টিপু শাহের মুরিদ দরবেশ ‘নজু’ শাহের আবির্ভাব! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-২১ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ২২ জুন, ২০১৪, ০৫:০৭:১১ বিকাল
পাঠকেরা নিশ্চয়ই বৈরাগীর টিলার সেই নজির আহমদের কথা ভুলে যান নাই! অদ্ভুত ও অসম্ভব সাহসী মানুষটির নাম তার দাদা নজির আহমেদ না রেখে যদি বে-নজির আহমেদ রাখতেন তাহলে নামের যথাযথ সার্থকতা হাসিল হত! শ্যামলা চামড়া, চুলে পাক ধরেছে অনেক আগেই। শরীর প্রস্তের তুলনায় দৈর্ঘ্যে একটু বেশী হওয়াতে, ধনুকের মত সামনের দিকে কিঞ্চিত বাঁকা হয়ে থাকে! পাঁজরের হাড়গুলো প্রত্যেকটি আলাদা করে গণনা করা যাবে। পাতলা গঠনের এই মানুষ যখন আড়াই মণ ওজনের চাউলের বস্তা কাঁধে তুলে নেয়; তখন যে কেউ তার দিকে তাকিয়ে এই ভেবে তাজ্জব হবে যে, চাউলের বস্তা কি নজিরের কাঁধে, নাকি নজির চাউলের বস্তার সাথে লটকে আছে! চোখ দুটো কোটরের গভীরে, দেখলেই মনে হয়, কলিজায় অসম্ভব সাহস। হাতের আঙ্গুল গুলো পেরেকের মত সরু, পায়ের আঙ্গুলের শেষাংশ দেখতে গোখরো সাপের মাথার মত! চল্লিশের কাছাকাছির বয়সী নজিরের দাবী এখনও সে চির কুমার! কলিজা অনেক কঠিন হলেও হৃদয় এখনো কারো জন্য নরম! গলার স্বর খুবই গভীর এবং কর্কট। বেসুরো গলায় গান গাইলে, পথিক চিৎকার করে বলে থাম! আর কষ্ট করে গাইতে হবেনা। মাটিতে হাঁটলে, পায়ের মুড়ি ও আঙ্গুলের অগ্র ভাগের ছাপ পড়ে, মাঝখানে খালি! হাতের পাঞ্জার ছাপ অদ্ভুত! ইংরেজি এক্স আকৃতির কুনোকুনি ধরনের আকৃতি। হাত গণক দেবেন্দ্র বিজয় শাস্ত্রী একদা তার হাত দেখে বলেছিলেন, তোমার মত হাতের ছাপ তো আমার বিদ্যা ও বইয়ের মাঝে নাই। এই নজির আহমেদ শেষ পর্যন্ত যে কাজ করে বসলেন আমি তা কল্পনাও করতে পারিনি।
নূর জাহানের একপক্ষীয় প্রেমে মশগুল নজির আহমেদ, স্থানীয় ধনী চৌধুরীর বাড়ীতে কাজ করে। শয়নে, স্বপনে সদা নূর জাহানের জন্য তার হৃদয় চিত্ত অস্থির! যে করেই হোক, সে নুর জাহানকে সে আয়ত্ত করতে চায়। আর সে জন্য দরকার, ভালবাসা সৃষ্টির একটি তাবিজ! নজিরের ভাষ্যানুযায়ী, নূর জাহান নজীর আহমদকে সহ্যই করতে পারেনা। নজীরকে ক্ষতিকর মানুষ হিসেবে মনে করে। নজীর তার মন পাবার চেষ্টায় নূর জাহানকে সালাম দিলেও, সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। নজিরের অগাধ আস্তা ও বিশ্বাস, আমার তাবিজের গুনে নূর জাহানের হৃদয় পারদের মত গলে যাবে। নতুবা সে বেশী দিন বাঁচবে না। তার কাছে তেমন সহায় সম্পদ নাই, যা দিয়ে সে আমাকে খুশী করতে পারবে। তবে তার পক্ষে সম্ভাব্য সবই আমার খুশীর জন্য ব্যয় করা হবে! নতুবা কোন এক সকালে সবাই শুনতে পাবে নজির আহমেদ গলায় রসি বেঁধে গাছে লটকে গেছে! চল্লিশ বছরের এক ব্যক্তি একটি তাবিজের আশায় এক কিশোরের কাছে যেভাবে আকুল আবেদন করছে, তা দেখে আমি যথেষ্ট বিব্রত বোধ করলাম। কি উত্তর দিব, বুঝতে পারছিনা, কিভাবে তাকে বুঝাই যে, আমার তাবিজ দিয়ে কোনদিন তার ভালবাসার মানুষের মন অর্জন সম্ভব নয়। কারো মন পেতে চাইলে, তাবিজের গুণের উপর নির্ভর না করে, নিজের গুণের উপর নির্ভর করাই উত্তম।
সরাসরি মুখের উপর না বলে, বললাম দেখি কি করা যায়, আমাকে চিন্তা করতে দাও। সে আবারো বলল, কোন চিন্তা নয়, আমার জন্য একাজ করতেই হবে, নতুবা সে মরবেই। কোন এক ফাঁকতালে অনিচ্ছা স্বত্বেও চৌধুরী বাড়ীতে আমাকে দাওয়াত গ্রহণ করতে হয়। এমনিতেই হর হামেশা বিভিন্ন স্থান থেকে দাওয়াত আসতে থাকত, তবে এই দাওয়াত আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল, সেটা পরের ঘটনা। নজির আহমেদ যখন জানতে পারল আমি চৌধুরী বাড়ীতে মেহমান হচ্ছি, তখন সে তো খুশীতে আটখানা। নূর জাহানকে ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়েছিল, আজকে এই অঞ্চলের প্রধান তান্ত্রিক আসছে সুতরাং তন্ত্রের জোড়ে আজ তাকে হ্যাঁ বলিয়েই ছাড়বে! আমি যখন চৌধুরী বাড়ীতে পৌঁছুই তখন সবাই আমাকে ঘিরে ধরেছে। এক কারণে আমি বাড়ীটি ঘুরে দেখার প্রয়োজন বোধ করলাম। পুকুরের শান বাধানো ঘাটে যাবার পর দেখলাম, নজির আহমেদ আমার আগমন সংবাদে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে! ঠিক সেই মুহূর্তে কোত্থেকে ঝাড়ু হাতে এক মহিলা উদয় হল এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই নজির আহমদে কে ঝাড়ু দিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দিল! শক্তিশালী নজির আহমেদ, মুহূর্তেই মহিলা থেকে ঝাড়ু টি কেড়ে নিয়ে হুঙ্কার দিল, নূর জাহান তুমি ভাল করনি, আমি এটার শেষ দেখে নেব!
যে মহিলার প্রেমে নজির পাগল, সে মহিলার ঝাড়ু পেটার বেনজির দৃশ্য দেখার জন্য অন্তত আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে থমকে দাঁড়ালাম। গোস্বায় উত্তেজিত নূর জাহান আমাকে বলল, সে বুড়ো নজিরকে পছন্দ করেনা, তাই আমি যাতে তাকে কোন তাবিজ না দেই। উত্তর দেবার আগেই, সে হন হন করে বাড়ীর ভিতরে চলে গেল। বুঝতে পারলাম নজীর হয়ত মেয়েটিকে আমার তাবিজের হুমকি দিয়েছিল আর মেয়েটিও আমার তাবিজের ভয়কে সমীহ করছিল। অপদস্থ নজির আহমেদ আমাকে বলল, দেখছ আমার সাথে কি আচরণ করল! আমি কি তার চুলের ঝুটি ধরে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলতে পারতাম না? তবে আমি তা করব না, আমি তোমার দেওয়া তাবিজ দিয়েই তাকে ঘায়েল করবই! ব্যাটা বলে কি? ‘অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর’ হবার দশা আমার।
নজির আহমেদ আবারো তাবিজের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলে, তাকে বললাম, তোমার প্রেম হল এক পক্ষীয়, তাছাড়া প্রেমের শুরু হয় আকর্ষণ দিয়ে, অথচ তোমার ক্ষেত্রে রয়েছে চরম বিকর্ষণ! সুতরাং তাবিজে কাজ হতে সময় লাগবে। আগে বিকর্ষণ তাড়িয়ে প্রভাবকে শূন্যে আনতে হবে, তারপর আকর্ষণের জন্য চেষ্টা করতে হবে। আর কাজটি হবে কঠিন ও সময় সাপেক্ষ। সে নাছোড় বান্দা, বলতে লাগল যত কঠিন কাজই হোক না কেন সে তা করবে। বললাম অমাবস্যায় মারা যায়, এমন মৃত ব্যক্তির কাফনের কাপড় লাগবে। এক রঙ্গা বিড়ালের সামনের পায়ের লম্বা হাড় ও পোপন গাছের লাটি যোগাড় করতে হবে। আমি চাচ্ছিলাম যদি একটি কঠিন শর্ত দেই, তাহলে সে শর্ত বাস্তবায়ন করতে কষ্ট হবে এবং আমিও দীর্ঘ সময় পাব, হয়ত ততদিনে তার মাথা থেকে জটিল প্রেমের ভুত চলে যাবে।
মাস যেতে না যেতেই, নজির আহমদ অমাবস্যায় মৃত ও রাত্রে কবরস্থ এক বালকের কাফনের কাপড় চুরি করে আমার নিকট হাজির! এটা যে প্রকৃতই কাফনের কাপড় সেটা বুঝানোর জন্য একজন সাক্ষীকেও আমার নিকট হাজির করলেন। যে কবর থেকে এসব তোলা হয়েছে, সে কবরের ভিতরে এক খানা প্রমাণও রেখে এসেছে। আমার বিশ্বাস না হলে, আমি যেন তার সাথে যাই। দ্বিতীয় কাজ হিসেবে, সে তিন গ্রামের তিনটি এক রঙ্গা বিড়াল চিহ্নিত করে রেখেছে। বাহাদূরীর সাথে বলল, তিনটার যে কোন একটাকে তার হাতে মরতেই হবে!
আমি যেন চোখে সর্ষে ফুল দেখছি! কি বলব, কি করব বুঝতে পারছিনা। অসম্ভব বদ মেজাজি একটি মেয়েকে পাবার জন্য সে যেভাবে অমাবস্যার রাত্রে কবর খুড়ে, সেখান থেকে কাপড় আনতে পারে, তার পক্ষে সবই করা সম্ভব! বললাম আপাতত বিড়াল মারতে হবেনা, বিড়ালের হাড় আমার কাছে আছে, আমি তোমাকে এমনিতেই একটি তাবিজ দেব। তবে তাবিজের ফলে তোমার নূর জাহানের মেজাজ ঠাণ্ডা হতে ছয় মাস সময় লাগবে। তারপর বশীকরণ তাবিজ দিয়ে আকৃষ্ট করানো হবে। এতেই সে রাজি হল, আমিও অন্তত এক বছরের একটি এক্সিট পারমিট পেলাম। অল্পদিন পরেই আমি সে এলাকা ত্যাগ করে চলে আসার কারণে, তার সাথে আস যোগাযোগ হয়নি। কোন কারণে তাকেও আগের মত অতি উৎসাহী হয়ে যোগাযোগ করতে দেখিনি!
পরবর্তীতে খবর পাই, নজির আহমেদর ‘নজু শাহ’ নাম দিয়ে একটি আস্তানা গড়ে তুলেছে। ফটিকছড়ি থেকে মিরশ্বরাই উপজেলায় যাবার পথে পাহাড়ি রাস্তার পাশে তার আস্তানা। পাহাড়ি রাস্তা হলেও এই পথে পায়ে হেটে দৈনিক অনেক মানুষ চলাফেরা করে। আসা যাবার পথে মানুষ তার আস্তানায় জিরিয়ে নেয়। মানুষদের কাজে সে নিজেকে একজন দরবেশ দাবী করে এবং প্রচার করে যে, টিপু শাহ তাকে খেলাফত দিয়েছে ও অনেক বিদ্যা শিখিয়েছে! মানুষকে ঝাড়-ফুঁক করে, পানি পড়া দেয়। এখানে আগত দর্শনার্থীরা কোনদিন টিপু শাহকে চোখে দেখেনি তবে টিপু শাহের জীবনের অতি প্রাকৃতিক ঘটনা গুলোর কথা শুনেছে! নজীরের কাছে এসব ঘটনাই পূঁজি। শুধুমাত্র নাম, কাহিনী, আজগুবি খ্যাতি শুনেই নজিরের মত একজন মূর্খ ব্যক্তিকে তার আস্তানায় এসব মানুষ ভিড় করত! আস্তানায় নারী পুরুষ এক সাথে হালকায়ে জিকিরে মশগুল হতো। আশে পাশের পাহাড়ি জনপদের গ্রাম থেকে গৃহবধূরা নিয়ত কবুলের প্রত্যয়ে, তার নিকট নানাবিধ দ্রব্যটি উপঢৌকন দিত। একদা নারী ঘটিত কোন এক কারণে, এলাকার মানুষ তার আস্তানায় হামলে পড়ে, তার কয়েক জন মুরিদকে পিটুনি দেয়, আস্তানা গুড়িয়ে দেয়, নজু শাহ তার দলবল নিয়ে সে এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
দেশে চাকুরী জীবনের শেষ দিকে, বিদেশে আসার কিছুদিন পূর্বে পুরানো কয়েকজন বন্ধুর সাক্ষাতের আশায় হেঁয়াকো বাজারে যাত্রা বিরতি করেছিলাম। হেঁয়াকো স্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবসায়ী পয়েন্ট। মিরশ্বরাইয়ের করের হাট থেকে রামগড় যাবার মাঝামাঝি জায়গায় এটি অবস্থিত। ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি এই জনবহুল জায়গাটি খুবই সুন্দর! একটি বিরাট রাবার বাগান রয়েছে, বাগানের পেট ছিঁড়ে সোজা দক্ষিণ দিকের রাস্তাটির নাম রামগড় সড়ক। সেটি ফটিকছড়ির উপজেলার উপর দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে শেষ হয়েছ। কলেজ জীবনের এসব বন্ধুরা কেউ শিক্ষকতা কেউ ব্যবসাকে, পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছ। তাদের সাথে দেখা করব এবং রামগড় সড়ক ধরে বাড়িতে ফিরে যাব এটাই ছিল লক্ষ্য।
এমন সময় সাদা বসন ধারী এক দরবেশকে ঘিরে, কয়েক জনের একটি দলকে, ওরসের কথা বলে বাজারে চাঁদা তুলতে দেখলাম। স্থানীয় বন্ধুরা দুষ্টামি করে আমাকে ধনী ব্যক্তি বানিয়ে আমার কাছ থেকে চাঁদা তুলতে বলে। আমি দোকানের সামনে দাঁড়ানো ছিলাম, দরবেশ সহ পুরো দল আমার নিকট আসল। দুই জন ঢোল বাজাচ্ছিল, একজনের হাতে খঞ্জনা, একজনের হাতে বেহালা, একজনের হাতে চাঁদার উপকরণ, দরবেশের হাতে বিরাট আকৃতির একটি সোনালী থালা! সেটিকে কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। দরবেশের মুখে দাড়ি, মাথায় লম্বা চুল, গায়ে আলখাল্লা পরিহিত, ডান হাতে হাতে থালা বাম হাতে একটি সুন্দর লাটি। নিকটে আসতেই চেহারা টিকে আমার পরিচিত বলে মনে হল। চিন্তা করতে লাগলাম, এই চেহারার কাছাকাছি কোন এক ব্যক্তিকে আমি যেন কোথাও দেখেছিলাম!
চিন্তা শেষ হবার আগেই আমার বন্ধু শিক্ষক ইউসুফ হেসে বলতে লাগল। তিনি নজু শাহ! করের হাট যাবার পথে ‘কয়লা’ নামক এলাকায়, সহা সড়কের পাশে, পাহাড়ের পাদদেশে, তার একটি আস্তানা আছে। সংসার বিরাগী দরবেশ নজু শাহ হিসেবে তাকে সবাই চিনে। মাঝে মধ্যে বাজারে বিভিন্ন উপলক্ষে চাঁদা তুলতে আসে। তার আস্তানায় প্রতি মাসে জিকির-আযগার হয়, খানা-পিনা চলে, সেমা মাহফিল হয়। (বাদ্যের তালে আল্লাহু আল্লাহু সহ নানা জিকির) বছরে একবার ওরস হয়। আগামী মাসে সেখানে ওরস হবে তাই তুমিও দুনিয়া আখেরাতের রেজামন্দি হাসিলের জন্য কিছু দিয়ে শরীক হয়ে যাও। বন্ধুটি আমার অতীত ঘটনা সম্পর্কে জানে এমন কি নজু শাহ কেও চিনে! মূলত আমার সাথে পরিচয় করিয়ে, আমাকে তাক লাগিয়ে দেবার জন্য নজু শাহকে হাজির করেছিলেন। নজু শাহর কথা মনে পড়াতে, অতীতে সেই স্মৃতি পুকুর ঘাটে নুর জাহানের ঝাড়ু পিটার দৃশ্যটি মনে আয়নায় ভেসে উঠল! বেচারা নজির ক্ষুব্ধ হয়ে নূর জাহানকে বলেছিল, এর শেষ দেখে ছাড়ব। আজ সেই নজীর সংসার বিরাগী দরবেশ খ্যাতি নিয়ে, আস্তানা গড়ে তুলছে। তারপরও ইনি আমার সেই নজীর কিনা শতভাগ নিশ্চিত হতে একটু পরখ করার চিন্তা করলাম।
কি নাম আপনার?
নজু শাহ!
আপনার পীর কে?
আমার পীরের নাম টিপু শাহ!
তিনি এখন কোথায় থাকেন?
বেলায়ত হাসিল করার জন্য তিনি এখন নিরুদ্দেশ!
তখন ইংরেজি ক্রস করা তার হাতের পাঞ্জাটি নজরে আসল। শতভাগ নিশ্চিত হলাম সেই নজীর আহমেদ এখন দরবেশ হয়েছে! বেশ-কমের তফাতের মাঝে আছে, মাথার প্রায় পাকা চুল গুলো গলা অবধি লম্বা ও কিছুটা জট পাকানো। দাড়ি বুক পর্যন্ত লম্বাটে, মোচ গুলো মুখের অলিন্দে ঢুকে পড়েছে, ফলে উপরের ঠোট দেখা যাচ্ছেনা। নাকের বেশ কিছু লম্বা লোম মোচ হবার জন্য চেষ্টা করছে। কানের লোমে জট পাকিয়ে আমাজন জঙ্গলের দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। পোশাকের ময়লা কোনদিন পরিষ্কার করেছিল কিনা সন্দেহ আছে! তারপরও মনে একটি সান্ত্বনা পেলাম যে, সে টিপু শাহের মুরিদ কথাটি গোপন রাখে নাই। সান্ত্বনা এই কারণে ছিল যে, টিপু শাহ বলতে বাস্তবে যদি কেউ না থাকে, তাহলে নজু শাহের দরবেশ গিরি ভুয়া প্রমাণ সহজ হবে! অন্যদিকে টিপু শাহ বলতে আসলেই যে কেউ ছিল না, সেটা প্রমাণের জন্য আমার ভূমিকাই যথেষ্ট।
নজু শাহকে প্রশ্ন করলাম আমাকে চিনেছেন?
না তো আপনাকে কিভাবে চিনব? আপনাকে কোনদিন দেখছি বলে তো মনে পড়েনা!
বললাম! আমিই সেই টিপু শাহ!
হতে পারে আপনার নাম টিপু শাহ। তবে আমার পীর টিপু শাহ আপনার মত কোট, প্যান্ট পড়ে, চলাফেরা করেনা!
কথা বার্তার ধরন দেখে, দরবেশের অনুসারীরা বুঝতে পারল কোন একটা অজানা গেঞ্জাম লাগতে পারে। তারা এক সাথে আমার কথার প্রতিবাদ করল! বলল, আমারা বুঝতে পারছি, আপনি আমাদের চাঁদা দিবেন না, তাহলে কেন এতক্ষণ ধরে আমাদের পীর বাবাকে এভাবে প্রশ্ন করছেন! কেন আমাদের অপমানিত করছেন? আপনি জানেন কি, আমরা আপনার কি চরম ক্ষতি করতে পারি! আমরা কাউকে ভয় পাই না! আপনি অনেক বেশী করে ফেলেছেন! নজু শাহ বাবা ইঙ্গিত দিলে আমরা আপনাকে এখান থেকে যেতেই দেব না! ততক্ষণে আরো কিছু মানুষ সেখানে ভিড় লেগে গেল। তারা বুঝল আমি দরবেশের মত একজন সাধারণ শান্ত মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও মশকরা করছি! সাধারণ মানুষেরা আমারও পরিচয় জানতে চাইল। এদের অকল্পনীয় সংগঠিত আচরণে আমি মুহূর্তে হতভম্ব হয়ে গেলাম! মানুষ আরো বেড়ে যাবার ইঙ্গিত দেখতে পেলাম। ভাগ্যিস এলাকার ছেলে ইউসুফ সাথে ছিল, শিক্ষক এবং ব্যবসায়ী হিসেবে সে সবার কাছে সমাদৃত। পরিবেশকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে, পিছনের বড় রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। পীরের চেয়ে মুরিদের ক্ষমতার দাপট থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁফ ছাড়লাম। আর একটু দেরী হলে, আজ ইজ্জত-সম্মান সব পথে ঘাটে হত। তখনও আমার ঘোর কাটেনি, কিভাবে একটি মুহূর্তের মধ্যেই পরিবেশ আমার আয়ত্তের বাইরে চলে গেল। ভাবলাম, অসৎ মানুষেরা যুক্তিহীন কাজ প্রতিষ্ঠা করতে যেভাবে সু-সংগঠিত থাকে, সৎ মানুষ ন্যায় নীতির কাজ প্রতিষ্ঠা করতেও এর শতভাগের এক ভাগও সংগঠিত থাকেনা।
নশ্বর পৃথিবীতে চিরকাল কেউ বেচে থাকেনা। সেই ধারাবাহিকতায় মহান দরবেশ নজু শাহ ও পৃথিবী থেকে ইন্তেকাল করেছেন। তবে তার স্মৃতি বয়ে বেড়ানোর জন্য তার মুরিদেরা নজু শাহ’র (নামটিতে নাকি ইদানীং একটু পরিবর্তন এসেছে) মাজারে প্রতি বছর ওরস পালন করে। সেখানে তার কবর কে ইট পাথর দিয়ে সৌন্দর্য মণ্ডিত করা হয়েছে! মানুষ মানত পূরণের আশায় সেখানে মানত দেয়। কদাচিৎ রাস্তার গাড়ি থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। বহু বছর বিদেশ করছি, দেশে কমই যাওয়া হয়। ইচ্ছা আছে এবারে দেশে গেলে মহান সাধক নজু শাহ (রহঃ) এর মাজার জেয়ারত করে আসব!
বিষয়: বিবিধ
২১৩৯ বার পঠিত, ৩০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুপ্রিয় পাঠক, এই পর্বটি মূলত ১৯ তম পর্ব হওয়াই উচিত ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম এই ঘটনাটি লিখব না। তাই অন্য ঘটনা গুলো অব্যাহত রেখেছিলাম। পরে ঘটনাটি লিখার জন্য সিদ্ধান্ত পালটালাম। ততদিনে আগের দুটো পর্ব প্রকাশিত হয়ে যায়। যদিও এটি একুশ তম সিরিয়াল তবে এটিকে উনিশ ধরে পড়লে ঘটনাটি এলোমেলো হবেনা। ধন্যবাদ
১.
ছাত্র জীবনে আমি একবার কেরামতি জাহির করে হোস্টেল সুপারসহ হোস্টেলের আবাসিক অনেক ছাত্রকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলাম। চায়না কর্তৃক উদ্ভাবিত এক জাতীয় চক যা ছারপোকা তাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তথন পন্যটি নতুন হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেনি। রেয়াজুদ্দিন বাজারের পরিচিত এক পাইকারী দোকানী থেকে চার-পাচঁটি চক উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম। দোকানীর কথা অনুযায়ী ব্যবহার করে দেখলাম ঠিকই ছারপোকা মারা পড়ছে। নিজে ব্যবহারের পর আমার রুমমিট আরেকজনের খাটের খুটি ও তক্তাতে বিশেষ কিছু মন্ত্র (ছারপোকার বংশ নির্বংশ হয়ে যাও, ওরিশের (আঞ্চলিক শব্দ) জাত তোদের রক্ষা নেই, ইত্যাদি আরো বেশকিছু অর্থবোধ কথা লিখে কিছু আজাইরা আকাঁজোকা করে দিলাম।)এভাবে কয়েকজনের খাটে এপ্লাই করার ফলে ছারপোকা শুণ্য হয়ে গেল। অনেকেই আমার দেখাদেখিতে ক্লাসের চক নিয়ে এসে প্রয়োগ করে দেখলো কিন্তু কাজ হয় না। যেহেতু রহস্যটা কাউরে বলিনি তাই গ্যাঞ্জাম খানের কেরামতিটা বাই দ্যা বাই হোস্টেল সুপারের কানে চলে গেল। তিনিও পূর্ব থেকেই ছারপোকার অত্যাচারে অতিষ্ট ছিলেন। হোস্টেল সুপার আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং তার রুম থেকে মন্ত্র প্রয়োগ করে ছারপোকা তাড়ানোর তাগেদা দিলে হাতে এক পেকেট চক ধরিয়ে বললেন এই নাও চক এবং মন্ত্র লিখে দাও!
আমি পড়ে গেলাম মহা গ্যাঞ্জামে!!
হোস্টেল সুপারের সাপ্লাই করা চক দিয়ে তো ছারপোকা তাড়ানো যাবে না!
অবশ্য জাড়িঝুরি সব পাংচার হয়ে যাওয়ার আগেই কৌশলে হোস্টেল সুপারের চকের পরিবর্তে নিজের পকেটের চক দিয়ে মন্ত্র লিখে দিয়ে সুপার সাহেবকেও বোকা বানানোর সুযোগ হাতছাড়া করিনি।
২
এখানেও আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করার ইচ্ছে ছিল আপনার লিখিত আজকের ব্লগটির সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে। কিন্তু মন্তব্য তো অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে। তাই পরবর্তী কোন সময় না হয় প্রকাশ করবো।
ইদানিং পাঠকের যে ক্রাইসিস চলছে, সেভাবে চলতে থাকলে লেখক নিজেই পাঠক হওয়া ব্যতিত গত্যন্তর থাকবে না। অনেক ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ
এটাতো শিবরাম চক্রবর্তির "দেবতার জন্ম" বা জসিমউদ্দিন এর "শেয়ালসা পিরের দরগার" চেয়েও আকর্ষনিয় গল্প। আপনি আপনার পরিচয় দিলে ব্যাপরটা কি দাড়াত ভাবতে ইচ্ছে করছে। এখনও আপনি এই দরগা ঘিড়ে যা হচ্ছে তা প্রতিরোধের চেষ্টা করতে পারেন। তবে বেচারা নজু শাহ!!! যাকে এত ভালবাসল তার হাতে ঝাড়ু খেলে মানুষের মধ্যে উদাসিনতা আসতেই পারে।
তবে মনে হচ্ছে আগে জানলে আমিও এরকম একটা ব্যবসা শুরু করতাম। আমিও আপনারই মুরিদ টেকনিক্যালি।
আপনি জানেন আমাদের এলাকার খবর। সেই ঘটনার ভুক্তভোগী ছিল আমার পরিবার, সেসব ঘটনায় আমরা সর্বশান্ত হয়েছিলাম! ফলে এক সময়ে অর্থনৈতিক ভাবে অনেক বিপদ গ্রস্ত হয়েছিলাম। আমার বাবাও মাইজ ভাণ্ডারের খলিফা ছিলেন, মাইজ ভাণ্ডারের উত্তর পাশেই পাঠান পাড়া তাঁর নানার বাড়ি, ভাণ্ডারের ঠিক পশ্চিম পাশেই মালদার পাড়া তার দুই খালার বাড়ি, জিয়াউল হক মাইজ ভাণ্ডারী আমাদের পাশের গ্রাম থেকেই বিয়ে করেছেন। তিনি ছোট কালে বাবার খেলার সাথী ছিলেন। কু-মতলব থাকলে এসব কানেকশন যোগ করে পয়সা আয়ের এটা একটা সুন্দর রাস্তা হত।
আসলে আল্লাহ যদি আমাকে দয়া না করতেন, তাহলে হয়ত আজকে যারা মাজার দরবারের বিরুদ্ধে লিখেন, আমি তাদেরকেই প্রতিহত করতাম। অনেক ধন্যবাদ।
হা হা হা হা।
ভাইয়া বাস্তব জ্ঞান অনেক বাড়ছে প্রতিটা ঘটনা থেকে দুনিয়া এবং দ্বীন সম্পর্কে এবং কমন সেন্স নিয়েও অনেক ধারনা পাচ্ছি
সত্যিই আল্লাহ আপনাকে হেফাজত করেছেন।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।
এসব পীরদের দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এলেম এর স্বল্পতার কারনেই হয়।
তাই এদেরকে হৃদয়ের গভীর থেকে দাওয়াত দিলে অনেকেই সৎপথে চলে আসে।
জাজাকাল্লাহ
আমার পীরের নাম টিপু শাহ! আরে এত আমাদের টিপু ভাইয়া যার লেখিনি সত্যের পক্ষে । সাধারন কথাও অত্যান্ত সুন্দর ভাষা শৈলীর কারনে হয়ে উঠে অসাধারন ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন