সোনার ডেক উদ্ধার! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-২৩ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ২৯ জুন, ২০১৪, ০৩:৩৭:৪৭ দুপুর
একদা বসন্তের এক কাক ডাকা ভোরে আমার মুখ চেনা সাইফুল মিস্ত্রী হন্ত দন্ত হয়ে উপস্থিত! তিনি জানালেন আমার স্ত্রী আবারো সোনার ডেকের সেই স্বপ্নটি দেখেছে! যদি এক সপ্তাহের মধ্যে ডেকটি মাটি থেকে তুলে না আনি তাহলে, সেটা আমাদের হাতছাড়া হয়ে অন্যজনের কাছে চলে যাবে! আমার বউকে এবারো স্বপ্নে জানানো হয়েছে, সোনার ডেকের বিনিময়ে আমার একটি সন্তান কে জ্বিনেরা হত্যা করবে। এখন আমি কি করতে পারি যদি শেষ বারের মত একটু পরামর্শ দিতেন! আপনি যদি আমার সন্তানকে বাঁচিয়ে সোনার ডেক উদ্ধার করে দিতে পারেন, তাহলে পুরো মালামালের চার ভাগের এক ভাগ আপনার! এক সপ্তাহের আজ দ্বিতীয় দিন, আমি আপনার সন্ধানে দুটি দিন নষ্ট করেছি। সুতরাং সময় নষ্ট করার আর সুযোগ নাই। তাছাড়া যে জায়গার সোনার ডেক থাকার কথা, সে জায়গাটি আমরা স্বামী-স্ত্রী গোপনে গিয়ে দেখে এসেছি। আমি শতভাগ নিশ্চিত সেখানে সোনার ডেক থাকবে। আর যদি না থাকে তাহলে আপনার লোকসানির তো কিছু যায় আসে না।
ইতিপূর্বে মুন্সীর ছেলে দিয়েছিল পাঁচ ভাগের এক ভাগ স্বর্ণের প্রলোভন। এবার এসেছে চার ভাগের এক ভাগ সোনার লোভ! তাছাড়া মুন্সীর ছেলের তথ্য উপাত্ত গুলো দূরহ ও অজানা ছিল কিন্তু সাইফুল মিস্ত্রীর তথ্য-উপাত্ত পরিষ্কার ও সুনির্দিষ্ট! শুধু আমার একটি সাহসী সিদ্ধান্তের দরকার! সিদ্ধান্তটি হল, সাইফুলের সন্তানকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে হবে এবং সোনার ডেকটি তুলে আনতে হবে। সাইফুল দম্পতির অবস্থাটি এমন যে, আমি যদি বলি তোমার সন্তানের কোন সমস্যা হবেনা, এগিয়ে যাও এবং সোনার ডেক তুলে আন। এতটুকু সাহস দিলেই তারা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি ভাবছি এ ধরনের অনিশ্চয়তা ও অদ্ভুত ধরণের বিপদজনক উৎসাহ প্রদান আদৌ সমীচীন হবে কিনা? আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে চার ভাগের এক ভাগ সোনার ভাগ বাটোয়ারার প্রলোভনের চেয়ে আসল ঘটনা নিজে চোখে দেখা ও বিস্তারিত জানা! ঘটনার শুরুতেই তাদের না বোধক জবাব দিলে, কিছু জানা হবেনা দেখাও হবেনা! একটু যাচাই বাছাই করা দরকার বললে; হাতে সময় পাব, সত্য জানতে পারব, তাছাড়া মাঝ পথে অভিযান পরিত্যক্ত করার সুযোগ তো থাকছেই!
তখনই মাথায় একটি কথা আসল, তাদের বললাম আগে আমাকে সেই জায়গা টি দেখাও। আগে আমি জায়গাটি দেখি, পর্যবেক্ষণ করি তারপর তোমাদের বলব কি করা যায়। জায়গাটি আমাকে দেখানোর এই এ কাজে যদি সন্দিহান হও তাহলে দুটো উপায় অবলম্বন করো। এক, গভীর রাত্রে আমাকে সেখানে নিয়ে চল যাতে করে আমি পথ না চিনি। দুই, আমার চোখ বন্ধ করে আমার হাত ধরে সেখানে নিয়ে চল, সেক্ষেত্র ও আমি জায়গাটি চিনব না। সাইফুল ভাবতে কিছুক্ষণ সময় নিল অতঃপর বলল, এখন কৃষ্ণ পক্ষ চলছে, রাত দশটার দিকে আমরা তিন জন সেখানে যাব। আমাকে নিজ দায়িত্বে রাত্রের আঁধারেই তাদের বাড়ীতে আসতে হবে! ইতিপূর্বে আমার বন্ধুকে নিয়ে একটি লোমহর্ষক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম যা আগের পর্বে বলেছি। এখানে কোন ভরসায় আমি গায়ে পড়ে আরো বিপদজনক ঝুঁকি নিতে যাচ্ছি তা একটু পরিষ্কার করাটা দরকার হয়ে পড়েছে!
আমার এক ফুফাতো বোন, আমার ছোটকালেই তার বিয়ে হয়। স্বামী অবস্থা সম্পন্ন না হলেও স্বাবলম্বী। আমাদের বাড়ী যেহেতু তাঁর মামার বাড়ী, সে হিসেবে বছরে চার-পাঁচ বার বেড়াতে আসত। আমার আব্বা-আম্মা দুজনই মেহমান প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। সে জন্য বাড়ীতে সর্বদা মেহমান লেগেই থাকত। আমি এসব দেখতে দেখতে বড় হয়েছি বলে, মেহমান কে উপদ্রব মনে করতাম না এখনও করিনা। কদাচিৎ বোনটি মামার বাড়ীতে বেড়াতে আসার সময় তাঁর ছোট দেবরটিকে সাথে নিয়ে আসতেন। এই সাইফুল হল বোনের সেই দেবর! সাইফুলের একগাদা সন্তানাদি, সবগুলো ছেলে! এত সন্তানের চাপে তার সংসার চালানো কঠিন হয়ে উঠেছিল। এই সমস্যার মাঝে, তার স্ত্রী স্বপ্নে দেখে যে, তাদের বাড়ীর অদূরে, নদীর বাঁকে একটি ছোট্ট জাম গাছের ছায়ায় মাটির নীচে সোনা ভরা ডেক লুকানো আছে! তার একটি সন্তানের জীবনের বিনিময়ে সে ডেকটি তুলে আনতে পারে। কাজটি অতি সত্বর করতে হবে, কেননা স্থানটি একটি পাহাড়ি খালের পানিতে ভেঙ্গে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
এই ঘটনাটি বিস্তারিত জানিয়ে সমাধান করতে আমারই ফুফাতো বোনকে মাধ্যম ধরে একদা সাইফুল দম্পতি আমার কাছে এসেছিল। এটা স্বপ্নে দেখার প্রায় এক মাস পরের ঘটনা। তখন তাদের বলেছিলাম যেহেতু ঘটনাটি পুরানো হয়েছে কিংবা সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের সুযোগ নাই, তাই আপাতত আমি কোন ভূমিকা রাখতে পারলাম না। আবার যদি কখনও এমন স্বপ্ন দেখা যায় তখন চিন্তা করব। আমার ফুফাতো বোনটি তখনই প্রাপ্ত সম্পদের চার ভাগের এক ভাগের কথা তুলে আমাকে এই কাজটি করে দেবার জন্য আবদার করেছিল। যাক, এ ঘটনাটিকে একটি স্বপ্ন মনে করে ভুলতে বসেছিলাম, তবে পুনরায় যখন সাইফুল স্বপ্নের কাহিনী নিয়ে, এগিয়ে আসে তখন নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছি। গ্রামের ভাবীর দেখা এ জাতীয় একটি গুরুত্বহীন স্বপ্নের কাহিনী দিয়েই তো আমার এই বিদঘুটে জীবনের শুরু হয়েছে। তাই এবার ঘটনাটিকে হালকা করে নিলাম না। তাদের সাথে রাতের অন্ধকারে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম, এই ঘটনার একজন গোপন সাক্ষী আমার আপন ফুফাতো বোন তো সাথে আছেই। তাছাড়া আমি কোথায় কার কাছে যাচ্ছি, এটার একটি বিস্তারিত বিবরণ ঘরে রেখে আসার চিন্তা করি। যাতে করে আমার অবর্তমানে সন্ধান করতে চাইলে আমার খবর সহজে পাওয়া যায়।
পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, সাইফুলের বাড়িটি সেই অলি মিয়া মুন্সীর বাড়ীর এক মাইল পশ্চিমে। রাত সাড়ে আটটার দিকে আমার জায়গা থেকে সাইফুলদের বাড়ীর পানে রওয়ানা হলাম। আগেই বলা হয়েছে, অন্ধকার রাত্রে একাকী চলতে আমার কোন অসুবিধা হত না! তাছাড়া তখনও গভীর রাত নেমে আসেনি। যখন সাইফুল দের বাড়ীর কাছাকাছি পৌঁছই তখন রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। এ দিকের জনবসতিতে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই রাতের নিস্তব্ধটা নেমে আসে। এখনো এই এলাকার ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যায় না, শতভাগ অশিক্ষিত জনপদ বলা যায়। কদাচিৎ দূরের কারো বাড়ি থেকে ইথারে ভর করে, পুঁথির আওয়াজ ভেসে আসে। ফাঁকা রাস্তার অনতি দূরে একমাত্র বড় আম গাছের তলায় কালো ছায়ায় কিছু একটা নড়ছে বলে মনে হল! মারাত্মক কোন প্রাণী হবার সম্ভাবনা নাই। চোর ডাকাত হতে পারে বলে মনে ভয় হল। নিরাপদ দূরত্ব থেকে ডাক দিলাম।
কে?
গাছের নিচ থেকে সোজা উত্তর ভেসে আসল। সাইফুল!
তুমি রাস্তায় কেন?
আপনার আসতে দেরী হচ্ছে দেখে, আমাদের তড় সই ছিল না!
তাহলে তুমি গাছের নিচে লুকোচ্ছিলে কেন?
আপনাকে অন্য কোন আগন্তুক ভেবে, গাছের আড়ালে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম!
আবার পথ চলা শুরু হল, অবশেষে ঘুটঘুটে অন্ধকারের এক স্থানে দাঁড়াতে বলে, সাইফুল কোথায় যেন হারিয়ে গেল! কিছুক্ষণ পরেই তার স্ত্রী ও কিছু যন্ত্রপাতি সহ হাজির। আমার চোখ বন্ধ করা নিয়ে কোন কথা বলা হল না বরং চুপি চুপি জানাল, কিছুটা পথ অন্ধকারে নিঃশব্দে চলতে হবে। সবার পিছনে অন্ধকারে কতক্ষণ চলেছি মনে করতে পারছিনা। তবে চলার সময় আমি যথেষ্ট সজাগ ও সতর্ক ছিলাম। ডানে কত কদম গেলাম, সামনে কত কদম এগুলাম তার একটা ধারনা মাথায় ঢুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করলাম। অবশেষে একটি পাহাড়ি ছোট খাল স্থানীয় ভাষায় ছড়া পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠলাম। তখন সাইফুল সস্ত্রীক দাঁড়ালেন! পকেট থেকে দেয়াশলাই বের করে বড় আকৃতির চেরাগে আগুন ধরালেন। মনে হল পুরো এলাকায় আলো ছড়িয়ে পড়ল। আমার পুরো শরীর ছম ছম করছিল। ইতিপূর্বে একাকী অমাবস্যায় শ্মশানে গিয়েছিলাম তবে আজকের অনুভূতিটা একেবারেই ভিন্ন। কেননা আমাকে অনেক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। ভাবলাম, এত রাত্রে এই নিভৃত পল্লীর অজানা গন্তব্যে কৌতূহলী লোভের কাছে পরাজিত হয়ে এভাবে চলে আসাটা ঠিক হয়নি। সোজাসুজি না বলে দিলে এমন কি হত! পরক্ষণে মনে পড়ল ওরা তো আমাকে জোড় করে আনে নি, আমিও কৌতূহলী ছিলাম, সে জন্য আমার দায় ও কম নয়। ভাবছি আর চলছি! মোহ ভেঙ্গে গেল, যখন শুনলাম আমরা চলে এসেছি।
সাইফুলের স্ত্রী বলল এটাই সেই জাম গাছ। চেরাগের আলোতে জাম গাছের কোন পাতা দেখা যাচ্ছেনা। গাছের স্বাস্থ্য দেখেও বুঝলাম না, লম্বা গাছটির বয়স কত হতে পারে। প্রশ্ন করলাম কিভাবে বুঝলেন এটি জাম গাছ? তখন সাইফুল বলল, দুই দিন ধরে আমাকে না পেয়ে, তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই এই জায়গাতে দিনের বেলা বার কয়েক এসেছে। বুঝলাম নিচে পরিষ্কার হলেও চারদিকে এলাকাটি ঘন জঙ্গলে ভরপুর। জন্মের পরে চারা গাছ আলোর অভাবে পড়লে, আলো পাবার আশায় গাছ আগে লম্বা হতে থাকে, পরে মোটা হয়। বললাম আমাদের কথা কেউ শুনবে না তো! উত্তরে বলল খালের এই পাড়ে কোন বসতি নাই, তাই কারো নজরে চেরাগের আলো যাবেনা এবং কারো কানে কথাও পৌছবে না! এখানে আসার পর বুঝলাম, বিস্তারিত না ভেবে বেকুবের মতই চলে আসলাম। এত বড় জায়গায় খোঁড়া খুড়ি করতে হবে, সেটা কোন জায়গা থেকে শুরু করব, আর কত দিনেই বা কাজ শেষ হবে? আমার কথা শুনা মাত্র সাইফুল পাশের জঙ্গলে আগে থেকেই লুকানো একটি লম্বা লোহার রড নিয়ে আসল। সে রাজ মিস্ত্রির কাজ করত বিধায়, প্রায় দশ হাত দীর্ঘ, মজবুত একটি লোহার রড জোগাড় করতে পেরেছিল! সাইফুল বলতে থাকল, এই মাটি গুলো একেবারে নরম, মাটি কাটাকাটি কোন দরকার নাই!
সাইফুল লোহার রডকে মাটির উপর দাড় করাল এবং জোড়ে নীচের দিকে চাপ দিল। অবিশ্বাস্য! রডটিকে যত চাপে তত নিচের দিকে গেঁথে যাচ্ছে। সে দেখাল এই স্থানের মাটি গুলো ফোস্কা আকৃতির। মাটি দেখতে মজবুত হলেও সহজে এই লম্বা রডটি গায়ের শক্তি ব্যবহার করে মাটিতে গেঁড়ে ফেলা যাবে! প্রমাণ হিসেবে তার লোহার রডের প্রায় পুরাটাই তখন মাটির নিচে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি, অতীত জীবনে এ ধরনের ফোস্কা মাটি দেখিনি! এমন কি এ ধরনের কোন কথাও শুনিনি! আমি জানতাম, যে ডোবায় ‘পদ্ম’ জন্মে, সে ডোবার মাটি ফাঁপা হয়। অনভিজ্ঞ কেউ দীর্ঘ বছরের পুরানো পদ্ম ডোবার, পদ্ম ফুল তুলতে গেলে জান নিয়ে ফিরতে পারবেনা। হালকা কাদায় শুধু ডুবতেই থাকবে, এক পর্যায়ে তিনি কাদার অন্তরালে হারিয়ে যাবেন! বালির এ ধরনের আচরণকে চোরাবালি বলে, সেভাবে এটাকে চোরা কাদা বলা যেতে পারে। তবে শুকনো মাটিতে, দীর্ঘকায় শক্ত দণ্ড ঢুকানো যে এত সহজ, তা আজকের আগে জানা ছিলনা!
লম্বা খুন্তি ও বর্শা আকৃতির একটি ‘ফলা’ ও সাথে করে আনা হয়েছিল। তিন জনে মিলে জাম গাছের নিচের বিরাট জায়গায় কাদা খোঁচা পাখির মত করে খুঁচাতে শুরু করলাম! না! এখন ভয়-ডর কোন টাই হৃদয়ে নাই। সাথে হালকা অস্ত্র আছে, মানুষ আছে তিন জন! সাইফুলের বউ কে কোনদিন দেখিনি, আজো দেখতে পারছিনা। লম্বা ঘোমটা মুখে, তিন চাপে যেভাবে লম্বা খুন্তিকে পুরোপুরি মাটিতে গেঁথে দিচ্ছে! তার চেয়ে চিকন বর্শার ফলা মাটির গেঁথে দিতে আমার আট বার কোশেশ করতে হচ্ছে! এখানকার মহিলারা স্বামীর সাথে চাষাবাদে সাহায্য করে, খুবই পরিশ্রমী এবং স্বামীর প্রতি বেশী আন্তরিক ও দয়াবান। তিনটি মানুষ রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ছিন্ন করে একটি মাত্র চেরাগের আলোর উপর ভিত্তি করে, ঘুমন্ত মানুষের গায়ে মশার হুল ফোটানোর মত করে, আমরাও অবিরত মাটির গায়ে হুল ফুটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম! সাইফুলের বউ বলল তার খুন্তিটি কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে! তার স্বামী কৌতূহলে এগিয়ে আসল। স্বামী শক্ত পেশীর শক্তিশালী হাতে লোহার রড ঢুকাতে চেষ্টা করল। আমি ধারনা করে তাকে বললাম, হয়ত গাছের শিকড়ে রডের অগ্রভাগ আটকে যাচ্ছে।
এবার আমি হাত লাগালাম! অন্যূন ছয় হাত মাটির নীচে রডের অগ্রভাগ সত্যিই কিছুতে আটকে যাচ্ছে। গাছের শিকড়ে আটকা পড়ার পরও জোড়ে চাপ দিলে শিকড় কেটে কেটে কিঞ্চিত হলেও নিচে যাবার কথা কিন্তু এখানে তেমনটি হচ্ছে না। পরে তিন জনেই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে, ছয় হাত নিচে গাছের শিকড় নীচের দিকে নামতে পারে কখনও আড়াআড়ি চলে না। তাই এটি শিকড় হতে পারেনা। এখানে খুন্তি-বর্শা-রড কে এক সুতা পরিমাণ নিচে নামানো যাচ্ছেনা। বাধাটি প্রায় ধাতব বস্তুর শক্ত বাধার মতই মনে হল! ব্যাপারটি একটু নিশ্চিত হতে, আমি বর্শার ফলাটি দুই ইঞ্চি দূরত্বে পর পর মাটিতে ঢুকাতে থাকলাম। একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পার হলে বর্শাটি ঠিকই নিচে চলে যায়। এভাবে সে স্থানে ‘যোগ’ চিহ্নের মত করে দাগ কাটলাম। মাটিতে আমার অঙ্কন দেখে সাইফুল দম্পতি ভাবল, এটা হয়ত মন্ত্র-তন্ত্রের কোন নকশা হবে! পুরো যোগ চিহ্নের দাগের উপরে বর্শার ফলা গেঁথে নিশ্চিত হলাম, মাটির গভীরে গোলাকার পাতিলের মত কিছু একটা বসানো আছে এবং সেখানে মাটির গভীরতার কোন হের ফের নাই! তারা প্রশ্ন করল, আমি কি বুঝলাম? তাদের ধারনায় জায়গাটিতেই সোনার ডেক থাকতে পারে!
তখন মাথায় একটি প্রশ্ন আমাকে বারবার আঘাত করছিল! একজন ভাবী একটি বাচ্চার আশায়, তের বছর ধরে আল্লাহ’র এবাদতের সাথে সাথে; নিজের মানত আর সিন্নি বিতরণে পীর, দরবেশ, মসজিদ, মাজার কোনটাই বাদ রাখে নাই! তাকে সাহায্য করতে গিয়ে আমি আমার জীবনটাকেই উলট পালট করে দিলাম। পিতা-মাতাকে শুধু চোখের জলে ভাসাচ্ছি! এখান থেকে নিস্তারের পথ খুঁজে না পেয়ে, মুক্তির রাস্তা খুঁজতে গিয়ে, এক প্রকার গৃহ হারা হয়ে, উদভ্রান্তের মত বিভিন্ন জনপদে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সেখানে আরেক জন দম্পতি তার অনেক সন্তানের মুখে খাদ্য গুঁজে দেবার ব্যর্থতার জন্য, নিশ্চিত এই বিপদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে! আমি যেভাবে নিশ্চিত হলাম, সোনা-রূপা-লোহা-পাথর যাই হোক, স্বপ্নে দেখানো তথ্য মতে একটি ডেকের অস্তিত্ব তো পাওয়া গিয়েছে। সেভাবে নিশ্চিত হলাম, এই দম্পতির কোন একটি সন্তানকে মরতে হবে, এটাও প্রায় নিশ্চিত! ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর নিমিত্তে, কোন একটি সন্তানের মৃত্যু হয়ত এই গরীব দম্পতি মেনে নিয়েও ফেলতে পারে। সেখানে আমি কেন এই মৃত্যুর দায়ভার নিতে যাব! মনে পড়ল, আমার বাবা গরীব নন বরং তিনি উদার ও দানশীল। রীতিমত মেহমান প্রিয় এক নির্মোহ ব্যক্তিকে আমি যদি স্বর্ণ প্রাপ্তির কথা বলি, নিশ্চিত তিনি এসব পানিতে ছুড়ে মারবেন! ভাবছি, আমি অনর্থক একটি লোভে পড়তে যাচ্ছি এবং অনিশ্চিত খেসারতের মুখে নিজের জীবনকে সঁপে দিতে অগ্রসর হচ্ছি!
এই প্রথম আমি আতঙ্কিত হলাম! যে ধরনের আতঙ্ক আমাকে শ্মশানেও পায় নাই। কারণ ছিল, নীচে গোলাকার কিছু আছে বলে ভ্রম হয়েছে কিন্তু আমি নিশ্চিত নই সেই গোলাকার বস্তুটি কি হতে পারে কিংবা সেই গোলাকার বস্তুর ভিতরে আদৌ কিছু আছে কিনা! যদি থেকেই থাকে, তাহলে জ্বিন সেটা নেবার জন্য আমাকে বাছাই করেনি, করেছে সহায় সম্বলহীন সাইফুল কে। সন্তান দিয়ে যার মূল্য দিতে হবে সাইফুল কে। তাছাড়া তার স্ত্রীর স্বপ্নের সাথে প্রায় হুবহু মিলে যাওয়ায় বিষয়টি আমাকে আরো বেশী ভাবিয়ে তুলেছে! অন্যদিকে সবাই আমাকে জ্বিনের ডাক্তার বললেও আমি জানি আমার বিদ্যার দৌড় কতটুকু। কোন ক্ষিপ্ত জ্বিনকে প্রতিরোধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি সেক্ষেত্রে আমি নিজেকেও বাঁচাতে সক্ষম হব না! অজানা আতঙ্ক ও ভয়, আমার মন আমাকে আর সামনে না যেতে বাধা দিচ্ছিল।
হাত ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম! বলে বললাম, দেখো আমি তোমাদের কিছুই বলতে পারছিনা। তোমরা নিশ্চয়ই আকল দিয়ে বুঝেছ এই মাটির নিচে কি থাকতে পারে? আমি এই রাত্রেই খালাম্মাদের বাড়ীতে ফিরে যাব। আমি তোমাদের সাথে এসেছিলাম এই কথা আমার ফুফাতো বোনকে বলার দরকার নাই, আমিও সে কথা বলতে যাব না। মানুষের হায়াত মউত সব আল্লাহর হাতে। কেউ কাউকে বাঁচাতে পারেনা আবার কেউ মারতেও পারে না, যদি না তাঁর সম্মতি না থাকে। জ্বিন আছে একথা সত্য, নাহলে তোমার স্বপ্ন সত্য হতো না। জ্বিনেরা গায়ে পড়ে মানুষের ক্ষতি করতে আসে না, যতক্ষণ না মানুষ তাদের ক্ষতি করে। সুতরাং আমি জ্বিন ও তোমাদের মাঝখানে কোন ভূমিকা রাখতে চাইনা। বেশীর বেশী আমি তোমাদের সবার জন্য শরীর বন্ধের তাবিজ ও পানি পড়া দিতে পারি। আমি এসব তৈরি করে রাখব, আগামী পরশু বাজার বারে, বিকাল বেলায় বাজার থেকেই নিতে পারবে। সর্বোপরি কথা হল, স্বর্ণের ভাগ নেবার কোন ইচ্ছা আমার নাই। স্বর্ণ পাবার গুজব উঠে ইতিপূর্বে আমার জীবন বিপন্ন হতে যাচ্ছিল, তাই তোমাদের এখানে সোনার তালাশে এসেছিলাম এই কথা আমি যেভাবে গোপন রাখব, তোমারাও গোপন রাখবে। নতুবা সোনা না পেয়েও পুলিশের লাটির বাড়ি আর ডাকাতের গুলিতে প্রাণ হারাতে হবে। এই বলে রাতের অন্ধকারে সেখান থেকে বিদায় নিলাম। আমার মনে হল, আমি নতুন করে বুকের পিঞ্জরে প্রাণ ফিরে পেলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম বাকী জীবনেও কোনদিন এসব কাজে উৎসাহী হব না।
বাজার বারে সাইফুল আর আমার সাথে দেখা করেনি। আমার তাবিজ লিখার কাজটি এই প্রথম পণ্ডশ্রম হল। বাজারে সাইফুলকে তেমন আর দেখা যেত না। খালাম্মা আমাকে রাখার জন্য তাদের পাকা বাড়ির লাগোয়া আরেকটি নতুন ঘর বানানোর চিন্তা করলেন। দক্ষ রাজমিস্ত্রির খোঁজ নিতে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন, মিস্ত্রি সাইফুল রাজমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে দিয়েছে। সে তার ছেলেকে নিয়ে তাদের এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বড় আকৃতির একটি মুদীর দোকান দিয়েছে! সাইফুলকে আমার সাথে দেখা করার জন্য খবর দিয়েছিলাম কিন্তু সে আমার এই খবর পাওয়ার পরও কোনদিন দেখা করতে উৎসাহ বোধ করেনি! একদিন তার দোকানে গিয়েছিলাম, আমাকে দূর থেকে দেখে আগে ভাগেই দোকান থেকে কেটে পড়েছিল! ফলে আমিও আর তেমন আগ্রহ দেখাই নি।
সাইফুলের হঠাৎ তরক্কীর কথা জানতে পেরে, কিছু দিন পরে, আমি একবার আমার এক বন্ধু সহ সে স্থানটি দেখতে গিয়েছিলাম! অনেক চেষ্টায় স্থানটি উদ্ধার করেছিলাম। দেখে মনে হয়েছে বুল-ডুজার দিয়ে জায়গাটিকে বারংবার উলট পালট করা হয়েছে! বন্ধুটিই বলল, কেউ এই জায়গাটিতে তন্ন তন্ন করে কিছু খুঁজেছে। তবে জঙ্গলাকীর্ণ এই জায়গাটি দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এখানে কোন কালে মানুষ বসবাস করত। হয়ত কারো খামার বাড়ী ছিল। এখানকার সবার ঘর বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় বলে, এই জায়গায় ঘরের কোন চিহ্ন অবশিষ্ট নাই। তবে সেখানে জাম গাছের পাশাপাশি, বেশ কিছু আম ও কাঁঠাল গাছ দেখেছি। একটি বেল গাছকে জঙ্গলের সাথে লড়াই করে বাঁচতে দেখেছি। একটি তিতা করল্লার লতা কয়েক কাঠা জায়গা দখলে নিয়েছিল। তখনি যত তাজা তিতা করল্লা লটকে থাকতে দেখেছি, ওজনে বিশ কেজির কম হবার নয়! পাখিদের মল ত্যাগের মাধ্যমে কদাচিৎ পেয়ারার বিচির ন্যায় ছোট বিচির ফলের গাছ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে, আমের আটি, বেল-কাঁঠালের বিচি পাখি গিলতে পারে না, তাই পাখির মাধ্যমে এগুলোর বীজ ছড়ায় না। বনে জঙ্গলে আম-কাঁঠাল গাছ দেখলে বুঝা যায়, কখনও এখানে মানুষের বসতি ছিল এবং নিজের প্রয়োজনে এসব রোপণ করেছিল। সর্বোপরি আসল কথা হল, খালের পারের, জঙ্গলাকীর্ণ এই জায়গাটির ওয়ারিশ ছিল অলি মিয়া মুন্সীর ছেলেরা..............
আগের পর্ব: সোনার হাড়ির সন্ধান লাভ! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-২২ পড়তে চাইলে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।
বিষয়: বিবিধ
২৪৬৩ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এতটা ঝুঁকি নেয়ার সাহস করলেন কি করে???
তবে এধরনের গুপ্তধন পাওয়ার খবর একেবারে মিথ্যা নয়। আমার আম্মার কাছে শুনেছি ফিরিঙ্গিবাজারে তাদের বাড়ির পাশে যেখানে এখন সিটি কর্পোরেশন হেলথ ইন্সটিটিউট সেখানে বাজারের ব্যবহার্য একটি ছোট পুকুর ছিল। তারা একদিন হঠাৎ দেখেন তাদের বাড়ির দেয়াল ঘেষে একটি বড় গর্ত। পরে জানতে পারেন কয়েকজন বার্মিজ মগ কিছুদিন হলো শুটকি বিক্রির ছদ্ধবেশে এখানে এসেছিল। সম্ভবত তারা কিছু তুলে নিয়ে গিয়েছে। তাদের কাছে সম্ভবত প্রয়োজনিয় তথ্য ছিল। ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বিপগুলিতেও মাঝেমাঝে জলদস্যুদের লুকিয়ে রাখা এই ধরনের গুপ্তধন এখনও পাওয়া যাওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। বুজর্গ উমেদ খান চট্টগ্রাম বিজয় এর পর আরাকানি প্রজা হিসেবে চট্টগ্রামের বহু মগ নাকি পালিয়ে গিয়েছিল। তারা তাদের মুল্যবান সম্পদ এভাবে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল। চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ পুনর্নিমান এর সময় পাইলিং এর জন্য গর্ত খুড়তে গিয়েও কিছু পুরান ডেকচি আবিস্কৃত হয়েছিল। অনেকে বলেন সরকারি কর্মচারিরা সেখান থেকে কিছু আত্মসাত করেছে। হারবাং এলাকায় আমার পরিচিত একজন বিল্ডিং তুলার সময় পাইলিং করতে গিয়ে সত্যিই কিছু বৃটিশ আমলের স্বর্ন ও রেীপ্য মুদ্রা ভর্তি কলস পেয়েছিলেন। সম্ভবত নিরাপত্তার জন্য তার কোন পুর্বপুরুষ এভাবে রেখেছিলেন কিন্তু পরে বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। তবে এই সব দেখে একটা কথাই মনে পরে। মানুষ স্বর্ন ও রেীপ্য বা অর্থ সঞ্চয় করে। কিন্তু মৃত্যুর পর এগুলি তার কোন কাজেই লাগেনা।
-বাংলাদেশের আইনে মাটির নীচের সম্পদের মালীক রাষ্ট্র, কোন মতেই সাইফুল নয়।
-সাইফুল যদি সেখানে কিছু পেয়েও থাকে সে, তাহলে ওয়ারিশেরা মালিক হবে কোন মতেই সাইফুল নয়।
সাইফুল সম্পদ পেয়েছে আমি কথাটি স্বীকার করলে আমি হলাম সাক্ষ্যি। আসামী একজন আর বাদী থাকছে দু'জন। সুতরাং ব্যাপারটি ঝামেলা যু্ক্ত। তাই আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলা মোটেউ সমিচীন হবে বলে মনে করিনা।
এই পর্বটি খুবই জটিল লাগছে, কিছু জট থেকেই গেলো।
-বাংলাদেশের আইনে মাটির নীচের সম্পদের মালীক রাষ্ট্র, কোন মতেই সাইফুল নয়।
-সাইফুল যদি সেখানে কিছু পেয়েও থাকে সে, তাহলে ওয়ারিশেরা মালিক হবে কোন মতেই সাইফুল নয়।
সাইফুল সম্পদ পেয়েছে আমি কথাটি স্বীকার করলে আমি হলাম সাক্ষ্যি। আসামী একজন আর বাদী থাকছে দু'জন। সুতরাং ব্যাপারটি ঝামেলা যু্ক্ত। তাই আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলা মোটেউ সমিচীন হবে বলে মনে করিনা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন