স্মৃতি রোমন্থন! আজ যা বাস্তবে দেখলাম!
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ২৬ অক্টোবর, ২০১৪, ১২:১৭:৫১ দুপুর
জনাব গোলাম আজম সাহেব,
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমতউল্লাহ।
জনাব, আপনাকে আমি জীবনে কোন দিন সামনা সামনি দেখিনি। হাই স্কুল জীবনের শুরুতে আপনার কু-কীর্তি গুলোর কথা জানতে পেরে আপনার উপর প্রচণ্ড ক্রোধ ও আক্রোশ বরাবরই ছিল। এখনও মনে আছে সেই পোস্টারের কথা, আশির দশকে আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীরা পোষ্টার ছাপিয়েছিল ‘গোলাম আজমের নাগরিকত্ব হরণ আদেশ বাতিল কর, করতে হবে’। সকাল বেলায় স্কুলের দেওয়ালে এই পোষ্টার দেখে হতচকিত হয়ে যাই। গোলাম আজম এটা কেমন ধরনের নাম! এ জাতীয় কোন নাম পূর্বে কখনও শুনেছি বলে মনে করতে পারলাম না। সন্দেহ ও সংশয় নিয়ে মূল ঘটনা জানতে আগ্রহ বোধ করি। সেটা ছিল ফেব্রুয়ারি মাস, হাই স্কুল গুলো নতুন ছাত্রদের আকর্ষণ করতে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে নাটক সহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। তাই আমাদের পাশের হাই স্কুলে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পুরো রাত ব্যাপী ‘মোগলে আজম’ নাটক হবে। রিক্সায় করে মোগলে আজম নাটকের নিমন্ত্রণ দেওয়া হচ্ছিল। রিকশার মাইকে কি বলা হচ্ছে, দক্ষিণের বাতাসের তোড়ে শব্দটি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলেন না, আমাদের শ্রেণী শিক্ষক জহুর মৌলভী। পেশায় স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক ও স্থানীয় দরগাহের খাদেম জহুর মৌলভী বারবার শুনতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন মাইকে কার নাম বলা হচ্ছে। তিনি ছাত্রদের কাছে জানতে চাইলেন মাইকে কি বলা হচ্ছে? কয়েক জন দাঁড়িয়ে বলল হুজুর নারায়ণ হাট স্কুলে ‘গোলাম আজম’ নাটক হবে।
ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া ছাত্রদের কাছে ‘মোগল আজম’ আর ‘গোলাম আজম’ এর তফাৎ বুঝা দুঃসাধ্য ছিল। তবে কয়েকদিন ধরে গোলাম আজমের নামে পোষ্টার দেখে মনে করলাম রিকশাওয়ালা বুঝি ভুল করে 'গোলাম আজমের' স্থলে 'মোগল আজম' বলছেন। তাই স্যারকে বলা হয়েছিল গোলাম আজমের নাম। নাটকের নাম শুনে জহুর মৌলভী তেলে বেগুনে তেতে উঠলেন! ক্ষোভের সাথে বলনেন, ‘এই ব্যক্তিই আমার মামাকে হত্যা করেছে, শুধু তাই নয় আমার মামা সহ হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে এই রাজাকার’। আর এখন তার নামেই নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে!
বুঝে নিলাম জহুর মৌলভীর মামা হত্যাকারী এই গোলাম আজম আমদের এলাকার কেউ হবেন। স্যারের উপস্থিত গোস্বা ও মন্তব্য শুনে আপনার উপর প্রচণ্ড ঘৃণা চলে এসেছিল! ছাত্র বয়সেই স্যারের উৎসাহ পেয়ে আপনার পক্ষে সাঁটাই করা দুটি পোষ্টার খুঁটি দিয়ে খুঁচিয়ে উৎখাত করি। রাত্রে ঐতিহাসিক মোগল আজম নাটকের পুরোটাতে শুধুই যুদ্ধ দেখেছিলাম! ফলে নাটকের মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝি নাই। কেননা জহুর মৌলভীর মামা হত্যাকারী গোলাম আজম আর রাত্রের নাটকে দেখা যুদ্ধ বিদ্যার কি সম্পর্ক থাকতে পারে কোন কুল কিনারা পেলাম না! তবে আমার ঘৃণিত গোলাম আজমকে জানার আগ্রহ কোন ক্রমেই নিবৃত হলনা। বড় হয়ে জানলাম গোলাম আজম নামটি খুবই তাৎপর্য পূর্ণ একটি নাম! তিনি ঢাকারই একজন মানুষ এবং আমাদের হুজুর জহুর মৌলভীর মামাকে হত্যা করতে তিনি আমাদের এলাকায় কোনদিন আসেন নি! আরো জানলাম, রাজাকার শব্দটির আভিধানিক অর্থ ভাল হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য সেটি দুর্নামে পরিণত হয়েছে!
জনাব, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় খারাপ চরিত্রের মানুষকে, ভাল বলে চালিয়ে দেবার প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। দস্যু বাহরাম, দস্যু বনহুর, দস্যু শাহবাজ সহ প্রচুর দস্যুকে ভাল চরিত্রের চাদর পরিয়ে সমাজ সংস্কারক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইংরেজি কাহিনীর ডাকাত রবীন হুডের আদলে তৈরি করা এসব বই আমাদের সুকুমার বৃত্তিতে আলোড়ন তুলত। আমারা কিশোর-তরুণ বয়সী ছাত্ররা এসব আজগুবি বই পড়ে পড়ে জানতে শিখেছি ভাল কাজ প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে বড় মাপের ডাকাত হতে হয়। চলমান রাষ্ট্রীয় আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, পুলিশের ঘাড় মটকিয়ে দেশের উন্নতি করতে হয়। এসব বই ও চলচ্চিত্র দেখে আরো শিখেছি যে, দাড়ি ওয়ালা মুসলমান মানেই খারাপ প্রকৃতির মানুষ! মোচ ওয়ালা ঝুটা চুল ধারী মানুষগুলোই মূলত ভাল মানুষ! বাংলাদেশে কার্টুন গুলোতে যত খারাপ মানুষের ছবি আঁকা হয় তার মুখে থাকে দাঁড়ি আর মাথায় থাকে টুপি। চলচ্চিত্রে যত খারাপ মানুষ দেখানো হয় তাদের মুখে থাকে দাড়ি, মাথায় টুপি, হাতে তসবিহ আর মুখে ইল্লাল্লাহ। দেশ স্বাধীন হবার পরও এসব নিয়ে কোন সচেতন মুসলমানকে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। যেভাবে টঙ্গির বিশ্ব ইজতেমায় দলে দলে মুসল্লি-মুরুব্বী বেড়েছে, সেভাবে দ্বিগুণ গতিতে ইসলাম বিদ্বেষ, ঠাট্টা-মশকরা আর প্রহসন করার প্রবণতাও বেড়েছে। মুষ্টিমেয় যে কয়জন মানুষ প্রতিবাদ করেছে তাদের উপর নেমে এসেছে নির্মম নির্যাতন আর জেলের গ্লানি।
জনাব, কলেজে ভর্তি হবার পর কোন এক বন্ধু ‘ছাত্র সংবাদ’ নামে একটি সাময়িকী দিয়ে অনুরোধ করেছিল পড়ার জন্য। প্রচুর বই পড়ার আগ্রহ থাকার পরও সাময়িকী টি পড়ার কোন প্রকার আগ্রহ আমার ছিলনা। ছুটির এক বিকালে আমার কক্ষে কয়েক বন্ধুর কথা-আলাপের ফাঁকে, সিনিয়র ক্লাসের একজন ছাত্র সাময়িকীটি মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকে। মনে হল তিনি শেষের দিকের একটি পৃষ্ঠা বারবার পড়লেন। সকল বন্ধু চলে যাবার পরও সিনিয়র বন্ধুটি বসে থাকেন। তিনি আমাকে বলেন এই লিখাটি পড়েছ কি? লিখাটি পড়ে আমি যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছি। সেটি পড়তে আমার অনাগ্রহের কথা জানালাম। তিনি বললেন, দেখ এই প্রবন্ধের নাম ‘শাহাদাতের মর্যাদা’ এবং লিখাটি লিখেছেন ‘অধ্যাপক গোলাম আজম’। সিনিয়র বন্ধুটি জানাল এই ব্যক্তি আমার কাছে নিন্দনীয় তবে কৌতূহলে পড়তে গিয়ে ওনার লিখায় প্রভাবিত হয়েছি। আমি মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে শাহাদাতের মর্যাদা প্রত্যাশা করি। তুমি সাক্ষী থাক আমি নিয়ত করেছি শাহাদাৎ বরণ করার। শাহাদাৎ কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তা আমি জানিনা, তাই আমার জন্য দোয়া করবে। পর দিন থেকেই মাইজ ভাণ্ডার দরবার শরীফের প্রতি প্রচণ্ড আসক্ত বন্ধুটির চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ঠিক তিন মাস পরেই ১৯৮৫ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর সেলিম জাহাঙ্গীর নির্মম ভাবে শাহাদাত বরণ করে। অসম্ভব মেধাবী এবং এলাকায় সবার কাছে অতি পরিচিত এই বন্ধুটির মৃত্যু পুরো দেশ জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে।
কিসের লোভে সেলিম জাহাঙ্গীর শহীদ হবার জন্য মাতোয়ারা হয়েছিল সেই ঘটনা জানতে, অতি কৌতূহলে অবশেষে আমিও আপনার লিখাটি হাতে নিয়েছিলাম। লিখাটি কয়েকবার পড়েছি, কোরআন এবং হাদিসের প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়ে আপনার সেই লিখাটি পড়ে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। সেই দিন থেকে আজ অবধি আমিও প্রতিনিয়ত এই কামনাই করে চলেছি, যাতে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস টি আল্লাহ যেন শাহাদাতের জন্য কবুল করেন।
এই শাহাদাতের জন্য আপনি কাউকে সন্ত্রাসের আশ্রয় নিতে বলেন নি। কাউকে হত্যা করতে গিয়ে নিজেকে নিহত হতে বলেন নি। প্রচলিত আইনকে অমান্য করে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করার জন্য বলেন নি। আপনি বলেছেন, সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজে বাধা দিতে গেলেই শহীদ কিংবা গাজী হবার রাস্তা স্বয়ংক্রিয় ভাবে তৈরি হয়ে যায়। মূলত এটাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রকৃত পথ ও সঠিক পন্থা। প্রচলিত সহজ বাংলায় আপনার হাতের লিখনি গুলো বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়, যার কারণে আপনার বিরুদ্ধে এই অপবাদ দেবার সুযোগ হয় নাই যে, জামায়াতুল মুজাহেদিনের মত যুবকদের কে আপনি শাহাদাতের জন্য বিভ্রান্ত করছেন। বাংলাদেশে যে সব যুবক আপনার সাহিত্য পড়েছে, তারা সঠিক রাস্তা পেয়েছে, একজন স্বচ্ছ ও সুন্দর মানুষ হবার নির্দেশনা পেয়েছ এবং তাদের জীবনের দিক পরিবর্তন হয়েছে!
বিশ্ববিদ্যালয়ের যে যুবক একবার আপনার সাক্ষাৎ পেয়েছে, সে অন্য পথের টানে পড়েছে। বাংলাদেশের ছেলেরা দলে দলে যখন বখাটে, উদভ্রান্ত, ডিজুস মার্কা হয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে। তখন এক দল যুবক সম্পূর্ণ ভিন্ন স্রোতে, হামলা-মামলার ভয়-ভীতি মাথায় নিয়ে আপনার পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছে। সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজে বাধাদান কারী সু-সংঘটিত, ভদ্র, শিক্ষিত ও মার্জিত বিশাল একটি কর্মী বাহিনী আপনি গড়ে তুলতে পেরেছেন। এরা অন্যায় করেনা বরং অন্যায়কারীরা তাদের ভয় করে। যারা নিজেরা ইভটিজার কিংবা লম্পট নয় বরং সকল চরিত্রহীন মানুষ তাদের সমীহ করে। যারা মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে রাজনীতি করেনা বরং সকল মিথ্যাবাদী, প্রতারক রাজনৈতিকেরা তাদেরকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে। বুঝতে বাকি নাই আপনার এই সাফল্যই আপনার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলাম ধর্মে এ ধরনের বিপদে বাঁচা-মরা দুটিই খুশীর খবর। আমরা দেখেছি আপনি এটিএন নিউজে দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ‘আল্লাহ ব্যতীত আপনি আর কাউকে ভয় করেন না। আপনি এমন কোন অপরাধ করেন নাই যার জন্য আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে এবং শহীদি মৃত্যু আপনার জন্য সম্মান ও কল্যাণ বেয়ে আনবে’। আপনার এই কথাগুলো ছিল যেভাবে দৃঢ়, সেভাবে প্রত্যয়ী এবং অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী। আপনার কথায় মনে হয়েছে, আপনি ধরে নিয়েছেন যে, বর্তমান সরকার সম্ভাব্য সকল পন্থা ব্যবহার করেই আপনার উপর নির্যাতন চালাবে। এটা নিশ্চিত জেনেও আপনি আপনার কর্তব্যের প্রতি সচেতন ও দৃঢ় ছিলেন!
আমি বিগত ৫/১১/২০১১ সালে ‘আর দুদিন বেশী বাঁচলেই যারা হতেন দালাল’ শিরোনামে লিখিত একটি প্রবন্ধে বলেছিলাম “বিএনপি মন্ত্রী আবদুল আলীম গোলাম আজমের সমকক্ষ, সম অপরাধী এবং সমান বয়সের অধিকারী হলেও আবদুল আলীম যেভাবে জামিন পেয়েছেন, গোলাম আজম সেটা পাবেন না! কেননা গোলাম আজম ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত এবং তার দল কোন অবস্থাতেই ভারতের তর্জনী হেলনকে ভয় পায়না’। ফলে দুই জনের শাস্তি, হেনস্তা, ধরণ প্রকৃতি দুই প্রকার হবে, তাতে কোন সন্দেহ নাই”! এই প্রবন্ধ বহু ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে এবং শত শত পাঠক তা শেয়ার করেছে। আমরা আপনাকে গ্রেফতারের শুরুতে অবিকল সেই আচরণ বাস্তবায়ন হচ্ছে এটা প্রত্যক্ষ করা শুরু করেছি। আপনি ভবিষ্যতে আরো কি কি অসুবিধা ও সমস্যায় পড়বেন তা একজন সচেতন পাঠক ধারনা করতে পারে।
বাংলাদেশে সবাই জানে, আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির রূপকার। একদা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান আওয়ামী সরকার বাংলাদেশে কেয়ামতের গজব নামিয়েছিল। হাজার কোটি টাকার সম্পদ জ্বালিয়েছিল। দুনিয়াতে সেই পদ্ধতির যথেষ্ট সুনাম হচ্ছে দেখে আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা সদম্ভে দাবী করেছিলেন, তিনিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবক্তা। তদানীন্তন বিরোধী দলীয় সম্মানিত নেত্রী ও রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে কটূক্তি করে বলেছিলেন, একমাত্র পাগল ও শিশু ব্যতীত কেউ নিরপেক্ষ নাই। বর্তমানে দেশে দিন বদলের হাওয়া লেগেছে, তাই সবকিছু উল্টো হয়ে গিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে গলা টিপে হত্যা করেছে আর সম্মানিত নেত্রী খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে রাস্তায় নেমেছে।
আপনি জেনে থাকবেন, যেদিন আপনি কারাগারে গেলেন ঠিক সেদিনই সম্মানিত নেত্রী খালেদা জিয়া আপনার বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে প্রেসিডেন্টের দরবার হলে ঢুকেছেন! ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক নিযুক্ত, গন আদালতের একজন পুরোধা এবং গায়ে পড়ে আপনার পক্ষের উকিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক আসিফ নজরুলের অফিসে তালা লাগানো হয়েছে, কক্ষে আগুন লাগানো হয়েছে। আসিফ নজরুলের অপরাধ ছিল, তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, আপনারই সতীর্থ মাওলানা সাঈদী কোন যুদ্ধাপরাধী নয়। কেননা তারা ১৯৯০ সালেই ব্যাপক তথ্য যোগাড় করার পরও তার বিপক্ষে কোন দলীল, সাক্ষী এমনকি কোন অভিযোগ পর্যন্ত পাননি।
জনাব, আপনাকে এমন বয়সে জেলে ঢুকানো হয়েছে, যে বয়সে জেলে থাকা চরম অপরাধী পর্যন্ত ক্ষমা পেয়ে যান। আপনি আবদুল আলীমের মত ক্ষমতাশালী মন্ত্রী ছিলেন না! আপনি কোনদিনই রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা কিছুই ভোগ করতে পারেন নি। তিনি আপনার মত বৃদ্ধ এবং সমান অপরাধী হওয়া স্বত্বেও আপনাদের দুই জনের জন্য দুই রকম প্রাপ্তি তথা তিনি তার ছেলের ঘরে রাত যাপনের সুযোগ পেয়েছেন আর আপনাকে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থাকতে বাধ্য করেছে।
আপনি যদি বেঁচে না থাকতেন এবং বিএনপি যদি অধিকতর দুর্বল দল হত, তাহলে বেচারা আবদুল আলীমকে এভাবে হেনস্তা হতে হতনা! তবে আপনার বয়স যদি দেড়শত বছরও হত তারপরও একজন বৃদ্ধ হিসেবে তাদের নিকট থেকে আপনি কোন প্রকার সুযোগ পেতেন না! আপনি প্রিজন সেল ভুলক্রমে পেয়ে গেছেন, জেলের জিল্লতীই হবে আপনার ভাগ্যের লিখন। কেননা সরকারের কিছু নাক চেনা মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য বলেই দিয়েছেন যে, 'আপনাকে রিমান্ডে নিয়ে কোন প্রশ্ন করার দরকার নাই, সরাসরি ফাঁসিতে লটকিয়ে দিন'! কেউ বলেছেন, সাক্ষী-সাবুদের দরকার নেই, পত্রিকার লিখা গুলো পর্যালোচনা করেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করুন! আপনার জন্য পত্রিকার লিখনই যদি ফায়সালা হবার মানদণ্ড হবে, তাহলে মাওলানা সাঈদীর জন্য কেনই বা সাক্ষী তালাশ করছে? তাঁর বিচার তো এভাবে খবরের কাগজের তথ্য দিয়ে করা সহজ ছিল! সুতরাং এক ব্যক্তির জন্য এক ধরনের বিচারের দাবী করার অর্থই হল, যেভাবে হোক আপনাকে ফাঁসানো হবে!
আপনি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভিনব এবং নির্যাতিত ব্যক্তি। আপনি কোনদিন কখনও ক্ষমতায় না থেকেও ক্ষমতাসীনদের দায়ভার আপনার কাঁধে পড়েছে। আপনি যেমনি অনেকের কাছে একজন বিশ্বসেরা ধর্ষক হয়েও গ্রীনিজ বুকে নাম লেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তেমনি আপনি অনেকের দৃষ্টিতে একজন বিশ্ব সেরা খুনি হয়েও আন্তর্জাতিক আদালতে আপনার নাম উঠেনি। তাদের দৃষ্টিতে আপনার অপরাধ ইয়াহিয়া ও টিক্কা খানকে হার মানিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আপনার নাম যতবার উচ্চারিত হয়েছে আইয়ুব, ইয়াহিয়া ও টিক্কা খানের নাম ততবার উচ্চারিত হয়েনি। আপনার সতীর্থরা আপনার সাথে নাগরিকত্ব হারিয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট, স্পীকার, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সকল প্রকার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে বসতে পেরেছে। আপনি তার সামান্য মাত্রাও পাননি। এমনকি জেলের মধ্যেও চরম অপরাধী যতটুকু সম্মান পাবে তার কানাকড়িও আপনার ভাগ্যে জুটবে না। অথচ বাংলার মানুষের ভাগ্য-উন্নয়নে আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ভবনে ও সংসদে আলোচনা চলছে আপনার দেখানো মতবাদ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি নিয়ে!
জনাব, আপনাকে টিভি চ্যানেল গুলো প্রশ্ন করেছিল, কেন আপনি শান্তি কমিটির দাওয়াত নিয়ে টিক্কা খানের কাছে গিয়েছিলেন? আপনি এসব অস্বীকার করেননি বরং স্বীকার করেই তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। আপনি দ্ব্যর্থ-হীন ভাবে বলেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে আওয়ামীলীগের সকল এমপি ও নেতারা জনগণকে অসহায়ত্বের মাঝে ফেলে দিয়ে ভারতে পালিয়েছিল। তারা না সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল না অসহায় হতাশাগ্রস্ত মানুষের মাঝে হাজির থেকেছিল! সেসব নেতারা যখন ভারতে বসে জানতে পেরেছিল এলাকা শত্রু মুক্ত হয়েছে, তখনই এলাকাতে হাজির হয়েছিল এবং মুক্তিযোদ্ধার খেতাব জুটিয়েছিল! আপনি সহ সকল ইসলামী দলের নেতারা সে সময়, যতটুকু সম্ভব মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছেন।
আপনার এই কথার বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগের কোন নেতা প্রতিবাদ করেনি। এমনকি কোন পত্রিকায় এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন পর্যন্ত তোলেনি! আমরা বুঝতে পারলাম তারা এ ব্যাপারে বেশী মাতামাতি করতে উৎসাহী নয়। তাদের এই মৌনতা বেগম খালেদা জিয়ার উক্তিকে প্রমাণ করে। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী নেতারা যুদ্ধের সময় কোন যুদ্ধ করেনি, ভারতে বসে আনন্দ ফুর্তি করে সময় কাটিয়েছেন’। তাঁর এই উক্তি শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে দিনই তড়িৎ বৈঠক করে নিজ দলের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, 'আওয়ামী নেতারা যে সব রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছে, সেটার বিস্তারিত বিবরণ খালেদা জিয়াকে দিতে এবং প্রমাণ করে দিতে যা ১৯৭১ সালে আওয়ামী নেতারা যুদ্ধ করেছিল! তার পরদিনই বিএনপির মিছিলে চরম হামলা করে প্রমাণ করে দিল যে, আওয়ামীলীগ নেতারা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিল! তবে আজ অবধি সে সব নেতারা সাংবাদিকদের ডেকে প্রমাণ করেন নি যে, তারা কে, কখন, কোথায়, কিভাবে যুদ্ধ করেছিল। জাতির কাছে এই প্রশ্ন দিন দিন বড় হতে থাকবে এবং তার উত্তর খুঁজতে থাকবে।
জনাব, আপনার বিচার আদালতের কাঠগড়ায় হবে, সেই বিচার দেখার প্রত্যাশায় রইলাম। তবে ইতিহাসের দুটি করুণ দিক তুলে ধরলাম জাগ্রত বিবেকের চেতনার প্রতি।
- তিউনিসিয়ায় ইসলামী আন্দোলনের নেতা রশিদ ঘানুসীকে, বেন আলী সরকার বহুবার ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল। ফল হল এমন যে, রশিদ ঘানুসী ফাঁসিতে তো মরেন নাই বরং তিনি নিজেই মৃত্যুদণ্ড উপভোগ করার জন্য বেন আলীর কোমা আক্রান্ত দেহের দিকে তাকিয়ে আছেন।
- মিশরের শাহ ফারুক জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে, ইসলামী নেতা হাসান আল বান্নার লাশকে দাফন করেছিল। ফল হল এমন যে, শাহ ফারুকের প্রতিও অবিকল একই অবিচার করা করেছিল আরেক জালিম শাসক জামাল আবদুন নাসের।
- সেই জামাল নাসের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে ইসলামী আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইসলামী আন্দোলনের প্রধান নেতা সাইয়্যেদ কুতুবকে গোপনে ফাঁসিতে লটকিয়েছেন। ফল হল এমন যে, সে দেশের অলি গলিতে এখন সাইয়্যেদ কুতুবের সাথীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং আমেরিকা তাদের কাছে, নাকে খত মারতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
- তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষ বাদী সরকার ও সামরিক জান্তা, নাজিমুদ্দিন আরবাকানের ইসলামী সরকারকে, প্রতি পদে নাজেহাল করেছিল। ফল হল এমন যে, দাড়ি মোচ বিহীন এমন এক শক্তির উদ্ভব হল, যারা মসজিদের জামায়াতে লাইন লাগিয়ে কাতার বন্ধী হয়ে দাঁড়ায় এবং সমুদয় অপবাদের মূলোৎপাটন করে। যাদের হাতে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ভূলুণ্ঠিত হল এবং সামরিক জান্তার প্রত্যেক দোষী সদস্যকে ইঁদুরের মত পাকড়াও করে জেলের প্রকোষ্ঠে ভরা হল।
- নতুন সৃষ্ট বাংলাদেশ সরকারের নিরাপত্তার জন্য, মিশর সরকার তখনকার বাংলাদেশ সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে আর্মি ট্যাংক উপহার দিয়েছিল। ফল হল এমন যে, এই ট্যাংক গুলো তাঁকে রক্ষার্থে কোন উপকারে আসেনি বরং এসব ট্যাংক তাঁদের বিরুদ্ধে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল।
এগুলো ইতিহাসের কিছু করুণ অধ্যায়। কে কার, কোন অপরাধের বিচার করবে কেউ জানেনা, তবে প্রতিটি প্রতিহিংসার একটি চরম প্রতিঘাত অপেক্ষা করে। আপনার বিচারের রায় কি হবে জানিনা, তবে আপনাকে স্মরণ করার জন্য লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত যুবক সৃষ্টি হয়েছে বাংলার বুকে। যারা আপনাকে চিরদিন মনে রাখবে, চিরদিন ভালবাসবে, সম্মান করতে থাকবে নিজের গরজে। আপনাকে এই শ্রদ্ধা পেতে রাষ্ট্রের কোন আইনের প্রয়োজন পড়বে না। আপনার লিখনি অনাগত যুবকদের জন্য হবে নতুন পথের দিশা এবং ঘটবে নব উত্থান। আপনি দীর্ঘজীবী হোন সত্য পথে চলার অনুসারীদের কাছে।
সুপ্রিয় পাঠক এই লিখাটি অধ্যাপক গোলাম আজমকে গ্রেফতার করার পর পরই লিখিত হয়েছিল। এই লিখাটি বহু ব্লগে লিখা হয়েছিল। প্রচুর মন্তব্য ও মেইল পেয়েছিলাম, তাই ঘটনাক্রমে সেটি সংরক্ষণ করেছি। সোনার বাংলাদেশ ব্লগ ব্যান করার আলামত পাচ্ছিলাম, তাই লিখাটি তড়িঘড়ি সংরক্ষণ করেছিলাম। তাই আজ আবারো সেই লেখাটি হুবহু প্রকাশ করলাম। ইতিহাসে দুটো জ্বলন্ত উদাহরণ দেখেছি। তথাকথিত বিচারে তুরস্কের ইসলাম পন্থি নেতা নাজিমুদ্দিন আরকাবানকে দোষী করেছিল কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে জানাজায় অংশ নিতে পুরো দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছিল। গোলাম আজমকেও দোষী বানিয়ে জুলুম করে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর মানুষের ঢল নেমেছিল বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে তাঁর জন্য আসমানের মালিকের কাছে লক্ষ লক্ষ হাত তোলা হয়েছে! অধ্যাপক গোলাম আজমের মৃত্যুর পর আবারো সেই কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, নেতা মরে যেতে পারে কিন্তু কোন অবস্থাতেই ইসলামী আদর্শ মরে না। একজন গোলাম আজম মরে গিয়েছে কিন্তু লক্ষ লক্ষ গোলাম আজম সৃষ্টি হয়েছে। এটা হল ইসলামের একটি মহান সাংস্কৃতি, যা শুধুমাত্র মুসলমানেরাই হৃদয়ে লালন করে।
একটি মন্তব্যের ফুটেজ দিলাম
বিষয়: বিবিধ
১৭২৭ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ব্লগে এতো লম্বা লেখা পড়তে বোরিং লাগে সাধারণত,কিন্তু আপনার অসাধারণ নান্দনিক আবেগময় আলোচনা অনেক বিষয়ে চোখ খুলে দিয়েছে।
মরহুম গোলাম আজম সাহেবের জান্নাতী উচ্চ মাকামের আর্জি জানাই মহান আল্লাহর দরবারে।
অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইরান আপনাকে।
সত্যি, মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবকে জালিম সরকার যতোটুকু অপদস্থ করতে চেয়েছে, মহান আল্লাহর রহমতে তিনি দেশবাসী ও দুনিয়াবাসীর নিকট তার চাইতে হাজার গুন সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন। বাংলাদেশের ৪৩ বছরের ইতিহাসে এই মহান ব্যক্তিত্বের মতো দুনিয়াব্যাপী সম্মান আজ পর্যন্ত কি অন্য কেউ পেয়েছে? সবাই নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুক..
আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুক।
আমীন
আমীন।
সুচিন্তিত, সুলিখিত পোস্ট। জাযাকাল্লাহু খাইরান।
তারপরও আপনার পরামর্শ মাথায় থাকবে, যাতে অনর্থক সময় নষ্ট না হয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন