গরু ব্যাপারী যায়রে, এক পিকুলিয়ার মানুষ-৩২ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ২৩ জুলাই, ২০১৫, ০৭:১৫:৩৬ সন্ধ্যা
বাংলাদেশের মানুষ ও সমাজ জীবন বড় বিচিত্র। বসে বসে অন্যের কাঁধে চড়ে আরাম আয়েশে দিন গুজরান করে খাওয়াকে মোটেও লজ্জাজনক মনে করেনা। সমাজে চলতে গিয়ে বহু মানুষকে দেখেছি, স্বামী ঘরে শুয়ে আছে, তার স্ত্রী প্রতিবেশীর নিকট খাদ্য চাইতে গিয়েছে কিংবা অন্য গৃহস্থের ফরমায়েশ করছে! দুনিয়ার অন্য জাতি গোষ্ঠীর তুলনায় বাংলাদেশীদেরকে অসম্ভব আলসে প্রকৃতির বলে মনে হয়। আগেই বলেছি Knut Hamsun এর Growth of the Soil তথা ‘মাটির জন্ম’ বইটি আমাকে অনেক খানি বদলে দিয়েছিল। তাই চিন্তা করছিলাম গ্রামে ফিরে গেলে আমি একটি গবাদি পশুর খামার প্রতিষ্ঠা করব। খামারের জায়গা, গো চারণ ভূমি, বৃহদাকায় ঘর, বাঁশ-গাছ-ছন-বেত জোগাড় করা সব কিছুই আমার পিতার সাধ্যের অনুকূলে ছিল। শুধু আমার নিকট থেকে দরকার ইচ্ছা শক্তি, যা ইতিমধ্যে জোগাড় হয়েছে।
একটি গবাদি পশুর খামার প্রতিষ্ঠায় বাবাকে বহু কষ্টে রাজি করালাম। তবে কাজটি কিভাবে শুরু করতে হবে সে সম্পর্ককে কোন জ্ঞান নাই। তাই ডিএলও ও টিএলও (ডিষ্ট্রিক লাইভেষ্টক ও থানা লাইভেষ্টক অফিসার) সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলাম তাঁদের যথেষ্ট অনুপ্রেরণা পেয়ে কাজেও নেমে গেলাম। তখনও চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক ভাবে কোন খামার শুরু হয়নি। বাংলাদেশ সরকার পাইলট প্রজেক্টের আওতায় দেশের কিছু কিছু এলাকায় গবাদি পশুর খামার করার ব্যাপারে চিন্তা করছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মত একজন অতি উৎসাহী যুবককে আগ্রহী পেয়ে; জেলা ও থানা পর্যায়ের সকল সরকারী কর্মকর্তা, আমাকে সকল প্রকার সহযোগিতা দিতে সিদ্ধান্ত নিল। জেলা পশুপালন কর্মকর্তা আমাকে নিয়ে ডিসি মহোদয়ের অফিস পর্যন্ত ছুটলেন; যাতে করে সকল প্রকার সরকারী সুযোগ প্রাপ্তিতে আমার কোন ব্যাঘাত না ঘটে।
পাঠক নিশ্চয়ই মনে আছে, কয়েক পর্ব আগেই উল্লেখ করেছিলাম কার্পেন্ট্রি নিয়ে আমার সেই জিল্লতির কথা! মৌমাছির বাসা বানাতে গিয়ে নিজেকেই কার্পেন্ট্রির কাজ শিখতে হয়েছিল, তাই লোকেরা আমাকে সুতার মিস্ত্রী বানিয়ে ছেড়েছিল! সেই অবহেলিত বিদ্যা আজ আমাকে একটি গরুর খামার গড়ে তুলতে বিরাট কাজ দিল। আমার নিকট সমুদয় যন্ত্রপাতি না থাকাতে, একজন সুতার মিস্ত্রী হাওলাত করে আনা হল। আমার ও তার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি বৃহদাকায় গোয়াল তৈরি হল। ভারী কাঠের কাঠামো ঘেরা উপরে টিনের ছাউনি ঘরে, অনেক গুলো গরু একসাথে রাখা যাবে। সর্বোচ্চ আধুনিক পদ্ধতিতে ঘরটা গড়ে তুলতে আপ্রাণ প্রয়াস ছিল। এই ঘরটি বানাতে গিয়ে কাঠ ও বাঁশের যে উচ্ছিষ্ট অংশ অবশিষ্ট রইল; তা দিয়ে ৫০ টি ছাগল রাখা যাবে, এমন আকৃতির একটি মজবুত মাচা ঘরও তৈরি হয়ে গেল! শিয়ালের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে পাহাড়ি অঞ্চলে ছাগলকে বাংলো বাড়ির মত ঘরে রাখতে হয়।
জেলা কর্মকর্তাদের পরামর্শে, এই প্রকল্পের শুরুতে গরু মোটা-তাজাকরণ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হল। আস্তে আস্তে দুধের গাভী সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলাম। সরকারী ভাবে আমার প্রকল্প টিকে পাইলট প্রকল্প নম্বর ১ হিসেবে রেজিস্টার করা হল। সে হিসেবে বাণিজ্যিক ভাবে গবাদি পশুর খামার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে চট্টগ্রামে আমিই প্রথম ব্যক্তি। গরু মোটা-তাজা করনে খাদ্যকে দুটি ভাগে ভাগ করতে হয়। সাইলেজ ও ইউরিয়া প্রসেসিং। সেগুলোর জন্য পদ্ধতিগত ভাবে আলাদা ব্যবস্থা নিলাম। কোরবানের ছয় মাস আগে, গড়ে ৬০০ টাকা মূল্যে ১০ টি বাছুর কিনলাম। কোরবানির বাজারে প্রতিটি গরু গড়ে ১৬০০ টাকায় বিক্রিও হয়ে গেল! বলা যায় অগ্রগতি অভাবনীয় ও উৎসাহ ব্যঞ্জক। ফলে পরবর্তী ধাপের জন্য, মোটা তাজার নিমিত্তে আরও ত্রিশটা গরু কেনা গেল। একই সাথে দুধের জন্য অনেক দামে কিছু সংকর জাতের বাছুর জোগাড় হল।
অন্যদিকে ছাগলের অবস্থা আরও রমরমা। ছাগল প্রতি ছয় মাসে বাচ্চা দেয়। দুই মাস পরে দুই-একটি ছাগল বাচ্চা দেওয়া শুরু করল। এর পরে প্রতি সপ্তাহে, কিছুদিন পরে তিন দিন অন্তর অন্তর ছাগলের বাচ্চা যোগ হতে থাকল। বছরান্তে ছাগলের একটি ঘর থেকে তিনটি ঘর বাড়াতে হল। সে এক মহা আনন্দ। গরু ছাগল গুলোকে সেবা শুশ্রূষা করাটা আমার বাতিকে পরিণত হল।
থানা পশু পালন কর্মকর্তা সপ্তাহে দুই দিন গরু-ছাগলের চিকিৎসা সেবা ও টিকা দান কর্মসূচী সফল করতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভিজিট করেন। তিনি আমাকে সাথী হিসেবে, সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং গরু-ছাগল, হাস-মুরগীর চিকিৎসা বিদ্যা হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। এর ফলে পশু পালন কর্মকর্তাকে আর আমাদের এলাকায় না আসলেও চলছিল। তিনি আমাকে দিয়ে পাশের দুটো ইউনিয়নেও একই কাজ করিয়ে নিচ্ছিলেন। এই সৎ কর্মকর্তা সরকারী ঔষধ বিনামূল্যে বিতরণ করতেন।
আমাকে পশুর চিকিৎসা এই বিদ্যা শিখাতে ওনার কোন দায় ছিল না। তিনি একজন সরকারী গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে, দেশের প্রয়োজন পুরনার্থেই আমাকে এই কাজে প্রচুর আনন্দ ও উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কেননা তখনকার দিনে পশু চিকিৎসকের বড়ই অভাব ছিল। আমি কখনও এই কাজ করে কারো নিকট থেকে বখশিশ আদায় করতাম না। কেননা ততদিনে আমি একটি খামারের গর্বিত মালিক বনে গিয়েছিলাম।
অল্পদিনের মাথায় আমার খামার করার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। সাধারণ মানুষ গবাদি পশুর খামার করার কারণে আমাকে গরু ব্যাপারী হিসেবে ট্রিট করতে লাগল! শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সবাই আমাকে গরু ব্যাপারী হিসেবে ডাকতে থাকল। একদা স্বপ্নের ঘোড়ে যে সব বেকার বন্ধুদের কে এই বিদ্যা শিখিয়ে স্বাবলম্বী করার চিন্তা করতাম, এখন তারাই আমার জন্য পথের মুসিবত হয়ে দেখা দিল। তারা আমাকে কোথাও যেতে দেখলে বলে গরু ব্যাপারী যায় রে বলে উপহাস করতে লাগল।
তাদের কে বুঝাতে চেষ্টা করলাম একদা বাংলাদেশে এই শিল্পই দেশের বড় অবদান রাখবে। তাদের আরও বললাম, আমার পিতার তো আর্থিক কষ্ট নাই যে, আমার খামারের আয় দিয়ে তাঁর পরিবার চলতে হবে। নিতান্ত শখের বশেই তো এই কাজে জড়িয়ে পড়েছি। এতে তোমাদের উপকার হতে পারে কিন্তু অপকার হবার কোন কারণ তো নাই। তারা বলতে রইল, ‘প্রয়োজনে ভিক্ষা করে চলব, অন্যের নিকট হাত পেতে খাব, তারপরও গরু-ছাড়ল পালন করে ভাগ্য বদলাবো না”! কিছু মানুষ উপযাচক হয়ে আমার পিতাকেই প্রশ্ন করে বসে, ‘দুনিয়াতে টাকা কামানোর এত রাস্তা থাকতে আপনি শেষতক ছেলেকে গরু ব্যাপারী বানিয়ে দিলেন’!
বাবা শুরু থেকেই আমার উৎসাহে বাধ সেধেছিলেন, এবার সরাসরি বললেন, ‘গরুর ফার্ম করতে গিয়ে আমার ইজ্জত সম্মান যা ছিল সবই গেছে, ভবিষ্যতে তোমার জন্য বউ জোগাড় করাও কঠিন হবে, অন্য ছেলেদের জন্য কেউ আমাকে আর বেয়াই বানাবে না। আল্লাহর ওয়াস্তে এই রাস্তা ছাড়, নতুবা গোয়াল ঘরে আগুন লাগানো হবে’।
আমাদের সামাজিক সমস্যা প্রকট। মানুষ আলসেমি করে ঘরে বসে থাকবে, প্রয়োজনে পুরো দিনে একবেলা খানা খাবে, তারপরও বেকারত্ব দূর করতে আগ্রহী নয়। অবশেষে বাবাকেও বেঁকে যেতে দেখে আমি হতাশ হলাম, সামনের সকল রাস্তায় অন্ধকার দেখতে পেলাম। ফলে উপায়ান্তর না দেখে সরাসরি জেলা কর্মকর্তার শরণাপন্ন হলাম। তিনি সুন্দর একটি পরামর্শ দিলেন, যা আমার মন-পূত হল।
তিনি বললেন, ‘আমরা তোমার খামার নিয়ে পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন দিব। আগামী তৃতীয় মাসের কোন একদিন ডিসি, ডিএলও, টিএলও সহ জেলা ও থানা পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তা তোমার খামার পরিদর্শনে আসব। সাথে আশে পাশের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কে রাখা হবে। সাধারণ জনগণ যখন দেখবে, সরকারী পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা তোমার খামার দেখতে গিয়েছে, তখন গন মানুষের উপলব্ধিতে পরিবর্তন আসবে। তখন তোমাকে অনেকে হিংসা করবে’।
এক বাক্যে সেরা পরামর্শ বলেই মনে হল। তাছাড়া তাদের আন্তরিকতার কোন ঘাটতিই তো দেখছি না। তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন, যে পরামর্শ পালন করতে গিয়ে আমি চির জীবনের তরে সাগরের অতল তলে নিমজ্জিত হই! সে কথায় পরে আসছি।
তিনি বলতে রইলেন, তৃতীয় মাসের কোন একটা দিন তোমার খামার পরিদর্শনের তারিখ ঠিক করা হবে। এই ফাঁকে এলাকার যে সমস্ত মানুষ সম্মানী, শিক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য, তাদেরকে যেন অনুরোধ করে আমার খামার বাড়ি খানা দেখাই। তাতে তারা চক্ষু লজ্জায় পড়ে হউক কিংবা বাস্তবতার কারণে হউক, আমার প্রতি নিন্দুকের সংখ্যা কমে আসবে!
এক প্রত্যুষে খবর পেলাম, এলাকার সবচেয়ে ক্ষমতাবান, ধনী ও প্রবীণ ব্যক্তিত্ব মোতালেব মুন্সী (ছপ্দনাম) আমার খামার বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছেন। চিন্তা করলাম, খামার পরিদর্শনের কাজটি তাঁকে দিয়েই উদ্বোধন করা যাক। তাই দ্রুত গিয়ে তাঁর চলার রাস্তা আগলে ধরলাম এবং আমার খামার পরিদর্শনের জন্য বিনীত অনুরোধ জানালাম।
তিনি কোমরকে ধনুকের মত বক্র করে দাঁড়িয়ে হতাশ ভঙ্গিতে জানালেন, ‘শুনেছি তুমি গরু ছাগলের কারবার শুরু করেছ, আজ তো আমার সময় নাই, অন্য কোন দিন সময় পেলে আসব। তাছাড়া গরু-ছাগল দেখার মাঝে নতুনত্ব তো কিছুই নাই, প্রতিনিয়তই তো দেখছি’!
আমি নানা তাঁকে সন্ধোধন করে, খামার বাড়ী দেখার জন্য জোড় খাটালাম। কেননা সম্পর্কে তিনি আমার নানার বেয়াই হন। যাই হোক আমার পিড়াপিড়িতে অগত্যা তিনি রাজি হলেন। তিনি যখন খামার এলাকায় প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছিল যে, কিছুক্ষণ আগের সৃষ্ট বিরক্তি এখন উৎফুল্লতায় রূপ নিচ্ছে! তিনি আধুনিক পদ্ধতির গোয়াল ঘর, ছাগলের খামার, সুন্দর গরুর বাচ্চা ও অসংখ্য ক্ষুদ্র ছাগল ছানা একটি কক্ষে দেখতে পেয়ে বলে আশ্চর্য হলে বলে উঠলেন;
উমা! এতো দেখছি মহা কারবার। এতদিন যা শুনেছি, এটাতো তার চাইতে আরো দারুণ। ইস্রে! কি সুন্দর গরুর বাচ্চা। ওরে বাপরে! সব গরু গুলোকেই তো তাজা তাজা লাগছে। আহারে! ঐ গরুটার মত যদি আমার একটি গরু থাকত। আহারে খোদা! আমার বাড়িতে এত সুন্দর ছাগল হয় না কেন?
ভদ্রলোকের এই ধরনের উপমাতে তাচ্ছিল্য প্রকাশ না পেলেও হিংসা ও লোভের আলামত বিলক্ষণ বুঝতে পারলাম। এতে আমি যথেষ্ট বিব্রত-বোধ করতে লাগলাম, ভাবলাম এখন তিনি গেলেই বাঁচি। ইতিপূর্বে তিনি আসতেই চায় নাই এখন তিনি গো-চারণ ভূমি, খাদ্য তৈরির জায়গাগুলো দেখতে আগ্রহ দেখাল। ততক্ষণে তাঁকে নিয়ে আমার আগ্রহ শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ফলে কোন রকমে তাঁকে বিদায় করলাম।
মুন্সী বিদায় নেবার একটু পরেই, হন্তদন্ত হয়ে খায়রুল বশর সাহেবের আগমন ঘটে! সম্পর্কে তিনি আমার ফুফাতো ভাই এবং ভাল পরামর্শ দাতাই বটে। তিনি উদ্বিগ্ন চেহারায় প্রশ্ন করলেন, মোতালেব মুন্সী কোথায় গিয়েছিল? আমি বললাম, তাঁকে ধরে এনে খামার দেখিয়েছি।
তিনি চোখ কপালে তুলে বললেন, সারে সর্বনাশ! ‘তুমি তো খাল কেটে কুমির এনেছ! মানুষ এই ব্যক্তির নিকট থেকে একশত হাত দূরে থাকতে চায়, আর তুমি কিনা তাকে ধরেই কাছে এনেছ’! তুমি কি জান, কতটুকু সর্বনাশ তুমি নিজের জন্য ঘটিয়েছ?
বললাম, না তো!
বললেন, ‘মোতালেব মুন্সীর মুখ পড়া দোষ আছে। তিনি যেটার দিকে তাকান সেটার সর্বনাশ হবেই। মানুষ ভয়ে তার সাক্ষাত থেকে দূরে থাকতে চায়’। হৃদয় অভ্যন্তরে ভয় পেলেও, চেহারায় সাহস মেখে তাঁকে জানালাম, আমি মুখ পড়ার তাবিজ জানি, পানি পড়া জানি, আমার কোন সমস্যা হবেনা। পাঠকেরা নিশ্চয়ই জানেন যে, একদা আমার নিকট থেকে মুখ পড়া পানি নেবার জন্য মানুষ লাইন ধরে দাঁড়াত। সে কথার দিকেই আমি খায়রুল বশর সাহেবকে ইঙ্গিত দিয়েছি।
তারপরও তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে নিরাপদ মনে করছি না’।
সন্ধ্যা বেলায় চাকর নূর বশর হন্ত দন্ত করে বাড়িতে আসে! সে জানাল আমাকে এখুনি যাবতীয় ঔষধ পথ্যাদি নিয়ে খামারে যেতে হবে। সবচেয়ে সেরা গরু দুটি খানা বন্ধ করে দিয়েছে এবং বসা থেকে উঠতে চাচ্ছে না! দৌড় লাগালাম। আমাদের বাড়ি থেকে খামারের দূরত্ব প্রায় তিন মাইলের মত। গিয়ে যা দেখলাম সেটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। দুটো সেরা গরুই ততক্ষণে মারা পড়েছে এবং আরও তিনটি গরু মাটিতে শুয়ে তড়-পড়াচ্ছে! কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।
তড়কা নামে গরুর একটি ভয়ানক ব্যধী আছে যা প্রকাশ পাওয়া মাত্র বেশী সময় নেয় না। সহসাই মারা যায় কিন্তু গরুর আচরণ তড়কার মত মনে হলনা। সবে মাত্র সন্ধ্যার শুরু, সকাল হলে থানা সদরে যেতে হবে, তাও দশ মাইল দূরে, তাছাড়া আগামী কাল থেকে হরতাল শুরু হবে। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম হরতাল। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রথম হরতালের চেহারা কেমন হবে, না দেখে তো আন্দাজ করা যাবেনা।
ততক্ষণে আমার বাবা-মা ও চলে এসেছেন। আমার বাবা গরু গুলোকে যখন নাম ধরে ডাক দিত, সেই গরুটিই তাঁর কাছে আসত। আমার অথবা বাবার একটু আদর পাবার জন্য ঠাই দাড়িয়ে থাকত। আদর না করা পর্যন্ত স্থান থেকে নড়ত না। তখনকার দিনে পেনিসিলিন ছিল সর্বোচ্চ এন্টিবায়োটিক। ইতিমধ্যে ‘এমব্লোসিন ৩০ লাখ’ নামের আরো পাওয়ার ফুল আরেকটি এন্টিবায়োটিক বাজারে এসেছে। আক্রান্ত গরুগুলোকে সেটিই প্রয়োগ করা হল। বোবা প্রাণী! শরীরের কষ্টের কথা বুঝাতে পারছিল না। প্রতিটি আক্রান্ত গরুই কান্না করছিল! চোখের দু’পাশ বেয়ে গল গল করে কান্নার পানি বেয়ে পড়ছিল।
হঠাৎ মনে পড়ল গরুর পিছনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, ছাগলের খবর তো নিলাম না। সকালের মুখ পড়ার ঘটনায় আমার মনে এমনিতেই একটি সন্দেহ জনক ভয় তাড়া করছিল। ছাগলের ঘরের দরজা খুলে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না! ততক্ষণে প্রায় অর্ধেক ছাগলের বাচ্চা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। বুক ফেটে কান্না আসল। আমার কান্না আর বোবা প্রাণীদের কান্না একাকার হয়ে গেল। আমার জীবনে এত কান্না আর কোনদিন করিনি।
পরদিন খামারে প্রাণীর সংখ্যা এক তৃতীয়াংশে নেমে আসল। হৃষ্টপুষ্ট সব প্রাণী গুলোই মরে গেল। সবাই আমাকে জোড় করে বাড়ীতে নিয়ে এলেন। বাবা-মায়ের চোখ দেখে বুঝলাম তাঁরাও পুরো রাত কান্না করেছে, আমাকে বুঝতে দেয়নি। আমার মেঝ ভাই খামারে কসাই নিয়ে গেলেন এবং নিলামে পানির দরে সমূদয় গরু-ছাগল বিক্রি করে দিলেন।
গ্রামীণ মানুষের গরু ব্যাপারীর তির্যক অপবাদ থেকে চিরতরে বেঁচে গেলাম বটে তবে Knut Hamsun এর Growth of the Soil এর অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত একটি সম্ভাবনায় ময় যুবকের অদম্য স্পৃহার করুণ মৃত্যু হল!
এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, মোতালেব মুন্সীর সাথে আর কোনদিন দেখা হয়নি। একদা জনগণ দেশের দুই রাজনীতিবিদের জালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠায়, বাজারে এক ব্যক্তিকে চিৎকার করে বলতে শুনেছি। ‘হায় আফসোস! আজ মতলব মুন্সী বেঁচে নাই, যদি বেঁচে থাকত তাঁর মুখ পড়ার বদৌলতে, হয়ত দেশের এই দুই ব্যক্তির পক্ষাঘাত হত, নয়ত কোনভাবে জাতি উদ্ধার পেত’।
বুঝতে পারলাম, কদাচিৎ বদ গুনের কদরও সমাজের প্রয়োজন পড়ে। সবাইকে মুখ পড়ার পানি দিলেও আমি মুখ পড়াকে বিশ্বাস করতাম না। তবে খামার করার শুরুতে থানা পশু পালন কর্মকর্তা আমাকে এই বিষয়টি অবহিত করেছিলেন কিন্তু ব্যাপারটিকে আমি মামুলী হিসেবে গণ্য করেছিলাম। তাছাড়া আমি নিজেই একদা মুখ দোষের পানি পড়া মানুষকে দিতাম। যখন মুখ দোষ আমার উপর আছড়ে পড়ল, তখন আমাকে কেউ রক্ষা করতে পারেনি।
বন্ধুদের মুখে ‘গরু ব্যাপারী যায়রে’, কথাটি শুনতে শুনতে আমি যতটা না বিব্রত হয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশী বিব্রত হয়েছিলাম, যখন দেখলাম এক ব্যক্তি রিক্সায় মাইক লাগিয়ে আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, আর চড়া গলায় ঘোষণা করছিল, ‘সু-খবর! সু-খবর! সু-খবর! দারুণ সু-খবর! আপনাদের আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, বাজারের আনন্দ ফার্মেসীতে অভিজ্ঞ পশু ডাক্তার টিপু সাহেবের আগমন উপলক্ষে……
বিষয়: বিবিধ
২৪০০ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এটা আমাদের মানুষের স্বভাব কেউ আগ্রহ নিয়ে নিয়ে কিছু করতে চাইলে উৎসাহ তো দিবেই যত রকম টিটকারি করা যায় তা করবে ।
জ্বি ভাই, মুখ পড়ে, খোদ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এই ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। এ সর্ম্পকিত আরো চাক্ষুস ঘটনা আমার অভিজ্ঞতার থলেতে আছে যদিও আমি বিজ্ঞান মনষ্ক বিজ্ঞানের ছাত্র। অনেক ধন্যবাদ।
৬০০ টাকায় গরুর বাছুর কি ভাবে পাওয়া গেলো বুঝতে পারছিনাহ্!!
তা বিক্রিও ১৬০০ টাকা। কো জামানার কথা??
প্রথম উদ্যোগতাদের এমন কিছু কথার মুখোমুখি হতে হয় যা সাময়িক লজ্জার হলেও সময়ের সাথে মিলিয়ে নেয়ায় চেষ্টা থাকলে সফল হওয়া সম্ভব! তা আপনি প্রমাণ করেছেন।
ধারাবাহিক গুলো এত সময়ের ব্যবধানে পোস্ট দিলে মনে রাখা কঠিন।
আমাকেও আপনার রোগে আক্রমণ করেছিল। ৯৬এ যুব উন্নয়ন সাভার থেকে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। তিন বন্ধুকে নিয়ে প্রজেক্টের প্ল্যান রেডি করে ফেলি।
যথা সময় আব্বার কাছে খবর চলে আসে তিনি আমাকে ডেকে অতি আদরের সাথে বলেন, 'যত দিন আমি বেচে আছি ততদিন আমার সম্মানের কথা চিন্তা করে হলেও এই চিন্তা বাদ দাও'।
আমি আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে আর এগতে পারিনি। তবে এখনও বিষয়টা মাথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে।
সুন্দর অভিজ্ঞতা জেনে ভালো লাগছে। আপনি আবার উদ্বগ নিলে যেখানেই থাকিনা কেন সাথী হব ইনশা'আল্লাহ।
তারপরও সমাজের গন্ডির মধ্যে থাকতে হলে, অনেক কিছুর সাথে কমপ্রমাইজ করতেই হয়। আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
যাদের মুখ লাগে - তাদেরকে জীবন্ত জানাযা পড়ে নেয়া। তাহলে তার আর মুখ লাগে না।
যাই হোক রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ফজরের নামাজের পর তিনবার করে সূরা ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস পড়ার জন্য। তাছাড়া জীবন্ত নামাজ পড়ানোর জন্য ঈমাম কে হবেন। যারা হবার তারা তো সবাই ইসলামী ফাউন্ডেশনে ঢুকে পড়েছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
লিখাটার শেষের দিকে খুব খুব খারাফ লাগলো,
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন