এক প্রবাসীর উপবাস ও বানভাসি যাত্রা!
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০২:২৫:৪৯ দুপুর
পাঠকেরা নিশ্চয়ই কেউ বানভাসি যাত্রার কথা শুনেন নাই, আমারও বিশ্বাস যে, এই শব্দটির সাথে কেউ পরিচিত নয়! আসলে সত্যি বলতে কি, ঘটনাটা না ঘটা পর্যন্ত আমিও এই শব্দের সাথে পরিচিত ছিলাম না! অতঃপর ভাবলাম বানভাসি যাত্রার বিব্রতকর অভিজ্ঞতার কথা তুলে না ধরলে রাস্তা-মাঠ-ঘাটের মত বন্যার পানিতে আমার ঘটনাটিও তলিয়ে যাবে।
আচানক সুযোগ ঘটা, হঠাৎ সিদ্ধান্ত এবং তড়িৎ বাস্তবায়নে গ্রামের বাড়ী যাবার সুযোগ ঘটেছিল। তাই ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও অনেক জনকে তা জানাতে পারিনি। ইচ্ছা ছিল দেশে গিয়ে সুবিধাজনক সময়ে সবার সাথে দেখা করব। কক্সবাজার ও রাঙ্গামাটি ঘুরতে যাব।
পৃথিবীর কয়েকটি দেশের নামকরা শহুরে বসবাস করেছি, ছাত্র জীবনে বেড়ে উঠেছি শহরে। স্ব-পরিবারে প্রবাসী হবার আগ পর্যন্ত পিতা-মাতার আগ্রহে পরিবার ছিল শহরে কিন্তু তারপরও আমার কাছে গ্রামের ভাল লাগা ছিন্ন হয় নাই। পিতা-মাতার মৃত্যুর পরেই পরিবারকে বিদেশে নিয়ে আসি। গ্রামে আমার ঘর-বাড়ি সবই আছে। ভাইয়েরা সবাই পৃথক হলেও, আমার খালি ঘর গুলো মেহমান খানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুটি তালা বদ্ধ আলমারি ব্যতীত খাট, পালঙ, সোফা, লাইব্রেরী সবই উন্মুক্ত। হঠাৎ বিদেশ থেকে গেলেও, যে কোন পরিস্থিতিতে রান্না-বান্না আপ্যায়ন করার ব্যবস্থা আগে থেকেই করা আছে। সংসারের টুকিটাকি সবই আছে! বড় দুই ভাবী এসব দেখভাল করে।
প্রতি নিয়ত শয়নে, স্বপনে, জাগরণে সর্বদা বাংলাদেশের একটি গ্রামের প্রতিচ্ছবি দেখি। আমার স্ত্রী-পুত্র ছোট কাল থেকে শহরে বড় হবার পরও গ্রামীণ জীবনকে তাদের বেশী ভাল লাগে। ইতিপূর্বে বহুবার তার নজির রেখেছে। পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, আমার চিরস্থায়ী ঠিকানা তথা কবরটি হবে আমাদের গ্রামের মসজিদের পাশের সেই কবরস্থানে। এই মসজিদের অনাগত মুসল্লিরাই হতে পারে আমার জন্য মুক্তির কারণ। ফলে এয়ারপোর্ট থেকেই সরাসরি গ্রামের বাড়ীতে চলে গিয়েছিলাম। ভাবীদের আপত্তি থাকার পরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এবার গ্রামের বাড়িতে নিজেরাই নিজেদের মত রান্না করে খাব। সে জন্য সব আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। এই কাজের উদ্দেশ্য ছিল, গ্রামীণ জীবনে গৃহস্থালি করতে গেলে, কি কি পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে এবং সে সব কিভাবে মোকাবেলা করা যাবে তার একটি ডেমো অভিজ্ঞতা অর্জন করা! গ্রামের পড়শিদের আনন্দ দেওয়া, তাদের কাজকে শ্রদ্ধা করা। বিগত পঁয়ত্রিশ বছরের অধিক কাল ধরে আমি গ্রামের বাহিরে এবং আমার স্ত্রী শহুরে জীবনে অভ্যস্ত। তাই এটি আমার ছোট্ট পরিবারের জন্য প্রয়োজন ছিল।
শাশুড়িকে বলে রেখেছিলাম, আমার সাথে সোজা আমাদের গ্রামেই চলে যেতে হবে। এতে করে আমার স্ত্রী-পুত্র দীর্ঘ সময় তাদের সান্নিধ্য পাবে। তাছাড়া তিনি আমার সকল ভাই-ভাবী ও তাদের সন্তান দের কাছে খুবই প্রিয় ব্যক্তি। প্রথম তিন দিন ফুফু, খালাম্মা, চাচী, মামী সহ আমার মায়ের সহপাঠী সকল মুরুব্বীদের সাথে দেখা করেছি। এটা আমার মায়েরই শিক্ষা ছিল, ছাত্রজীবনেও গ্রামে গেলে এবং গ্রাম থেকে শহরে ফিরে যাবার আগে তাদের সাথে দেখা করাটা আমার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে মামা, চাচা, খালু, ফুফারা এখন আর কেউ জীবিত নেই। গ্রামের প্রতিটি অলি-গলি মেঠো পথ দিয়ে, আমার স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছি। যদিও এখন গ্রামে সবাই রিক্সায় চলাচল করে। ছেলেকে আমার বাল্যকালের সকল স্মৃতি বিজড়িত স্থান গুলো দেখিয়েছি। আমার সকল স্কুল গুলো কোথায় এবং কত দূরত্বে অবস্থান তাও দেখিয়েছি। আমাদের বাড়ীতে যতজন চাকর-চাকরানী ছিল সম্ভাব্য তাদের সকলের বাড়ীতে গিয়েছি। চাকর-চাকরানী হলেও তখনকার দিনে তাদের আচরণ ঘরের সক্রিয় সদস্যদের মত হত। সকলের সাথে আমার হৃদ্যতা ছিল অপরিসীম। তাদেরই একজন চাকর এখন আমার চেয়েও বহু গুনে বেশী সম্পদশালী! একজন চাকরানীর অবস্থা এতই ভাল যে, তাঁর ছেলে এখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়া করে! তাদের ছেলেদের সাথে আমার ছেলে পরিচিত হতে পেরে সে খুবই আনন্দ অনুভব করছে। ছেলেটি তাদের ফুফু, মামী, চাচী ও খালাম্মাদের কাছে বেশী জানতে চেয়েছে তার পিতা ছোট কালে কেমন ছিল! বস্তুত আমার ছোট কালের অনেক সামগ্রী এখনও বহাল তবিয়তে আছে, যা আমার আম্মা সংরক্ষণ করেছিলেন পরে তিনি এসব পুত্রবধূকে হস্তান্তর করেন।
১২ তারিখ সন্ধ্যার আগেই, গ্রামে অবস্থিত সকল আত্মীয়ের সাথে দেখা সাক্ষাৎ শেষ করার মাষ্টার প্লান হাতে নিয়েছিলাম। আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহ আমাকে তা যথাযথ পূর্ণ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। এবারে চান্দ্র মাস আর সৌর মাসের তারিখ প্রায় মিল ছিল। পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নার সুযোগ নিতে পেরেছিলাম। আমার ছেলেটি টিউব লাইটের আলোর মত এত ব্যাপক আলো মিশ্রিত জ্যোৎস্না ইতিপূর্বে দেখেনি। জ্যোৎস্নাময় প্রতিটি রাত গভীর হওয়া পর্যন্ত উঠানে বসে সবার সাথে আলাপ করেছি। উঠানের চারিদিকে ফুল গাছ আছে, সন্ধ্যা মালতী গাছে এত ফুল ফুটেছে যে, গাছের পাতাই দেখা যাচ্ছিল না। এই স্মৃতি বাকী জীবনেও কোনদিন ভুলব না।
পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল ১৩ তারিখ সকালে শহরে চলে যাব এবং সকল বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী ও ব্লগারদের সাথেও দেখা করে আসব। পরে সুবিধা জনক সময়ে পুনরায় গ্রামে ফিরে আসব। ১২ তারিখ দুপুর থেকেই হঠাৎ করে মুষল ধারায় বৃষ্টি শুরু হল। রাত অবধি এই বৃষ্টি বন্ধ হবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। বৃষ্টির মৌসুম আমার এমনিতেই খুবই পছন্দ। ফলে সবাইকে নিয়ে অবিরাম বৃষ্টি উপভোগ করতে পেরে খুবই মজা লাগছিল। পাকা বাড়ীতে বৃষ্টির আওয়াজে মজা আসে কম, আমি বড়-সড় প্রসস্থ রান্নাঘর পছন্দ করি তাই রান্নাঘরটি বড় করেই বানানো হয়েছে। ঢেঁকি বসানোর প্লান ছিল বাস্তবায়ন হয়নি। উপরে টিন বসানো হয়েছে এবং কিছুটা স্থানে স্বচ্ছ টিন লাগানো হয়েছে। এই টিনের আলোতে সকাল বেলায় মনে হয় উঠানের আলোতে বসা হয়েছে, আর সন্ধ্যায় মনে হয় বিকাল নেমেছে। টিনের চালে বৃষ্টির অবিরাম ঝুম-ঝুম শব্দে, অতীতের অনেক কিছুই মনে পড়ছিল। কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তিও বৃষ্টি নিয়ে অনেক সুন্দর গান ও কবিতা লিখেছেন। সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদের মত আমারও বৃষ্টি পছন্দ! তাই ভাগ্য গুণে আমার বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল ঘন বরষার দিনে। বিয়ের দিনটি ছাড়া, আগে পরের সাত দিন বৃষ্টি হয়েছিল। বউ আনতে ও ফেরত নেবার কালে, রাস্তার দু-কোল চেপে মাইলের পর মাইল চারিদিকে পানি আর পানি থৈ থৈ করছিল। দূর থেকে মনে হচ্ছিল, কোন মহান ব্যক্তির ঐশ্বরিক শক্তির বলে সাজানো নান্দনিক রাস্তার গাড়ি যেন পানির উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল!
১৩ তারিখ সকালে উঠে দেখি চারিদিকে পানি থৈ থৈ করছে। গ্রামের সকল পুকুর, মাঠ, বিল সবই পানিতে একাকার। আমাদের ঘরটি বিলের কিনারায়। ১১ তারিখ দেখছিলাম এই এলাকার শেষ কৃষকটি তাদের চাষবাস যোগ্য শেষ ধানি জমিতে শেষের ধানের চারা রোপণ করতে। পুরো বিলটাই কচি ধানের চারায় হেলছে-দুলছে। দুই দিন পরেই বৃষ্টির শুরু! নির্ঘাত কৃষকের মাথায় হাত। একজন নামকরা কৃষকের ছেলে হিসেবে বিলক্ষণ বুঝতে পারলাম, এসব কৃষকের কপালে নির্ঘাত দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে। এখন ভাদ্র মাস, শরতের শুরু; ভাদ্র মাসের ইতর প্রাণীদের যত্রতত্র আটকে থাকতেও দেখলাম। ধানের চারা তৈরি করতে একমাস সময় লাগে, সেই চারা গাছ রোপণ করতে আবারো জমি প্রস্তুত, আবারো শ্রমিক সংগ্রহ করে যখন কৃষক প্রস্তুত হবে, তখন হেমন্তকাল কৃষকের দরজায় উঁকি দেবে। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক দুর্ভিক্ষ প্রায় নিশ্চিত! দিব্য দৃষ্টিতে বুঝতে পারছি, এবার দুর্গা হাতির পিটে তিমির পিটে চড়ে আসলেও কাজ হবেনা!
দুপুরে বাজারের উদ্দেশ্য রাস্তায় গিয়ে দেখি, সকল রাস্তা ততক্ষণে পানির নিচে। মানুষ বাজারে যেতে পারছেনা, প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগাড় করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে পানি শুধু বেড়েই চলছে। পুরো জনপদের মানুষ পানি বন্ধী হয়ে আছে। সবাই বলছিল স্মরণকালে এত পানি কেউ দেখেনি, আমার বাল্যকালেও কোনদিন এত পানি হতে দেখিনি। পূর্ব অভিজ্ঞতায় আমি বুঝতে পারলাম আমার সফরের কর্মসূচীকে সংক্ষিপ্ত করতেই হবে। কেননা আজ পূর্ণিমা, সাগরের পানি জোয়ারের মাধ্যমে ফুলে উঠবে। উজানের পানি নামার সুযোগ পাবেনা, তাই গ্রামীণ জনপদের এই পানি তো নামবেই না বরং বাড়তে পারে। তাছাড়া পানি গ্রামের দিকে কমে আসলেও আমার সমস্যার সমাধান হবেনা। কেননা গ্রামের এই পানি কমে শহরে গিয়ে ফুলে উঠবে! শহরে আমি যেখানে গিয়ে উঠবো, তখন এই পানি সেখানে প্লাবিত হবে! সুতরাং খুশী হবার কোন সুযোগ নাই। ওদিকে ভাগ্য ভালই বলতে হবে যে, আমার গিন্নী ইতিমধ্যেই তার গ্রামীণ সংসারের ডেমোনেষ্ট্রেশন পুরো দমে শুরু করে দিয়েছেন। গতকালই ওল কচু আকৃতির একপ্রকার পাহাড়ি শাক, অসময়ে পাওয়া পাকা তাল, পানি ফল, তিত বেগুন মার্বেল আকৃতির ছোট বেগুন যার ভর্তা আমার খুব প্রিয়, থানকুনি পাতা সহ গ্রামীণ জীবনে পাওয়া যায়না এমন কিছু সবজি গিন্নীকে যোগাড় করে দিয়েছিলাম। অন্যান্য সবজি ও মাছ আমার মেজ ভাই আগেই জোগাড় করেছিলেন। আমি বৈশিষ্ট্য গত ভাবেই পাহাড়ি শাক-সবজি পছন্দ করতাম যা আমার গিন্নী বা সন্তানেরা কেউ চিনবে না। গন্ধ ভেদুলির মত অতি দুর্গন্ধযুক্ত শাকও আমার খুব পছন্দ! একজন খবর দিয়েছে ভয়ানক দুর্গন্ধযুক্ত এই দুর্লভ শাক পাওয়া গিয়েছে কিন্তু পানির কারণে পৌছাতে পারছেনা।
মেজো ভাই সহ একটি লাটি হাতে, প্রায় দুই ফিট পানি উৎরিয়ে পুরো পোশাক ভিজিয়ে বাজারে পৌঁছলাম। বাজারে বিক্ষিপ্ত মানুষ ঘোরাফেরা করছে, তেমন কোন ক্রেতা নাই। কসাইরা একটা দেশী গরু জবাই করে বসে আছে, তারা জানত না আজকে এত পানি হবে। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। গিন্নীকে বাড়ীতে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, আজকের রাত্রে বাড়ীর চাচাত ও জেঠাত ভাইদের সকলকে দাওয়াত দাও। বাজারে যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে আসি, যেহেতু এমনিতেই কিছু পাওয়া যাচ্ছেনা, আবার যা পাওয়া যাচ্ছে তার দাম বেশী। আজকের এই দিনে আমি না হয় একটু বেশী দামেই জিনিষ কিনে সবাইকে নিয়ে একসাথে খাই, তুমি প্রস্তুতি গ্রহণ করো। গরুর তাজা গোশত, বড় আকৃতির পানি কচু, কদু-শাক, আলু, ডিমের ঝুড়ি সহ বাজারের থলে কাঁধে বহন করে পুনরায় আরো বেশী পানি সাঁতরিয়ে বাড়িয়ে পৌঁছলাম। রাত্রে হৈ-হুল্লোড়ের সহিত সবাই মিলে আনন্দের সাথে বর্ষার আরেকটি রাত উৎযাপন করলাম। খাদ্যের মেনুতে ছোট মাছ ও কয়েক প্রকারের ভর্তার মজাটা যেন এখনও জিহ্বায় লেগে আছে। সে দিনের আনন্দের কথা ভাষায় বুঝাতে পারব না। গিন্নী খুবই উৎসাহের সাথে এতগুলো মানুষের খাদ্য খুব কম সময়েই তৈরি করতে সক্ষম হল। আমার বাবা-মা আত্মীয়দের সাথে নিয়ে এভাবে খাওয়া দাওয়া করতেন, আমরা ছোটরা হঠাৎ খুশীতে আত্মহারা হতাম। এই মজা, এই আনন্দ, এই স্বাদ পাঁচ তারা হোটেলে পেতাম কিনা সন্দেহ আছে।
পরদিন আমার জেঠাত ভাইটি এলাকার অবস্থান রত স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়র শিক্ষকদের নিয়ে একটি টি পার্টির আয়োজন করেছিলেন। যাদের অনেকেই আবার আমার বন্ধু কিংবা সহপাঠী; সেখানে আমাকেও দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। যাতে করে আমরা ভাবের আদান প্রদান করতে পারি। বিদেশ সম্পর্কে কোন প্রাঞ্জল আলোচনা করতে পারি। তাদেরকে যে জায়গায় উপস্থিত হবার জন্য বলা হয়েছিল, সে জায়গায় যাওয়ার রাস্তাটি ততক্ষণে পানির অনেক নিচে তলিয়ে যায়। মানসিক ভাবে সবাই প্রস্তুত এমন একটি পোগ্রাম স্থগিত করতে বাধ্য হচ্ছিল। তাদের সবাইকে ফোন করলাম যাতে আমাদের বাড়ীতে চলে আসে। সংক্ষিপ্ত আহবানে তাদের অধিকাংশই রাজি হয়ে যায়। অনেকেই দীর্ঘ পথের পানি মাড়িয়ে আমার মেহমান দারিতে হাজির হয়েছিলেন। এসব মেহমান ছিলেন আমার জন্য বোনাস স্বরূপ। তারা আজকে একটি প্রোগ্রামে যাবেন মানসিক প্রস্তুত ছিলেন, সেই প্রস্তুতিকে কাজে লাগিয়ে সবাইকে আমার মেহমান বানালাম। বাহিরে ঘন বৃষ্টি আর ঘরে আলোচনা, তিন ঘণ্টার এই সৌজন্য আতিথেয়তা কখনও ভুলার মত নয়। কড়া বাদলের দিনে, দুই ঘণ্টার প্রস্তুতিতে গিন্নী অনেক নাস্তা বানালেন; সবাই খুশী হলেন। প্রবাস জীবনেও গিন্নী মেহমান প্রিয় ব্যক্তি হিসেবে সমাদৃত। তবে আজকের কথাটি গিন্নীর সুনাম কিংবা নিজের প্রশংসার জন্য বলছিনা। বলছি এই কারণে যে, আমরা এই কাজটি ভাবীদের অনুরোধ করে করতে পারতাম না! কেননা আমরা নিজেরাই তাদের মেহমান ছিলাম। নিজেরা বাংলাদেশ জীবনের একটি প্র্যাকটিক্যাল ডেমোনেন্ট্রষ্ট্রশন করতে গিয়ে এই মেহমান দারী করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছিলাম ঠিক একটি পিকনিকের মত করে এবং কিছু সু-প্রতিবেশী সুলভ আচরণের উত্তম শিক্ষা অর্জন করলাম।
আরো দুদিন এভাবে চলে গেল! তাই শহরের প্রোগ্রাম আরো সংক্ষিপ্ত করার প্রতি মনোযোগী হলাম। বন্ধুদের সাক্ষাৎ বাদ, ব্লগারদের সাথে যোগাযোগ বাদ ইত্যাদি। অগত্যা আবহাওয়ার কোন পরিবর্তনের আভাষ দেখতে না পেয়ে পরদিন দুইগুণ বেশী ভাড়ায় দুইটি সিএনজি নিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। রাস্তার উপর তখনও পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। খবর পেলাম রাস্তার পানির উপর দিয়ে বড় চাকার গাড়ি ও নৌকা দুটোই পাশাপাশি চলছে। এভাবে আট কিলোমিটার চলতে হবে। সিএনজির চাকা ছোট তারা চার কিলোমিটার পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিল। সেখানে একটি প্রাইভেট কার আগে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কারের চাকা সিএনজির চেয়ে বড়, কারের ড্রাইভার দুই কিলোমিটার পর্যন্ত গিয়ে বুঝতে পারল তার গাড়ি দিয়ে সামনে আর আগানো যাবে না। পানি কমার যে অগ্রিম তথ্য সে পেয়েছিল তা ভুল বলে প্রমাণিত হল। তার ভুল প্রমাণের জন্য এভাবে আমাদেরকে বিলের মাঝখানে নামিয়ে বললেন দুঃখিত! রাস্তার উপর পানির যে উচ্চতা, সেখানে চালাতে গেলে ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়তে পারে। ফলে তিনি আমাদেরকে আবার সেই দুই কিলোমিটার পিছনে নিয়ে গেলেন, যেখান থেকে আমাদের এনেছিলেন! ওখানে পৌছার পর দেখি সেই সিএনজিও নাই যেগুলোতে আমরা এসেছিলাম অথচ এগুলো আসা যাওয়ার টাকা দিতে হয়েছিল! আমরা পড়ে গেলাম এক অনিশ্চয়তার মাঝে। যাত্রী হিসেবে পাঁচজন মহিলা, দুই জন বাচ্চা আর আমি। যাত্রীদের একজন সিরিয়াস অসুস্থ, মেডিক্যালে ভর্তি করাতেই হবে। সুতরাং পিছনে যাবার সুযোগ নাই।
সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে যেতেই হবে। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা বিশাল চাকার ট্রাক্টরের প্রতি নজর পড়ল। বাগানের ভারী কাজে এগুলো ব্যবহৃত হয়, আপাতত মাটি ও ইট টানার কাজ চলছে। চালকের খবর নেয়াতে জানতে পারতাম তিনি খেতে গিয়েছে। উৎসাহী একজন এগিয়ে এলেন, তিনি বললেন, তার কাছে লাকড়ি টানার একখানা চাদের গাড়ী আছে! এগুলো যাত্রীবাহী গাড়ী নয়, লাকড়ি বাহি গাড়ী! তাই সিট নাই, বসার জন্য চেয়ারের মত কোন সুযোগ নাই। লোহার ফ্লোরে বসে আছাড় খেতে খেতে যতটুকু যাওয়া যায় যেতে হবে। সাথে অনেক গুলো লাগেজ আছে, কেননা বিদেশ থেকে সোজা গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে বিভিন্ন জনের দামী মালামাল আছে, যা শহরের বন্ধুদের বাড়ীতে পৌছাতে হবে। আমার সাথের যাত্রীদের বললাম, ডিসকভারির জন্য একটি গাড়ি পাওয়া গিয়েছে, ইচ্ছে করলে সেটাতে যাওয়া যায়। ডিসকভারি গাড়ির নাম শুনে সবাই খুবই খুশী হল। ঘটনাস্থলে গিয়ে যখন দেখল এটা লাকড়ি টানার গাড়ি, সবাই মনমরা হল। বললাম, এটাতেই যেতে হবে, কেননা আজ এটাই আমাদের তকদির। আমার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় এটাই পাওয়া গিয়েছে। উপরে বৃষ্টির পানি, নিচের বন্যার পানি সুতরাং বিকল্প কোথাও রাস্তা নাই। গাড়ীর চালক কে ভাড়া কত প্রশ্ন করলাম? সে পাঁচ গুনের বেশী ভাড়া হাঁকাল! কেন প্রশ্ন করাতে রূঢ় হেঁসে বলল, 'টাকা কামানোর এমন মোক্ষম সুযোগ জীবনে খুবই কম আসে'!
ঠিক আছে বলে চড়ে বসলাম। ড্রাইভার ও হেলপার দুজন মিলে আমাদের সকলের যাত্রা হল শুরু! এই যাত্রায় কবি নজরুলের, দুর্গম গিরি নাই, কান্তার মরু নাই, তবে অবিশ্বাস্য কষ্টকর দুস্তর পারাপার আছে! রাস্তার কোন হদিস নাই। রাস্তার দুই পাশে ইউক্যালিপটাস গাছের সাড়ি দেখে অন্ধের মত করে গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে! চারিদিকে খাঁ খাঁ করা বিল, পানি আর পানি। ড্রাইভার ও হেলপার আলোচনা করে, তাদের অতীতের মুখস্থ শক্তির মাধ্যমে চিন্তা করে রাস্তার গর্তের স্থান ও আকারের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে! হেলপার বলে সামনে তো একটা বিরাট গর্ত ছিল! ড্রাইভার বলে সেটা তো ভরাট হয়েছিল! হেলপার বলে ভরাট হয়েছিল, সেটা তো গত বছরের কথা! কয়দিন আগেই সেখানে ট্রাক একটা পইড়া সবাই মরেছিল! এত প্রকার ভয়ঙ্কর মন্তব্য ও বলাবলি শুনে আমরা রাস্তা পাড়ি দিচ্ছিলাম!
রাস্তার পাশেই সাদা বকের মত ঠাঁই দাঁড়িয়ে, যে সব পথিক শহরে যেতে পারছেন না; তারা আমাদেরকে পরম সৌভাগ্যশালী বলে ঈর্ষা প্রকাশ করলেন। পানির নিচের তলিয়ে যাওয়া রাস্তায় গাড়ির গতি আর দুই পায়ে হাটার গতি প্রায় একই! চাঁদের গাড়ি চারিদিকে খোলা, গাড়ীতে সবাই সাঁতার জানে, একমাত্র আমার ছেলেটি ব্যতীত! ইচ্ছা ছিল এবারে সাঁতার শিখাব, প্রবল বৃষ্টি সে আশা ব্যর্থ করে দিল। গাড়ি সামনে চলছে আমি গাড়ির পিছনে পানিতে হেটে চলছি। কোথাও গর্তে পড়লে আমি আর হেলপার মিলে হেইও করে তাকে উপরে তুলেছি। চোখ সর্বদা গাড়ীতে বসা ছেলের দিকে রেখে পথ চলছি। খোদা না খাস্তা গাড়ি যদি রাস্তার খাদে পড়ে পানিতে ডুব দিতে যায়; তাহলে সর্বাগ্রে তাকে ছিনিয়ে নিতে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি মাথায় নিয়ে পথ চলছি! ভয়ানক অস্বস্থি নিয়ে এভাবে পথ চলছি। আর রাস্তার দু'পাশে ঠাঁই দাড়িয়ে থাকা মানুষদের অগণিত শ্রম ঘণ্টা নষ্ট হবার ব্যথা নিয়ে ভাবছি! রাস্তায় শুধু দাড়িয়ে থাকতে হবে, বসার কোন জায়গা নাই, এমনটি হাতে-কাঁধে রাখা মালামাল গুলিও কোথাও রাখার জায়গা নাই। আমাদের গাড়ীতে মালামালের সাথে অত মানুষকে নেবার সুযোগও নাই। আমাদের ছোট কালে এভাবে কখনও পানি জমতে দেখি নাই। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে নগর তো বটেই, তার প্রভার পড়ছে গ্রামীণ জনপদেও।
পানির প্রবাহে রাস্তার উপরের আস্তর চলে যাওয়া গর্তগুলো বরাবরই কষ্ট দিচ্ছিল। প্রতিটি গর্ত থেকেই উপরে উঠতে হেলপার আর আমি মিলে হেঁইয়ো করে গাড়িকে উপরে তুলছি আর যথারীতি পথের দূরত্ব ছোট করছি। সময় ও পরিবেশের সাথে দীর্ঘক্ষণ লড়াই করার পর আমাদের দ্বিতীয় মেয়াদের যাত্রা শেষ করতে সক্ষম হলাম। এখান থেকে আরেকটি গাড়ি নিতে হবে কেননা মেট্রোপলিটন এলাকায় চাঁদের গাড়ি ঢুকা আজীবন নিষিদ্ধ। ভেজা শরীরে, কর্দমাক্ত শাটে যখন গাড়ীর ভাড়া দিতে গেলাম চালক অতিরিক্ত কাজ তথা গাড়ী ঠেলার মাসুল হিসেবে, আরো চারশত টাকা বখশিশ চেয়ে বসলেন! বললাম পুরো পথে তো আমিও গাড়ী ঠেলেছি এমনকি আমিই বেশী ঠেলেছি, তাহলে আমার বখশিশ কে দিবে? ড্রাইভার ঝটপট বলল, তাহলে আপনার বখশিশ বাবদ দুইশত টাকা রেখে দিয়ে, আমার বখশিশের দুইশত টাকা দিয়ে দেন! অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর হওয়া ব্যতীত রাস্তা রইল না।
পেটের খিদে ও পানির পিপাসায় বুক ফেটে যাবার দশা। এটা কোন বাজার বা দোকান পাট আছে এমন জায়গা নয়, এখানে দূরে যাবার জন্য গাড়ী পাওয়া যায়, ফলে সেখানেই নামতে হয়েছে? খিদে পিপাসা আমাকে দুটোতেই কাতর করেছে! পানির উপর দিয়ে হেঁটে আসার ফলে পানির পিপাসা পেয়েছে, দীর্ঘ পথ হেইও করে গাড়ী ঠেলতে গিয়ে খিদে পেয়েছে। ভাগ্যিস পাশেই কলা মুড়ির একটি দোকান দেখতে পেলাম। সবাইকে প্রশ্ন করলাম কে কি খেতে চায়? গাড়ি থেকে একজন উকি মেরে বলল এই মুড়িতে ইউরিয়া গিজ গিজ করছে। মুড়িতে এত বিরাটকায় গর্ত তৈরি হয়েছে যাতে করে এক এক মুড়িতে কমপক্ষে ত্রিশটি করে ক্ষুদে লাল পিপড়া লুকিয়ে পারবে। বিদেশে থাকায় মুড়ির ইউরিয়া নিয়ে অভিজ্ঞতা ছিলনা তাই বুঝতে পারি নাই। গোটা দশেক আপেল যত্ন করে সাজানো দেখতে পেলাম, দাম জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে গাড়ী থেকে আসতে করে আমাকে জানানো হল, ফরমালিন! থমকে দাঁড়ালাম! ঠিকই তো যেখানেই যাই সেখানেই ফরমালিন। যেহেতু ফরমালিন কিট সাথে নাই, তাই এটা না খাওয়াই উচিত। যাক, কলা তো খাওয়া যাবে, মোটা চামড়ার কলায় ফরমালিন লাগালেও পুরু চামড়া ভেদ করে ফরমালিন ঢুকতে খবর আছে। কলার গায়ে হাত দিয়ে চিন্তা করতে থাকলাম, কলার গায়ে হাতি দিয়েছি নাকি শসার গায়ে হাত দিয়েছি? কলার শরীর নরম তো নয়ই মনে হল অনেক শক্ত। আমার আচরণ দেখে আবারো গাড়ী থেকে ডাক পড়ল। বলা হল, ওগুলো পাকা কলার চামড়া নয় কার্বাইডের আস্তরণ। কৃত্রিম ভাবে পাকানো! মাথার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল পকেটে টাকা, দোকানে মাল, পেটে খিদে কোনটারই সমাধান হচ্ছেনা। এমনি সময় পাশের মসজিদের কোনায় একটি নলকূপ চোখে পড়ল। দৌড়ে গেলাম সেদিকে। যেই মাত্র নলকূপের হাতলে হাত দিয়েছি অমনি ছেলেটি আর্সেনিক! বাবা আর্সেনিক বলে চিল্লাতে লাগল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখলাম ঠিকই তো! লাল বর্ণের নলকূপ! একজন কে প্রশ্ন করলাম এটা কি আর্সেনিক যুক্ত নলকূপ! ব্যাটা হা করে তাকিয়ে রইল, আর্সেনিকের নামই শুনে নাই!
আমার সন্দেহ যুক্ত আচরণে কয়েকজন পথিকও হতবাক হল। তবে কেউ আর্সেনিকের কথা জানেনা অতঃপর মাষ্টার মার্কা একজনকে প্রশ্ন করলে তিনি জানালেন এটা আর্সেনিক যুক্ত নলকূপ নয়। নলকূপ কোন্পানী তাদের সকল পণ্যে এই ধরনের রং লাগিয়ে বাজার জাত করেন। কি মুসিবত রে বাবা! নলকূপ কোম্পানি কি জানেনা, যে দেশে লাল রংয়ের নলকূপের আলাদা একটি বিপদজনক পরিচিতি আছে! তাকিয়ে দেখলাম নলের গায়ে উৎপাদন স্থল ও কোম্পানির ঠিকানা লিখা আছে। একদা একটি নলকূপ দেবার ওয়াদা করলে ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হত। এখন সেই দেশে স্থানীয় ভাবে নলকুপ ও তৈরি হয়, এটাকে অবশ্যই স্থানীয় শিল্প বিপ্লব বলা চলে। তবে যে কোম্পানি এত বিনিয়োগ করে, তার কি এটা জানা জরুরী ছিলনা যে, লাল রং হল বিপদের লক্ষণ। অর্থাৎ কারো কোন জবাব দিহীতা নাই, তাছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে আর্সেনিকের প্রভাব নাই বলে হয়ত অনেকেই জিনিষটা চিনে না। যাক, সীমিত আকারে পানি পান করে আবারো সেই দোকানে গেলাম, খিদে তো পেটে আনচান আনচান করছে। তাদের দোকানে সমুচা-সিঙ্গারা আছে। সবার জন্য দুটি করে নিলাম। আমার ভাগের সমুচা টা খেয়ে সিঙ্গারাতে কামড় দিয়েছি, বেজায় বাসি গন্ধের আলামত পেলাম! দোকানিকে প্রশ্ন করলাম কখন বানিয়েছ? সহজ ও সোটা সাপটা উত্তর, গতকাল বানিয়েছি আজকে আবার তেলে গরম করেছি!! মেজাজ বিগড়ে গেল! জিজ্ঞাসা করলাম আগে বল নাই কেন, যে এগুলো গতকালের? সে ততোধিক ক্ষিপ্ত হয়ে উত্তর দিল মানুষ তিন দিনের পুরানাটা খাইয়া এত কথা বলেনা। যত কথা আমি জিগাইলাম। গোস্বাটা কোথায় দেখাব বুঝতে পারছি না! পথে ঘাটে গোস্বা প্রকাশ করার মত চরিত্রও নাই। অবশেষে নিজের দুই হাতের উপর আস্তা নিয়ে পুরো প্যাকেট টাই বন্যার পানিতে ছুড়ে মারলাম এবং মনে মনে খেদোক্তি করলাম এই বলে যে, 'পুরো টাকাটাই জলে গেল'!
আরেকটি কার নিয়ে শহরের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। আর গিন্নী আমার পিপাসা, খিদে আর নাস্তার প্যাকেট পানিতে ছুড়ে ফেলা নিয়ে কটূক্তি করলেন। পরামর্শ দিলেন আর কোনদিন যাতে এসব না করি! তাকে বুঝালাম দেখ! পুরো জীবনে মাত্র একবারই এই জাতীয় সমস্যায় পড়েছি! তুমি কি বুঝাতে চাও আমি যেন আরেক বার এই জাতীয় সমস্যায় পড়ে, তোমার বাতলে দেওয়া ধৈর্যের পরীক্ষা দেই! তিনি হাসলেন এবং চুপ রইলেন! শহরের রাস্তা ঘণ্টা খানেকের পথ। এখানেও রাস্তার উপর পানি। তারপরও বাস চলছে, ট্রাক চলছে, মহা সড়কে মানুষ জাল ফেলছে। পেটের ভিতর কেমন জানি লাগছে; ড্রাইভার কে বললাম জলদি চালাও। অবশেষে ড্রাইভার সহি সালামতে আমাকে শহরে পৌঁছাইয়া দিলেন আর পচা-বাসি সিঙ্গারা-সমুচার দয়ার বাসায় পৌছার অনেক আগেই দেহের প্রধান গুদাম তথা পেটে গোলযোগ দেখা দিল। ফলে টয়লেট টু বাসা এবং শয়ন কক্ষ টু গোসল খানা করতে করতে আরো একটি দিন আরো নষ্ট হল!
আর মাত্র চার দিন বাকি! ওদিকে অবিরাম বৃষ্টি আর বৃষ্টি! হাতে অনেক কাজ বাকি। প্রত্যেক দিন সকালে বেরিয়ে গেলে রাত্রি এগারটার পরে বাসায় ফিরতে হল! চট্টগ্রাম শহরের স্টিল মিল এলাকা থেকে বহদ্দার হাট পর্যন্ত দীর্ঘ ও বিশাল গুরুত্বপূর্ণ মহা সড়কে রাত এগার টার পর বাতি জ্বলে না এটা দেখতে পেয়ে যার পর নাই তাজ্জব হলাম। রাত এগারটা বাজে এটাকে একটা ভুতুড়ে নগরীর মত মনে হল। নব্বইয়ের দশকে রাত তিনটা বাজেও জাহাজে মালামাল ভর্তি করার জন্য যেতে হত। এই মহা সড়কের পাশে একটি কালো বিড়াল লুকালেও খুঁজে পাওয়া যেত। ডিজিটাল যুগের মহা সন্ধিক্ষণে কুইক রেন্টাল বিদ্যুতে শহর বাসিকে সয়লাব করার পরেও এই মহা সড়কে এমন ভীতিকর নীরবতা আমাকে যারপরনাই চিন্তিত করেছে। মনে হল আমাদের পুরো জাতিটা ফ্যাসবুক, ইউটিউব আর মোবাইল চালানোতেই ব্যাপক দক্ষতা অর্জন করেছে আর সর্বত্র অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলাকেই যেন আমন্ত্রণ জানিয়েছি।
বিষয়: বিবিধ
২৯৯৬ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
একদম হাচা কথা
আপনার লেখা সুখপাঠ্য। পাঠককে শেষ পর্যন্ত কেন জানি ধরে রাখতে চায়।
ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
সর্তা জায়গাটি ফটিকছড়ির অন্তভূক্ত এবং আমাদের বাড়ী থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরে। আমরা ফটিকছড়ি উপজেলার মধ্য ভাগে অবস্থান করছি, তার পরও উপজেলার একেবারে উত্তরে তথা ভারত সীমান্তের দূরত্ব প্রায় ২০ মাইল।
মূলত হালদার অববাহিকায় ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলার উত্থান। ফটিকছড়ি নামে আরেকটি স্বচ্ছ ও নির্মল পানির ঝরণা পাহাড়ের উপর থেকে নির্গত হয়। তার মিষ্টি পানি স্ফটিক তথা ফটিক তথা স্বচ্ছ থেকেই নাম হয়েছে ফটিকছড়ি। অনেক ধন্যবাদ।
" ফটিকছড়ি নামে আরেকটি স্বচ্ছ ও নির্মল পানির ঝরণা পাহাড়ের উপর থেকে নির্গত হয়। তার মিষ্টি পানি স্ফটিক তথা ফটিক তথা স্বচ্ছ থেকেই নাম হয়েছে ফটিকছড়ি"- জেনে খুব ভালো লাগলো।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
টান টান উত্তেজনা এবং গোটা সফরটাই বিভিন্ন গ্যাঞ্জামে ভরা।
এলাকার শেষ কৃষকটিকে চুপে চুপে কিছু সাহায্য করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন।
আপনার নেককার গিন্নীর জন্য দোয়া রইলো।
নাস্তার প্যাকেট পানিতে ছুড়ে ফেলা নিয়ে তাঁহার কটূক্তি ও পরামর্শ ভাল লেগেছে। এই রকম নেকবতি জিবনসাথি থাকলে ভুলের পুনরার্বিত্তি হয় না ।
জাযাকাল্লাহ খায়ের
আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ফটিকছড়ির পুরান অনেক গুলি খাল ভরাট হয়ে গিয়েছে এবং শহরের দিকে বেশি ঘরবাড়ি তৈরি হয়ে পাহাড়ি ঢল কে বদ্ধ করে দিয়েছে। ফটিকছড়ি থেকে কেবল মাত্র হালদা হয়ে দক্ষিন দিকে পানি আসতে পারে। বাকি দুইপাল রাঙ্গামাটি আর মিরসরাই এর উচু পাহাড় দিয়ে বন্ধ। এই নিয়ে কোন পরিকল্পনা বা মাথাব্যাথা কোন কর্তৃপক্ষেরই নাই। ফটিক ছড়ি তো অনেক দুর সেইদিন মদুনাঘাট এ চাকরিরত আমার এক বন্ধু আটকা পড়ে গিয়েছিল! আপনার সাথে দেখা করার খুবই আশা ছিল!!!!
আমার জন্ম ঢাকা শহরে আর ছোট বেলায় দেশ ছাড়াতে বন্যা তেমন দেখি নি ।২০১০ দেশে গিয়েছিলাম তখন দেখেছিলাম ঢাকার রাস্তায় নৌকা চলতে তবে সেটা বন্যা ছিল না বৃষ্টির পানিতে ।
আপনার বর্ণনাটি এতই সজীব, প্রাণবন্ত এবং মাটির কাছাকাছি হয়েছে যে মনে হলো,শহর অভিযানে আমিও সেদিন আপনার সহযাত্রী ছিলাম। আর আগের দিনের রাতের খাবারের যে চিত্র অংকন করলেন, তাতে মনে হলো, ইশ্, কি দারুন একটা বৃষ্টিময় রাত উপভোগ হতে বঞ্চিত রইলাম।
অবশেষে ভালোয় ভালোয় যে সবকিছু শেষ করে আসতে পেরেছেন, তার জন্য শোকর আলহামদুলিল্লাহ। ভাতিজার ও এটা জীবনের একটি মহান স্মরণীয় দিন ঘটনা হয়ে থাকবে। নিশ্চয়ই স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় স্মরণীয় ঘটনার রচন লিখতে দিলে এই পর্বটিকেই চুজ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
ভাবীকে সালাম ও ভাতিজার জন্য অনেক অনেক দুয়া।
পানি নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় অনেক দুর্ভোগের স্বীকার হতে হয় দেশের মানুষদের! আমাদের স্বজনদের জীবনকাহিনীর প্রকৃত স্বরুপ তুলে ধরলেন ভাই! কত পিছিয়ে আছি আমরা এখনো!
শুকরিয়া শেয়ার করার জন্য!
কলার মোচা, কলার থোর, কাঁচা কাঠাল, চাপলাইস কাটালের বিচি, বাশের কটি ডগা, মুগ ডালের শাঁস, সহ কি নাই এখানে! ভাগ্য ভাল যে গিন্নী এসবে বিরক্ত হয়না, সেও আমার এই বিদঘুটে চরিত্রকে খুবই উপভোগ করে। অনেক ধন্যবাদ।
শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে
হা হা হা হা.....খুব মজা পাইলাম
মন্তব্য করতে লগইন করুন