লাট সাহেবের বাংলোয় জ্বিনের আক্রমণ! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-২৪ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ০৬ আগস্ট, ২০১৪, ০২:২৫:১৯ দুপুর
একদিন খুব ভোরে বাড়ীর সামনে অবিরত গাড়ীর হর্ন বাজার শব্দ শুনতে পাই! অনেকের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় খবর নিতে আমাকেই বাড়ীর বাহিরে আসতে হয়। বাড়ির বাহিরে ওভার কোট পরিহিত এক আগন্তুক দাড়িয়ে! তিনি বললেন আমি আপনার জন্য শেষ রাত থেকেই এখানে অপেক্ষায় আছি। আশ্চর্যান্বিত না হয়ে পারলাম না! প্রশ্ন করলাম আপনি কে? তিনি পকেটের ভিতর থেকে একটি চিঠি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। চিঠি খুলতেই আমার পরিচিত ব্যক্তির হাতের লেখা দেখে তাজ্জব হলাম! আমারই সর্বজ্যেষ্ঠ জেঠাত ভাই লিখেছে, এই চিঠি পাওয়া মাত্র কাল-বিলম্ব না করে ড্রাইভার ফজলুর সাথে যেন চলে আসি। গতকাল রাত থেকে তাদের ম্যানেজারের স্ত্রী ও তাদের দু-কন্যা অদ্ভুত আচরণ করছেন। ম্যানেজারকে বিপদ মুক্ত করতে সহসা সেখানে আমাকে প্রয়োজন। সে জন্য ম্যানেজার গাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছেন।
নেপচুন চা বাগান! ব্রিটিশ আমল থেকে পরিচালিত ইস্পাহানী গ্রুপের অতি পুরানো একটি প্রতিষ্ঠান। এই বাগান থেকে উন্নত ও ভাল মানের ‘চা’ তৈরি হয়, প্রক্রিয়াজাত এসব চা পাতা ইউরোপে রপ্তানি হয়। বিশাল বাগানের দাপ্তরিক কাজে তদারকির জন্য দু’জন ম্যানেজার ও পাঁচজন কারণিক সহ অনেক মানুষের রুটি রুজির ব্যবস্থা হয় এখানে। বাগানের ‘হেড ক্লার্ক’ সবারই বয়োজ্যেষ্ঠ, সবচেয়ে বেশী পুরনো ও বিশ্বস্ত স্টাফ; আমারই আপন জেঠাত ভাই। একমাত্র স্থানীয় মানুষ হিসেবে সকল কর্মকর্তারা তাঁর উপর অতিরিক্ত নির্ভর করেন। বড় ভাইয়ের দুজন পিঠে-পিটি ছেলেমেয়ে আমারই ছোট কালের একমাত্র খেলার সাথী ও প্রিয় বন্ধু। ফলে এই বাগানের প্রতিটি বস্তু, রাস্তা, ভবন ও অনেক অজানা ইতিহাস আমার জানা ছিল। আমার জীবনের সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয় স্থান গুলোর মধ্যে এই নেপচুন চা বাগান অন্যতম!
বাগানের ফ্যাক্টরিতে দানবাকৃতির ইঞ্জিন ও বিশালকায় চুল্লী দেখার মত বস্তু ছিল। চুল্লীতে আগুন জ্বালাতে এক সাথে কমপক্ষে এক শত মন লাকড়ির দরকার হত। পুরানো সময়ের চা বাগানের ডিজেল চালিত প্রতিটি মেশিনের আকৃতিই ছিল বিশালকায়। বেল্ট ঘুরানোর জন্য ইঞ্জিনের মূল চাকাটির ব্যাসের দৈর্ঘ্য একটি পাকা ঘরের উচ্চতার সমান! কাজের চাপ থাকলে রাত আটটা অবধি ইঞ্জিন চলে, যতক্ষণ এই ডিজেল ইঞ্জিন চলে, তার সাথে বিদ্যুতের জেনারেটরটি ও চলতে থাকে। তখনও চা বাগানে বিদ্যুৎ আসেনি ফলে রাত আটটার পরে আর বিদ্যুৎ থাকত না। যেহেতু পাহাড়ি জনপদে এসব বাগান অবস্থিত। তাই বাগানের কর্মকর্তাদের খুশী রাখার জন্য প্রচুর সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়। উদাহরণ হিসেবে প্রতিজন কর্মকর্তা একজন করে চাকর, চাকরানী, পাচক, দারোয়ান ফ্রি পেয়ে থাকে। আমার ভাইটি গরু কিনে গোয়ালে ঘরে ভরতেন! আর সে গোয়াল ঘর প্রশস্ত হত কোম্পানির টাকায়! গরু গুলোকে চরিয়ে পেট ভরিয়ে ঘরে বেঁধে রাখার দায়িত্ব ছিল রাখালদের! এসব রাখালদের বেতন-ভাতা পরিশোধ হত কোম্পানির তহবিল থেকে! যে কর্মস্থলে সকল কর্মকর্তারা এমন সুবিধা পেয়ে থাকলে, সেখানে ম্যানেজারদের অবস্থা কেমন হতে পারে তা চিন্তা করলেই বোধগম্য হবে।
বিলাস বহুল বাংলো বাড়িতে অবস্থান করেন বাগানের প্রধান ম্যানেজার। দুই একর ফুল বাগান পরিবেষ্টিত, টিলার উপর অবস্থিত, ব্রিটিশ আমলে বিরাট বাংলো বাড়িটি বানিয়েছেন এক ইংরেজ ভদ্রলোক। সবাই তাকে লাট সাহেব হিসেবে চিনতেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এখানকার ম্যানেজার বিলাতি ছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে দেশীয় মেধাবীরা ম্যানেজারের সুযোগ পান। চারজন শ্রমিক প্রতিদিন সকালে টিলার পাদদেশে অবস্থিত বিশেষায়িত নলকূপ দিয়ে, চেপে চেপে পানি তুলে টিলার অনেক উপরে রক্ষিত পানির ট্যাংক পুরো করতেন। সত্তরের দশকের শেষ দিকে আসামীয় স্টাইলে নির্মিত এই বাংলোর প্রতিটি ঘরের দেওয়াল ছিল, বিরাট আকৃতির আয়না দিয়ে ঢাকা। উপরে ছিল তারের জাল, তার উপরে টিন, আবার তার উপরে বিশেষ কায়দায় ছন বসানো। ফলে গরমে ঠাণ্ডা আর ঠাণ্ডার সময় উষ্ণতা অনুভব হত! দক্ষিণের উত্তাল হাওয়া খেতে বানানো এই বাংলো পাঁচ মাইল দূর থেকে নজরে আসত। চারিদিকে বারান্দা ও তার প্রবেশপথ গুলো দূর থেকে দেখলে সিলেটের এম সি কলেজের সদর দরজার কথা মনে পড়বে। ম্যানেজারের আপন ও বিশ্বস্ত ব্যতীত বাগানের সকল কর্মকর্তারাও এই বাংলোর ভিতরে কেমন তা দেখার সুযোগ পেত না! ম্যানেজারের সাথে সাক্ষাত করতে আসা কর্মকর্তাদের জন্য চারিদিকে একটি খোলা প্রশস্ত আলী-শান বৈঠক খানা ছিল, সেখানে বসে সাক্ষাৎকারী কর্মকর্তারা খোশ-গল্প কিংবা প্রয়োজনীয় কাজ সাড়তে পারতেন। এ ধরনের বৈঠক খানা আজ অবধি আমি অন্য কোথাও দেখিনি। আমি ভারতের লাল কেল্লার মোতি মহল দেখেছি, আগ্রার খাস মহল দেখেছি, বর্তমানে পৃথিবীর সেরা অত্যাধুনিক নয়নাভিরাম ভিল্লা ও সুইটের জৌলুস ময় ডিজাইনের সাথে জড়িত আছি। কিন্তু বাংলাদেশের পাহাড়ের অভ্যন্তরে বাঁশ বেত দিয়ে বানানো এত সুন্দর দেশীয় স্থাপত্য তৈরি হতে কোথাও দেখিনি! আজ আমি এই বাংলোর এক ম্যানেজারের স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ছুটে এসেছি!
ম্যানেজারের সাথে প্রথম দেখাতে তিনি প্রশ্ন করলেন, এত দেরী করে আসলাম কেন? তাঁর একটি মিনিট যাচ্ছে এক দিনের সমান করে। তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না, তিনি এখন কি করবেন, কাউকে ব্যাপারটি বলতেও পারছেন না। তখনি দেখলাম, তার তিন বছর বয়সের দুটো যমজ কন্যা, হাত ধরাধরি করে ‘আয় তব সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি, নাচিবে.........আ আ, করে গান গাচ্ছেন। রবি ঠাকুরের এই গানটি দু-কন্যার কণ্ঠে জীবনে এই প্রথম শুনলাম। সে সময় ঘরে ঘরে রেডিও ছিলনা, মাইক ছাড়া গান শোনার সুযোগ কম ছিল। ম্যানেজার বললেন, গতকাল থেকেই তারা এই গান গেয়ে চলেছে। কন্যাদের সম্মিলিত গানের কণ্ঠে যখন গভীর রাত্রে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে যায়, দেখেন তার পাশে স্ত্রী নাই! হারিকেনের আলো বড় করে দেখেন স্ত্রী বারান্দায় শুয়ে আছেন! যে স্ত্রী রাত্রে জানালার পাশে দাঁড়ায় না, সেই তিনি খোলা বারান্দায় শুয়ে আছে! খোলা বারান্দা হলেও, চারিদিকে তার-জালি দিয়ে ঘেরা এবং সেখানে যেতে হলে শয়নকক্ষের ভিতর দিয়েই যেতে হবে। সুতরাং বাহিরের কারো প্রলোভনে এই কাজ সম্ভব নয়, ঘটনাটি অতি-লৌকিক কিছু বলে তিনি মুহূর্তেই বুঝে ফেললেন। স্ত্রীকে জাগালেন, তিনি নিজেও তাজ্জব বনে গেলেন কিভাবে, কখন এবং কেন তিনি সেখানে শুয়ে আছেন।
ম্যানেজার আমাকে পেয়ে বেশ ভাল ভাবেই আটকালেন। তার অন্তরে দৃঢ় ধারনা হল, আমাকে দিয়ে অন্তত কোন একটা গতি হবে। তবে আমি তো জানি ভিতরে ভিতরে আমি কি? আমার কতটুকুই বা ক্ষমতা। তারপরও বই থেকে শিখা কিছু দোয়া পড়ে পানি পড়া দিলাম এবং রাজমোহিনী বিদ্যার বই থেকে শিখা, জ্বিন-ভুত থেকে রক্ষা পেতে বিশেষ কায়দায় বাড়িটি বন্ধ করলাম। ম্যানেজার বললেন তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীর অধিকারী। তার স্ত্রী ইডেন কলেজের ছাত্রী! ইডেন কলেজ নামটি ইতিপূর্বে কখনও শুনেছি বলে মনে হলনা! তবে, আমার কাছে নামটি আকর্ষণীয় মনে হল এবং কৌতূহলী করে তুলল। ম্যানেজার বলতে রইলেন, তারা স্বামী-স্ত্রী জ্বিন ভুতে বিশ্বাস করেন না কিন্তু এখানে এমন কিছু ঘটে চলেছে, যা দেখলে পালোয়ানের মনেও ভয় ধরে যাবে। কথা প্রসঙ্গে আরো বললেন, বুড়ো পাচক তাকে এই বাংলোয় বিভিন্ন সময় জ্বিনের উৎপাতের কথা জানিয়েছেন। তিনি পাচকের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে ভাবলেন, পাচক হয়ত সাহেবের কাছাকাছি হবার জন্য গল্প ফাঁদতে চাইছে।
আমি নিজের পাচকের শরণাপন্ন হলে পর তিনি জানালেন, বিগত চল্লিশ বছরের বেশী সময় ধরে তিনি এখানে আছেন। ছোটকালে এখানে নতুন যোগ দান করেন, তখন আগের বৃদ্ধ পাচকের মুখে শোনা কিছু কাহিনী ও তার নিজের অভিজ্ঞতার কিছু ঘটনা আমাকে বললেন। চা বাগানের এই বাংলোতে এখন বাংলাদেশীরা থাকলেও আগে বিলাতী সাহেবরা একাকী থাকতেন। তারা কদাচিৎ নিজের জৈবিক চাহিদা পূরনার্থে বাগানের কুলিদের উঠতি বয়সী সুন্দরী তম্বী-তরুণী কুমারী কন্যাদের প্রতি আকৃষ্ট হতেন। নিজের মনোরঞ্জনের জন্য সাহেব যে কন্যাকে বাছাই করতেন, তার পিতা-মাতাকে অভাবনীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে হাত করে ফেলতেন। পরবর্তীতে সেই কন্যাকে গৃহপরিচারিকা হিসেবে বাছাই করত এবং বাংলোর অভ্যন্তরে সাহেবেরা নিজেদের লালসা চরিতার্থ করত। আগেই বলেছিলাম কুলিরা মদের লোভে মতোয়ারা থাকে। আর মদখোর ব্যক্তিরা স্ত্রী-কন্যার অনৈতিক কাজকে হজম করে এমনকি মাতাল অবস্থায় স্ত্রী-কন্যাকে জোর করে অন্য পুরুষের হাতে তুলে দিতেও কুণ্ঠিত হয়না! কখনও নিজের কন্যার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটে। ইতরামির জ্বালায় মদখোরের বাড়ীতে কখনও, আপন জনও মেহমান হয়ে বেড়াতে যায় না!
কুলি কন্যা বলেই সে নিজের উপর অন্যের অযাচিত হস্তক্ষেপ সহ্য করবে এমন তো হয়না। বর্তমান যুগে কুমারীত্ব হারানো সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাতাস থেকে শোনা যায় শিক্ষিত নারীরা টিভি, নাটকে, বিজ্ঞাপনে সুবিধা লাভের আশায় নিজের কুমারীত্বকে পূঁজি বানায়! তখনকার দিনে কুলি কন্যা হলেই যে, ক্ষমতার জোড়ে কেউ কারো গায়ে হাত দিতে পারবে এমন দুঃসাহসী মানুষ দেশে ছিলনা। একদা এক কুলি কন্যা বিলেতি সাহেবদের এই ধরনের আবদার মেনে নিতে না পেরে বাংলোর বারান্দায় আত্মহত্যা করেছিল। পরবর্তীতে আরেকজন গরীব কুলি কন্যার ভাগ্যেও একই পরিণতি জুটেছিল। কুলি কন্যা আরেক কুলি সন্তানকে ভালবেসেছিল। সেই কুলির সন্তানও বাগানে কুলির কাজ করত। বাগানের বড় সাহেব, কুলির কুমারী কন্যাকে বাগে আনতে তার ভালবাসার কুলি পুত্রকে বাধা মনে করে। এতে করে ছেলেটির চাকুরী যায়, পিতা-মাতা চুরির দায়ে দোষী হয়। বাগান থেকে বের করে দেওয়া হয়। অপমান এবং প্রেমিক হারানোর বেদনায় আক্রান্ত যুবক, গভীর রাত্রে সাংকেতিক ভাবে বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে, মেয়েটিকে বাংলোর বাহিরে নিয়ে আসে এবং বাংলোর পাশের নিম গাছে লটকে এক সাথে আত্মহত্যা করে।
বর্তমান সময়ে আত্মহত্যা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার! তখনকার দিনে এ ধরনের একটি ঘটনায় পুরো দেশ জুড়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেত। এমনকি তখনকার দিনে কোন ছেলে কারো মেয়েকে একটি রুমাল উপহার দিলেও, গ্রামে গ্রামে কথা রটে যেত। কবিয়ালেরা সেই ঘটনাকে মুখ রোচক বানিয়ে কবিতা লিখে ফেলত। সে সব কবিতা বাজারে বিক্রি হত। যুবকেরা সেই কবিতা পড়ে, মনের ব্যথা মনের মাঝে চাপিয়ে রাখত। পাচকের দাবী, প্রেমিক যুগলের আত্মহত্যার পর থেকেই কখনও বাংলোর বাহিরে, কারো পদচারণ লক্ষ্য করা যায়। অথবা বিলাপের সুরে কারো কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। কদাচিৎ গভীর রাত্রে কোন মহিলা বাংলোতে ঢোকার জন্য দরজায় কষাঘাত করে। পাচকের দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলল, নতুন কোন বাসিন্দা বাংলোয় আসলে এটা ঘটনা শুরু হয় এবং তা আস্তে আস্তে থেমে যায়। তবে বাংলোতে কখনও নারী সদস্যা আসলে উৎপীড়নটা বেশী হয়। সেটাও আস্তে আস্তে থেমে যায়, হয়ত বর্তমান সাহেবের বেলায়ও তাই হতে যাচ্ছে। পাচক সহ আর যারা বাংলোয় কাজ করে, তারা এটা দেখেই দীর্ঘ বছর এখানে চাকুরী করে যাচ্ছে।
সাহেবের কন্যা দুটো সকাল থেকে দীর্ঘক্ষণ ঘুমানোর পরে, সাধারণ আচরণ করছে বলে মনে হচ্ছে! সাহেবের স্ত্রী তো পাগল হয়নি, তিনি সুস্থ ও ভাল আছেন, তবে গত রাতের ঘটনা তখনও ভুলতে পারেন নি। সামনের রাত গুলোতে এ ধরনের হলে কি হবে সে চিন্তায় পেরেশান হয়ে আছে। যাক, জ্বিন দৌড়ানোর কাজে আমার ঝোলায় পুঁজি পাট্টা যা ছিল তা আগেই প্রয়োগ হয়ে গিয়েছে। নতুন করে প্রয়োগ করার মত অতিরিক্ত আর কোন বিদ্যা আমার কাছে নাই। তাই দুপুরেই ম্যানেজারকে বললাম, আমাকে যে যেতে হয়! এই কথা শুনে সাহেব যেন আসমান থেকে পড়লেন! তিনি আমার হাত ধরে বললেন, কালকেই তিনি পুরো পরিবার সহ শহরে চলে যাবেন। আজকের রাতটি যেন তাদের সাথে এই বাংলোয় কাটাই। নতুন করে আর কোন অজানা আতঙ্কের মুখোমুখি তারা হতে চায় না। কিছুদিন আগেও এই জাতীয় একটি অতি-ভৌতিক ঘটনার কথা শুনলে আমার হৃদয়ে এডভেঞ্চার অনুভব করতাম। সোনার ডেকের ঘটনার পর থেকে কেন জানি এসব ঘটনায় আর উৎসাহ বোধ করিনা! এই বাংলো নিয়ে সবার কৌতূহল, আমার প্রিয় জায়গাটির একটি হওয়া, সর্বোপরি আমারই বড় জেঠাত ভাই এই বাগানের একজন বড় কর্মকর্তা হবার কারণে ম্যানেজারের রাত্রি যাপনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করাটা আমার জন্য দুরহ হয়ে দাঁড়াল। তাই অনিচ্ছা স্বত্বেও বাগানের সেই বাংলোয় রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম এবং অনর্থক আরেকটি ঝামেলা মাথায় তুলে নিলাম।
ছোট কালে বন্ধুদের আগ্রহে বাগানের অনেক কাহিনী বলে বেড়াতাম। কারো অতি উৎসাহের সুযোগ নিয়ে অনেকের মুখে শোনা কথাগুলোকে নিজের দেখা কাহিনী বলেও চালিয়ে দিতাম। এতে বন্ধুদের কাছে আমার যথেষ্ট কদর থাকত। তাদের মধ্যে ইউসুফ প্রায়ই আমাকে বলত যদি কখনও সুযোগ ঘটে তাকে যেন একটু বাগানে নিয়ে আমার বলা যায়গা গুলো দেখাই। ইউসুফ সাহিত্যপ্রেমী ছিল, বই পড়ার বিরাট বাতিক তাকে ঘিরে ধরেছিল। তখন পর্যন্ত আমার কাছাকাছি সংখ্যক বই পড়ার রেকর্ডটি তার কাছেই ছিল। দু’জনের তফাৎ ছিল, সে দেশীয় সাহিত্যের সাথে পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্যে রসকেও পছন্দ করত। আমার নিকট সকল প্রকার সাহিত্যের সাথে সাথে কবিতা, পুঁথি, যাদু-মন্ত্র, তাবিজ, আদি ভৌতিক বিষয়গুলো পর্যন্ত প্রিয় ছিল। ৩৫০০ একর জায়গার বিশাল ভু-খণ্ড জুড়ে এই বাগানের অবস্থান। আমি ঘন ঘন সে বাগানে যাবার সুযোগ যেতাম বলে, অনেক কিছু দেখতাম জানতাম। সাধারণের জন্য এই সুযোগ অবারিত ছিলনা। বাগানের অনেক কর্মকর্তারা পর্যন্ত বাংলোতে যাবার সুযোগ পেত না। সেখানে আজ আমি অন্য এক কারণে অবস্থান করতে যাচ্ছি। কেন জানি আজ হঠাৎ মনে পড়ল ইউসুফের কথা! ম্যানেজারকে জানালাম রাত্রে থাকতে হলে আমার সাথে আমার এক বন্ধুকে আনতে হবে। তাকে আমার সাথে রাখাটা জরুরী। ম্যানেজার দ্বিমত পোষণ না করে, ড্রাইভারকে বললেন জিপে করে আমাকে নিয়ে যেতে এবং যথারীতি ফিরে আসতে। আমার মন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল দুটো কারণে। ছোট কালের বন্ধুর আবদার রক্ষা করতে পারব। দ্বিতীয়ত আমার সম্মান ও গ্রহণ যোগ্যতা কেমন তা সে উপলব্ধি করুক। কেননা ইউসুফ গ্রাম্য কবিদের কবিতা, পুথি, তাবিজ কিতাবের বই মোটেও পছন্দ করত না! বলত, এসব বিষয় কি সাহিত্যের মধ্যে পড়ে না কি?
বিকাল বেলায় জিপে চড়ে তাকে বাগানের অনেক কিছু দেখানো হল। সন্ধ্যার আগেই বাংলোয় ফিরলাম। সে উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপছিল! বাংলোর চারিদিকের প্রশস্ত বাগান ঘুরিয়ে দেখালাম। সন্ধ্যা নেমে আসার অনেক আগেই বেলি ফুলের ঘ্রাণে পুরো এলাকাটি মৌ মৌ করছিল। রং-বেরঙ্গের পাতা বাহার ও বিভিন্ন ফুলে আচ্ছাদিত বাংলোর পরিবেশ। বাংলোর অবস্থান পাহাড়ে হলেও, রান্নাঘর, গোসল খানা, পায়খানা, শয়নকক্ষের যাবতীয় ফিটিংস গুলো ইংল্যান্ড থেকে আনা। পাচক রান্নাঘরে দাড়িয়ে রান্না করছিল, বিরাট আকৃতির ধূয়া-বিহীন রান্নার চুল্লী ইতিপূর্বে দেখিনি। রান্না ঘরে বড় আকৃতির ফায়ার-প্লেস রয়েছে। বিভিন্ন আকৃতির গাছের গোড়ালি দিয়ে বসার জন্য চেয়ার বানানো। খ্যাত-অখ্যাত কোন গাছের গোড়ালি বাদ যায়নি! সবগুলোই অপূর্ব। আমি সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই বাংলোর চারিদিকে যথারীতি মন্ত্র পড়ে পানি পড়া ছিটিয়ে দিলাম। ম্যানেজার যাতে ভরসা পায়, সে জন্য তাদের ঘরেও ভাল করে ছিটালাম।
ইউসুফ বলল, পাহাড়ি পথে গাড়ির ঝাঁকুনিতে তার পায়খানার বেগ পেয়েছে কিন্তু পায়খানা কক্ষে পয়: নিবারণের কোন সুযোগ নাই! ম্যানেজারকে বললাম পায়খানা কোথায়? তিনি বললেন আমাদের জন্য যে ঘর দেওয়া হয়েছে, সেখানকার লাগোয়া কক্ষটাই পায়খানা। আমি নিজেও গেলাম কিন্তু পায়খানা করার কোন কমেট দেখতে পেলাম না। ওয়াস-বেসিন, শাওয়ার, বাথটাব সবই আছে, যেটা এই মুহূর্তে দরকার সেটা নাই! চেয়ার আকৃতির ঝকঝকে তকতকে অতিরিক্ত ফিটিংসটা দেখে মনে হল এটা দিয়েই সম্ভবত কাজ চলে, কিন্তু কিভাবে? আশির দশকে নিজেও বহুবার শহরে গিয়ে ভাল হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা ছিল কিন্তু এই ধরনের কমেটের কথা না বইয়ে পড়েছি না কারো মুখে শুনেছি! দু’জনেই যেন বেকুব হলাম, ভাবলাম বই তো কম পড়ি নাই। সেবা প্রকাশনীর কল্যাণে বিদেশী সাহিত্যও ইতিমধ্যে প্রচুর পড়া হয়েছে কিন্তু এ ধরনের টয়লেটের কথা কোথাও পড়ি নাই। অবশেষে লজ্জার মাথা খেয়ে চাপরাশি একজনকে প্রশ্ন করলাম কোথায় পায়খানা করে? সে ঘরে এসে দেখিয়ে বলল এটার ভিতরেই পায়খানা করে তবে কিভাবে করতে হয় তা সে জানেনা বা কখনও দেখেনি। দেখলাম এটার উপরে আদিম স্টাইলে দাড়াতে গেলে দু’দিকে দু’টুকরা হয়ে ভেঙ্গে পড়বে! অনেক চিন্তার পরও মাথায় আসেনি যে, এটার উপরে চেয়ারের মত সাহেবি স্টাইলে বসেই কাজ সাড়তে হয়! ইউসুফ পেট চেপে বসে আসে, আবার ফিরে এসে বলল ফ্লোর এর মাঝখানে যে ট্র্যাপ আছে সেটাতে কাজটা সেরে ফেলবে কিনা! নিষেধ করলাম! কেননা ফ্লোর ট্র্যাপের পানি ঘরের বাহিরে বাগানে ঢুকে পড়ে, দুপুর বেলাতেই তা দেখেছি। তাকে বললাম চেপে রাখ, দেখা যাক সকাল বেলায় কি করা যায়!
পেটের অস্বাভাবিক চাপের উপর নতুন মাত্রায় চাপ বৃদ্ধির হবার ভয়ে সে আর রাত্রে খানা খায়নি। আমিও যথাসম্ভব কম করে খেলাম। চাঁদের জ্যোৎস্না ভরা রাত, পুরো বাংলোকে দিনের মত পরিষ্কার দেখাচ্ছে! লক্ষ লক্ষ জোনাকির আনাগোনা, বেলি ও হাসনাহেনার সৌরভে এমন মায়াময় মোহনীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যেখানে দাঁড়ালে অনুভূতি শেয়ার করার জন্য অবশ্যই একজন সঙ্গীর অভাব তীব্র ভাবে অনুভব হবে। সেই পরিবেশে দাড়িয়ে ইউসুফ প্রশ্ন করছে, কিছু ভেবে পেয়েছ পায়খানা করব কোথায়? ইউসুফকে ভুলিয়ে রাখতে ও ম্যানেজার পরিবারে সাহস জোগাতে জোনাকির আলোতেই বাংলোটি আরো কয়েকবার প্রদক্ষিণ করলাম। ম্যানেজারকে সাহস দিতে বলা ছিল আপনারা ঘুমাবেন আমি পুরো রাত চেতন থাকব! তবে কিভাবে চেতন থাকব তখনও ঠিক করতে পারি নাই। হাটতে হাটতে বাংলোর একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, চারিদিকের নান্দনিক নৈসর্গিক দৃশ্যের বর্ণনা করছি! এমন সময়ই, আমি আর ধরে রাখতে পারছিনা বলে, ইউসুফ কাপড় তুলে ঠিক সেখানেই বসে গেল! তাকে ডাক দিলাম, তুমি করছ টা কি! ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। অন্ধকারে আওয়াজ শুনে মনে হল সেখানে মলের পাহাড় জমে উঠেছে! দুঃচিন্তায় মাথায় ভোঁ ভোঁ করছিল; কেননা এই বাংলোর কোন বাসিন্দা সকালের ঘুম ভেঙ্গে, সামনে তাকাবা-মাত্রই, যে জিনিষটা নজরে পড়বে, সেটা হল ইউসুফের মলের পাহাড়। তার উপর গোস্বা আসল, কেননা একই ধরনের ঘটনা সে এটা দ্বিতীয়বার ঘটাল! আগের বারে মহামান্য কোদাল পোকায় ইজ্জত বাঁচিয়েছিল! এবার কে ইজ্জত বাঁচাবে সেই চিন্তায় আমি অস্থির! নামকরা কলেজের প্যান্সিপ্যাল এই বন্ধুটির দুরবস্থার কথা মনে পড়ে এখনও হাসি পায়।
এই ঘটনায় আমি হতবাক কিংকর্তব্য বিমূঢ়। সকালে কি উত্তর দিব, কিভাবে এই নোংরা দূর করব এই দুঃচিন্তায় আমার পুরো রাতের ঘুম উধাও হয়ে গেল। এসেছি জ্বিন তাড়াতে, সেখানে এখন বসে বসে মল তাড়ানোর দুঃচিন্তায় আমি ব্যস্ত। ইউসুফ খুব আরাম বোধ করল ফলে প্রশান্তির ঘুম তাকে গ্রাস করল। বাংলো থেকে বের হলাম, চিন্তা করলাম দেখি কোথাও একখানা কোদাল পাই কিনা? তাহলে মেথরের কাজ টা না হয় নিজেই করে ফেলব, কেননা এখানে আমার ইজ্জতই সবচেয়ে বেশী মূল্যবান। ভাগ্যিস বাংলোর দারোয়ান সহ সবাইকে বলেছিলাম, রাত্রে ঘুরাঘুরি করব। নতুবা চোর বলে চিল্লিয়ে বাগানের হাজার হাজার কর্মচারীকে জড়ো করত। অনেক চেষ্টার পরও একটি কোদাল জোগাড়ে ব্যর্থ হলাম। অতঃপর হতাশ হয়ে ঘরে বসে চিন্তা করলাম, ঘুমানো যাবেনা। সকালের আলো ফুটে উঠার সাথে সাথেই, গাছের কাচা পাতা জোগাড় করে, কেউ দেখার আগেই ওসব পরিষ্কার করব। জানালা দিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম, ত্রিশ মাইল দূরে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপরের বসানো বৈদ্যুতিক বাতিটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নিস্তব্ধ শান্ত রজনীর পরিষ্কার জ্যোৎস্না, ফুলের সৌরভ, জোনাকির আলোর সকল সৌন্দর্য, দুষ্ট জিনের ভীতিকর আবির্ভাবের সকল চেতনার উপরে চেপে বসল, আগত সকালের প্রথম কাজটি দুঃচিন্তা নিয়ে। বারবার চিন্তা করছিলাম, জান্নাতে এই ধরনের একটি ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন, আমাদের সকলের পিতা, বাবা আদম (আঃ)। এই ঘটনা আর আমাদের বাবা আদমের ঘটনা সমান নয়, নিশ্চয়ই কোটি গুন বেশীই হবে। তবে তাঁর দুঃচিন্তা, হতাশা, মনের জ্বালা, ক্ষোভ, লজ্জা ও ভয় কি পরিমাণ ছিল, তার কিঞ্চিত হলেও অনুমান করতে পেরেছি!
পুরো রাত চেতন, শেষ রাত্রের দিকে একবার জায়গাটি জরিপ করতে গেলাম, কোথাও কিছু দেখলাম না। ভাবলাম হয়ত মাটির রঙ আর মলের রঙ একই হওয়ায় দেখতে ভ্রম হয়েছে। সাত সকালে দুঃচিন্তা মাথায় নিয়ে মেথরের কাজ সাড়তে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার চোখ ছানাবড়া। সেই জায়গাটি একেবারে পরিষ্কার, মানুষের মল দূরে থাক, আশেপাশে অন্য কোন নোংরার চিহ্ন পর্যন্ত সেখানে নাই! ভাল করে তাকাতে দেখি, একজন সকল মল গুলোকে খুব যত্নের সহিত সরিয়ে ফেলেছে। তখন তিনি ফিনিশিং পর্বে ব্যস্ত। আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জানালাম, তিনি দ্বিতীয়বারও একই কায়দায় আমার ইজ্জত রক্ষা করছেন, শরমিন্দা হতে হয়নি! চিন্তা করলাম যত ঘৃণিত সৃষ্টিই হোক না কেন, সেটা কোন না কোন ভাবে মানুষেরই উপকারে আসে। মসজিদের ইমাম সাহেবের কথা মনে পড়ে গেল, তিনি একদা মসজিদে উল্লেখ করেন; আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, ‘আমি তামাসাচ্ছলে কোন কিছুই সৃষ্টি করিনি’।
সকালে ম্যানেজার দম্পতির ঘুম ভাঙ্গার পরে জানতে পারলাম তাদের ভাল ঘুম হয়েছে। তারা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হলেন এবং বললেন, জ্বিনের উপদ্রব দূর করার জন্য আমি পুরো রাত ঘুমাই নি। তারা রাত্রে বহুবার টের পেয়েছেন যে, আমি একাকী বাংলোর চারিদিকে পায়চারী করছি। আমার কাজের উপর তাদের আস্তা বিশ্বাস বেড়েছে, তবে এক সপ্তাহের জন্য তারা শহরে যাবে, শহর থেকে ফিরলে আমাকে আবারো ডাকা হবে। সকালের প্রাতরাশ শেষেই সবাই বাংলো থেকে বের হয়ে আসলাম। আমিও বাঁচলাম, কেননা আমাকে কোন জ্বিন-ভূতের মুখোমুখি হতে হয়নি।
বাল্যকালে এক শহুরে বন্ধু গ্রামে বেড়াতে আসায়, তাকে গ্রাম দেখাতে বের হয়েছিলাম। আমাদের পুকুর পাড়ের কবরস্থানের নির্জন পরিবেশ দেখে তার কাছে ভাল লেগেছিল। সে বিরাট কবরস্থানের নির্জন স্থানগুলো খুঁটিয়ে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করল। এই পরিবেশ গ্রামীণ ছেলেদের জন্য বিরক্তিকর হলেও শহুরে ছেলের কাছে কেন জানি উপভোগ্য মনে হয়েছিল। সেদিনও কিভাবে যেন অন্য গ্রামের শিশু ইউসুফ আমাদের সঙ্গ নিয়েছিল। কবরস্থানের এক জায়গায় দাড়িয়ে আমি সবাইকে পাখির বাসা ও মান্দার গাছের সুন্দর ফুল দেখাচ্ছিলাম হঠাৎ ইউসুফ প্রশ্ন করল পায়খানা করব কোথায়? তাকে বললাম সেটার ব্যবস্থা তো আমাদের বাড়িতে! সে বলল তার এখন, এই মুহূর্তে কাজটি সাড়তে হবে! বলতে না বলতে আমাদের সামনেই একটি ঝোপের আড়ালে বসে গেল!
ডানপিটে, রগচটা স্বভাব, সদা দোষ তালাশে ব্যস্ত, দুষ্ট আলমগীর সাথেই ছিল! সে চিল্লানো শুরু করল, আরেক গ্রামের ছেলে আমাদের কবরস্থানে পায়খানা করে দিয়েছে। আমার মেহমানের সাথে ইউসুফ এসেছে তাই সঙ্গত কারণে এই দোষ আমার উপরও বর্তায়। আলমগীর গ্রামের মুরুব্বীদের দৃষ্টি লাভের আশায় এক নাগাড়ে চিল্লাছে। আমি ধমক দিয়ে বললাম, তুমি চিল্লাচ কেন? এটা তো আমার দাদার কবর! সমস্যা হলে আমারই হবার কথা, তাতে তোমার কি? বস্তুত এটা আমার দাদার কবর ছিল এবং মলত্যাগ হয়েছে কবরের ঠিক উপরে। আমার দেওয়া তথ্যে আলমগীর আরো সুযোগ পেয়ে বলতে লাগল, কবরে আমার দাদার মুখের উপর পায়খানা করা হয়েছে, আপনারা যারা কাছে আছেন দেখে যান।
ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি হাজির! ভৌঁ করে আমাদের চারিদিকে তিন চক্কর দিলেন! তারপর মলের কাছাকাছি স্থানে ল্যান্ড করলেন! গুবড়ে পোকার মাথায় একটা শাবল থাকে, সেটার ব্যবহার কোনদিন দেখিনি। আমাদের চোখের সামনে, বুল ডোজারের শক্তি নিয়ে, মাথার শাবল ব্যবহার করে সে কিছুক্ষণের মধ্যেই গোলাকার ও গভীর একটি টানেল বানিয়ে ফেলল! আলমগীর সহ সবাই আমরা তাকিয়ে রইলাম। সবাই চিন্তা করছে, গোবরে বেটার মতলব কি? বৃহৎ আকৃতির গোবরে পোকা সচরাচর চোখে পড়েনা, এগুলোর কাজ কি তাও জানতাম না। আজ সে চোখের সামনে সুন্দর গর্ত খুড়তে দেখে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলাম। অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার বলা যায়! সে মলের পরিমাণ দেখে, কত ঘন ইঞ্চি ব্যাসের গর্ত লাগবে তা আগেই নিরূপণ করে নিয়েছিল। এবার সে মল গুলো গর্তে ঢুকাতে শুরু করল। সমুদয় মলের উপর দখল প্রতিষ্ঠা করতে তার বেশীক্ষণ সময় লাগল না! এক পর্যায়ে আলমগীর দেখল হায়! হায়! একটু পরেই এই গুবড়ে পোকা সমুদয় মাল মাটিয়ে গায়েব করে ফেলবে! এবার সে নিরীহ পোকাটিকে ধমক দিল, আমরা তাতে বাধা দিলাম। আলমগীর পুনরায় চিল্লানো শুরু করল, আপনারা তাড়াতাড়ি দেখতে আসেন, কবরের পায়খানা সব গুবড়ে পোকায় নিয়ে যাচ্ছে। সব গুবড়ে পোকায় নিয়ে যাচ্ছে................।
আগের পর্ব: সোনার ডেক উদ্ধার! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-২৩ পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।
বিষয়: বিবিধ
১৮১৭ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দোস্ত ইউসূপ উত্তর দিলো শালা তোরে নিয়ে যেখানেই যায় সেখানেই গ্যাঞ্জাম সৃষ্টি করস? নিজের বিপদ নিজেই সামলা! তখন কি আর করা! ইকু পার্কের এক উচু টিলা থেকে সরু পথে সোজা ঝাড় জঙ্গলের ফাকে একদম নীচে চলে গেলাম। প্রায় আড়াই শ ফুটের কম হবে না। আরো শ খানেক ফুট নীচে নামতে পারলে সেখানে একটি লেক এবং পানি পাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু নামার কোন সুযোগ নেই। অগত্যা পাহাড়ী ঝাড়ের আড়ালে সুযোগ করে এনসিসি ব্যাংকের লেনদেন সাড়তে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। মনের সূখে কাজ শেষে পকেটের টয়লেট টিস্যু দিয়ে বিপদ মোকাবিলা করতে গিয়েই গ্যাঞ্জামটা লেগে গেলো। আমার অবস্থান থেকে আরেকটু নীচে, অনেকটা পাহাড়ী গুহার মত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। সেখানে আমার আগে থেকেই রোমিও জুলিয়েটের মত এক জুটি অবৈধ কর্মকান্ডে জড়িত ছিল তা আমি টের পাইনি। হয়তো তারা আমার কি কারণে যাওয়া সেটা বুঝতে পেরেই এতোক্ষণ চুপ ছিল যে, আমি প্রাকৃতিক কাজ সেরে চলে যাবো, তাদের দেখতে পাবো না, তারাও লজ্জা শরম থেকে বেচে যাবে। কিন্তু যখনই আমার ব্যবহৃত টয়লেট টিস্যু গুলো গিয়ে তাদের গায়ে পড়লো তখনই তারা এক সাথেই চিল্লাই উঠলো- ঐ মিয়া হাগু দিচ্ছেন ভাল কথা, আমাদের গায়ে কেন ব্যবহৃদ টয়লেট টিস্যু নিক্ষেপ করছেন? নীচ থেকে হঠাৎ মানব যুগলের আওয়াজ শুনে আমি তো চাপ ধড়!!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন