স্কুলের শ্রেনীকক্ষেই সহপাঠিদের তাবিজ প্রশিক্ষন প্রদান! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-২৫ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৫:২৯:৩২ বিকাল
স্কুল কামাই করার বদ অভ্যাস ছিলনা তাই এত কিছুর পরও এখানে স্কুল কামাই করতাম না। ভয়ে হোক কিংবা দাপটে হোক স্যারেরা ক্লাসের পড়া তেমন একটা ধরতেন না! এই সুযোগটাই আমাকে স্কুল কামাই না করার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। যতটুকু সম্ভব পড়া তৈরি করে আনতাম, যেহেতু পড়াটা কেউ নিত না, তাই বুঝতে পারতাম না রেকর্ড কোন পর্যায়ের আছে। এ ধরনের একটি ঘন বর্ষার দিনে ক্লাসের সকল বন্ধুরা, একটি বিষয় নিজেদের চোখে দেখতে আমার কাছে আবদার করে বসল! ক্লাসের সবাই এক যোগে আমার কাছে দাবী করল, শত্রুকে বদ করতে ব্যবহার করা হয়, এমন একটি তাবিজ ব্ল্যাক বোর্ডে অঙ্কন করে যেন সবাইকে দেখাই!
উল্লেখ্য আমাদের স্কুলের মূল ভবন থেকে শিক্ষকদের জন্য নির্মিত ভবনটি একটু দূরে অবস্থিত। প্রায় দুইশত মিটার দূরত্বে একটি পৃথক ভবনে প্রধান শিক্ষক, সাধারণ শিক্ষক, ল্যাবরেটরি ও ছাত্রীদের জন্য বিশ্রামঘর তৈরি করা হয়েছিল। বৃষ্টির সময় শিক্ষক ও ছাত্রীদের ক্লাসে আসতে হলে, মাঠের উপর হয়ে খোলা আকাশের নিচ দিয়ে আসতে হত; এভাবে আসার সময় কাপড় ভিজে যেত। হালকা বৃষ্টিতে সমস্যা হত না, তবে যখন মুষল ধারায় বৃষ্টি নামত, তখন শিক্ষকদের জবুথুবু হয়ে ভিজে যাবার কারণে ক্লাস স্থগিত করতে বাধ্য হত।
আজো এক নাগাড়ে মুষল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রতিটি ক্লাসের আগের পিরিয়ড বাতিল হয়েছে, এখন যেহেতু বৃষ্টির মাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে, তাই সবাই নিশ্চিত হল, এই ক্লাসও বাতিল হবে। একে একে ক্লাসের সকল ছাত্ররা কিভাবে ঐক্যজোট হয়ে আমাকে ধরে বলল, আজ তুমিই ক্লাসের টিচার। আজকে আমাদের বিষয় হল, ‘তাবিজ ও তার ব্যবহার পদ্ধতি’! ব্ল্যাক বোর্ডে অঙ্কন করে আমাদের সবাইকে জানাও, কিভাবে তাবিজ অঙ্কন করতে হবে এবং তার ব্যাবহার বিধি কি হবে! যদি তুমি ক্লাসটি করাও, তাহলে আজ থেকে তোমাকে সবাই জেঠা মশায় হিসেবে ডাকব। যদি তা না কর তাহলে সবাই মিলে ভাঙ্গা জানালার ঐ ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির মাঝে বাহিরে ফেলে দেব! সুতরাং তুমি এবার ভাব কোনটা তোমার জন্য সম্মান জনক!
একজন ছাত্র খুব আদবের সাথে আমার হাতে একখানা চক ধরিয়ে দিল। অন্যজন বোর্ড পরিষ্কার করে দিল। ক্লাস ক্যাপ্টেন ওয়ান-টু-থ্রি বলে এক সাথে, এক যোগে, গভীর মনোনিবেশ ও কৌতূহলোদ্দীপক আকর্ষণ নিয়ে ক্লাসে বসে পড়ল। পুরো ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। চিন্তা করলাম যেহেতু স্যার আসার সম্ভাবনা নাই। সেহেতু একটি তাবিজের প্রশিক্ষণ তাদের দিয়েই দেই! পরবর্তী ক্লাস শুরুর অনেক আগেই ব্ল্যাক বোর্ড পরিষ্কার করতে সময় পেয়ে যাব।
ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে বললাম, যেহেতু এই ক্লাসে বহু ধর্মের মানুষ আছে, তাই আরবি অক্ষরের তাবিজের প্রশিক্ষণ না দিয়ে বাংলা অক্ষরের কাছাকাছি তথা সংস্কৃতি ভাষার অক্ষরে একটি তাবিজ প্রশিক্ষণ দেই। তাবিজের বিষয় হল, ‘শত্রু বধ’। কিভাবে একজন শত্রুকে বধ করতে হবে তার বিষদ বিবরণ ও ব্যাখা এখানে থাকবে।
যথারীতি বোর্ডে তাবিজ আঁকা শুরু হল। নিয়ম অনুযায়ী তাবিজের মাঝখানের গোল চিত্রে যাকে বধ করতে হবে, তার নাম লিখতে হয়। যখন গোল বৃত্তে আসলাম তখন ছাত্রদের বললাম এই ঘরে শত্রুর নাম লিখতে হবে। ছাত্ররা বলল, ঘরটি খালি না রেখে, উদাহরণ হিসেবে বুঝার জন্য কোন একজনের নাম লিখে দাও। প্রশ্ন করলাম কার নাম লিখব? একজন বলে উঠল, সুমনের নাম লিখ! কেননা সে ক্লাসের স্যারদের জন্য বেত বয়ে আনে। তাছাড়া সে ক্লাসের সকল কথা স্যারদের বলে দেয়। দুষ্ট একজন একথা বলার সাথে সাথেই ক্লাসের অন্য সবাই, এক যোগে, সহাস্যে সে কথায় সমর্থন জানাল। দাবী উঠল উদাহরণ হিসেবে তার নামই বসাতে হবে, এটাই যুক্তিযুক্ত! হতে পারে, এতে করে তার বে-আকলী পনা দূর হয়ে যাবে!
সুমন! খুবই ভদ্র! প্রতিটি ক্লাসেই যথারীতি যোগদান করে। লেখাপড়ায় মোটামুটি ভাল, তবে স্বভাবে শান্ত হলেও সব কিছু দেরীতে বুঝে বলে ক্লাসের সবাই তাকে নিয়ে সমস্যায় পড়ে। বন্ধুরা সবাই সাবালক হলেও সে এখনও নাবালক! সাবালক ছাত্রদের বিভিন্ন গোপনীয় কথা সে কৌতূহলে মনদিয়ে শুনে, কিন্তু সে এ সবের কোন গুরুত্ব বুঝে না, বরং এসব কথাকে বেয়াদব ছাত্রদের অশ্লীল আচরণ ভেবে স্যারদের কানে তুলে দেয়! আবার তাকে সে সব কথা শুনতে বারণ করলেও, সে মনে করে সবাই তাকে শত্রু ভাবছে! একদা বাংলা দ্বিতীয় পত্রের ক্লাসে বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি যাচাই করতে বাংলা শিক্ষক হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন, ধাতু কাহাকে বলে? সুমনের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর জানা নাই তাই তড়ি ঘড়ি উত্তর জানতে, তারই পাশে বসা ক্লাসের সবচেয়ে অকাল পক্ষ ও ইঁচড়ে পাকা ছাত্র রবিউলের দ্বারস্থ হল। রবিউল এমনিতেই বে-আকল বলে বরাবরই বদনাম ছিল। সে নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর জানেনা, তারপরও সে নিরীহ গোবেচারা সন্ত্রস্ত সুমন কে তার ফিসফিস করে ধাতুর একটি সংজ্ঞা বলে দিল। ফিসফাস করা অমনোযোগী উভয় ছাত্রের প্রতি স্যারের নজর গেলে পর, স্যার সুমনকেই প্রশ্ন করে, ধাতু কাহাকে বলে?
সুমন সটান দাড়িয়ে, বড় গলায় স্পষ্ট আওয়াজে ধাতু কাহাকে বলে তার ব্যাখা করল। উল্লেখ্য সুমনের বলা পুরো বাক্যটি ইতরামিতে ভরা! লিখার অযোগ্য, বলা দুঃসাধ্য! এমন একটি বাক্য যোগে সে যেভাবে ধাতুর ব্যাখা দিল তা শুনেই স্যারের চোখ যেন লজ্জায় ফেটে বের হবার দশা! ক্লাস ভরা এতগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে স্যার কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না! স্যার কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললেন, কি?...... সুমন ভাবল স্যার হয়ত প্রশ্নটি বুঝে নাই, সে আবারো সটান দাড়িয়ে বলা শুরু করল, ‘ঘর্ষণে ঘর্ষণে মহা ঘর্ষণের ফলে, যে সাদা তরল....... স্যার মুহূতেই কক্ষফাটা বিকট চিৎকার দিয়ে বলল, চুপ..................!
স্যার প্রচণ্ড গোস্বা মাথায় নিয়ে প্রশ্ন করল, এই উত্তর তোমাকে কে শিখিয়েছে? সুমন কোন ভয় ও ভণিতা না রেখে সাহসিকতার সাথে বলে দিল, রবিউল! স্যার রাগে থর থর করে, সুমনকেই বলল, স্কুলের সকল বেত এক্ষুনি ক্লাসে হাজির কর। সুমন বেত সংগ্রহে ভৌঁ দৌড়! ওদিকে সুমনের বেত নিয়ে আসতে দেরী হওয়াতে, স্যার আগ বাড়িয়ে বারান্দায় বেরিয়ে খবর নিতে গেলেন, অমনি সেই ফাঁকে রবিউল আলম ক্লাস থেকে বের হয়ে স্কুলের মাঠ ছিঁড়ে ভৌঁ দৌড়। বরিউল আলমের সে ভৌঁ দৌড়ের পর তাকে আর স্কুলে দেখিনি। তবে, কলেজ জীবনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শহীদ মিনারে একজন দলীয় নেতা হিসেবে বক্তৃতা দেবার সময় বেফাঁস কথা বলায়, সতীর্থদের হাতে হেস্তনেস্ত হতে দেখেছি। বুঝলাম মানুষের বয়স বাড়লেও খাসিয়ত পরিবর্তন হয়না। ব্যাংক কর্মকর্তা সুমন, দুই ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবার সময় প্রশ্ন করেছিলাম, কিরে সুমন! কি হয়েছে? উত্তরে বলেছিল, ছেলেগুলো বড় হয়েছে বটে এখনও বয়স অনুপাতে কাণ্ডজ্ঞান হয়নি! সেখানেও বুঝলাম, পরিণত বয়সে মানুষ বুদ্ধিমান হলেও, সন্তানেরাও কদাচিৎ পিতার মত কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ বংশগত ভাবেই অর্জন করে।
বেয়াদবের সাথে কিছুটা উঠা বসা করা যায় কিন্তু বে-আকলের সাথে চলা ফেরা করা কখনও বিরাট লজ্জার কারণ হয়। স্যারেরা কখনও অনেক কথা শুনেও না শুনার ভান করে! কিন্তু সুমনের কথা না শুনে উপায় ছিলনা। সেদিন কাণ্ডজ্ঞানহীন সুমন যে কথা গড়গড় করে বলে ফেলল, সে কথা একজন পরিপক্ব ছাত্রকে পঞ্চাশ ঘা বেত মেরেও বলানো যেত না! ক্লাসের ছাত্রদের মাঝে বয়সের তফাৎ যদি উপরে নিচে হয়, তাহলে সে জন্য কত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, তা একমাত্র ভুক্তভোগী ব্যতীত কেউ বলতে পারবেনা। আমাদের ক্লাসের ছাত্ররা এই সুমনের জন্য নানা কারণে নিজের কান ধরা, অন্যের কান মলা সহ নানাবিধ শাস্তি পেত। যাক, আমি সুমনের বদনামী কিংবা রবিউলের বে-আকলী নিয়ে লিখতে বসি নাই! বলছিলাম ক্লাসের ব্ল্যাক বোর্ডের তাবিজে সুমনের নাম লিখতে হবে, সেই ঘটনার কথা।
আমি যুতসই করে সুমনের নামটি তাবিজের মাঝখানে বসিয়ে তাবিজের গতি অব্যাহত রাখলাম। আমি নিবিড় মনে তাবিজের চিত্রটি অঙ্কনে ব্যস্ত, এমন সময় মনে হল পিছনে কেউ গোঙ্গানির মত কান্না করছে! তড়িৎ পিছনে তাকালাম! দেখি সুমন পিছনের বেঞ্চে বসে কান্না করতে করতে শার্ট ভিজিয়ে ফেলেছে! আমি তার কাছে গেলাম এবং বুঝিয়ে বললাম এটা আনন্দ করার লক্ষ্যে লিখা হয়েছে! এই তাবিজে তোমার কোন ক্ষতি হবেনা। তাবিজ তো কাগজে লিখতে হয়, সেই তাবিজ কৌটায় ঢুকিয়ে সাথে রাখতে হয়, তারপর মন্ত্র পড়ে পানি দিতে হয়। আর এই তাবিজ তো বোর্ডে লিখা হয়েছে, সেটা তো নামিয়ে ব্যবহার করা যাবেনা, ইত্যাদি। আমার এই কথা শুনার পর তার কান্না আরো বেড়ে গেল! ইতিমধ্যে অনেক ছাত্র ব্ল্যাক বোর্ড থেকে তাবিজটি নিজেদের নোট বুকে টুকিয়ে নিল এবং কেউ কেউ বলতে থাকল ভবিষ্যতে এই তাবিজ দিয়েই সুমন কে সোজা করা যাবে! এতে করে সুমনের কান্না বন্ধ করানোর মত পরিস্থিতি আর আমার আয়ত্তে রইল না। তারপরও তাকে বুঝাতে লাগলাম, পিটে হাত বুলালাম।
খানিক পর মনে হল, কেন জানি ক্লাসে পিন পতন নীরবতা নেমে এসেছে! পিছনে ফিরে দেখি আমাদের বাংলা স্যার ক্লাসে ঢুকে ব্ল্যাক বোর্ডের তাবিজ পড়ায় মনোনিবেশ করেছেন! সুমনের কান্না থামাতে গিয়ে, বোর্ডের তাবিজ মুছে ফেলার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম! পিনপতন নীরবতায় স্যারের নজর বোর্ডের দিকে আর সুমন টেবিলের উপর মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সকল ছাত্ররা বোবার মত বসে আছে, আমি কি করব বুঝতে পারছিনা! মনে পড়ল রবিউলের কথা। একদা রবিউল, এই ধরনের একটি ক্লাস থেকেই তো ভৌঁ দৌড়ে পালিয়েছিল। রবিউলের অপরাধ আর আমার অপরাধ নিশ্চয়ই এক নয়। তাছাড়া তখন ছিল শুকনো মৌসুম এখন তো মুষল ধারায় বৃষ্টির মৌসুম। নানাবিধ কারণে রবিউলের মত আমার পক্ষে পালানো সম্ভব নয় সুতরাং যাই ঘটে কপালে, তা মেনে নেবার জন্য মনকে স্থির ও ধীর করে অপেক্ষা করলাম।
অজিত স্যার বাংলা প্রথম পত্রের শিক্ষক, তিনি সংস্কৃত ভাষারও পণ্ডিত। ক্লাসের হিন্দু ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত সংস্কৃত ক্লাস তিনিই নিয়ে থাকেন। নামে সংস্কৃত ক্লাস হলেও, ছেলেরা কেউ এই বিষয়টা নিয়ে আগ্রহী ছিল না। স্যারের শত চেষ্টার পরও হিন্দু ছাত্ররা না সংস্কৃত পড়তে পারত, না বলতে পারত। ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে নেবার মতলবে সংস্কৃত কে বাছাই করত। আমাদের মৌলভী স্যার মুসলিম ছাত্রদেরকে আরবিতে সর্বদা আশির উপরে নম্বর দিতেন, অজিত স্যার প্রতিযোগিতা করে সংস্কৃত বিষয়ে হিন্দু ছাত্রদের নব্বই মার্ক দিতেন! এভাবে দুই স্যারের মাঝে অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলতে থাকত! ছাত্ররা পরীক্ষায় নম্বর পেত বটে কিন্তু তারা ‘না আরবি বলতে পারল আর না সংস্কৃত শিখতে পারল’! স্যারের দীর্ঘ মৌনতার কারণে আমি ভাবতে রইলাম। স্যারের একপাল অযোগ্য অদক্ষ সংস্কৃত ছাত্রদের মধ্য থেকে এমন পরিষ্কার ভাষায় সংস্কৃতির লেখক তার মুসলিম ছাত্রদের মাঝে আছে, সেটা নিয়ে তিনি হয়ত চিন্তা করছেন! হঠাৎ তিনি ছাত্রদের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন ‘এসব ভীতিকর কথা কে লিখেছে’? চোখ তাঁর লাল এবং পুরো শরীরে কম্পন দেখে আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ‘এটা কি গোস্বার কম্পন নাকি ভীতির স্পন্দন’! ব্যাপারটি খোলাসা করার জন্য আমি ব্যাখা করতে যাব কিন্তু আমার মুখ খোলার আগেই; ক্লাসের সকল ছাত্রদের মধ্যে প্রকৃত ঘটনাটি কার আগে কে বলবে সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল!
ভাবলাম এসব কি হচ্ছে? এসব ছাত্র বন্ধুদের প্ররোচনায় কিছুক্ষণ আগেই আমি তাবিজ লিখেছিলাম! এখন সবাই আমার বিপক্ষে গিয়ে আমার ক্ষতি করতে দাড়িয়ে গেছে! বিশ্বাসই হচ্ছিল না! স্যার একজনকে সুযোগ দিলে পর সে বলতে রইল: ‘এটা এক প্রকার তাবিজ, যা সুমন কে শায়েস্তা করার জন্য লিখিত হয়েছে’! এই তাবিজ দিয়ে কিভাবে ক্ষতি করা যায় বিস্তারিত ব্যাখা সে দিল! আমার ইতি-পূর্বেকার আরো তাবিজীয় দক্ষতা ও যাদুকরী ক্ষমতার কথা শ্রেণীকক্ষে অনেকেই বলতে রইল! একজনের মুখ বন্ধ হয় তো, অন্যজনের মুখ খোলে যায়! আমি পাথরের মুর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে আমারই অপূর্ব ক্ষমতা, যাদুকরী দক্ষতা, সম্মোহনের সক্ষমতার কথা আমার ক্লাসের বন্ধুদের মুখে শুনতে রইলাম! অন্যদিন ছাত্রীরা অকারণে হাসাহাসি করলেও, আজ তারাও গম্ভীর এবং ব্যাপারটার গভীরে যাবার চেষ্টা করল! এক পর্যায়ে এত ভয়ানক সুনাম শুনতে শুনতে আমার কাছে মলে মনে হল, আমি নিজেই যেন আলিফ লায়লার সেই সিন্দাবাদ! আমার এত বিপুল ক্ষমতার কথা শুনে আমি নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কোন জগতের মাটিতে আমি দাঁড়িয়ে আছি!
স্যারের কম্পনটা যেন আরো একটু বেড়ে গেল! তিনি হাতের আঙ্গুল গুলোকে একস্থানে রাখতে পারছিলেন না। বুঝতে পারছি এটা সু-স্পষ্ট আতঙ্কের লক্ষণ। তখনই সুমনের মোহ ভাঙ্গল! এতক্ষণ সে বুঝে উঠতে পারছিল না কি করা উচিত। যখনই সে বুঝতে পারল, পুরো পরিবেশটাই আমার বিপক্ষে চলে গেছে। তখনই সে হঠাৎ লাফ দিয়ে স্যারের দিকে দৌঁড়ের মত করে তেড়ে আসতে লাগল। আর কান্না জড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘অ’ স্যার আমারে বাঁচান! শান্ত সুমনকে এভাবে অশান্ত অবস্থায় তেড়ে আসতে দেখে, স্যার মনে করলেন, এটা বুঝি তাবিজের খারাপ প্রভাব! আমার তাবিজ বাস্তবিকই তাকে পাগল করে দিয়েছে! সুমন স্যারের দিকে যাচ্ছিল, আর অজিত স্যার শ্রেণী কক্ষ থেকে বারান্দার দিকে পিছু হঠতে লাগলেন। স্যারের চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছিল, তিনি দরজার কাছে পৌছা মাত্রই দৌড় লাগাবেন! মুহূর্তেই তাই ঘটল। দরজার নিকটে পৌঁছেই দিলেন দৌড়! তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, এটা বর্ষা কাল! ফলে বৃষ্টি ভেজা পিচ্ছিল ফ্লোরে টাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে এক বিশাল আছাড় খেয়ে বসলেন! ভিজা বারান্দার ফাঁকা মেঝেতে ব্যাপক পিচ্ছিলতার কারণে, তাঁর স্থূল দেহটি ছেঁচড়িয়ে এক শ্রেনী কক্ষের দরজার সামনে থেকে আরেকটি শ্রেণী কক্ষের দরজার নিকটে গিয়ে থামল। মনে হল তিনি হুশ হারিয়েছেন, মুখে ফেনা এসে গেছে!
আমি তখনও আগের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। সকল ছাত্ররা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মুহূর্তে কি হতে কি হয়ে গেল। কেউ হিসেব মিলাতে পারছে না! সুমনের দিকে তাকালাম, সে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে অপরাধীর মত দু’হাত জোড় করে আমার সামনে দাড়িয়ে আমার! কৃপা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে! সে যে স্যারের কাছে সাহায্য চেয়েছিল, সেই স্যারের এমন ধপাস পতনকে, আমার জাদুকরী প্রভাবের ফল ভেবেই সে এভাবে হাত জোড় করেছে! তখন আমি ভাবছি অন্য কথা! রবিউল এর চেয়ে ভয়ানক অপরাধ করেও, পরবর্তীতে ক্ষমা চেয়ে পুনরায় স্কুলে রীতিমত হয়েছিল। তবে আমার অপরাধের একমাত্র মাশুল হবে, শাস্তি সমেত এই স্কুল ত্যাগ করা! গত সপ্তাহে বাবাকে বলেছিলাম, সোনা-দানার ডেক নিয়ে, এই এলাকার পরিবেশ আমার জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছিল। আমাকে যথারীতি পূর্বের স্কুলে স্থানান্তর করবেন বলে তিনি প্রায় নিমরাজি ছিলেন।
হুশ ফিরে আসার পর স্যার প্রলাপ বকতে রইলেন! তিনি আর এই স্কুলে শিক্ষকতা করবেন না এমনকি ঐ ছাত্রকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হলেও। তারপর দিন থেকে অজিত স্যার আর আমি সেই স্কুলে চিরদিনের জন্য অনিয়মিত হয়ে গেলাম! এভাবে এক হাস্যকর ঘটনার মাধ্যমে একজন ছাত্র ও শিক্ষকের স্কুল জীবনের যবনিকাপাত হল। নিজে নিজের ঠোঁট কামড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, আর নয় যথেষ্ট হয়েছে। তাবিজ-কবজ, জ্বিন-ভূত, মন্ত্র-দোয়ার যত সামগ্রী আছে তা সবই আগুনে পোড়াব। জীবন গেলেও কাউকে এই ব্যাপারে একটি কথাও বলব না। জীবনে যত কষ্টই আসুক, সৎ ও সততার উপর দৃঢ় হতে চেষ্টা করব। সামান্য কৌতূহল থেকে আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম! তাছাড়া বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন আমার সম্পর্কে এক অবাস্তব ও অদ্ভুত ধারনা পোষণ করে চলছে! আজকের ক্লাসের বন্ধুদের মুখে আমার সম্পর্কে যে সব আজগুবি ও গাঁজাখুরী খ্যাতির কথা যা শুনলাম, তা শুনে আমি নিজেই ‘থ’ হয়েছিলাম! এভাবে অন্যান্য মানুষেরাও যে, একই ধরনের ধারনা করে যাচ্ছে না, তা কিভাবে নিশ্চিত হতে পারি। এ থেকে উত্তরণের একটিই উপায়, মানুষের কাছে বলে বেড়ানো যে, আমার কাছে জ্বিন ছিল, তার প্রভাবেই এটা হয়েছে এবং বর্তমানে সে জ্বিন আর নাই। উপরন্তু আগে আমার কাছে যে ক্ষমতা ছিল এখন সে ক্ষমতাও নাই, আমি এখন পরিপূর্ণ ক্ষমতাহীন এক বালক! পরবর্তী সময়ে বাবার পরামর্শে আমার পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রকাশ্য স্বীকারোক্তিকে কম-বেশী সবাই বিশ্বাস করল। ধীরে ধীরে আমার ব্যাপারে সবার অতি আগ্রহ স্তিমিত হয়ে গেল! তবে........
সুন্দর সাহেবের সিলার যে ঘটনা দিয়ে আমার এই বিদঘুটে জীবনের শুরু হয়েছিল। তার একটা শেষ দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল। সেখানকার কিছু ঘটনা নিয়ে, মুরুব্বীদের কাছে অনেক প্রশ্ন করার ছিল, কোন উত্তর পাইনি। সিদ্ধান্ত নিলাম এবার একাকী নিজেই গিয়ে দেখে আসব, সম্ভব হলে মানুষকে বুঝাব এবং এ সবের গোমড় ফাঁস করব! ছোট্ট সরু ছিদ্র দিয়ে কিভাবে সুন্দর শাহের মত একটি ব্যক্তি পালাতে পারে? সে প্রশ্ন আমি সেখানকার খাদেম থেকে আদায় করেই ছাড়ব। আগামী পরশু সেখানে ঘটা করে ওরস উৎযাপন হবে, গ্রামে গ্রামে সর্বত্র পোষ্টার ছাপানো হয়েছে। এই বার প্রথম পোষ্টার ছাপানো হল, ইতিপূর্বে কখনও এমনটি দেখিনি। যাক ওরসে যাব এবং এবং এর একটা গতি একটা করতেই হবে বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। ওরসের দিন সিলায় গিয়ে দেখলাম, হাজার হাজার মানুষ। চারিদিকে মেলা, সেই পুরানা খাদেম প্রমোশন পেয়ে এতদিনে দরবেশ হয়ে গেছে! তাঁর সাথে দেখা করতে আগে টাকা দিতে হয়। প্রচুর গুণগ্রাহী তাকে পরিবেষ্টন করে আছে! এমনকি তাকে সেবা যত্ন করার জন্য আরো বহু নতুন খাদেমের জন্ম হয়েছে!
পরবর্তী জীবনে, অজিত স্যারের বাড়ী কোথায়, সেটা উদ্ধারের বহু চেষ্টা করেছি, পারি নাই। আমার ইচ্ছা ছিল, তাঁর কাছে গিয়ে ঘটনাটি বিস্তারিত বলে, ক্ষমা চেয়ে আসব। আমি এ ব্যাপারে লেগেই ছিলাম তবে কোন হদিশ পাইনি। কলেজ জীবনে এসে আমার এক স্কুল বন্ধুকে পাই, যে ক্লাসের সে ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল। সে আমাকে আরেকটি সুন্দর তথ্য দিয়ে জানাল যে, সেই অজিত স্যারের আপন ছোট ভাই হল, আমাদের কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রভাষক! মনে হল আল্লাহ একটা সুযোগ করে দিয়েছেন! স্যারের সাথে কথা বলে জানতে পারি তাঁর বড় ভাই বাড়ীতে থাকেন এবং তাদের বাড়ীটি সড়কের পাশেই। অজিত স্যারের সাথে দেখা করার জন্য কয়েকবার গিয়েছি, তবে প্রতিবারই তাকে পেতে ব্যর্থ হয়েছি। বিদেশে চলে আসি, এক পর্যায়ে বিয়ে শাদী করে সংসারী হয়েছি। ট্যাক্সিতে চড়ে, নববধূকে নিয়ে প্রথমবার যখন শহরে যাচ্ছি, দেখলাম অজিত স্যার সাইকেল চালিয়ে বিপরীত দিকে ছুটেছেন। গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে গিয়ে তাঁকে ধরি ও বিস্তারিত বলে ক্ষমা চাইলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, তোমাকে দেখার আমারও সখ ছিল! ভগবানের কৃপায় তা হয়ে গেল। চৌধুরী পরিবারের সন্তান অজিত স্যার অনেক ভূ-সম্পত্তির মালিক। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে, ভাইয়েরা বাহিরে থাকে, তিনি সবার জমি-ঝোলা দেখাশুনা করেন। অর্থকড়ির অভাব কোনদিনই ছিলনা। অনুরোধ করলাম বাজার থেকে বাড়ীতে যাবার সময় যেন, কিছু মিষ্টি কিনে নিয়ে যান, সেজন্য মিষ্টির টাকাটা জোড় করে তাঁর পকেটে ঢুকিয়ে বিদায় হলাম।
দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ!
আগের পর্ব: লাট সাহেবের বাংলোয় জ্বিনের আক্রমণ! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-২৪ পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।
বিষয়: বিবিধ
২৮১৩ বার পঠিত, ৩২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে আগের পর্বগুলো সময় নিয়ে পড়ে মন্তব্য করব ইনশা আল্লাহ।
ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মতই লেগেছে।
ধন্যবাদ।
পর্বগুলোর একেবারে প্রথটি থেকে শুরু করতে চাচ্ছি পড়াটা।
অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
অদ্ভুত ভাবে যার নাম দেওয়া হলো তার পরিবর্তে তাবিজদাতা আর নিরিহ একজনের উপর ক্রিয়া করে বসল!!!তবে মনে হয় আপনার শিক্ষক নিজেও এই ধরনের তাবিজে বেশি বিশ্বাস রাখতেন তার ফলেই এটি তার উপর মানসিক চাপের সৃষ্টি করেছিল।
অনেক অনেক শুভকামনা
মন্তব্য করতে লগইন করুন