যেভাবে পশু ডাক্তার হয়ে গেলাম! এক পিকুলিয়ার মানুষ-৩৩ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ২৬ জুলাই, ২০১৫, ১২:৪১:৫৮ দুপুর
জীবন যুদ্ধে চলার হাজারো পাঁকে-বাঁকে মানুষকে সহযোগিতা করতে গিয়ে আমি একদা খ্যাতনামা পশু ডাক্তার হিসেবে চিত্রিত হয়ে যাই। বাবা বললেন জনসেবা করতে গিয়ে এই পর্যন্ত যতগুলো খেতাব কপালে জুটেছে, সবগুলোই হল ভাল পাত্রী পাবার অন্তরায়, তথা আমার বাবার পছন্দনীয় কাউকে বেয়াই না হওয়ার জন্য অনুঘটক। অথচ এসব কাজে আমার কোন অতি আগ্রহ ছিলনা কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাটাই এমন যে, কারো অনিচ্ছা স্বত্বেও নামের নতুন শিরোনাম জুটে যাবেই।
আগেই বলেছিলাম ভয়ানক টাইফয়েডের কারণে, দুই বছরের স্টাডি ব্রেক হয়েছিল। এই ফাঁকে মধু চাষ ও পশুর খামার করতে গিয়ে কি সামাজিক সমস্যায় পড়েছিলাম তা আগেই উল্লেখ করেছি। আমার পিতা চাইতেন, বাড়ীতে বসে থাকলেও ছোটকালে কোনভাবেই যেন অর্থ উপার্জনের রাস্তা না দেখি; তাহলে লেখাপড়ায় গতি আনা যাবেনা। গরুর খামারের জিল্লতি বাদ দিয়ে এবার কলেজে ভর্তি হবার পালা শুরু হল।
দুই বছরের স্টাডি ব্রেক হবার কারণে, প্রয়োজনীয় নম্বর থাকা সত্ত্বেও সরকারী কলেজে ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকলাম, মেনে নিলাম এটা আমার তকদিরে ফায়সালা। চট্টগ্রাম শহরে যে কয়টি বেসরকারি কলেজ ছিল যেমন, এম,ই,এস কলেজ, সুলতান আহমেদ চৌধুরী কলেজ, এগুলোর চাইতে মফস্বলের বেসরকারি নাজির হাট কলেজ তখনকার দিনে খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। সাইন্সে ডিগ্রী পড়ার জন্য এই কলেজের খ্যাতি ছিল ব্যাপক। তখনকার দিনে বায়োলজিতে পড়ুয়া ৪৫ জন ছাত্রকে আলাদা করে মাইক্রোস্কোপ দিতে পারত একমাত্র এই কলেজ। যন্ত্রপাতিতে চট্টগ্রাম কলেজের পরেই ছিল এই কলেজের অবস্থান। ফলে আমি এই কলেজে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাছাড়া কলেজ প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে এই কলেজের প্রিন্সিপ্যাল থাকত ব্রিটিশ নাগরিকেরা। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে গোল্ড মেডালিষ্ট টি আহমেদ ১৯৪৯ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হয়ে আসেন। তিনি আমার গ্রামেরই মানুষ ছিলেন, এটা নিয়ে আমার অতিরিক্ত গর্ববোধ কাজ করত।
এখন তো সবাই শহর মুখী শিক্ষায় আগ্রহী কিন্তু আমাদের সময় এই ইকুয়েশন কাজ করত না। দেশের বেশীর ভাগ মেধাবী ছাত্র মফস্বল থেকেই সৃষ্টি হত। তাই নাজির হাট কলেজে পড়ার জন্য উল্টো শহর থেকেই শত শত ছাত্র বাস ও ট্রেন যোগে এই কলেজে পড়তে আসত। সন্দীপ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজারের ছাত্রদের রীতিমত রাজত্ব ছিল। এখানে দ্বীপাঞ্চলের ছাত্রদেরকে প্রকৃত ভাবে স্থলভাগের ছাত্রদের তুলনায় অধিক মেধাবী দেখেছি। বিরাট এলাকা জুড়ে বাগান ঘেরা, বিশাল দিঘীর পারে নান্দনিক ও নিরাপদ ছাত্রাবাস, সকল শিক্ষক পরিবারের জন্য বিস্তৃত আবাসিক সুবিধা এই কলেজের গ্রহণযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল।
এরশাদ সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিরোধী দলের সকল ছাত্র সংগঠন গুলোর মাঝে গোপনে অস্ত্র ঢুকিয়ে দিয়ে লড়াই জিইয়ে রাখত। এতে তারা নিজেরা মারামারি করত এবং এরশাদের বিরোধিতা করার সময় সুযোগ পেত না। এটা ছিল এরশাদীয় রাজনীতির মূলমন্ত্র। ৮০-৯০ দশক থেকে ছাত্র অঙ্গনে স্বার্থ নিয়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি সৃষ্টির মুল গুরু হল ‘কবি এরশাদ’! বাংলাদেশের কিছু এলাকা ছাত্র সন্ত্রাসের ভয়ানক জনপদ হয়ে উঠেছিল কিছু এলাকা। তার মধ্যে নাজির হাট কলেজ ছিল অন্যতম! কত নিরীহ ছাত্র মরেছে কত শত আহত হয়েছে তার হিসেব নাই, পরিণতিতে এই কলেজের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যায় এবং আশে পাশের অনেক গুলো নতুন কলেজের আবির্ভাব ঘটে এবং পরবর্তীতে কলেজটি ছাত্র সংকটে পড়ে যায়। একদা দেশ ব্যাপী আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড তথা সন্ত্রাসীদের গুলিতে নির্মম ভাবে নিহত ‘গোপাল কৃষ্ণ মুহুরি’ এই কলেজেরই প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন এবং হত্যাকারীরাও তাঁর ছাত্র ছিল!
নাজির হাট কলেজ থেকে পাশ করা, অনেক ছাত্র পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে, ভিসি হয়েছে। চট্টগ্রামের সরকারী-বেসরকারি স্কুল-কলেজের বহু শিক্ষক এই কলেজ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। তৈরি হয়েছে অগণিত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-প্রফেসর! ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত হবার কারণে পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই কলেজের বিশাল অবদান। কলেজের বদান্যতায় নাজির হাটের আশের পাশের ত্রিশ বর্গমাইল এলাকায় প্রতি ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। গড়ে প্রতি চার গৃহস্থের মাঝে একজনের ঘরে গৃহ শিক্ষকের দরকার পড়ত। তাছাড়া নাজির হাট অঞ্চলটি ঐতিহ্যগত কারণে আগে থেকেও খ্যাতিমান ছিল।
মাইজ ভাণ্ডার দরবার শরীফ এই এলাকায় অবস্থিত। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের প্রধান শিল্পপতি একে খানের শ্বশুর বাড়ী এখানে, তৃতীয় প্রধান শিল্পপতি মির্জা মোহসিনের বাড়ীও এখানে। নৌ যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম, হালদা নদীর তীরে নাজির হাটের অবস্থান। বার ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈসা খাঁ মোগলদের আক্রমণ থেকে কৌশলে রক্ষা পেতে এই এলাকায় আত্মগোপন করেছিলেন। ঈসা খাঁর সেনাদের নামানুসারে এই এলাকার নাম গুলো সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ঈসা পুর, মুসা পুর, ইব্রাহীম পুর, নানু পুর ইত্যাদি। ঈসা খাঁর কিছু অনুসারীর নামে নগর দিয়েও সৃষ্টি হয়েছে বহু জনপদ; বাবু নগর, শাহ নগর, আজিম নগর, আজিজ নগর, মহা নগর ইত্যাদি। প্রাচীন কাল থেকে মাইজভান্ডারের পাশে অবস্থিত পাঠান বসতি এখন পাঠান পাড়া, ভারতের মালদহ থেকে আগত অধিবাসীদের গ্রাম মালদহ পাড়া আজো বিদ্যমান।
কিছুদিন হোস্টেলে থেকে ভাল লাগছিল না। বাজার করা, নিজের রান্না নিজে করা, রাত্রে রান্না করলে বিকালে গরম করতে দেরী হলে পুরো তরকারী নষ্ট হবার জ্বালা লেগেই থাকত। এক পোয়া গোশত, একটি তেলাপিয়া মাছ বিক্রির সিল সিলা তখনও বাজারে চালু হয়নি। আধা সেরের নিচে কিনলে উল্টো বিক্রেতাকে তাচ্ছিল্য হবার ভয় ছিল। ছাত্রদের অঞ্চল ভেদে রুচিবোধের তারতম্য হেতু কয়েকজন মিলে একত্রে খাবারও জো ছিল না। তখন মফস্বলের এই উপশহরে খাবার হোটেল চালু হয়নি যে, মাস হিসেবের চুক্তিতে খাওয়া যাবে!
অগত্যা বন্ধুদের পরামর্শে সিনিয়র কয়েক ভাইয়ের আন্তরিক পরামর্শে লজিং যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কলেজের কাছাকাছি এলাকার লজিংয়ে কদর কম, অপেক্ষাকৃত দূরের এলাকার লজিংএ কদর-আপ্যায়ন একটু বেশী! সিনিয়র ভাইদের এমন পরামর্শে দেড় মাইল দূরের লজিংয়ে চলে গেলাম। তাছাড়া এমনিতেই আমাকে দূরের লজিংএ যেতে হত, কেননা লজিং ও এলাকা বাছাই করার পিছনে আমার অজান্তে অন্যরাও বিদ্যা-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে যাচ্ছিল, যেটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম। কপাল গুণে এক ভয়ানক দুষ্ট ছেলের শিক্ষক হিসেবে লজিং জীবন শুরু হল। প্রতিনিয়ত এই পাজি ছাত্রের বেতমিজির কারণে গ্রামের মুরুব্বীরা বিচার বসাত। একদা ছাত্রকে যথাযথ শিক্ষা ও দুষ্টামীনুপাত শাসন করতে না পারার অপরাধে স্থানীয় ক্ষমতাবান ‘ঢেঁড়স চৌধুরী’ খোদ গৃহ শিক্ষকের বিরুদ্ধেই বিচার অনুষ্ঠান আহবান করল! কলেজ জীবনের শুরুতেই ছাত্রের ব্যক্তিগত অপরাধের দোষে গৃহ শিক্ষককে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে কোনদিন ভাবিনি!
তবে যার বাড়ীতে লজিং সেই ভদ্রলোকও কম যান না। তিনি একাধারে আওয়ামী নেতা, আবার মাইজভান্ডার দরবারের সুন্নি নেতাও বটে। ব্যবসায়ী ভদ্রলোক দুটো দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এলাকার কারো ঘরে ছাত্র শিবির করে এমন ছেলে মাষ্টার হিসেবে গেলে তাকে এলাকা ছাড়া করার ঈমানী দায়িত্বও তিনি পালন করেন। ‘যেমনি বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল’। ছাত্র-শিক্ষকের বিচারের কথা পিছনেই আলোচনা হত, এই ব্যক্তির ভয়ে কেউ সামনে অগ্রসর হত না। ‘বাপ কা বেটা’ বাপ যেমন ছেলেও তেমন হবে। পদে পদে সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার আবর্তনে এক মহা জিল্লতীর লজিং জীবন শুরু হয়েছিল! তবে শেষের দিকে এই লজিং জীবন নিয়ে দারুণ মজাদার অনেক ঘটনার কথা মনে পড়ে কদাচিৎ আজো নিজের অজান্তে হাসি।
যাক, আমি কিন্তু পশু ডাক্তারির কথা বলতে বসেছিলাম, কিছু কথা আগে থেকেই ভেঙ্গে না রাখলে, পাঠকেরা হয়ত আমাকে গৃহ শিক্ষকের বিচারের মত করে আরেক বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাবে। ঘটনা পড়লে, প্রশ্ন জাগবে, সেই প্রশ্নের উত্তরও যাতে পাঠকেরা সাথে সাথে পেয়ে যায়, সেজন্য উপরোক্ত কথা বলাটা জরুরী ছিল। সেগুলো মোটেও অ-প্রাসঙ্গিক কথা নয়।
লজিংএ এসে সবকিছু গোছগাছ হবার পরে, থানা পশু পালন কর্মকর্তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। খামার বন্ধ করে দিলেও তিনি আমার কল্যাণকামী ছিলেন, তাই তাঁর অনুপ্রেরণার কথা ভুলতে পারিনি। আজকের মত হাতে মোবাইল থাকলে হয়ত তিনিই আমাকে ফোন করে খবর নিতেন।
আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি খুব খুশী হলেন। যারপরনাই আরো খুশী হলেন এই কথা জেনে যে, আমি নাজির কলেজে ভর্তি হয়েছি।
নড়ে চড়ে চেয়ারে মজবুত হয়ে বসলেন! বললেন, এক আজিব কথা!
কথাগুলো তাঁর মুখেই শুনুন:
বাবা, ‘তুমি ফার্মে মার খেয়েছ সেজন্য আমি খুবই অনুতপ্ত ও মর্মাহত। তবে খামার করতে গিয়ে তুমি একটি বিদ্যা আয়ত্ত করে ফেলেছ যেটা আর কেউ পারেনি। সেটা হল তুমি নিজের অজান্তে একজন পশু ডাক্তার বনে গেছ। আমি যে আজ সরকারী গেজেটেড পশু ডাক্তার হয়ে বসে আছি, বস্তুত সারা দেশের থানা পর্যায়ের কোন পশু ডাক্তারের স্বীকৃত কোন ডিগ্রী নাই। আমরাও কারো নিকট থেকে হাতে কলমে এই বিদ্যা কিছুটা শিখে সরকারী বড় কর্মকর্তা হয়ে বসে আছি। সরকার এ বিষয়ে ভাবছে, ভবিষ্যতে এই ধরনের পদে আসতে হলে ডিগ্রীর দরকার পড়বে, অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করবে। বিসিএস ক্যাডারদের মাঝে তাদেরই বেশী মূল্য দিবে, যারা কাজটি আগে থেকেই জানে। কেননা বর্তমানে পুরো দেশে হাজার হাজার পদ খালি থাকার পরও, সরকার আরো পদ সৃষ্টি করছে। তুমিও যদি বিসিএস পাশ কর তাহলে শুরুতেই সরকারী বড় কর্মকর্তা হয়ে যেতে পারবে, এটা একটা বিরাট সুযোগ’।
প্রশ্ন করলাম, তো চাচা কি করতে হবে?
বললেন, ‘নাজির হাট বাজারে আনন্দ ফার্মেসী নামে একটি বিরাট ফার্মেসী আছে (ছপ্দ নাম কেননা ফার্মেসীটি এখনও আছে)। তারা যখন ঔষধ কিনতে যায়, তখন ঔষধ কোম্পানি লাইসেন্সের বিপরীতে জোড় করে কিছু গবাদি পশুর ঔষধ ঢুকিয়ে দেয়। বাজারে কোন পশু ডাক্তার না থাকাতে তাদের ঔষধ গুলো অবিক্রীত অবস্থায় নষ্ট হয়ে যায়। এসব ঔষধ ফার্মেসী মালিক কিনতে বাধ্য হয় কিন্তু চিকিৎসকের অভাবে বিক্রি করতে পারে না। তারা আমাকে প্রতিনিয়ত অনুরোধ করে যাচ্ছে যে, সপ্তাহে যদি একটি কিংবা দুটি দিন তাদের দোকানে দুই ঘণ্টার জন্য বসি তাহলে তাদের ঔষধ গুলো বিক্রি হয়ে যাবে। তারা আমাকে আকর্ষণীয় সম্মানী দিবে বলেছে। এই বয়সে এত লম্বা পথ ভ্রমণ করা আমার জন্য কঠিন বলে, কোন কথা দিইনি। এই কাজের আমি তোমাকে বাছাই করেছি। তুমি যদি সপ্তাহের কোন একদিন দুই ঘণ্টার জন্য বস, তাহলেই তাদের হয়ে যাবে। আমি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা তাদের দিয়ে দিব, তারা তোমাকে যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদা দিবে’!
চাচা! এটা করতে গেলে তো আমার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে? আবার না জানি কোন ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হই। সময়ের অভাব হবে, যন্ত্রপাতির দরকার হবে, এগুলো তো বিরাট ঝামেলার ব্যাপার। তাছাড়া আপনি কিভাবে বুঝলেন যে, আমি এই কাজের উপযুক্ত হয়েছি?
তিনি বললেন, “দেখ লেখাপড়ার কোন সমস্যা হবে না। পাশ্চাত্যের দেশ গুলোতে ছাত্ররা পার্ট টাইম চাকুরী করে। তুমি কি সৈয়দ মুজতবা আলী কিংবা কবি জসীম উদ্দিনের বিদেশী ছাত্রদের চাকুরীর সেই কাহিনীগুলো পড়নি? এসব ঘটনা তো ছাত্রদের মোটিভেটেড করার জন্যই সিলেবাসে রাখা হয়! আর সময়ের অভাবের কথা বলেছ? তাহলে শুক্রবার বিকেলেই বস। কারো সাথে আড্ডা দেবার বিপরীতে কি এই কাজ উত্তম নয়? তুমি কি মেট্রিকের সিলেবাসে পড়নি, ‘জীবে দয়া করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর’। আরে বাবা এসব কি পরীক্ষায় পাশ করার জন্যই পড়েছ”?
চিন্তার জগতে চলে গেলাম আর ভাবলাম, ঠিকই তো, আমার মেট্রিক পরীক্ষার প্রশ্নে তো এই ভাব সম্প্রসারণটিই এসেছিল! তখন তো জোড় করে এটা মুখস্থ করে লিখেছিলাম, মাথা মুণ্ডু কিছুই অনুধাবন করিনি। আজ ইনি সেটা বলেই আমাকে উদাহরণ দিচ্ছেন!
ডাক দিলেন, তুমি মনে হয় অন্য মনস্ক হয়েছ?
বললাম না চাচা?
বলতে রইলেন, ‘অগ্র পশ্চাৎ এত ভাবার দরকার নাই। তুমি একজন পরিপূর্ণ পশু বিশেষজ্ঞ! আমার স্বীকৃতিই তোমার সার্টিফিকেট। আমি থানা সদরের পক্ষ থেকে তোমার জন্য কিছু উপকরণ দিব। সেগুলো দিয়ে পশু চিকিৎসার কাজটি করে নিতে পারবে। তাছাড়া ভবিষ্যতে এই বিষয়ের একটি সরকারী চাকুরীর সুযোগ হয়ত তোমার জন্য অতি সহজ হতে পারে’।
তাঁর এই পরামর্শে আমি আর না করতে পারলাম না। মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ বুঝে তিনি বললেন, আগামী বৃহস্পতিবার বেলা চার টায় তুমি থাকবে, আমি নিজেই সেখানে আসব।
এখানে উল্লেখ্য, বর্তমানে যেভাবে পথে ঘাটে ফার্মেসী গড়ে উঠেছে, ঔষধ কোম্পানির এম আর এসে ঔষধ দিয়ে যায়। তদানীন্তন সময়ে এ সিস্টেম ছিলনা। যাদের কাছে ঔষধের লাইসেন্স আছে, তারাই বৈধভাবে ফার্মেসী দিতে পারত এবং লাইসেন্সের বিপরীতে ঔষধ কোম্পানি থেকে ঔষধ কিনতে হত। এসব ফার্মেসী আকারে অনেক বড় হত এবং সকল প্রকারের ঔষধ পাওয়া যেত। গ্রামীণ ক্ষুদ্র ফার্মেসী গুলো এসব ফার্মেসী থেকেই ঔষধ কিনত।
আমার বাবার কাছে এই ধরনের একটি ফার্মেসী ছিল, সদ্য পাশ করা বড় ভাইয়ের মাসিক ২৫০ টাকায় আর্মীর কমিশন রেঙ্কে চাকুরী হয়েছিল। বাবা বলেছিলেন আমার ফার্মেসী থেকেই মাসিক আয় আসে ২৫০০ হাজার টাকা, সেখানে ২৫০ টাকার চাকুরীর কি দরকার? তখনকার দিনে, একটি ফার্মেসীর মাসিক আয় বুঝানোর জন্য কথাটি উল্লেখ করা হল। ঘটনা হল, লাইসেন্সের বিপরীতে ঔষধ কিনতে গেলে যে ঔষধ ফার্মেসী মালিকের প্রয়োজন নাই, সেটাও তারা কিনতে বাধ্য হতেন। পশুর ইনজেকশন গুলো পাইজার ও মে এন্ড বেকার কোম্পানি তৈরি করত। এক বোতলে এক হাজার সিসি তথা ২৫০ থেকে ৫০০ গরুর ইনজেকশন! প্যারাসিটামল, নিভাকুইন সহ সকল প্রকার ট্যাবলেট আসত টিনের কৌটায় ভরে, যেভাবে গুড়ো দুধ আসে। প্রতি কৌটায় ১০০০ ট্যাবলেট। এক লিটার, দুই লিটারের বৃহদাকায় স্পেশাল বোতলে করে তরল ঔষধ আসত।! রোগীরা ডাক্তারের কাছে যাবার সময়,বাড়ী থেকে কাঁচের খালি বোতল নিয়ে যেত। ডাক্তার রোগ অনুপাতে বিভিন্ন তরলের মিশ্রণ ঘটিয়ে রোগীর কাঁচের বোতলে ঔষধ ঢুকিয়ে দিতেন। অর্থাৎ প্রতিটি বড় ফার্মেসীতে একটি ক্ষুদ্র ল্যাবরেটরির কাজও হত।
আমি যথারীতি তাদের ফার্মেসীতে বিকাল বেলা বসতে রইলাম। এক পর্যায়ে তাদের অতিমাত্রায় যত্নের কারণে সপ্তাহে দুই দিন করে বসতে রইলাম। তাদের ঔষধ বিক্রির হিড়িক বাড়ল।
কলেজের একই এরিয়াতে একটি হাই স্কুল ও একটি গার্ল স্কুল আছে। স্কুল-কলেজ এক সাথেই ছুটি হয়। আমি যে এলাকার মাষ্টার সে এলাকার স্কুল-কলেজের সকল ছাত্র-ছাত্রীরা একটি রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করে, যাতে করে এক সাথে কথা বলে বাড়ী যাওয়া যায়।
একদিন আমিও সবার সাথে যাচ্ছিলাম, এমন সময় রিক্সায় মাইক লাগিয়ে এক ব্যক্তি গলা হাঁকিয়ে ক্যানভাস করে যাচ্ছিল, তিনি বলছিলেন,
‘সু-খবর! সু-খবর! সু-খবর! দারুণ সু-খবর! আপনাদের আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, বাজারের আনন্দ ফার্মেসীতে অভিজ্ঞ পশু ডাক্তার টিপু সাহেবের আগমন উপলক্ষে আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ। যাদের গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগীর সমস্যা আছে, আপনারা সবাই যোগাযোগ করুন। পাশ করা অভিজ্ঞ ও দক্ষ পশু ডাক্তার টিপু সাহেব সার্বক্ষণিক উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। ভাই সব, ভাই সব............
আমি এসব শুনে রাস্তার মাঝখানে পাথরের মত ‘থ’ হয়ে দাড়িয়ে থাকলাম। ভাবলাম মাটি যদি ফাঁক হত তাহলে আমি এখুনি লুকিয়ে যেতাম! কৌতূহলী ছাত্র-ছাত্রীদের কয়েকজন আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, স্যার মাইক ওয়ালা কি আপনার কথাই বলছে? আমি খুবই অপমান জনক কষ্টে হাঁসলাম আর বললাম, টিপু কি দুনিয়াতে আমি একা?
ফার্মেসী ওয়ালা বেশী টাকার লোভে নিজের গরজে রিক্সায় মাইক লাগিয়ে যেভাবে ক্যানভাস করে আমার নাম পুরো অঞ্চল ময় করল, তাতে আমার কি দশা হবে, আল্লাহ ব্যতীত আর কারো বুঝার ক্ষমতা নাই।
সেখানেই আমার পশু ডাক্তারি শেষ, তবে দোকান দার যাতে তার ঔষধ গুলো বিক্রয় করতে পারে, সেজন্য গরুর রোগ, লক্ষণ, বিবরণ দিয়ে একটি নোট বানিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে করে নিজেদের মত করে ঔষধ বিক্রয় করতে পারে।
কিছুদিন পরে ওই সব ছাত্র ছাত্রীরা বুঝে ফেলে যে, আমিই ছিলাম সেই পশু ডাক্তার টিপু সাহেব। পরবর্তীতে এই ব্যাপারটি আমার জন্য যত না বিব্রতকর ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশী বিব্রতকর ছিল, যখন আমাকে দেখতে পেল এক বেতমিজ ও নাটের গুরু ছাত্রের গৃহ শিক্ষক হিসেবে!
বিষয়: বিবিধ
৩১০৬ বার পঠিত, ৩২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নরসুন্দরকে কে নাপিত বললে তো ভয়ানক ক্ষেপে যায়। নরসুন্দর কথাটি সাহিত্যে আছে, ব্যবহারিক জীবনে নাই।
সে জন্য সকল নাপিতের দোকান এখন 'সেলুন' হয়ে গিয়েছে। দেশের ধনী ব্যক্তিরা তাদের স্ত্রী, কণ্যাদের দিয়ে এখন লেডিস সেলুন খুলে। আচ্ছা যদি অতীতের শব্দগুলো বহাল তবিয়তে থাকত, তাহলে ধনীর বউদের বলা লাগত, 'মহিলা নাপিত'! তাহলে কেউ কি লেডিস সেলুনের ব্যবসা করত? অনেক ধন্যবাদ
ছাত্রদের কথা লিখার সময় আবার মাদারবাড়ির খারাপ ছাত্র সম্পর্কে লিখবেন না যেন!! যা একটু প্রেস্টিজ এই ব্লগে আছে পুরাই ডাউন হয়ে যাবে।
এখনো এই দেশে বিলাতী ডিগ্রীধারী একজন, স্পেশায়লিষ্টের যে বেতন, একজন ভেটিরীনারী ডাক্তারের বেতন কয়েক গুন বেশী।
ছাত্রদের কির্তী নিয়ে শিক্ষক লিখবেন, তাতে পাঠকদের দুঃচিন্তা করার কোন কারণ তো দেখছি না। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ঘটনা কি হাটে হাড়ি না ভাংগার আবেদন
আপনার মন্তব্য টাও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মন্তব্যের মতই হয়ে গেল। ধন্যবাদ আপনাকে,ছাত্র-শিক্ষক দুইজন কেই ব্লগার হিসেবে পেয়ে অনেক ভাল লাগতেছে।
শেষ পর্যন্ত মেট্রিক পাশ করা ব্যক্তিটি পাশ করা অভিজ্ঞ ও দক্ষ পশু ডাক্তার হিসেবে আবির্ভাব হলেন, সত্যিই আপনি এক পিকুলিয়ার মানুষ।
‘সু-খবর! সু-খবর! সু-খবর! দারুণ সু-খবর! আপনাদের আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, বাজারের আনন্দ ফার্মেসীতে অভিজ্ঞ পশু ডাক্তার টিপু সাহেবের আগমন উপলক্ষে আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ। যাদের গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগীর সমস্যা আছে, আপনারা সবাই যোগাযোগ করুন। পাশ করা অভিজ্ঞ ও দক্ষ পশু ডাক্তার টিপু সাহেব সার্বক্ষণিক উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। ভাই সব, ভাই সব............
মাইকে ডাঃ আসবে শুনে উটটি নিয়ে আসলাম ট্রাকে করে... উটটির সমস্যা হলো সে বসলে উঠতে পারেনাহ্ এবং উঠলে বসতে পারেনাহ্!!! ডাঃ হিসেবে আপনি কোন সুব্যবস্থা করে দিন প্লিজ।
ধন্যবাদ ব্যতিক্রমী ধারাবাহিক লেখা উপহার দেবার জন্য।
তবে উট নিয়ে আমার একটি রচনা আছে, 'একটি উটের আত্নকথা' নামে। সুযোগ ঘটলে পড়ে নিবেন। তখন বুঝবেন উটের সাথে খাতির করে ভুল করেন নি। লিঙ্কটি এখানে: একটি উটের আত্নকথা
একটি উটের আত্মা কথা ...... লিংক দিলেন কি করে?
অতপর, কমেন্ট বক্সের উপরে চেইনের মত ছবি দেওয়া ক্ষুদ্র ছবি তথা Add link এ ক্লিক করুন। নিচে ছবি দেখুন।
সেখানে আপনি আপনার কপি করা লিঙ্কটি পেষ্ট করুন।
ওকে দিন।
আবরো ওকে দিন।
ধরুন লিখাটি এখাবে দেখা গেল:
"http://www.monitor-bd.net/blog/blogdetail/detail/1704/tipu1900/57318#.VbTHMPmqpBd" target="_blank"]Click this link[/url]
সতর্ক ভাবে দেখুন, যেখানে Click this link কথাটি আছে সেটি কেটে ঠিক সেটার স্থলে আপনার বাংলা কথাটি লিখে দিন এবং সাবমিট করুন।
এখানে শুধুমাত্র আপনার বাংলা বাক্যটি দেখা যাবে কিন্তু ক্লিক করলে মূল জায়গায় চলে যাবে। আশা করি পরিষ্কার হয়েছে। ধন্যবাদ।
যে লেখাটির লিঙ্ক দিতে চান সেই লেখাটি ওপেন করে এ্যাড্রেস বার থেকে পুরো এ্যাড্রেসটি সিলেক্ট করে কপি করুন। যে লেখার উপরে লিঙ্ক দিতে চান সেটা সিলেক্ট করুন। এবার উপরের আইকনগুলোর মধ্য থেকে Add Link আইকনে ক্লিক করুন। যে বক্স আসবে সেখানের সবকিছু ডিলেট করে আপনার কপি করা এ্যাড্রেসটি পেস্ট করে ok করুন। কাজ শেষ। ধন্যবাদ।
যদিও টিপু ভাইয়ের দেয়া টিপস এ কাজ হয়েছে!
আপনার এগিয়ে আসাকে একজনের প্রতি আরেক জনের আন্তরিকতার বহিপ্রকাশ। দুজনকেই ধন্যবাদ।
হয়েছে কিনা দেখুন প্লিজ।
ভাই সংসারী না হয়ে যদি বাউল হতেন তাহলে এক সন্তানের জায়গায় দেশ জুড়ে আপনার হাজার সন্তান থাকত(নট বায়ওলজিক্যাল)।
মরার পর ফেরেশতারা যে আপনাকে কত ঘাটের পানি খাইয়ে বেহেস্তে ঢুকায় আমি সেই চিন্তায় আছি।
এই পোষ্টটির শুরুতেই বলেছিলাম, এসব লিখতে গেলে হয়ত আমার বর্তমানের পজিশনের কারণে মান সম্মানের ক্ষতি হতে পারে। তারপরও সাহস করে লিখে যাচ্ছি, কেননা না লিখলে কেউ তো জানবে না।
প্রথম পোষ্টেই উল্লেক করেছি যে, বাবা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, আমি বড় হয়ে কি হতে চাই? 'বলেছিলাম সাধু হতে চাই'! সুতরাং আপনার চিন্তার সাথে মিল তো আছেই। অনেক ধন্যবাদ।
আমি যে কথাটা গুছিয়ে বলতে পারিনি তাহল, আল্লাহ্ যখন ফেরেশতাদের নির্দেশ দিবেন, 'টিপু পাগলাকে জান্নাতে ঢুকা' তখন ফেরেশতারাও বিপাকে পরে যাবে যে কোন জান্নাত রেখে কোন জান্নাতে ঢুকাবে কারণ তার অবদান তো সব সেক্টরে।
আশা করি সেদিন দেখা হবে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুণ। তবে আমি ফেরেশতাদের অনুরোধ করবে তারা যেন আপনাকে বানের জলে ভাসা ভবীর সাথেই শেষ পর্যন্ত একই জান্নাতে রাখেন।
যে লেখাটির লিঙ্ক দিতে চান সেই লেখাটি ওপেন করে এ্যাড্রেস বার থেকে পুরো এ্যাড্রেসটি সিলেক্ট করে কপি করুন। যে লেখার উপরে লিঙ্ক দিতে চান সেটা সিলেক্ট করুন। এবার উপরের আইকনগুলোর মধ্য থেকে Add Link আইকনে ক্লিক করুন। যে বক্স আসবে সেখানের সবকিছু ডিলেট করে আপনার কপি করা এ্যাড্রেসটি পেস্ট করে ok করুন। কাজ শেষ। ধন্যবাদ।
এবার লজিং মাষ্টারিতে কি পেলেন তা জানার অপেক্ষায় রইলাম৷ ধন্যবাদ৷
খুব খুব ভাল লেগেছে, ধন্যবাদ আপনাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন