একটি ডিজিটাল চোখ - জীবন থেকে নেয়া
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ৩০ আগস্ট, ২০১৫, ১২:১১:১২ দুপুর
আমি অন্ধ, কপাল মন্দ, আপনাদের জানাই,
আমার মত জনম দুঃখী, এ সংসারে নাই।
বোবা, কালা, পঙ্গু যারা, কিছুই হারায় না তারা,
দুটি আঁখি বন্ধ যার, সেতো; বড় অসহায়।।
আমার মত জনম দুঃখী এ সংসারে নাই......
সুরেলা কণ্ঠের গান শুনে, নাসরিনের হৃদয়ে দাগ কাটে। কথাগুলো যেমনি আবেদনময়ী, তেমনি বর্ণনামূলক। ড্রাইভারকে গাড়ী থামাতে ইশারা করে, গাড়ী থেকে নেমে সোজা গায়কের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
টিনের একটি ভাঙ্গা থালা নিয়ে, মানুষ চলাচলের পথের উপর দাড়িয়ে গায়ক! পথিক ভাঙ্গা থালায় ঝন করে আওয়াজ তুলে ধাতব মূদ্রা ছুঁড়ে দিয়ে, নিজ গন্তব্যে উদাও হচ্ছেন।
নাসরিন প্রশ্ন করে: কি নাম আপনার?
মেহেরুল্লাহ, গায়ক উত্তর দেন।
আপনি কি আমার সাথে যাবেন? এই ঢাকা শহরে আপনার জন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করব।
মেহেরুল্লাহ জবাব দেন, দুই চোখ অন্ধ মানুষকে আপনার কাছে নিয়ে, নিজের ঝামেলা বাড়িয়ে কি লাভ? জীবনের ৭০ টি বছর তো এভাবেই কাটিয়েছি! আর ক’দিন বাঁচব? আল্লাহ আমাকে মনোবল, সাহস এবং ধৈর্য সবই দিয়েছেন এখন ইতি টানার পালা, বরং সম্ভব হলে আমাকে কিছু সাহায্য করুন, সেটিই আমার জন্য বিরাট পাথেয় হবে।
টিস্যু পেপারে চোখ-মুখ মুছে এক টাকার চেয়েও কম ওজনের, একশ টাকার একটি নোট মেহেরুল্লাহর ভাঙ্গা থালায় রেখে, নাসরিন দ্রুত নিজের গাড়িতে উঠলেন।
ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী ও মেধাবী ছাত্রী নামরিন! সে যখন কুমিল্লা শহরের দামী কলেজের নামকরা ছাত্রী; তখন তার উপমা ছিল, সুন্দরী-সুনয়না নাসরিন। পাড়া মহল্লার তাগড়া যুবকদের কাছে সে স্বর্গীয় অপ্সরা সমতুল্য। দেশে বখাটে বিরোধী আইন চালু হওয়ার বহু আগে থেকেই নাসরিন এবং এবং তার সহপাঠিদের রাস্তায় চলা মুস্কিল হত।
বান্ধবীরা টিপ্পনী কেটে বলত, তোর কারণেই রাস্তায় এত বখাটে জট লেগে থাকে।
উত্তরে নাসরিন বলত, আমিতো কিছুই করিনা, আল্লাহ প্রদত্ত চেহারা নিয়েই ক্লাসে আসি। আমিতো কোন ম্যাক আপ, গেট আপ করিনা! সাধারণ ভাবেই কলেজে আসি। কোন উত্তেজক পোশাকও পারিনা, তারপরও ছেলেরা যদি পিছনে লেগে থাকে তাহলে আমার কি করার আছে?
অনেকে বিভিন্ন মাধ্যমে চিঠিপত্র দিয়ে নাসরিনের মনোভাব বুঝতে চাইত। ব্যাপারটি দাদীর নজরে পড়ে, তিনি কড়া ভাষায় হুশিয়ার করে দেন, কখনও যেন করো চিঠি-পত্র গ্রহণ না করি কিংবা আগ্রহ না দেখায়। তাহলেই বিপদ সুনিশ্চিত। দাদী বলেছেন, যে নারী নিজেকে হেফাজত করতে চেষ্টা করে, তাকে আল্লাহও হেফাজত করেন।
ব্যাংক ম্যানেজার বাবা এবং দুই ভাইয়ের এক বোন নাসরিন। যথেষ্ট প্রতিভাবান বলে; ভবিষ্যতে বড় কিছু হতে পারবে, এরকম আশা, ঘরের সবার কাছে ছিল। নাসরিন তরুণদের আবেদন উপেক্ষা করে, দেখেও না দেখার ভান করে, উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি খুব ভাল ভাবেই পার করে। সাময়িক সমস্যা হলেও তার শিক্ষা জীবনে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। বেশী লেখা পড়া করার কথা বলে, বহু বিয়ের প্রস্তাব বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছে।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালে বান্ধবী রোকেয়া একটি খাম তার ভানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। রোকেয়া এতটুকু বলেছিল, কলেজ প্রতিষ্ঠাতার ছেলে এবং ইংরেজির প্রভাষক, রায়হান স্যার এটি দিয়েছেন। তিনি তোমাকে পছন্দ করেন, সম্ভবত তোমার মতামত চেয়ে থাকবেন।
নাসরিন উপস্থিত মুহূর্তে খামটি ফেলেও দেয় নাই, কৌতূহল বশত: পড়েও দেখে নাই। দাদীর উপদেশের কথা মনে পড়াতে স্যারের চিঠ পড়ে প্রভাবিত হবার ইচ্ছা ত্যাগ করে। কেননা সে আরো অনেক দূর যেতে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনে তার দিন বরাবরই ভাল যাচ্ছিল। কুমিল্লায় অবস্থিত ব্যবসায়ী বড় ভাই, প্রতি সপ্তাহে তার খবর নিতে আসত এবং যাবতীয় তত্বাবধান সেই করত। অনার্সে ভাল রেজাল্ট করার পর তার আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গেল; যদি আরেকটু সচেতন হওয়া যায়, তাহলে মাস্টার্সে সবার চেয়ে ভাল করাও অসম্ভব কিছু নয়। যেই ভাবা সেই কাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে, প্রতিটি মুহূর্তকে সে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হল। পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনদের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হোক, বড় কোন সরকারী পদ, নিজ যোগ্যতায় দখল করতে পারবে, এই বিশ্বাস দৃঢ় হল। বান্ধবী ও শিক্ষকেরা বলল যত্নশীল হলে তুমি ভাল করবে।
দীর্ঘক্ষণ লোকমান সাহেবের ফোন বাজতে রইল, খুবই বিরক্ত হলেন! গিন্নীকে নিষেধ করেছেন, দুপুরে ব্যাংক চলাকালীন ব্যস্ত সময়ে যেন ফোন না করেন। তার পরও কেন জানি মনে সন্দেহ হল! তাই মিটিংয়ের মাঝখান থেকেই ফোন ধরলেন। গিন্নীর কান্না জড়িত কণ্ঠ পেলেন! কান্নার মাঝেই যে কথাটি বুঝতে পারলেন; সেটি হল, নাসরিন ঢাকায় গাড়ী এক্সিডেন্টে মারাত্মক আহত হয়েছে এবং জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মেডিক্যারে অবস্থান করছেন। লোকমান সাহেবের মাথায় আসমান ভেঙ্গে পড়ল, ঐ অবস্থায় তিনি মিটিং স্থগিত করে, সপরিবারে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
দুঃচিন্তাগ্রস্থ পিতামাতাকে হাসপাতালের ডাক্তার জানালেন। আপনার মেয়ে কপাল জোড়ে বেঁচে গেছে, সম্পূর্ণ সেরে উঠতে দু’মাস লাগবে, তবে তার ডান চোখটি চিরতরে হারিয়ে গেছে; বাকী জীবন একটি চোখ নিয়েই তাকে বেঁচে থাকতে হবে!
পিতা-মাতা ‘আমার নাসরিন’ বলে চিৎকার দিয়েই, হাসপাতাল লবিতে জ্ঞান হারালেন। শপিং এর উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বান্ধবীদের নিয়ে বেবি টেক্সিযোগে বের হয়েছিল নাসরিন। বাতাসের তোড়ে রাস্তার ওপরে ডাল-পাতা বিস্তৃত, গাছের বিরাট এক আস্ত ডাল রাস্তার উপর আছড়িয়ে পড়ে। বেবি ট্যাক্সির ড্রাইভার কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগেই, পুরো ট্যাক্সিটি ততক্ষণে রাস্তার উপর পতিত ভাঙ্গা ডালের জঙ্গলে আছড়িয়ে পড়ে। গাছের একটি ছোট্ট ভাঙ্গা ডাল সরাসরি ট্যাক্সির সামনের আয়নায় গেঁথে যায়। ড্রাইভার ভাঙ্গা ডাল থেকে হঠাৎ নিজেকে সামলাতে পারলেও; ট্যাক্সির পিছনে যাত্রী হিসেবে বসা নাসরিন নিজেকে বাঁচাকে সক্ষম হয়নি। ভাঙ্গা ডালটি সোজা তার চোখ বরাবর গিয়ে ঢুকে পড়ে! করাত দিয়ে গাছের ডাল কেটেই নাসরিনকে উদ্ধার করে মেডিক্যালে নেওয়া হল। এক্স-রে চেক আপের পর দেখা গেল ডান চোখটি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে, যা কোনদিন ভাল হবার নয়।
এক চোখ হারিয়ে নাসরিন যখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরল, তখন তার জীবন খানি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। যে মেয়েটিকে এক নজর দেখার জন্য ছেলেরা হুড়মুড় করে রাস্তায় দাঁড়াত, সে ছেলেরা নাসরিনের এক চোখ বিহীন চেহারা দেখে দূরে চলে যায়। ইতিপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, গায়ে পড়ে যে সমস্ত ছাত্ররা হাই-হ্যালো বলত, এখন তারাও একবার অনুশোচনা করে কেটে পড়ে!
নাসরিন ভাবে, পৃথিবীতে রূপের মোহেই কি সবাই কাছে আসতে চায়! একজন মানুষের কাছে গুন, ব্যক্তিত্ব, যোগ্যতার কি কোনই আবেদন নাই। একদা রূপসী-তরুণী নাসরিন তখনকার মানুষের চাওয়াগুলো কাছে থেকে দেখেছে। আজ একই মানুষের অবজ্ঞাগুলো এক চোখ বিহীন নাসরিন তিক্ততার সহিত অবলোকন করছে। সে হিসেব মিলাতে পারেনা, এটি ভাগ্যের পরিহাস, নাকি কর্মের দোষ! মানসিক চাপগ্রস্থ নাসরিন অবশেষে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় কোনমতে প্রথম শ্রেণী অধিকার করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেন।
শেষ ভাল যার, সব ভাল তার; এই হিসেবে নিকেশে নাসরিন পরাজিত হল। পুরো শিক্ষা জীবনেই সে ভাল করছিল, শেষ পর্যন্ত আরো ভাল করার প্রত্যয় ছিল। কিন্তু একটি চোখ এবং সম্ভাবনাময় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশাটুকু হারিয়ে, ভানিটি ব্যাগ কাঁধে চড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ত্যাগ করে।
গ্রামের বাড়ীতে গেলে পর নাসরিনের মানসিক যন্ত্রণা বেড়ে গেল, সবাই তাকে দেখতে আসে। কেউ করুণা, কেউ বেদনা, কেউ সান্ত্বনার হাত বাড়িয়ে দেয়। কৌতূহলী মানুষের ভিড় বাড়ে। নাসরিন কুমিল্লার সেই অতীত জীবনের মিল খুঁজে পায়না, সর্বত্রই ছন্দ হারিয়ে ফেলে। পদে পদে দুঃখ আর হতাশা যোগ হয়। অতীত দিনগুলোর স্মৃতি তাকে ঘন ঘন কাঁদায়, ব্যথাতুর করে তুলে। উপায়হীন বাবা মেয়েকে সান্ত্বনা দেবার হাজারো চেষ্টা করে, তবুও এক চোখ হারা, এলাকার সেরা সুন্দরী তরুণী, পিতার কাঁধে মুখ লুকিয়ে কাঁদে। পরিবারে অর্থ-বিত্তের অভাব-হীন নাসরিন অবশেষে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। চাকুরী করবে, ব্যস্ত থাকবে, নিজের মত করে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাবে।
বহু স্থানে চাকুরীর জন্য দরখাস্ত করেছে, কোন ফিরতি উত্তর পায়না। তার বান্ধবীরা একে একে সবাই ব্যস্ত হয়ে গেছে। কেউ চাকুরী, কেউ বিয়ে, কেউ স্বামীর সাথে প্রবাসে চলে গেছে; শুধু নাসরিন একা পড়ে আছে। নাসরিন সবাইকে একটি চাকুরীর জন্য ধরে, তবে কোথাও তার জন্য চাকুরীর ঠাঁয় হয়না। সকল প্রকার যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও নাসরিন প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হচ্ছেন অন্তত একটি ইন্টারভিয়্যূ দেবার সুযোগ থেকেও।
একদিন ক্লাসের বান্ধবী রীণাকে ধরে বসে; বল আমার কোন জিনিষটির অভাবে, আমাকে চাকুরীর ইন্টারভিয়্যুর জন্য কেউ ডাকছেনা?
রীনা আমতা আমতা করে। অনেক চাপাচাপির পরে সে যে কথাটি বলল, সেটা শোনার জন্য নাসরিন প্রস্তুত ছিলনা। রীনা জানায়, বর্তমানে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি, যদি আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারিণী হয়, তাহলে চাকুরীতে অগ্রাধিকার থাকে। এখন তোমার অনেক যোগ্যতা থাকলেও তোমার একটি চোখ নাই, হয়ত সেজন্যই তোমাকে কেউ পরীক্ষার জন্য ডাকেনা।
তুমিই দেখ তোমার সবগুলো প্রথম শ্রেণী, আমাদের অনেকেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ পাওয়ার পরও চাকুরী পেতে সমস্যা হয়নি। রীনার এই অপ্রিয় সত্য ভাষণ, নাসরিন সঠিক বলে মেনে নিলেন এবং অঝোর কান্নায় বালিশ ভিজায়।
উপায়হীন নাসরিন কাউকে মনের কথা বুঝাতে পারে না। এই পৃথিবীকে এমন কাউকে খুঁজে পায়না, যার সাথে তার দুঃখগুলো ভাগাভাগি করবেন।
মা-বাবা তাকে সাহস দেয়, পরামর্শ দেয়, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখে। তার পরও এমন কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো তাদের সাথেও শেয়ার করা যায়না। তাই নিজ সিদ্ধান্তে, একদিন সে মগবাজারের কম্পিউটার গ্রাফিক্সের দোকানে হাজির হয়।
তার সদ্য তোলা একটি ফটো তাদের দেখিয়ে বলে; ফটোটি স্ক্যান করে, আমার বাম চোখের মত অবিকল একটি ডিজিটাল চোখ ডানদিকে লাগানো যাবে কিনা?
যুবক লাফ দিয়ে উঠে বললেন, এটা কোন ব্যাপার নয়, মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে আপনাকে একটি ডিজিটাল চোখ লাগিয়ে দিতে পারি। গ্রাফিক্স ডিজাইনার যুবক আধা ঘণ্টার প্রচেষ্টায় বাম চোখের মত অবিকল আরেকটি ডিজিটাল চোখ, চেহারার ডান পাশে বসিয়ে দিলেন!
নাসরিন চিন্তা করেই কুল পাচ্ছিল না যে, কিভাবে একটি নষ্ট চোখের গর্তে আরেকটি ডিজিটাল চোখ নিখুঁতভাবে বসিয়ে দেওয়া হল! কৃত্রিম চোখ সমেত, দুই চোখের নিজের এত সুন্দর লাস্যময়ী ছবি দেখে বাঁধ ভাঙ্গা কান্না পেল। কালো চশমার আড়ালে নদীর মত প্রবাহিত অশ্রু দোকানদারের চোখ এড়িয়ে গেল। এই নিবর চোখের পানি ও অব্যক্ত দুঃখ নাসরিন শুধু একা এবং তার স্রষ্টা আল্লাহ ব্যতীত পৃথিবীর কেউ দেখেনি।
ডিজিটাল চোখযুক্ত পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিয়ে নাসরিন বিভিন্ন জায়গায় চাকুরীর দরখাস্ত পাঠায়। গড়ে প্রতি তিনটি দরখাস্তের বিপরীতে একটি করে উত্তর পেতে শুরু করল। সে সুযোগে নাসরিন বি, সি, এস পরীক্ষার লিখিত পরীক্ষাটি সেরে ফেলেছিল এখন মৌখিক পরীক্ষার ডাক পেয়েছে! মানসিক ভাবে নাসরিন, ভেবে রেখেছিল, যতটুকু পারা যায় সামনে যাবে, চোখের ব্যাপারখানা যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখবে। ভাইবা বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত এক শিক্ষককে দেখতে পায়, এতে তার মনে সাহস আসে। দুটি কথা বলার পরই, নাসরিনের প্রবলবেগে হ্যাঁচ্ছো আসে। অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে হ্যাঁচ্ছো আসায়, চশমার আড়ালে ডান চোখের গর্তে কৃত্রিম ভাবে সযত্নে বসানো, পাথরের চোখটি বের হয়ে, সজোরে মাটিতে আছড়ে পড়ে!
ভাইবা কমিটি, অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেবার অপরাধে তাকে যথেষ্ট ভৎসনা করেন এবং প্রক্সি পরীক্ষা দেবার অজুহাত তুলে গ্রেফতার করতে চাইলেন। কেননা সংযুক্ত ছবিটি দুই চোখের এক সুন্দরী নারীর, আর যিনি ভাইবা দিচ্ছেন তার একটি চোখই নাই। উপায় না দেখে নাসরিন তার সত্য ঘটনা খুলে বলে এবং সাক্ষী হিসেবে তার পরিচিত স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
স্যার নাসরিনের ঘটনা জানত, তাই তিনি ঘটনাটি স্বীকার করেন এবং তথ্য লুকাবার জন্য তাকে নতুনভাবে আবারো তিরস্কার করেন। পাথরের নির্মিত নকল ডামি চোখটি হাতে নিয়ে, নাসরিন মৌখিক পরীক্ষা কমিটির বিশাল রুম থেকে বের হয়ে আসেন। পেছনে পড়ে রইল একরাশ জিজ্ঞাসা ও হতাশা।
কলেজের প্রভাষক হিসেবে যে দরখাস্ত করা হয়েছিল; সেখান থেকে পত্র আসে, সরাসরি দেখা করার জন্য। নাসরিনের মনে দ্বিতীয় বারের মত ক্ষীণ আশা তৈরি হল। কেননা এটা সেই কলেজ, যে কলেজ থেকে সে কৃতিত্বের সাথে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছিল। ইংরেজির সেই প্রভাষক রায়হান স্যার এখন কলেজের ভাইস প্রেন্সীপ্যাল।
নাসরিন জানতে পেরেছে, রায়হান স্যারও নির্বাচক বোর্ডে থাকবেন। বাসায় ফিরে, কলেজের পুরানো ডকুমেন্ট খোঁজ করতে গিয়ে; রোকেয়ার মাধ্যমে পাঠানো রায়হান স্যারের দেওয়া সেই পত্রটি, অবিশ্বাস্য ভাবে উদ্ধার হয়! যেভাবে পেয়েছিল এখনও সেভাবে আছে। হঠাৎ সেই পুরানো চিঠি নিয়ে আজকে তার অসম্ভব কৌতূহল তৈরি হল এবং সাথে সাথেই চিঠি খুলে পড়া শুরু করল।
নাসরিন চিঠির প্রতিটি লাইন বিনা নিঃশ্বাসে পড়ছিল এবং অতীত দিনের স্মৃতির মাঝে ঢুবে গেল। রায়হান স্যার পত্রের একেবারে শেষ পর্যায়ে লিখেন, নাসরিন পারস্য কবি ওমর খৈয়াম লিখেছিলেন,-
‘গালে কালো তিল, সেই সুন্দরী, স্বহস্তে ছুঁলে হৃদয় আমার;
বোখারা তো ছাড়, সমরখন্দও, তাকে দিতে, পারি উপহার’
‘যদি আমার আহবানে রাজি থাক, ওমর খৈয়ামের বোখারা-সমরখন্দের কথা বাদ; তোমার জন্য পুরো মধ্য এশিয়া উজাড় করে দিতে রাজি আছি’।
নাসরিন গভীর উল্লাসে, মনের অজান্তে লাফ দিয়ে চিঠিটি শূন্যের মাঝে ছুঁড়ে দিল। ফ্যানের বাতাসের ধাক্কায় নাসরিনের পত্র মাটিতে পড়ার আগেই, চোখের নকল পাথর টপাস করে ফ্লোরে ঝড়ে পড়ল। মন ভারী হয়ে গেল। স্বগতোক্তি করল, হায়! আমি তো আর সে আগের নাসরিন নই। আমি এখন এক চোখ অন্ধ সেই অনাথ মেয়ে! পৃথিবীতে যার অর্জনের নূন্যতম কোন মূল্য নাই!
নাসরিনের বাকী স্বপ্নটুকু সেদিনই ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল, মৌখিক পরীক্ষায় যখন রায়হান স্যার বলল: নাসরিন তোমার মত ব্রিলিয়ান্টকে চাকুরী দিতে পারলে আমরা লাভবান হতাম, উপকৃত হতাম। তবে তোমাকে দেখলে পর ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটবে। তোমার পাঠানো ডিজিটাল চোখযুক্ত ছবি ও তোমার বর্তমান চেহারার মাঝে বিরাট তফাৎ বিদ্যমান। তুমি যদি ডিজিটাল চোখযুক্ত ছবিখানা না পাঠাতে আজকে তোমাকে কষ্ট পেতে হতনা। আমরা তোমার দুঃখময় পরিণতির জন্য দুঃখিত ও অনুতপ্ত। নাসরিনের চোখের পানি অনেক আগেই শুকিয়েছিল। সে এক চোখের আলো দিয়ে দিগন্তের প্রান্তে ভেসে বেড়ানো মেঘের প্রতিটি রং বুঝতে পারে; তবে দুই চোখের অধিকারীরা, অতি নিকটে বসেও তার মনের রং বুঝেতে পারেনা!
অমাবস্যার আঁধারে তক্তায় ভর করে ভেসে বেড়ানো হতভাগার জন্যও দিন ফিরে আসে; নাসরিনের জন্যও একদা সুদিন আসে। সে এখন একটি বেসরকারি বিদেশী সাহায্য সংস্থার বড় কর্মকর্তা। অনেক বেতন, কোম্পানি গাড়ী-বাড়ীর ব্যবস্থা করেছেন। বাবা-মা দুজনই মারা গিয়েছে, ভাইয়েরা নিজেদের মত থাকে। নাসরিন বাসায় একাই থাকে; নিজ চেষ্টায় দুটি অন্ধ কল্যাণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে, অবসরে তিনি এগুলো পরিচালনা করেন। অন্ধদের খোঁজ করে, তাদের সহযোগিতা দেয, যারা লেখাপড়ায় আগ্রহী তাদের পিছনে সময় ব্যয় করে।
নাসরিনের অর্থ সম্পদের অভাব না হলেও, এখনও তার বিয়ে হয়নি। কলেজ জীবনে শুধু রূপ দেখেই বিয়ের পয়গাম পাঠানোর জন্য ছেলেরা লাইন ধরত। এখন অনেক প্রতিভা, গুন, অর্থ, বিত্ত, সম্মান, সুখ্যাতি থাকার পরও কেউ কোনদিন বিয়ের পয়গাম পাঠায়নি! খোদার দেওয়া একটি চোখের অভাবে, একজন মানুষের এতগুলো গুনরাজি পিছনে পড়ে গেল! সব অবমূল্যায়িত হল। এটা কেউ না বুঝলেও নাসরিন তিলে তিলে, ক্ষণে ক্ষণে তা অনুধাবন করে।
নাসরিনের অফিস সহকর্মী শিরিন রোজকারের মত আজো দেরী করে অফিসে এসেছে। দেরী করে আসার অনেক কারণ তার ব্যাগে জমা থাকে। নিত্যদিন নতুন নতুন কারণ উপস্থাপন করা তার স্বভাব। লেখাপড়ায় মাঝারী গোছের, প্রশাসনিক দক্ষতা নাই বললেই চলে। তবে খুবই আধুনিক ভাবে চলাফেরা করে, বসদের ম্যানেজ করার দক্ষতা তার অনেক বেশী। অফিসে আসার জন্য সাজগোছের পিছনেই তার বেশী সময় চলে যায়। আজ সে নতুন সাজে অফিসে এসেছে, নতুন ম্যাকআপে তাকে অন্যরকম লাগছে! চোখ দুটো রং বদলিয়েয়ে, দেখতে ঠিক বিড়ালের চোখের মত!
কিরে শিরিন! তোমার চোখ দুটো রিড়ালের মত লাগছে কেন? শিরিন বলল, গত কাল তার স্বামীর বন্ধু তার জন্য ছয় জোড়া রঙ্গিন লেন্স উপহার দিয়েছে। বিড়ালের চোখ থেকে শুরু করে কোকিলের চোখের মত লেন্স সেই উপহারে আছে। এক দিন এক জোড়া ল্যান্স ব্যবহার করব, পৃথিবীকে ভিন্ন চোখে, ভিন্নভাবে উপভোগ করব।
স্বামীর বন্ধুরা তো বটেই অফিসের সব স্টাফেরাও এই রঙ্গিন চোখ খুব পছন্দ করেছে। রাস্তার মানুষ আমার এই ধরনের চোখ দেখে হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকে! কিন্তু একজন মানুষের এগুলোর কোনটাই পছন্দ নয়, সে হল আমার স্বামী। এটা নিয়ে সর্বদা ঝগড়া লেগে থাকে। আমি নাকি এগুলোর পিছনে বেশী সময় দেই। বাচ্চাদের দেখা-শোনার ক্ষেত্রে সময় দেইনা। সংসারের প্রতি নাকি আমার অনীহা দিন দিন বাড়ছে। আমার স্বামীর এই অহেতুক বাড়াবাড়ি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় আত্মহত্যা করে মরে যাই। মজা ভরে দেখতাম স্বামী তার পুত্রদের নিয়ে কি করে!
নাসরিন বলে, শিরিন আল্লাহ তোমাকে দুটি চোখ দিয়েছেন। তুমি এগুলোর যথাযথ ব্যবহার কর। তোমার কাছে বিনা কষ্টে, চোখগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় আছে বলে, এগুলো মূল্যহীন বস্তুতে পরিণত হয়েছে। যার কারণে আরো কৃত্রিম নতুন চোখ কিনে, পৃথিবীকে রঙ্গিন ভাবে দেখতে প্রলুব্ধ হয়েছ। আল্লাহর দেওয়া চোখ গুলোকে তুমি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে অবমাননা করছ।
তোমার স্বামী তোমার রঙ্গিন চোখ দুটো না দেখেই কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তুমিই তোমার দাম্পত্য জীবনকে যন্ত্রণাময় করেছ। অফিসের কলিগ ও স্বামীর বন্ধুরা তোমার সৌন্দর্য দেখে বাহবা দিবে বলে, দীর্ঘক্ষণ রূপ চর্যা করে অফিসে আসতে দেরী কর। মানুষের মুখে রূপের সুনাম শুনার জন্য তোমার আদরের বাচ্চাদের অবহেলা কর।
আমিও তোমার মত নারী। তোমার যত যোগ্যতা, রূপ ও লাবণ্য আছে; তার চেয়ে আমার কোন অংশে কম নয়। আমার অযোগ্যতা বলতে, আমি একটি চোখ হারিয়েছি। তাই আমি আজ সবার কাছে অবহেলার পাত্রী হয়েছি! তুমি এসব পেয়েও, সবকিছুকে অবজ্ঞা করে, অকৃতজ্ঞতার পৃষ্টকে আঁকড়ে ধরেছ। তুমি ভাল স্বামী, সন্তান ও সংসার পেয়েও অবহেলায় হাতছাড়া করছ। অথচ আমার জীবনে স্বামী, সন্তান, সংসার কিছুই আসেনি। যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও কেউ আমাকে বিয়ে করতে চায়না।
তুমি নারী হয়েও নারীত্বকে তাচ্ছিল্য করেছ, আমি নারী হয়েও নারীত্বের সুখ ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। নারী যতদিন গৃহিনী না হবে, মা না হবে, ততদিন তার জীবন অপূর্ণাঙ্গ থাকে। আমিও সে ধরনের প্রত্যাশা হৃদয়ে পোষণ করি। আমার জীবনে একটি চোখের অভাবে, সমূদয় স্বাদ আহ্লাদ অপূর্ণই থেকে গেল! ইস্ আমার আফসোস! এ জীবনে কোন পুরুষ যদি অন্তত তামাশা করে হলেও, একবার বিয়ের পস্তাব পাঠাত! তাহলে আমার জীবনটা ধন্য হয়ে উঠত এবং নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করতাম....।
বিষয়: বিবিধ
২৫৭৩ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জীবনের একটা পর্যায় না আসা পর্যন্ত এই বিষয়ে লিখা একটু কঠিন। শরৎচন্ত্র শ্রীকান্ত লিখতে গিয়ে শুরুতেই সেই কথা গুলো উল্লেখ করেছেন। আমিও ভাবতাম তিনি অপ্রয়োজনে কেন প্রথম প্যারাটি লিখেছেন। আমি যখন লিখতে যাই, তখন শরৎচন্দ্রের প্রকৃত সমস্যা আমার কাছেই পরিষ্কার হয়। কেননা লিখতে গেলে আমিও সেই কথার যাঁতাকলে পড়তে পারি। তবে এখনও পড়িনাআই কেননা আমি শরৎচন্ত্রের মত খ্যাতিমান কেউ নই, আর হবারও সম্ভাবনা নাই।
তাই সিদ্ধান্ত একটা নিয়ে ফেলুন কে পড়ল কে পড়ল না, লেখকেরা সেটা চিন্তা করতে গেলে তো লেখাই হবে না।
একটানেই পড়লাম!
হঠাত করেই যেন শেষ হয়ে গেল!!
**
নিজ পরিচয়ে সরাসরি প্রকাশ করে নিঃসন্দেহে দুরূহ ব্যাপার!!
সঠিক উপলব্ধি ও পর্যবেক্ষণ প্রকাশের পর বাস্তব জীবন বিড়ম্বিত হওয়া প্রায় নিশ্চিত!!
জীবনের একটা পর্যায় না আসা পর্যন্ত এই বিষয়ে লিখা একটু কঠিন।
ক'জন-ই বা সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন?
আল্লাহ তখন তাকে দেয়া আল্লাহর অগনিত নিয়ামতে মাঝ থেকে মাত্র একটা চোখের কথা বর্ণনা করবেন । তখন দেয়া যায় ঐ লোকের সারা জীবনের বিনিময় মাত্র একটা চোখ যে কত বড় নিয়ামত তার শুকরিয়ার বিনিময় ও হয় না ।
তখন ঐ লোক তার ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হবে ও বিনয়ের সাথে বলবে হে আল্লাহ তুমি অনুগ্রহ করে আমাকে বেহেস্ত দাও ।
সময় থাকতে আল্লাহর দেয়া এসব নিয়ামতের সঠিক ব্যবহার ও আল্লাহর শুকরিয়া করার তৌফিক আল্লাহ আমাদের দিন । আমীন ।
অনেক ভাল ও শিক্ষনীয় একটা গল্পের জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।
উলু বনে মুক্তো ছড়াচ্ছেন ভ্রাতা
এটাই এখন বাস্তবতা। নিজেই এই বৈষম্যের শিকার।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন