নতুন পরিমণ্ডলে বালক পীর! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-১৭ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ৩১ মে, ২০১৪, ০৬:০৮:১৪ সন্ধ্যা
একদিন স্কুল ছুটির পর স্কুলের সামনের রাস্তার বট গাছের নীচে নজির আহমেদ ওরফে নজির কে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম! পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, একদা গোপনে ধনী লোকের স্ত্রী থেকে জ্বিন বিতাড়ন করে ভাল করেছিলাম। সেই ঘটনাটি নজির আহমেদ পুরো এলাকায় রটিয়েছিলেন, যার কারণে আমি বৈদ্য হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলাম। ইনি সেই নজীর আহমেদ! তিনি কোনভাবেই খবর পেয়েছিলেন যে, আমি এই স্কুলে ভর্তি হয়েছি এবং ছোট খালার বাড়ীতে থাকি। নজির আমাকে খুব অনুনয় বিনয় করে বলল, সে প্রত্যহ সকাল বিকাল আমার স্কুলের বই-খাতা গুলো বয়ে আনবে এবং আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েই সে তার কাজে চলে যাবে। গায়ে পড়ে তার তার আবদার দেবার অঙ্গভঙ্গি নিয়ে ভাবছিলাম কি উত্তর দেব? আমাকে বেশীক্ষণ ভাবনার সুযোগ না দিয়েই, সে আমার নিকট থেকে স্কুলের বইয়ের বাণ্ডিলটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিল! বই দিতে চাইলাম না, তবে কেড়েও নিতে পারলাম না। খালাম্মাদের বাড়ীতে ফিরে যাবার জন্য রাস্তায় পথ চলা শুরু করলাম। সে আপত্তি জানাল! এই রাস্তায় কোন গাছ নাই, তাই পুরো পথ রোদে পুড়ে বাড়ী যেতে হবে। সে আরো বলল, আমার খালাম্মার বাড়ীতে যাবার জন্য আরো সহজ, উপরন্তু পুরো রাস্তায় ছায়াঘেরা আরো একটি কম দূরত্বের রাস্তা আছে, আজ সেই রাস্তাটিই সে আমাকে চিনিয়ে দিবে।
খালাম্মাদের বাড়িতে গিয়ে আমি নতুন পরিবেশ, নতুন স্কুল, নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম। শ্রেণী কক্ষে নতুন বন্ধু বানানো কষ্টকর হয়ে উঠল। স্কুলে ভাল মানের নিরাপদ হোস্টেলের সুবিধা ছিল। ফলে এখানে পড়ার জন্য দূরের পাহাড়ি এলাকার ছেলেরা ভীর করত। তারা হোস্টেলেই থাকত এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের অভিভাবকদের বিশ্বাস ভাজন হয়ে উঠতে পেরেছিল। পিতারা সময় সুযোগ মত এসে সন্তানদের খবর নিয়ে যেত। ক্লাসে স্থানীয় মুসলিম হিন্দু ছাত্রদের সাথে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মগ সহ বিভিন্ন উপজাতির সম্মীলন ছিল। রুচি বোধ ও সংস্কৃতি ভিন্ন হবার কারণে সকলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলাটা সবার জন্য কঠিন ছিল। তার মধ্যে আমি ছিলাম নবাগত, সুতরাং নিজেকে নিজের মত করে গড়ে তুলতে সময় লাগবেই। এই নামকরা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা দীর্ঘ ত্রিশ বছরের অধিক কাল ধরে এলাকার চেয়ারম্যান এবং আমাদের আত্মীয়। স্বয়ং আমার খালু এই স্কুলের গভর্নিং বডির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল। আমি জানতাম আপাতত সাময়িক সমস্যা হলেও, এখানেও সবার সাথে বন্ধুত্ব করাটা তেমন একটা বেগ পেতে হবেনা। তারপরও আমার কাছে মনে হত একটা মাসের আয়তন একমাসের সমান! একজন বন্ধু কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব তিলে তিলে অনুভব করছিলাম। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে নজির আহমদের মত স্বল্প পরিচিত ব্যক্তিটির সাথে মোলাকাত হয়ে খারাপ লাগেনি।
নজির আহমদের দেখানো রাস্তাটি বস্তুতই সুন্দর, দুপাশে গাছের সারি সারি বাগান, ছোট ছোট টিলা যাতে ছোট্ট গাছ, ঝোপ, ঝাড়ে পরিপূর্ণ। নীরব নির্জন একটি টিলার উপরে অনেক গুলো চিতার সারি, পাশে একটি হিন্দু মন্দির, সামনে রয়েছে বড় আকৃতির বট বৃক্ষ। প্রথম দেখাতেই জায়গাটি খুবই পছন্দ হল। নজির আহমেদ কে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, জায়গাটির নাম বৈরাগীর টিলা! এখানে ধনী পরিবারের নিহত হিন্দুদের চিতা আছে, সকাল-সন্ধ্যা মন্দিরে পুজো হয়, বৈশাখী মেলা সহ নানাবিধ হিন্দু ধর্মীয় উৎসব এই স্থানেই পালিত হয়। শনি-মঙ্গল বারে মানতের বিভিন্ন উপঢৌকন, স্থানীয় হিন্দুরা এই বট বৃক্ষের নিচে রেখে যায়। তাছাড়া নলকূপের ব্যবস্থা থাকার কারণে ক্লান্ত পথিক দুপুরে এই স্থানে জিরিয়ে নেয়। বৈরাগীর টিলার আশে পাশে বিক্ষিপ্ত ভাবে অনেক ধরনের ফলজ গাছ জন্মে আছে, যেগুলো কোন মানুষ কোনদিন রোপণ করেনি! ধারনা করা হয়, এটা দেবতাদের আশীর্বাদেরই একটা উজ্জ্বল নমুনা। নারায়ণ হাট বাজার প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার দু’দিন বসে। স্কুলের সপ্তাহের ছুটি শুক্রবার হলেও, শনিবারের বাজারের কারণে আমাদের স্কুল শনি বারে অর্ধদিবস চলে। ঘটনাক্রমে আজকেই শনিবার, ভর দুপুরে স্কুল প্রাঙ্গণে নজির আহমদের সাথে দেখা। আজকের এই দিনে, বৈরাগীর টিলার কাহিনী বলার ফাঁক তালেই, দুটি হিন্দু পরিবারকে মানতের জিনিষ বট গাছের নিচে রাখতে দেখলাম। নানাবিধ খাদ্য সামগ্রী, দুধ, দই সহ নতুন ফল, ফুল স্থানীয় হিন্দুরা এভাবে দেবতার মনোরঞ্জনের জন্য উৎসর্গ করে, এটাকে হিন্দুদের পুজোর ভাষায় ‘ভোগ’ বলা হয়। যা হোক, ঘটা করে, লুলু ধ্বনীর সাহায্যে ভোগ পর্ব সমাধা হতে দেখলাম।
স্কুলের বন্ধুদের কাছে আমার পরিচিতি প্রকাশ পেতে বেশীদিন লাগেনি। যে কোনভাবেই হোক বলতে গেলে পুরো স্কুলের সবাই কম-বেশী আমার বিদ্যা বুদ্ধি সম্পর্কে জেনে যায়। আমার এলাকার স্থানীয় বন্ধুদের চেয়ে দূরের এসব বন্ধুদের আগ্রহ টা অনেক বেশী মাত্রায় বলে মনে হল। তারা আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে কিংবা নিজেদের উৎসাহ দমাতে আমার সাথে গায়ে পড়ে বন্ধুত্ব গড়তে লাগল। পুরো স্কুলে ক্লাসের পরে অতিরিক্ত সময়টাতে ছাত্রদের আলোচনার প্রধান বিষয় বস্তু হত জ্বিন-ভুত। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হাজারো প্রশ্ন আমার দিকে ছুড়ে দেওয়া হত। আমি যতই বলি আমি এসবের কিছু জানিনা কিংবা তোমরা আমার সম্পর্কে যা ধারনা কর তার অধিকাংশই মিথ্যা ও আজগুবি। জ্বিন ভুতের পাণ্ডিত্য নিয়ে আমি কোনকিছু দাবী করিনা এমনকি আমি এসবের কোন বিশেষজ্ঞও নই। এসব জানতে যেমন তোমাদের যেভাবে আগ্রহ আছে, একদা এসব নিয়ে আমারও আগ্রহ ছিল ও আছে। হতে পারে তোমাদের চেয়ে তা একটু বেশী মাত্রায়। আমার এসব কথায় তাদের সোজা জওয়াব হল, তুমি ঝামেলা এড়াবার জন্য মিথ্যা বলছ, আমরা যে শুনেছি তোমার দেওয়া তাবিজে পাগল মানুষ ভাল হয়, নিঃসন্তান সন্তান প্রাপ্ত হয়েছে! এসব ঘটে যাওয়া ব্যাপার কে তুমি কি বানানো কাহিনী বলবে?
দাম্ভিক শ্রেণীর কিছু ছাত্র ছিল, তারা নিজেরা কোন প্রশ্ন করতনা, অন্যদের মুখে শুনে মন্তব্য করত। এসব বাজে ঘটনা বলে কটাক্ষ করত। তখন তাদের কে অন্য ছাত্ররা ধরে বসে বলত, সেতো এই ঘটনা গুলো নিয়ে কোনটাই দাবী করেনা বরং এড়িয়ে চলে। বরং আজগুবি বলে আমাদেরকেই অনাগ্রহী হতে বলে! সে যদি কিছু একটা দাবী করত, তাহলে সেটার বিপক্ষে গিয়ে বাজে ঘটনা বলে আক্রমণ করাটা যুক্তিসঙ্গত হত। যা সে দাবী করেনা, সেটাকে বাজে বললেই বা কি, সঠিক বললেই বা কি? তবে সেসব বন্ধুরা যখন, আমার সাথে কথা বলত, তখন আমার কথার দ্বারা আমাকে বেকুব সাব্যস্ত করাটা তাদের জন্য কঠিন হত। আগেই বলেছি, আমি প্রচুর বই পড়তাম, আমার কাছে যে পরিমাণ বাহ্যিক ও সাধারণ জ্ঞান মজুত ছিল, তা তাদের পক্ষে অবহেলা করার মত নয়। অল্প কিছু দিন পরে ছাত্রদের সাথে সাথে এবার স্কুলের শিক্ষকেরাও আমার নিকট অনেক প্রশ্ন নিয়ে হাজির হত। স্কুল ছুটি কিংবা আসার পথে শিক্ষকেরাও চলার মাঝে এই বিষয়ে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠল।
পাহাড়ি ছাত্রদের মনোবৃত্তি, পরিবেশ, সংস্কৃতি, আচার, রুচি, অভ্যাস, কৃষ্টি স্থল ভাগের মুসলমান হিন্দুদের থেকে আলাদা। এসব ছাত্ররা কোন ভূমিকা না রেখেই পথিমধ্যে প্রশ্ন করে বসত। বাজারে, মাঠে সর্বত্র তাদের প্রশ্ন করার কোন ভদ্রতা থাকত না। কিছু একটা জানতে ইচ্ছে হল, বন্ধের দিনে তারা সোজা আমার খালাম্মাদের বাড়ীতে চলে আসবে। কোন অনুমতি নেওয়া কিংবা আমি সেখানে আছি কিনা এসব যাচাই বাছাই করার সামাজিক রীতিনীতি জানত না। তারা বুঝতেও চাইত না যে, কোন ব্যক্তি কোন মুসলমানের বাড়ীতে গেলে আগে কাউকে বাড়ীর ভিতরে পাঠিয়ে খবর পাঠাতে হয়, যাতে করে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি বাহির বাহিরে আসে। একই নীতি হিন্দু-বৌদ্ধদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পাহাড়ি এসব ছাত্রদের নিয়ে আমি মাঝে মধ্যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেতাম। ভাগ্য ভাল ছিল যে, আমার খালাম্মাদের বিরাট বাড়ি ও বাড়ির বাহিরে একটি পাকা দহলিজ ছিল, যাতে কেউ থাকত না। আমি এই দহলিজের কল্যাণে পাহাড়ি বন্ধুদের বিব্রতকর সাক্ষাতকারের সুযোগ নিতাম। পাহাড়ি বন্ধুরা এমনিতেই এই নামকরা বাড়ীতে আসার সুযোগ খুঁজত। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার ঘর এখানে, স্কুলের হেড মাষ্টারের বাড়ী এখানে, চেয়ারম্যান ও এই বাড়ীর মানুষ। পাকিস্তান আমল থেকেই এই বাড়ীর প্রতিটি মুসলিম মেয়েরাও উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে আসছে। স্কুল কলেজের শিক্ষক ছাড়াও তদানীন্তন তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ তিনজন শিক্ষকের শ্বশুর বাড়ীও এখানে।
পাহাড়ি বন্ধুদের ঘটনা বলার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এসব বন্ধুরা নির্দ্বিধায় তাদের গ্রামে যাবার দাওয়াত দিত। তাদের ঘরে আমাদের মত চৌকি, মাদুর, লেপ, তোষক নাই এসব বলতে দ্বিধা করত না। এদের জীবন যাপনে কোন ভণিতা থাকত না। তারাও বলত তাদের গ্রামেও ভিন্ন ধরনের যাদুকর, ওঝা, বৈদ্য আছে। তারাও মানুষ থেকে জ্বিন ভুত দূর করে। আমি যদি কখনও তাদের সাথে বেড়াতে যাই, তাহলে তারা খুশী চিত্তে আমাকে তাদের মেহমান বানাবে। বন জঙ্গলের অনেক কিছু দেখাবে যা কখনও সমতলের মানুষেরা দেখেনি। আমার আগ্রহ থাকলে তাদের ওঝা বৈদ্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে ইত্যাদি। পরবর্তীতে আমি বহুবার তাদের সাথে পার্বত্য এলাকায় গিয়েছিলাম, তাদের মেহমান হয়েছিলাম, তাদের সাথে থেকেছি, তাদের জেনেছি। তাদের বাড়ীতে মেহমান হতে হলে, একেবারে কাছের বন্ধুর বাড়ীতে যেতেও কমপক্ষে দশ মাইল পায়ে হাটতে হত। এর চাইতেও লম্বা পথ হাটতে পারাটা একদা আমার জন্য মামুলী ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে আমার এই পাহাড়ি স্কুল বন্ধুরা প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছিল। এম, বি, বি, এস ডাক্তার, সরকার শিক্ষা অফিসার সহ অনেক সরকারী পদে এখনও তারা চাকুরী করে। এই পাহাড়ি মানুষের পরিচিতির কারণে, একদা আমাকে মামুন ডাকাত বলে গণপিটুনি শুরু করার মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড আগে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। যাক, সেটা একটা ভিন্ন পর্ব, ভিন্ন অধ্যায়! আমি লিখছিলাম এক পিকুলিয়ার মানুষের কাহিনী
আগের পর্ব: বিপদের অবসান ও ভুতের রহস্য উন্মোচন! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-১৬ (রোমাঞ্চকর কাহিনী) পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।
পরের পর্ব: বৈরাগীর টিলার ‘ভোগ’ থেকে ভুত বিতাড়ন! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-১৮ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)
প্রথম পর্ব: এক পিকুলিয়ার মানুষ! (রোমাঞ্চকার কাহিনী- ভূমিকা পর্ব)
বিষয়: বিবিধ
১৬৩৯ বার পঠিত, ২৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শীলপাড়ার বড় পুকুরের পাড়ে একটি চিতাখোলা ছিল। তাদের কেউ মারা গেলে ওকানে শেষকৃত্যানুষ্ঠান করা হয়। ওখানে একটি মন্দিরও ছিল। প্রতি সন্ধ্যার পুকুরের পাড়ে এবং মন্দিরে মোমবাতি জ্বালিয়ে হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন রীতি রেওয়াজ পালন করা হয়। সাধারণত চিতাখোলাটি নির্জন এলাকা হওয়াতে সন্ধ্যার পরে তো মানুষ যেতই না দিনের বেলাতেও অনেকে যেতে ভয় পায়। আমরা কয়েকজন তেদড় টাইপের দুষ্টু পোলা মিলে সন্ধ্যার পরে চিতাখোলা থেকে প্রতিদিন মোমবাতিগুলো নিয়ে আসতাম। একবার মোমবাতি সংগ্রহ করতে গিয়ে দারুণ এক তুলকালাম কান্ড ঘটে গেল।
খুব ভালো লাগলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন