুকুরের অংশটুকুও পিতা জীবিত কালে বিক্রি করে দিয়েছেন। পুকুরের মালিকানা না থাকলেও গ্রামের পুকুরে গোসল করার রেওয়াজ তখনও শেষ হয়নি বলে সে সুযোগটি আল্লাহ তাদের জন্য রেখেছিলেন। এই অবস্থায় তাদের পিতার মৃত্যু, মহাশূন্যের গ্রহ নক্ষত্র সমেত, পুরো আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত দশা হয়েছিল তাদের!
ফলে সংসার রক্ষার দায়িত্ব পড়ে অসম্ভব মেধাবী, কলেজ ছাত্র, সাহেব আলীর কাঁধে। শিক্ষা জীবন নিয়মিত করবেন নাকি কোথাও একটি চাকুরী জোগাড় করবেন এই চিন্তার দোলাচলে আচ্ছন্ন সাহেব আলী, অকস্মাৎ আমাদের মেসের সন্ধান পেয়ে যান। তার পরিবারের এই ঘোরতর বিপদের কথা শুনে, মেসের সবাই তার জন্য টিউশনির সন্ধানে নেমে গেল। দুদিনের মধ্যেই অলৌকিক ভাবে কয়েকটি টিউশনি যোগাড় হল। ইন্টারভিয়্যুর মাধ্যমে প্রথম দুটি টিউশনিই পাকাপোক্ত হল, তখনকার সময়ের মূল্য হিসেবে, দুটি টিউশনি থেকেই অনেক বেশী আয়ের একটি সুবন্দোবস্ত হল।
দুঃচিন্তায় নাকি অন্য কারণে হোক, কিছুটা অন্যমনস্ক সাহেব আলীকে নিয়ে আমাদের ভোগান্তিও কম সইতে হয়নি! সকালে ঘুম থেকে উঠে, টাকা সমেত অন্য জনের শার্টকে নিজের শার্ট মনে করে চলে যাবার বহু নজীর ছিল। নিজেরা সাময়িক বেকায়দায় পড়লেও, কখনও কারো টাকা সে বেহাত করেনি। মেসে সবাই ছাত্র, তাই মেধাবী অথচ অভাবী সাহেব আলীর ভুল ভ্রান্তিকে সবাই সহজে মেনে নিত।
মুসিবত হয়েছিল সেদিন, ‘যেদিন আমার ডান পায়ের স্যান্ডেল আর ফারুকের বাম পায়ের স্যান্ডেল পায়ে ঢুকিয়ে হন্ হন্ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গিয়েছিল’! একজন ব্যক্তি দুইজনের দুই পাঠি স্যান্ডেল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল বটে কিন্তু দুইজন মানুষকে যে ঘরের ভিতরে অকেজো রেখে গেল; বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ যাতায়াতেও তার হুশ আসেনি!
বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত সাহেব আলীর চাঙ্গা মুখ-বদন দেখে বুঝার উপায় ছিলনা যে, দুই জনের, দুই পাটি স্যান্ডেল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন কিংবা প্রত্যাগমনে তার কোন সমস্যা হয়েছিল!
সাহেব আলী রাত্রে ও বিকেলে দুটি টিউশনি করত। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যেত। মাসের শেষ দিকে গ্রাম থেকে ছোট ভাই এসে চাউল, তেল, তরি-তরকারী, ছোট ভাই-বোনদের জন্য খাতা ও স্কুলের বেতন পাঠিয়ে দিত। এতগুলো মানুষ তার টিউশনির উপর নির্ভর করেই দিন চালাচ্ছিল। সে জন্য তার নিজের ক্লাসের পাঠে সময় দিয়ে সমস্যা হত। এত কিছুর পরও সাহেব আলী ইকোনোমিকস অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায়ও যথারীতি ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে! শুনে মেসের সবাই তাজ্জব না হয়ে পারল না! অর্থের পিছনে ঘুরতে গিয়ে তাকে কখনও কেউ বই নিয়ে বসতে দেখিনি।
একদা প্রশ্ন করেছিলাম, ‘ইকোনোমিকসের মত অপেক্ষাকৃত কঠিন বিষয়ে তুমি না পড়েই কিভাবে এত ভাল করলে’?
সে উত্তরে জানাল, ‘সে ক্লাসের পড়া মনদিয়ে শুনে ও নোট করে; ট্রেনে চলার পথে নোটগুলো একবার দেখে নেয়। তাছাড়া কোন পড়া তাকে দুইবার পড়তে হয়না; ভালভাবে একবার পড়তে পারলেই পড়াটি মুখস্থ হয়ে যায়’। একথা কাউকে না বলার অনুরোধ করে, আরো জানাল; ‘তার অসহায় মা, ভাই-বোনদের জীবন রক্ষার্থে আল্লাহ তাকে বিদ্যা মুখস্থ করার অপূর্ব সুযোগটি করে দিয়েছেন এবং দিন দিন এই ক্ষমতা বেড়েই যাচ্ছে’! ফলে মাস্টার্সেও সাহেব আলী আবারো ফাস্ট ক্লাস পেয়ে শিক্ষা জীবন শেষ করে।
চাকুরীর জন্য হন্য হয়ে পড়ে সাহেব আলী। ষ্টান্ডাট চার্টার্ড ব্যাংকে চাকুরীটা হয়েও ফসকে গেল। সব পরীক্ষা ভালই হল, শেষবার দেখা করতে যাবার দিন, ভারী বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যায়। সে জোতা মার্কা স্যান্ডেল পড়েই ব্যাংকে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল, সে কারণে চাকুরীটা হয়নি। বার বার লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেও, ঠুনকো কারণে চাকুরী ভেস্তে যাচ্ছিল। ওদিকে বি,সি,এস পরীক্ষাও ভাল হয়েছে; তারপরও লম্বা পথ বাকি।
চাকুরীর সন্ধানে হতাশ সাহেব আলী অবশেষে নোয়াখাইল্যা মতিনের বুদ্ধিতে নতুন জীবনের সন্ধান পায়। নোয়াখালীর মতিন আমাদের সহপাঠী, চটপটে ও মিশুক। সে সাহেব আলীকে শুধায়; চট্টগ্রামের ছেলেরা আমাদের নোয়াখাইল্যা বলে ক্ষ্যাপায়, তবে তাদের মাথায় যে বুদ্ধির ‘ব’ নাই একথা কোন হালায় জিগায়? চট্টগ্রামের ছেলেরা সর্বদা বড় চাকুরী খোঁজ করে, কখনও ছোট চাকুরী করতে চায়না। মতিন বলল, ‘বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে’। আজকের পত্রিকার বিজ্ঞাপন এসেছে পেশকার পদে মানুষ নিচ্ছে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ ছেলেরা দরখাস্ত করতে পারবে। তুমি ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র দাবী করে পেশকার হিসেবে দরখাস্ত কর; ভাগ্যের চাবি জুটে যাবে। যেই বলা সেই কাজ, বি, সি, এস পরীক্ষা দেওয়া সাহেব আলী; অবশেষে নিজেকে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ঘোষণা দিয়ে দরখাস্ত করল, ইন্টারভিয়্যূ হল, সোনার চাকুরীও হয়ে গেল!
কোলাহল বেড়ে যাওয়াতে তন্দ্রা হারালাম; দেখি সাহেব আলী চেয়ার ছেড়ে উঠেছে এবং ত্রস্ত পায়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে পিছনে শার্ট ধরলাম। আহত বাঘিনীর ন্যায় ফিরে তাকাল! দেখতে চাইল কার এত্তবড় সাহস! চোখে চোখ পড়তেই, গোস্বা পানিতে পরিণত হল এবং বুকে জড়িয়ে ধরল।
কথা না বাড়িয়ে একটি রড় রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। বিশেষ কায়দায় বানানো, প্যান্টের হাঁটু অবধি লম্বা বিরাট পকেট থেকে টাকা বের করে টেবিলে স্তুপাকারে রাখতে রইল। হোটেলের ছোট্ট দুটো বালক দৌড়ে এসে তাকে টাকা গুছাতে সহযোগিতা করল। খুবই দ্রুততার সাথে দুই পকেটের টাকাগুলো গুছিয়ে ফেলল।
ধরণ দেখে বুঝলাম এটা তাদের রুটিন ওয়ার্কই হবে। নতুবা আন্তরিক না হলে, এত দ্রুততার সাথে তা করতে পারত না।
বললাম, ‘তুমি যেভাবে প্রকাশ্যে টাকা গুছিয়ে নিচ্ছ, তা দেখে সন্ত্রাসী-মাস্তান যদি হামলে পড়ে’?
উত্তরে বলল, ‘এই শহরে আমি এমন এক ব্যক্তি, যার পকেটে হাত ঢুকিয়ে পকেটের উত্তাপ পরিমাপের সাহস কারো নাই’। বরং আমার খালি পকেট ভরে দেবার জন্য মানুষ ধাক্কাধাক্কী করে। শহরের যত চোর, মাস্তান, হাইজ্যাকর, যেই ধরা পরুক না কেন, তাকে কোন এক সময় আমার শরণাপন্ন হতে হয়। সুতরাং কেউ ভুলেও আমাকে ত্যক্ত করবেনা’। মনে মনে বললাম, সে তো কিছুক্ষণ আগে নিজ চোখেই দেখেছি।
আমার বিয়ের দাওয়াত পেয়ে বেজায় খুশী হল, দাওয়াতে না যাবার জন্য বারংবার মাফ চাইল। প্রতিটি মিনিট মূল্যবান এমন বন্ধুটি, আমার বিয়ের জন্য আধা ঘণ্টা ঘণ্টা সময় দেবার জন্য রাজী হলেন।
বিদায়ের আগে তার সাথে পুনরায় অফিস পর্যন্ত গেলাম। গিয়ে দেখি আরেক কাণ্ড! সারা শহরে পুলিশ কর্তৃক আটক করা ড্রাইভিং লাইসেন্সগুলো এখানেই আনা হয়েছে। বিভিন্ন ড্রাইভার প্রশ্ন করছে আমার লাইসেন্স কি আপনার এখানে এসেছে? হ্যাঁ বা না এতটুকু সংবাদের বিনিময়ে টাকার বাণিজ্য আগের চেয়েও জমজমাট হয়ে উঠল। রাত্রে সাহেব আলীর বাসার চিত্র আরো জমজমাট। বিভিন্ন গ্রাহক আসে, তাদের মামলাটিকে পক্ষে নেবার জন্য দেন দরবার করতে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, খোদা তায়ালা সাহেব আলীর প্রতিটি নিঃশ্বাসে টাকার প্রবাহ সৃষ্টি করেছে। মাত্র দু’বছরের মধ্যেই সাহেব আলী শহরে বহুতল ভবনের মালিক হয়েছে, কিনেছেন কয়েকটি প্লট!
ইতিমধ্যে গ্রীণল্যাজ ব্যাংক থেকে সাহেব আলী অফার পেয়েছে, চার্টার্ড ব্যাংকের চাকুরীও হয়েছে, তাছাড়া সে ইতিমধ্যে বি, সি, এস পাশও করেছে। তবে সকল চাকুরীর অফার বিনয় মিশ্রিত ঘৃণার সহিত সে ফিরিয়ে দিয়েছে! জীবনের মূল্যবান লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সে পেশকারীর পেশাকে বাহু বন্ধনে মজবুত ভাবে ধরেছে। উপরে বর্ণিত সম্মানী চাকুরী ফিরিয়ে দেবার জন্য তার কোন আফসোস নাই, সে সব চাকুরী করে একসময় সে সম্মানী হত বটে, তবে সংক্ষিপ্ত সময়ে এত টাকার মালিক হতে পারত না। একদা টাকার পিছনে ঘুরতে থাকা সাহেব আলীর পিছনে; উড়ন্ত টাকাই ঘুরঘুর করে। ইচ্ছা করলেই টাকা ধরতে পারে; বানাতে পারে প্রচুর টাকা; অনেক, অনেক টাকা।
সাহেব আলী পেশকারের ভাইয়েরা বড় ব্যবসায়ী, বোনেরা সবাই সুখী, সবাই তাদের পরিবার নিয়ে শহরে বসবাস করে। পেশকার বিয়ে করেছেন আরেক বিত্তশালীর আদুরে কন্যাকে। তার ঘরের প্রতি কক্ষের দেওয়ালে ঝুলানো আছে, বিরাটকায় পাতলা টিভি, দামী আসবাব পত্রে টই টুম্বুর তার ফ্লাট। চারিদিকে সুখ আর সুখের যোগসূত্র রয়েছে তার বাড়ীতে। ধনী লোকের স্ত্রী দু’হাতে খরচ করেন। ফকির মিসকিন অপেক্ষায় থাকেন, কখন তাদের বাড়ী থেকে ময়লা আবর্জনা ফেলা হবে। কয়েকদিন আগে ফেলে দেয়া আলমারিতে চারটি দামী কাথান শাড়ী পাওয়া গিয়েছিল। যে শাড়ীগুলো কিনার পর ব্যবহার করাতো দূরে থাক, প্যাকেট পর্যন্ত খোলা হয়নি। পরিচিত গরীব মিসকিন তাদের পরিত্যক্ত জিনিষ থেকে প্রতিনিয়ত মূল্যবান জিনিষ লাভ করতে থাকে! আশে পাশের কৌতূহলী মানুষ সর্বদা তাকিয়ে থাকে পেশকার মহোদয়ের ঘর থেকে কখন নোংরার বস্তাটি রাস্তায় ফেলা হবে।
ঘুমের ট্যাবলেটের কল্যাণে, স্বামী-স্ত্রী দৈনন্দিন সুখের ঝগড়া পর্ব শেষ করে আরামের বিছানায় ঘুমাতে যান। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া ক্লাস নাইনের ছেলেকে দিয়ে ঘুমের ট্যাবলেট আনিয়েছিলেন। সেই ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে পেশকার পরিবার টানা দুই দিন ঘুমিয়ে ছিলেন। হাসপাতালের বিছানায় ঘুম ভাঙ্গলে পর ডাক্তার প্রশ্ন করেন; স্যার আপনি মাদক পেয়েছেন কোথায়? একটু বেশী মাত্রায় গ্রহণ করেছিলেন বলে, দুটি দিন অফিস করতে পারলেন না! মাদক নিলেও কম করে নেওয়া ভাল, বাহিরে খবর রটে গেলে ছি ছি রব উঠবে।
বুদ্ধিমান পেশকার সাহেব মুহূর্তেই বুঝে ফেললেন সকল ঘটনা। দুইটি আয়ের দিন হারানোর বেদনায় পেশকার হায় হায় করে উঠল! কত টাকার আয় বরবাদ হল, কত বড় সর্বনাশটাই না করল নিজের ছেলে! ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া এই সন্তান নিয়ে, পেশকারের দুঃচিন্তার শেষ নাই। তিন জন গৃহশিক্ষকের নিরবচ্ছিন্ন তত্বাবধানেও ছেলে একটি সামান্য প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করতে পারেনা। পেশকার খেদোক্তি করে বলে, যেখানে আমি একবার দেখা মাত্র যে পড়া শিখতে পারতাম। সেখানে আমার ছেলে বইয়ের প্রতি দশবার তাকালে, এক লাইন পড়া দেখতে পায়!
নিজে পেশকার হলেও ছেলেকে ব্যরীষ্টার বানানোর স্বপ্ন এখনও দেখতে পায়। পেশকার কষ্ট করে বড় হয়েছিলেন বলে, সন্তানদের কষ্টের মুখ দেখান নি, যখন যা চেয়েছে তখনই তা দিতে চেষ্টা করেছে। এত সুখ ও ঐশ্বর্যের ভিতর বড় হয়েও ছেলে বহিঃর্মুখী হতে চায়। সুখের মধ্যে বেড়ে উঠা ছেলে গত সপ্তাহে বন্ধুদের সাথে স্থানীয় হোটেলে গিয়ে মাদক গ্রহণ দিবস উৎযাপন করে এসেছে! পেশকার ছেলের মাদকাসক্তির কথা মনে পড়লেই লাঠি হাতে তেড়ে আসেন। তখনই পেশকার গৃহীণি ছেলেকে আদর করে বলে, বাবা সন্ধ্যার আগেই আমার পুরিয়াটি বাসায় দিয়ে যেয়ো.......।
(একটি ঘটনার ছায়া অবলম্বনে গল্পটি রচিত এবং এখানের সকল চরিত্রই কাল্পনিক)
বিষয়: বিবিধ
২৬৪৭ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমরা তবুও দুনিয়ার মোহে সব হারাতে রাজি।
বেতন ডাবল হলেও মনে হয় অভাব থেকেই যাবে, আসলেই আমরা না শোকরী বান্দাহ।
শিক্ষণীয় গল্পের জন্য ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন