ফকির আলী মেম্বারের চুড়ির ব্যবসা (জীবন থেকে নেয়া ঘটনা)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:০৪:৫১ বিকাল
চেহারায় আভিজাত্যের এক বাহারি ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে ফকির আলী ১২৫ সিসি সিলভার রঙ্গয়ের হোন্ডা মটর সাইকেলে চড়ে রাস্তা দিয়ে যায়; মনে হয় হোন্ডা কোম্পানি যেন তার জন্যই মটর সাইকেল তৈরি করেছে! সবে মাত্র হোন্ডা কোম্পানি সিলভার বর্ণের ১২৫ সিসি মটর সাইকেল বাজারে ছেড়েছে। তারই একজন সৌভাগ্যবান ক্রেতা সবার পরিচিতি ফকির আলী।
নামে ফকির আলী হলেও, মাশায়াল্লাহ চেহারা খানি তার রাজকীয় ভঙ্গিমায় ভরপুর। পুরো শরীরের চামড়ার কোথায় সরিষা পরিমাণ দাগ নাই। দুধের মাঝে আলতা মিশালে যে বর্ণ সৃষ্টি হবে, সেই ধরনের বর্ণের চামড়ার অধিকারী ফকির আলী! সর্বদা হাসি হাসি চেহারার ফকির আলী যখন তার গোল্ডেন কালারের চশমা চোখে লাগিয়ে মটর সাইকেল চালিয়ে সামনে দিয়ে চলে যায়, যে কোন পথিক তার দিকে তাকাতে বাধ্য হবেই। কালো, খয়েরী, বাদামী যে ধরনের পোশাক পরা হউক না কেন, সব পোষাকেই তাকে আকর্ষণীয় করে তুলে। ঠোঁটের কোনে রোথম্যন্স সিগারেট লাগিয়ে, সিগারেট আর গাড়ির ধূয়া, আর রাস্তার ধূলি রাশি গগনে উড়িয়ে যখন রাস্তা পার হয়, তখন তাকে দেখতে তো রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুরের মতই লাগে! বহু জনকে প্রশ্ন করে মাত্র একজন থেকে তথ্য পেয়েছিলাম ফকির আলী ব্যবসা করে! কিন্তু কিসের ব্যবসা সেই কথাটি বিগত ছয় মাসেও অনেক জনকে জিজ্ঞাসা করে কোন সদুত্তর পাইনি।
সুন্দর চেহারার ফকির আলী স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে মেম্বার পদে দাড়িয়ে যায়। রাস্তা ঘাটে যাকে পায়, তাকেই বলে আমি আপনাদের সন্তান নিজে ভাল হয়েছি, জনগণকেও ভাল কিছু দিতে চাই। আপনারা আমাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন।
এবার কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলাম না।
একজনকে ধরে বসলাম, ভাই আজ বলতেই হবে আসলেই ফকির আলী কি কাজ করে?
ব্যবসা করে।
কিসের ব্যবসা?
আমতা আমতা করে বলল: চুড়ির ব্যবসা!
আশ্চর্য হয়ে বললাম, চুড়ির ব্যবসা করে এত টাকার মালিক হয় কিভাবে?
ভাবলাম হয়ত চুড়ির বড় সাপ্লাইয়ার হবে।
ওনার দোকান কোথায়? তাকে তো সর্বদা গ্রামেই দেখি, শহুরে ব্যবসায়ী হলে তো জানতাম? প্রশ্ন করলাম।
ভাই, সকল ব্যবসায়ে দোকান লাগেনা, সে একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী, কথা দিয়েই তার ব্যবসা চলে! এভাবেই উত্তর পেলাম!
মনকে সান্ত্বনা দিতে পারলাম না এইসব আজগুবি উত্তরে। অগত্যা রহস্য অন্তরেই চেপে থাকল।
একক প্রচেষ্টাতেই ফকির আলী সেবার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হয়ে গেল। গলায় ফুলের মালা দিয়ে ফকির আলী পুরা গ্রাম প্রদক্ষিণ করল। কিছু মানুষ তাকে বাহবা দিল, কিছু মানুষ ভ্রু কুঞ্চিত করল। ইউনিয়ন পরিষদে এখন তার দাপট বেড়েছে, দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ও নেতা বনে গেছে। এলাকাতে চুরি-ডাকাতি বন্ধ হয়েছে, তবে এলাকার ওয়াজ মাহফিলে হামলার ঘটনা বেড়ে গেছে। ফজরের নামাজে মুসল্লির মাথায় কে বা কাহাদের মাধ্যমে ডিমের আক্রমণ বেড়ে গেছে।
ফকির আলীকে পছন্দ করেনা, এমন এক মুরুব্বীকে প্রশ্ন করলাম, ফকির আলীর ব্যবসা সম্পর্কে আমি একটু জানতে চাই?
তিনি বললেন, তওবা তওবা সে কোন দুঃখে ব্যবসা করতে যাবে, আপনাকে কে বলেছে, সে ব্যবসা করে?
তাজ্জব ও আগ্রহী হয়ে প্রশ্ন করলাম, একজন তো জানালেন তিনি চুড়ির ব্যবসা করেন সেটা যদি না হয়, তাহলে তিনি কি করেন?
মুরুব্বী কষ্টের হাসি হাসলেন এবং বললেন, ‘তুমি ঠিক শুনেছ তবে বুঝেছ উল্টো। এই চুড়ি সেই চুড়ি নয় যে, মহিলারা হাতে দেয়। সে এলাকার একজন পেশাদারী চোর! তার চোরামীর জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে একদা মানুষ উত্তম মধ্যম দিয়ে তাকে পুলিশে দেয়। পরে তার দুই বছর জেল হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সে আর এলাকায় আসেনি। দশ বছর পরে এলাকায় হাজির হয়েছে। মানুষ তার অতীতের কথা ভুলে গেছে কেননা ফকির আলি এখন সাফ হয়ে গেছে, সে সুন্দর মানুষে পরিণত হয়েছে! চামড়া সাদা হয়েছে কিন্তু মন এখনও সাদা হয়নি। শুনা যায়, তার সাথে জেলে আরও চোরের সাথে সাক্ষাত ঘটে, তাদের সান্নিধ্যে সে আরও বড় চোরে পরিণত হয়। চোরাচালানের ব্যবসায় তার দারুণ হাত। অনেক অর্থকড়ি কামিয়ে এখন সে জনপ্রতিনিধি’।
এতদিন পরে বুঝলাম এই চুড়ির ব্যবসা মানে হাতে দেবার চুড়ি নয়, এটা চুরি হল মাল-সম্পদ চুরি করার ব্যবসা!
প্রশ্ন করলাম, মানুষ জানেনা যে সে চোর ছিল? এবং তাকে ভোট দিয়ে জিতিয়েও দিল!
উত্তরে বললেন, ‘জানে, তবে মানুষ নিজেদের ভাল মন্দের বিচার করার জন্য চোরকেই বেশী বিশ্বস্ত মনে করে। আমাদের দৃষ্টিতে যারা ভাল মানুষ, তাদের উপর আস্তা রাখেনা। কেউ নিজের বিচারের ভার যদি চোরের উপর সোপর্দ করে, তাহলে সাধারণের করণীয় কি?
বলতে রইলেন, এই যে ওয়াজ মাহফিলে হামলা হচ্ছে, এগুলো তার মানুষেরাই করছে। কেননা ভাল মানুষ গুলো চোরের শত্রু। আজকে যারা মাহফিল করে মানুষকে ভাল কথা শুনাতে চায়, একদা তারাই ফকির আলীকে চোরাকে পুলিশে দিয়েছিল।
আরও কৌতূহলী হয়ে, প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে ফজরের নামাজের মুসল্লির গায়ে যে ডিম মারে, তারা কে হতে পারে’?
তারা আবার কে হবে! তারাও ফকির আলী মেম্বরের মানুষ! এসব মানুষ আগে মানুষের মাল চুরি করত। এখন ফকির আলী মেম্বারের কল্যাণে তারা সরকারী গো-ডাউনের গম চুরি করে! ফজরের নামাজ আর তাহাজ্জুদের নামাজের মুসল্লি চোরদের জন্য বিরাট মুস্কিল স্বরূপ, পথের কাঁটা। ফজর ও তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত চোরদের ঘরে ফেরার সময়। কোন মুসল্লি এ ধরনের কাউকে পথে পেয়ে গেলে, সহজে বুঝে ফেলবে এই ব্যাটা তো নামাজি নয়, তাহলে এত রাত্রে আসে কোত্থেকে! তাই তাদের পথ পরিষ্কার করতে, বিশেষ একটি জায়গার মুসল্লিদের ডিম মেরে ভয় লাগিয়ে দেয় যাতে করে, ফজরের নামাজ যাতে মসজিদে না পড়ে।
চিন্তা করলাম আর মনে মনে চিল্লায়ে উঠলাম, ‘জয় ফকির আলী, ফকির আলীদের জয়।
বিষয়: বিবিধ
২৯৯৭ বার পঠিত, ২৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাল মানুষেরা এসব পারে না ।
ফকির আলীর চুড়ি থেকে চোর হওয়ার কাহিনীর সিকুয়েন্সে ব্যাপক আনন্দ পেলাম
আসলেই ভালো লিখেছেন তবে এই ধরণের ফকির বনাম বড়লোক চোরদের সন্ত্রাসী থেকে দেশ ও জাতি যেনো অচিরে মুক্তি পায় সেই দোআ করি!
দোআ করবেন আমাদের জন্য!
আমরা যখন যেনে শুনেও এই ধরনের লোকদের ভয় পেয়ে ভোট দিই তখন আমাদের পাওনাও তাই।
ভালো লাগলো।
আর
চুড়ি মানে হাতের কঙ্কন
চুরি মানে তো চুরিই করা
উচ্চারনে তেমন একটা বুঝা যায়না কোনটি কি?
তাছাড়া ফকির আলীর চেহারা আভিজাত্য, চলার ভঙ্গিমা দেখে কোন বেকুপ মানুষ ও ভাববে না যে, এই ব্যক্তি চুরির মত মন্দ কাজ করতে পারে। অনেক ধন্যবাদ।
আপনার লেখাটা রম্য হলেও বাস্তবতা তাই।
ফকির আলীদের হায়া-শরম থাকতে নেই!!
আপনি পূর্ণ সুস্থতা থেকে কতদূরে?
ফী আমানিল্লাহ
শারীরিক অবস্থা এখন প্রায় ৮০ শতাংশ ভাল, দোয়া করবেন, ভাল থাকুন।
চোর নিজে মেম্বর!!
রাগে ক্ষোভে ভালোমানুষ গড়গড়।
চোর ক্ষমতায় গেলে মানুষের বুদ্ধি বাড়ে মনে হয়!!!?
মন্তব্য করতে লগইন করুন