আসুন নকল প্রক্রিয়ায় ইন্তেকাল করি!
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ২৮ আগস্ট, ২০১৫, ০৭:৫৮:১৬ সন্ধ্যা
কাউকে ইন্তেকাল করার ডাক দেওয়া অন্যায়, অবৈধ! কারো আহবানে উত্তেজিত হয়ে কেউ ইন্তেকাল করলে ফৌজদারি আইনে সে অপরাধী হবে, তাকে গ্রেফতার করা হবে! তারপরও আমি ইন্তেকালের আহবান করেছি অন্য কারণে। কেননা ইন্তেকাল শব্দটির সাথে বাংলাদেশের ছেলে-বুড়ো সবাই একযোগে পরিচিত। প্রতিদিন পত্রিকাতে ইন্তেকালের খবর পাওয়া যায়। মুসলমান মারা গেলে ঐ ব্যক্তি ইন্তেকাল করেছেন বলে ঘোষণা করা হয়। সেভাবে ইন্তেকালের বিপরীতে মৃত্যু বরণ, মারা যাওয়া, দেহত্যাগ, প্রাণত্যাগ, প্রাণ-বায়ুত্যাগ, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ, ইহলোক ত্যাগ, পরলোকগত ইত্যাদি বুঝায়। হাল আমলের কিছু মানুষ ইন্তেকাল শব্দটিকেও পরিহার করে চলে! কিন্তু তারা জানেন না আমাদের পুরো জাতিটাই নিজের অজান্তে রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টায় ইন্তেকাল নিয়ে ব্যস্ত। বাংলাদেশের সর্বত্র এখন ইন্তেকালের জয় জয়কার।
ইন্তেকাল শব্দটি মূলত আরবি। এই শব্দের প্রকৃত অর্থ হল, অর্থকড়ি স্থানান্তর, পরিবহন। মোগল শাসনামলে এই শব্দটি দেওয়ানী আদালত ও রাজস্ব বিভাগের অন্যতম পরিচিত শব্দ হয়ে উঠে। ব্রিটিশ আমলেও সরকার সেই পরিভাষা পরিবর্তন করেনি। মানুষ সাব রেজিস্ট্রি অফিসে গেলে ভূমির মালিকানা পরিবর্তন, সম্পত্তির হাত বদল, রাজস্ব খাতের এক অর্থকে অন্যত্র স্থানান্তর করার পদ্ধতিকে ইন্তেকালি বলে। আজকের দিনে জমির নাম জারি করা হয়, সে নাম জারির পদ্ধতিকে দেওয়ানি আদালতের ভাষায় ইন্তেকালি করানো বলা হয়। যাদের কাছে এখনও পুরানা দিনের দলিল-দস্তাবেজ আছে সেখানে ইন্তেকাল শব্দের বহু ব্যবহার দেখে থাকবেন।
আবার বাংলা ভাষায় যে নকল শব্দটি ব্যবহার হয়, সেটিও ইন্তেকালের প্রতিশব্দ অর্থাৎ ইন্তেকাল শব্দটি তৈরি হয়েছে আরবি ‘নকল’ শব্দ থেকেই। বর্তমান বাংলাদেশে নকল ছাড়া তো ও শিক্ষা ব্যবস্থাই অচল। পণ্যে নকল, শিক্ষায় নকল, উৎপাদনে নকল, মানুষে নকল, ব্যবসায় নকল, উন্নয়নে নকল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের কোন জিনিষটাতে নকলের ব্যবহার নাই?
মূলত নকল শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছিল রাজস্ব বিভাগ থেকে। কারো মূল দলীল হারিয়ে গেলে কিংবা পুড়ে গেলে মহা সমস্যায় পড়তে হত। তখন তো আর ফটোকপি মেশিন ছিলনা। তাই রাজস্ব বিভাগে দরখাস্ত করলে, সরকারী হেফাজত খানায় রক্ষিত অন্য মূল দলীল দেখে, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আসল জিনিষটির বর্ণনা ও তথ্য হুবহু আরকে টি দস্তখত ও সিলের মাধ্যমে কাগজে লিখে দিতেন। দস্তখত ও সিল করা সেই দলীল কেই বলত ‘নকল’ কপি। সেখান থেকে আসল আর নকলের ব্যবহার শুরু হয়। শুধু তাই না, সরকারের রাজস্ব খাতে সরকারি বেতন ভুক্ত যে ব্যক্তিরা এই কাজ করত তাদের পেশার নামই ছিল ‘নকল’ পেশা। এসব কর্মকর্তারা আদালতে বসে ‘নকল’ করেন বলে অহংকারের সাথে বলে বেড়াত। সুতরাং বুঝা গেল, নকল হল সেই দলিল, যার মাধ্যমে আসল জিনিষের রূপ, পরিমাণ, গুন, স্থান ইত্যাদি প্রকাশ পায়। কিন্তু বর্তমানে নকলের সই সম্মান নাই। বরং নকলে নকলে পুরো জাতি আজ বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত।
বলছিলাম ইন্তেকালের কথা। যে অর্থে রাজস্ব মন্ত্রণালয়ে ইন্তেকাল শব্দের ব্যবহার, সে অর্থেই মানুষ মারা গেলে যে ইন্তেকাল বলে থাকে তা যথার্থ। কেননা মানুষ প্রকৃতই মরে না। সে জীবিত থাকে কিন্তু তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
মানুষ দুনিয়াতে আসার আগেও জীবিত ছিল,
আসার পরেও জীবিত থাকে
এবং মরার পরেও জীবন অব্যাহত থাকে
উপরোক্ত প্রতিটি ধাপে মানুষের একটি পর্যায়ের পরিবর্তন ঘটে, এই পরিবর্তনের নামই আরবি ভাষায় ইন্তেকাল তথা অবস্থার পরিবর্তন কিংবা স্থানান্তর।
কোন আবদুল্লাহ যখন মারা যায়, তখন ঘোষণা হয় মরহুম আবদুল্লা ইন্তেকাল করেছেন! অথচ তখনও আবদুল্লাহ মৃত দেহ সবার সামনে পড়ে আছে কিন্তু সেই দেহে আবদুল্লাহর প্রাণ নাই। সুতরাং বুঝা গেল সেই প্রাণের নামই আবদুল্লাহ, দেহের নাম আবদুল্লাহ নয়।
প্রাণ বাহন ছাড়া চলতে পারেনা, সেজন্য দুনিয়াতে আসার সময় আবদুল্লাহর সেই প্রাণকে দেহ নামক একটি বাহন দিয়ে চলতে দেওয়া হয়। আবদুল্লাহর প্রাণ বহনকারী এই বাহনের মালিক আবদুল্লাহ নয়। সেজন্য দেহ হত্যা তথা আত্মহত্যা করার অনুমতি আল্লাহ কাউকে দেন নাই। যেভাবে ভাড়া করা গাড়ি কিংবা ভাড়ার বাড়ী ভাড়াটিয়া আগুন জ্বালিয়ে পুড়াতে পারেন না। তাকে গ্রেফতার করা হয়। শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
দেহ দুনিয়ার মাটি দিয়েই তৈরি, মাটির বিভিন্ন খনিজ উপাদান দিয়েই দেহ কোষের সৃষ্টি। সে জন্য দেহকে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষকে মাটির উপর নির্ভরশীল হতে হয়। মানুষের প্রবৃত্তি ও দেহ চোখ, মুখ, জিহ্বা, নাক, কান মাটি থেকে সৃষ্ট জিনিষের প্রতি সর্বদা আকৃষ্ট থাকে। অবশেষে মানুষের ইন্তেকালের পরে সেই দেহটাকে মাটির কাছে সোপর্দ করে যেতে হয়। প্রাণটা প্রাণের জায়গায় জীবন্ত অবস্থায় ফিরে যায়, যেভাবে সে জীবন্ত অবস্থায় দেহে ফিরে এসেছিল।
ইসলামে রুহ তথা প্রাণের এই আসা যাওয়ার পর্যায়কে ইন্তেকাল বলে। মানুষ কখনও মরে না, তাকে তার হিসাবের মুখোমুখি হতেই হবে এই দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্তা আছে বলে ইসলামে মৃত্যু না বলে ইন্তেকাল শব্দের প্রয়োগ করা হয়।
বিষয়: বিবিধ
১৫১৬ বার পঠিত, ৩৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মৃত্যু জিবনের শেষ নয় বরং আরেকটি পর্যায় মাত্র।
হে আল্লাহ আপনি নজরুল ইসলাম টিপু ভাইয়াকে নেক হায়াত দান করুন আরো বেশী বেশী লিখার তৌফিক দিন ।আমীন.
স্কুলের শিক্ষকরাও হয়তো এই শব্দটির অর্থ জানেনা, আপনার লেখাটি আরো বেশি পরিসরে জানবার জন্য আমার ফেসবুকে শেয়ার করলাম।
লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
ধন্যবাদ।
প্রাণ বাহন ছাড়া চলতে পারেনা, সেজন্য দুনিয়াতে আসার সময় আবদুল্লাহর সেই প্রাণকে দেহ নামক একটি বাহন দিয়ে চলতে দেওয়া হয়। আবদুল্লাহর প্রাণ বহনকারী এই বাহনের মালিক আবদুল্লাহ নয়। সেজন্য দেহ হত্যা তথা আত্মহত্যা করার অনুমতি আল্লাহ কাউকে দেন নাই। যেভাবে ভাড়া করা গাড়ি কিংবা ভাড়ার বাড়ী ভাড়াটিয়া আগুন জ্বালিয়ে পুড়াতে পারেন না। তাকে গ্রেফতার করা হয়। শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
অসাধারণ কথাগুলো, অকাট্য যুক্তি দ্বারা উপস্থাপন করেছেন। জাযাকাল্লাহ খাইর
مَنْ مَاتَ মান মাতা (সহিহ বুখারী :: খন্ড ২ :: অধ্যায় ২৩ :: হাদিস ৩২৯)
مَنْ مَاتَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সঙ্গে শির্ক করা অবস্থায় মারা যায়, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (সহিহ বুখারী :: খন্ড ২ :: অধ্যায় ২৩ :: হাদিস ৩৩০)
فَقَالَ بِأَبِي أَنْتَ يَا نَبِيَّ اللَّهِ، لاَ يَجْمَعُ اللَّهُ عَلَيْكَ مَوْتَتَيْنِ، أَمَّا الْمَوْتَةُ الَّتِي كُتِبَتْ عَلَيْكَ فَقَدْ مُتَّهَا ইয়া নবী আল্লাহ্! আমার পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক । আল্লাহ্ আপনার জন্য দুই মৃত্যু একত্রিত করবেন না । তবে যে মৃত্যু আপনার জন্য নির্ধারিত ছিল তা তো আপনি কবুল করেছেন । (বুখারী হাদিস ৩৩৩)
زَوْجَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم নবী (সাঃ)-এর সহধর্মিণী আয়িশা (রা.) আমাকে বলেছেন, [রাসূলুল্লাহ্(সাঃ)-এর ওফাতের খবর পেয়ে] (বুখারী-ঐ)
نَعَى النَّجَاشِيَّ فِي الْيَوْمِ الَّذِي مَاتَ فِيهِ، خَرَجَ إِلَى الْمُصَلَّى، فَصَفَّ بِهِمْ وَكَبَّرَ أَرْبَعًاনাজাশী যে দিন মারা যান সেদিন-ই রাসূলুল্লাহ্(সাঃ) তাঁর মৃত্যু সংবাদ দেন এবং জানাযার স্থানে গিয়ে লোকদের কাতারবদ্ধ করে চার তাক্বির আদায় করলেন । (বুখারী হাদিস ৩৩৭)
قَالَ فِي مَرَضِهِ الَّذِي مَاتَ فِيهِ রাসূলুল্লাহ্ (সা) যে রোগে মারা গিয়েছিলেন। (বুখারী-হাদিস ৪১৪)
@@@@@@@@@
রসুল (সা) এর বানী ও সাহাবী (রা) দের বাণী থেকে মাতা বা মৃত্যু পাওয়া যায়। তাই এটা বলাই শ্রেয়। বলছিনা ইনতেকাল বলা যাবে না। তবে অর্থের কারনে অনেকে বিদআতে পতিত হতে পারে। যেমন কেউ বললো ও ইন্তেকাল! তার মানে কবরে জীবিত! তাহলে তো জীবিতর কাছে চাওয়া যাবে?
আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে, মিনিং নিতে গিয়ে গোমড়াহী ডেকে আনবে।
আপনার বিশ্লেষন অনেক সুন্দর ভাই। আমি আপনার মুরিদ হতে চাই। গ্রহণীয়? নাকি বর্জনীয়?
মানুষের দেহকাটামো টাই মানুষ হিসেবে পরিচিত। দেহ কাঠামো ভিন্ন প্রকৃতির কিন্তু চরিত্রে আমাদের কাছাকাছি হওয়া স্বত্তেও আরেকটি সৃষ্টিকে আমরা জ্বীন বলি। এই দেহের দুটি বিন্যাস একটি শরীর ও অন্যটি রূহ তথা প্রাণ। দেহ থেকে যখন প্রাণ চলে যায়, তাকে মৃত্যু বলে। অর্থাৎ দেহে প্রাণ নাই। আমরা দেখি দেহ একদা মাটির সাথে মিশে যায়, এখানেই তার ইতিহাস শেষ।
প্রাণ কিন্তু মরেনা। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মাত্রই তার আরেকটি জগতের পদচারণা ও হিসেব নিকেষ শুরু হয়। এই ক্ষেত্রে ইন্তেকাল শব্দ ব্যবহার হয়।
বাংলাদেশে কিছু বিদয়াত পন্থীরা, মৃত পীর জিবীত আছে মনে করে, তাদের কাছে সাহায্য চায়। আসলেই এরা সকলেই মৃত এমনকি প্রিয় নবী (সাঃ) ও মৃত্যুবরণ করেছেন, কেননা তাঁকে কবর দেবার সময় তাঁর শরীরে প্রাণ ছিল এমন কেউ দাবী করেনি।
আপনাকে আবাও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন