আচানক! এলাকায় এক দরবেশের অভ্যুদয় (রসাত্মক কাহিনীর শেষ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:২৭:৫৮ দুপুর
........মরার উপর খড়ার ঘায়ের মত সেবা খোলায় হঠাৎ এক কান্ড ঘটে গেল। কে বা কাহারা রাতের আঁধারে সেবাখোলাস্থ ভাগাড়ে একটি মরা গরু ফেলে যায়! চারিদিকে হৈ হৈ রব উঠল, সবার মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করতে লাগল! কাল থেকে গরু পচা দুগর্ন্ধে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যাবে, মানুষ দাঁড়াবে কিভাবে! অনেকেই বলাবলি করছিল, মরা গরুর মালিকের কাছে কি ইহকাল-পরকালের ভয় নাই? দরবেশের বদ দোয়ার কথা কি একবারও চিন্তা করেনি? সে কি একবারও ভাবেনি যে, তার গোয়ালের বাকী গরুও বাবার বদদোয়ায় মরে যেতে পারে!
এ ঘটনায় দরবেশ বাবাও কিছুটা চিন্তিত বলে তার চেহারা দেখে অনুমিত হল। পরিচালনা কমিটি সিদ্ধান্ত নিলেন, তদন্ত করে দেখবেন এটা কার গরু? এটার পচা-গলিত থেকে দুর্গন্ধ বের হলে দরবেশ বাবার কি হবে? তিনি কিভাবে এখানে ধ্যান করবেন? কিভাবে শত শত মানুষ অপেক্ষা করবেন? ইত্যাদি....।
শীতকাল থাকায় তখনও মৃত গরু লাশ থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়া শুরু হয়নি। কয়েকজন পরামর্শ দিল আজকের রাত অবধি অপেক্ষা করা হউক। রাত্রে শৃগাল এসে ডিনার সেরে নিক। শৃগালের উচ্ছিষ্ট বাকি অংশ কুকুর দিয়ে সেরে ফেলা হবে। সিদ্ধান্ত হল, সকালেই গ্রাম থেকে কুকুর আনা হবে। যাদের কুকুর আছে তারা নিজ দায়িত্বে নিজেদের কুকুর নিয়ে আসবে। কেউ ইচ্ছে করলে গ্রামের মল খাওয়া বেওয়ারিশ কুকুরও নিয়ে আসতে পারে। ফলে পচা গরুর বাকি অংশ নিশ্চিহ্ন করা তেমন কোন সমস্যা হবে না।
পরবর্তী সকাল শুভ হলনা! কবরস্থান জঙ্গলের গর্তে যে গুটিকয়ের শৃগাল বাস করত, দরবেশের অনুসারীদের পদচারণায় শৃগালের গোষ্ঠী পুত-নাতি সহ দিন কয়েক আগেই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল। ফলে শৃগাল কর্তৃক মরা গরু আর খাওয়া হয়নি বরং বাগডাসা অথবা খেঁকশিয়াল এসে, গরুর পেট দিয়েছে ফুটো করে! পেটের কিছু ময়লা, নাড়ি-ভুরির কিয়দংশ ও কিছু পচা রস বের হয়ে পরিবেশকে বেকায়দা পূর্ণ করেছে।
রোদ বাড়ার সাথে সাথে গন্ধের তীব্রতাও বাড়তে রইল। বহু কসরত করে, লোভ লাগিয়ে যারা কুকুর নিয়ে এসেছিল, তাদের নিয়ে নতুন সমস্যা দেখা দিল। বেওয়ারিশ কুকুর সর্বদা স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়ে চলে। তারা স্বাধীনভাবে তাজা মল খাবে কিন্তু গরুর পচা গোশত খেতে রাজি হলনা! বরঞ্চ কয়েকটি বদমেজাজি কুকুর নিজেদের মাঝে মারামারি বাধিয়ে বসল! এতে মানুষের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে গেল, খোদ দরবেশ বাবাকেই বার কয়েক তাঁর আসন ছেড়ে উঠতে হল। অবশেষে পরিচালনা কমিটির সদস্যরা মৃদু লাটি চার্জ করে, সেবা খোলা কুকুর মুক্ত করল।
শীতের সকালের একমুখী বাতাস বইতে শুরু করল! সেখানে অবস্থান করাটা তাই দায় হয়ে পড়ল। পচা দুর্গন্ধে দরবেশ বাবার চেহারা বিদঘুটে ভাব ধারণ করল! তাঁর নূরানি চেহারায় দুশ্চিন্তা ও পেরেশানির ভাব পরিলক্ষিত হল! অভিব্যক্তি দেখে বুঝা গেল, পচা গরুর যদি কোন একটা বিহিত না হয়, তাহলে আজই তাঁর শেষ দিন হবে! ভক্ত মুরিদদেরকে নিজেদের নাচ চেপে, প্রয়োজনীয় কথা বার্তা সারাতে দেখা গেল। সিদ্ধান্ত হল, যেভাবেই হোক পচা গরু সরতেই হবে; কিন্তু কিভাবে!
সেবা খোলার পশ্চিম দিকের ছোট্ট গাঁয়ের দূরত্ব একটু কম, গাঁয়ের মাঝ বরাবর একটি মেঠো পথ আছে, তার পরেই একটি খাল; কোন জনবসতি নাই। সিদ্ধান্ত হল পচা গরু বিশেষ পদ্ধতিতে কাঁধে বহন করে সেখানেই ফেলা হবে। এখন বাস্তবায়নের পালা।
মোটা দড়ি আনা হল! গাছের হালকা অথচ মজবুত লম্বা গদাও জোগাড় হল! দুজন ব্যক্তি এক হাতে নিজের নাক ধরে, আরেক হাতে কাজ করার প্রত্যয়ে, দৌড়ে পচা লাশের কাছে পৌঁছে গেল। দুজনে নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে, তাদের দুটি খালি হাতে যতটুকু পারল, গরুর পায়ে সাথে দড়ি বাধার চেষ্টা করল। দশ শেষ হলে তারা ফিরে এল মুহূর্তে আরেক দল নতুন দম নিয়ে গরুর কাছে পৌঁছল! এভাবে কয়েক বার অনুশীলনী দৌড়ের মাধ্যমে গরুর চারটি পাকে দুটি-জোড়ায় করে বাঁধা হল।
দরবেশ বাবার দুঃখ লাগবে পচা গরুর পা বাঁধা এমনকি কাঁধে নিয়ে দূরে ফেলে দেওয়ার মত উৎসাহী এবং সাহসী মানুষের অভাব হলনা! ভক্তকুলের মধ্য থেকে শক্ত-সামর্থ্য, দীর্ঘক্ষণ দম রেখে ভার বহনে সক্ষম, এমন কিছু স্বেচ্ছাসেবক বাছাই করা হল। নাকে গামছা বেঁধে আগে দুজন, পিছনে দুজন মিলে, গরুর পচা লাশ কাঁধে তুলে নিল!
ভাগ্য ভালই বলতে হয়! গরুটি ছিল একটি বাছুর, ওজনে অপেক্ষাকৃত হালকা, অতি সহজেই চারজনে আস্ত পচা গরু কাঁধে তুলে নিতে পারলেন। বুকে দম নিয়ে যতটুকু পারা যায় চারজন বীরের গতিতে সামনে চলল। সুপারভাইজার ইঙ্গিত দিল পালা বদলাতে হবে। পরবর্তী চারজন এসে কাঁধ বদল করে লাশের দায়িত্ব নিল। শীল কালে মাঘ মাসের মৌসুমে বিল ছিল খালি, খুব সহসাই বহনকারী দল, বিলের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল। সামনেই গাঁয়ের মেঠো পথ, ডানে হিন্দু বাড়ী, বাঁয়ে মুসলিম বসতি, উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একটু গরীব। ছোট গাঁয়ের মধ্যখানে মেঠো রাস্তায় পচা গরুর লাশ যাচ্ছে, পেছনে চলছে ভক্তকুলের বিরাট মিছিল! খোলা বিল দিয়ে আসার সময় পচা বহনকারীরা খুব দ্রুতই আসতে পেরেছিল। গাঁয়ের এই মেঠো পথে সেভাবে দ্রুত চলা মোটেও সম্ভব ছিলনা।
গাঁয়ের পৌঢ় গৃহবধূরা নাকে শাড়ীর আঁচল পেঁচিয়ে প্রতিবাদ করল, এই সংক্ষিপ্ত রাস্তা দিয়ে পচা গরুর লাশ না নিতে। পুরুষেরা কেউ বাড়ীতে নেই, অনেকেই দিন কামলা মানুষ। ওদিকে দরবেশের অনুসারী প্রচুর সুতরাং মহিলাদের জোড়ালো প্রতিবাদে তারা কান দেবে কোন দুঃখে? লাশ মেঠো পথ দিয়ে চলছিল, পিছনের দুজনের দম ফুরিয়ে যাচ্ছিল তাই পালা পরিবর্তনের প্রয়োজন হল। পরবর্তী বহনকারী দল দায়িত্ব নেবার ফাঁকে পিছনের দুজন মেঠো পথের নরম আল ভেঙ্গে খানিকটা নিচে ধ্বসে পড়ল। সামনের বহনকারী দুজন টাল সামলাতে পারল না। গদায় ঝুলন্ত পচা লাশে আচমকা হ্যাঁচকা টান পড়ল, লাশ টালমাটাল গতিতে দোলতে রইল। মুহূর্তেই মৃত গরুর পিছনের একটি পা, শরীরের বিরাট অংশ, দেহ থেকে সম্পূর্ণ খসে গেল। ফলে চার জনের অসাধারণ দলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে! অমনি আছাড় খেয়ে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়।
টানা হ্যাঁচড়াতে লাশের নাড়ি-ভূরি ইতিমধ্যেই এক প্রকার ডাল হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে লাশের এধরনের পতনে, পচা থেকে গল গল করে পচন রস বের হতে লাগল। মুহূর্তে ছোট্ট গাঁয়ের ঠিক মাঝখানে ভয়ানক দুর্গন্ধ, বীভৎস ও কদাকার পরিস্থিতি তৈরি হল। অবস্থা এমন হল যে, গরুর ছিন্নভিন্ন পচা লাশকে, একমাত্র বালতিতে ভরে নেওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর রইল না! ভক্ত কূলের বিরাট মিছিল, পুলিশের পিটুনি ছাড়াই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল! মানুষ নাক ধরে জ্ঞানশূন্য হয়ে দিক্বিদিক ছুটল, গাঁয়ের অসহায় মানুষ প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে উল্টো গাঁ ছেড়ে পালাল!
সন্ধ্যা অবধি তিন মাইল দূরের ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ গেল, কাঁচা রাস্তায় থানা ১২ মাইল দূরে। এলাকায় বিজলী বাতি তখনও পৌঁছেনি। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিছুদিন আগে, কয়েকদিন আগেই সিপাহী বিপ্লব হল। দেশে উন্নয়নের জোয়ার তখনো শুরু হয়নি, শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা ছিল, ধর্মীয় শিক্ষায় মানুষ অনেক পিছিয়ে ছিল, শুধু মুখের দাঁড়িকেই ধর্মের মানদণ্ড ভাবা হত। এমতাবস্থায় মানুষের করার কিছু ছিলনা। পরদিন থেকে দরবেশ বাবাকে আর হদিশ পাওয়া গেলনা, কিছু মানুষ হন্য হয়ে খুঁজেছে সর্বত্র। তাঁকে পেলে প্রয়োজনে মাফ চেয়ে, হাতে-পায়ে ধরে আবার নিয়ে আসবে। সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল, তিনি আর ইদিলপুরে ফিরে আসেনি। গ্রামের মানুষ দরবেশের কথা ভুলে যায়।
সপ্তাহ খানেক পর একদিন পুলিশ এসে হাজির। পুলিশ দরবেশের খবর জানতে চায়। দরবেশ কে না পেয়ে, পুলিশি আলামতের আশায় পরিচালনা কমিটির কয়েকজনের বাড়ীতে তল্লাশি চালায়। নতুন করে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে, সবাই বলাবলি করছিল, এটা দরবেশের বদদোয়ার ফল।
পুলিশের তথ্য থেকে জানা যায় মহামান্য দরবেশ কুমিল্লা থেকে পলাতক হয়েছেন এবং এক খুনের আসামী। পুলিশ দরবেশের পিছনে লেগেই ছিল, যথেষ্ট দেরী করে ফেলেছিল দরবেশ কে পাকড়াও করতে। এ সমস্ত কথাকে দরবেশ অনুসারীরা পাত্তাই দিলনা, তারা বলল এটা এক প্রকার বিদ্বেষ, পুলিশ মিথ্যা বলছে। দরবেশ ইদিলপুরে এলেন, অবস্থান করলেন, থাকলেন একটি কথাও কখনও কারো সাথে বলেননি; সর্বদা বোবার মত ধ্যান করলেন! ধর্মপ্রাণ মানুষ ইজ্জত দিয়ে ভালবাসলেন, বলাবলি করলেন, এ ধরনের মানুষের শত্রু হয় কিভাবে? এলাকাতে এখনও তাঁর যথেষ্ট সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে আছে। তাঁর কোন শত্রু হয়নি, কেনা ‘বোবার কখনও শত্রু হয়না’।
আগের পর্ব দেখতে চোখ রাখুন এই লিঙ্কে: আচানক! এলাকায় এক দরবেশের অভ্যুদয় (রসাত্মক কাহিনী)
বিষয়: বিবিধ
১৯৪০ বার পঠিত, ২৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আকল শেষ! আকল শেষ!!
হি হি হি হা হা হা
দরবেশতো ভালো একটা দান দিতে পারতো! দিলোনা দান।
পালিয়ে জীবন খান খান!
ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
বিদ্রুপাত্মক সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
অনেক বিনোদন পেলাম, ধন্যবাদ
অথচ মানব জাতির সকল সমস্যার সমাধান দিয়ে আল কোরআন।
আগের লেখা ও আজকের লেখা পড়ে খুবই বিনোদিত হলাম সাথে দরবেশ গিরি ও পীর গিরীর খোলা মুখোশ পেলাম।
আশা করি আগামী প্রজন্ম ভন্ডদের ভন্ডামী থেকে দূরে থাকবে।
পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিলো পঁচা গরু টানার দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি, মনের অজান্তে নাকে কাপড় চলে এসেছে
চমৎকার ধারা বিবরণীর জন্য আন্তরিক শুকরিয়া
মন্তব্য করতে লগইন করুন