প্রিয়তম বিশ্বস্ত বন্ধু : আমার বাবা
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ৩০ মার্চ, ২০১৪, ০৫:৪৬:০৭ বিকাল
‘ও পরানের তালত ভাই, চিটি দিলাম পত্র দিলাম ন’ আইলা কিল্লাই? আচমকা তিনি বলে উঠলেন, তওবা! তওবা! তওবা! এটা কোন সুন্দর গান নয়! কোন ভদ্র ছেলেরা চিল্লিয়ে এসব বাজে গান গাইতে পারেনা। তিনি আমাকে অন্ধকারে দীর্ঘক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলেন অতঃপর বললেন, এসব গান গাইলে মানুষ খারাপ বলবে, বড় বয়সেও মানুষ সম্মান করবেনা। আলিঙ্গন ছেড়ে তিনি বললেন আর কখনও এই গান গাইও না। এই তিনি আমার অকৃত্রিম পরম বন্ধু, আমারই বাবা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার অনতিবিলম্বে, চাঁদনী আলোয় মেঠো রাস্তা ধরে বাজার থেকে বাড়ী যাচ্ছিলাম। সামনে দুজন মুরুব্বী একজন আমার বাবা, অন্যজন দেওবন্ধ আলীয়া মাদ্রাসা থেকে পাশ করা বাবার কাছাকাছি বয়সের, আমার জন্য নির্বাচিত গৃহ শিক্ষক। তাঁরা রাস্তায় তাদের কথায় ব্যস্ত। শিক্ষক প্রথম সেদিনই আমাদের বাড়ীতে যাচ্ছেন কাল থেকে আমি তাঁর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হইব। আমিও একাকী তাঁদের পিছনে অনুসরণ করে চলছি। অন্য মনস্ক হয়ে নিজের অজান্তেই ভুলে গিয়েছিলাম, সামনের চলমান দু-জন্য ব্যক্তি আমাকে শাসন করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষমতাবান! তাই গান পাগল মন নিয়েই গলা উজাড় করে মন প্রাণ খুলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের টান মেরেছিলাম। বুঝতে পারলাম নতুন শিক্ষকের পদার্পণের দিনে, প্রকাশ্যে এভাবে গান গাওয়াটা আমার উচিত হয়নি কিন্তু বাবা যে বললেন এসব খারাপ গান! কথাটি আমার যুক্তিযুক্ত মনে হলনা! কেননা এসব গান বিয়ে বাড়ীতে, হাটে, ঘাটে, মাঠে, ময়দানে এমন কি স্কুলের মাঠে যে রাতভর নাটক হয় সেখানেও সবার কণ্ঠে উচ্চারিত। কই, কেউ তো কোনদিন বললেন না এসব খারাপ গান। যাক, বাবা যেখানে আমাকে থাপ্পড় মারার কথা, সেখানে থাপ্পড় না মেরে বুকে জড়িয়ে ধরে বুঝালেন, এতেই আমার মনে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও মমত্বটা আরো বেড়ে গেল।
খোলা মনে গান গেয়ে শাস্তির সম্মুখীন হওয়াটা আজ প্রথম নয়। ইতিপূর্বে বহুবার মায়ের কান মলা, কান ধরে উঠবস করা, তওবা করা, বেত্রাঘাতে জর্জরিত হওয়ার মত লঘু শাস্তি পেয়েছি। তবে কখনও আমার বাবা এসব নিয়ে কোনদিন আমাকে বকাবকি করতেন না, তিনি বুঝানোর নীতি গ্রহণ করতেন। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় একদা শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের, ‘যৌবন জোয়ার একবার আসেরে, ফিরে গেলে আর আসেনা’ গানটি বাড়ীর পাশে পেয়ারা গাছের উপরে বসে গাইতে ছিলাম। জেঠাই মা আধা হাসি, আধা ক্ষোভ মার্কা চেহারা নিয়ে আমার মাকে উদ্দেশ্য কর বললেন, তুমি শুনছ! ‘তোমার নাবালক ছেলে যৌবন জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে’, এসব কিসের আলামত, কেয়ামত নিকটে এসে গেছে নাকি? মা শাড়ির আঁচলের নিচে লুকিয়ে একটি বেত নিয়ে এক্কেবারে পেয়ারা গাছের নিচে। আমাকে আদর করে বললেন, নিচে নেমে আস, তোমার খুশীর খবর আছে। মায়ের মনভুলানো এমন আবদারে, মনভরা বিশ্বাস নিয়ে নেমে আসলাম। কিছু বুঝে উঠার আগেই, শফাং শফাং শব্দে পায়ের মধ্যে বেতের আঘাত অনুভূত হতে থাকল। সেই মুহূর্তেই কোত্থেকে যেন বাবা হাজির! বাবা আমাকে মায়ের হাত থেকে কেড়ে না নিয়ে, ইশারায় বুঝালেন তাঁর কাছে যেন পালিয়ে যাই।
আমি মায়ের হাত থেকে কোনমতে ছুটে বাবার কাছে পালিয়ে গেলাম। বাবা প্রশ্ন করলেন কি দোষ করেছ? মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশের সুযোগ পেয়ে সরাসরি বললাম, পেয়ারা গাছে বসে গান গেয়েছি। তিনি (আমার মা) লেখা পড়া জানেনা, কোনদিন স্কুলে যায় নাই, তাই আমার গানের কথা না বুঝেই, আমাকে বেত মারা শুরু করলেন। এসব গান তো আমাদের স্কুলের শিক্ষক মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী তো হরহামেশাই গেয়ে থাকেন। কই! তার মা, তাকে তো কখনও মারে না! মনে হল বাবা-মা দুজনেই হাসলেন এতে আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। মেজাজ খারাপের বিষয়টা মা লক্ষ্য করলেন, তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘মা হিসেবে আমাকে পছন্দ না হলে, প্রয়োজনে অন্য কাউকে মা বানিয়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে গান গাও। আমাকে মা হিসেবে চাইলে এসব বাজে গান গাওয়া চলবে না’। এটা মায়ের রুটিন হুমকি, এই হুমকিতে আমি ধরাশায়ী হয়ে যেতাম, বাদানুবাদ না করে গোস্বা হজম করে মেনে নিতাম। আমি নতুন মা চাইনা, এই মা আমার জন্য সর্বোত্তম। বরাবরই লক্ষ্য করতাম মা আমাকে শাস্তি দিলে বাবা কোনদিন এটা নিয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া কিংবা কটুভাষণ করতেন না! মা আমাকে শাস্তি দিলে উল্টো বাবা আমাকে বুঝাতেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। মায়ের সাথে কোনদিন বেয়াদবি করতে নেই। মা যদি ভুল করেও কখনও মারে, সেটাতেও সন্তানের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে। বাবা বললেন প্রয়োজনে কদাচিৎ আমিই তোমাকে মায়ের পিটুনি থেকে বাঁচিয়ে দিব, তারপরও ভুলে যেন মায়ের সাথে খারাপ আচরণ না করি। আবার বাবা কখনও আমাকে শাসন করলে, মা বলা শুরু করত। ‘বাবারা কত কষ্ট করে ছেলেদের জন্য আয় করে, বাবা যদি দুনিয়াতে না থাকত তাহলে আমাদের কতই না কষ্ট হত। বাবার শাসন যে পেয়েছে সে দুনিয়াতে সবচেয়ে বড় হয়েছে। বাবার হাতের বেতের আঘাত কেয়ামতের অন্ধকার বিপদে আলো হয়ে জ্বলবে’। বড় হয়ে বুঝলাম, মা-বাবা একে অপরের প্রতি সন্তানের ইজ্জত ও আস্তা বাড়ানোর জন্য এই পরিকল্পিত নাটক মঞ্চস্থ করতেন! আমার বাবার কৌশলী ও চাতুর্যপূর্ণ পদ্ধতি ছিল, পিতা-মাতা একজন শাসন করলে অন্যজন আদর করা, তবে এটা নিয়ে যেন স্বামী-স্ত্রী ঝগড়ায় লিপ্ত না হয়। এই বুদ্ধি দিয়ে আমিও আমার পারিবারিক ব্যক্তি জীবনে সন্তানের উপর কাজে লাগিয়ে বিরাট উপকার পেয়েছি।
আমার বাবা ছিলেন সদা রহস্যময়, হাস্য ময়, দূরদৃষ্টি ও যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন! তিনি প্রচুর বই পড়তে ভালবাসতেন। কোন সভা সমিতির অনুষ্ঠানে তিনি মধ্যমণি হয়ে থাকতে পারতেন। উপস্থিত বুদ্ধি ও কথার পাণ্ডিত্যের কারণে তাঁকে সবাই ভালবাসত। আমার পুরো জীবনেও তাঁর কোন শত্রু দেখিনি। তিনি ছিলেন যথেষ্ট উদার ও সবার বিপদে উপকারী। মুসলিম তো বটেই, হিন্দু, বৌদ্ধদের কাছেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য ও সমাদৃত। শিক্ষার প্রতি তাঁর ছিল যথেষ্ট ঝোঁক। অশিক্ষিত একটি সমাজ থেকে আমার বাবা তার সকল সন্তানদের শিক্ষিত ও দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আপন মানুষেরা যাতে শিক্ষা অর্জন করতে পারেন, সে জন্য আমার বিত্তশালী নানাকে দিয়ে বাড়ীর সামনে একটি প্রাইমারী স্কুল ও কয়েক গ্রামের মাঝখানে মাইল খানেক দূরে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করিয়েছেন। আমার বাবা, সম্পদ ও ক্ষমতাশালী নানার বড় কন্যার স্বামী হিসেবে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য ছিলেন। বাবাও নিজের পকেটের টাকায় একটি প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমার বড় ভাইকে শিক্ষিত করিয়ে, বাড়ীর অনতিদূরে আরেকটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমিকা রাখতে বললেন। বাবার উৎসাহ উদ্দীপনায় বড় ভাই ও তার অপর দুই বন্ধু মিলে আরেকটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছিলেন। মেঝ ভাই মাদ্রাসায় পড়তেন, তাঁকে দিয়ে একটি এবতেদায়ী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করান। বাবা আমাকেও শিখিয়েছেন গরীব মানুষ শিক্ষিত হলেও, তাদের মনোবল মজবুত থাকেনা, ফলে তাদের অনেকের পক্ষে বৃহৎ কিছু করা কষ্টকর হয়। শিক্ষিত সৎ মানুষ, ধনী হলে, তার দ্বারা দেশ সমাজ, রাষ্ট্র বহুভাবে উপকৃত হয়। যেমনটি হয়েছিল হাজী মোহাম্মাদ মুহসীন ও তাঁর বড় বোন মুন্নুজানের হাতে।
আমাদের গ্রামে তখনও মাদ্রাসা পাশ পড়ুয়া কোন ছাত্র ছিলনা। জুমা ও দুই ঈদের নামাজ পড়া, দুই বড় রাত্রের নামাজ পড়া, রোজা রাখা, মীলাদুন্নবীতে গরু জবাই করা, মানত ও আশা পূরণের জন্য কবর-মাজারে গিয়ে সেজদা করা এবং আনন্দের সাথে ওরস উৎযাপনের নামকেই ইসলাম পালন মনে করা হত। আমাকে ইসলামী আদব কায়দা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেবার জন্য বাবা তীব্রভাবে একজন আলেমের অভাব অনুভব করলেন। একজন আলেমের প্রয়োজনীয়তার কথা, বাবা অনেক পরিচিত জনকে বলেও রেখেছেন। আমাদের বাড়ীর সামনে স্কুলের মাঠের পাশে, একটি গ্রাম্য মসজিদের অভাব অনুভূত হল। সবার সম্মিলিত আগ্রহে এক মাসের মধ্যেই একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা হল। ইত্যবসরে একজন ঈমাম পাওয়া গেল, তিনি মসজিদের পাশের হুজুরী খানায় থাকবেন, আমাদের ঘরে খাবেন এবং আমাকে আরবি পড়িয়ে, যাবতীয় উত্তম শিষ্টাচার শিখিয়ে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। আমাকে বলা হল, প্রথম ১০দিন কাজ হল নতুন হুজুর থেকে খাওয়ার আদব কায়দা শিখে নেওয়া। প্রথম দিন দুপুরে আমি, বাবা ও হুজুর এক সাথে খেতে বসলাম। আমি যেহেতু হুজুর থেকে শিষ্টাচার শিখব তাই বাবাকে অনুসরণ না করে হুজুরকে অনুসরণ করতে থাকলাম। হুজুর প্লেটে ভাত নিলেন, তাতে ডালের পানি দিলেন, তার উপরে ডিম ভাজাটা বসালেন, তার উপরে আলু ভর্তার কিছুটা রাখলেন, তার উপরে তিতা করল্লা রাখলেন। এতক্ষণ আমিও অবিকল করতে থাকলাম কিন্তু তিতা করল্লা দেখে থামলাম! এই তেতো সবজি আমি খাইনা। বাবার চোখে চোখ পড়াতে দেখলাম তাঁর চোখে-মুখে গোস্বা! ভয়ে তিতা করল্লাও পাতে নিলাম। হুজুর তিতা করল্লা উপর কদুর দুটো টুকরা নিলেন, অতঃপর মুরগীর গোশতের ঝোল ছিটালেন। আমিও যথারীতি করতে থাকলাম! হুজুর হাতের উপর থেকে শার্টের হাতাটি আরো উপরে আটকালেন এবং হঠাৎ করেই থালার সবকিছুকে একসাথে কচলায়ে ভর্তা বানানোর মত একাকার করে ফেললেন! পাঁচ আঙ্গুলে কচলানো খাদ্যে ফুলে উঠল, হুজুর প্রথমেই আঙ্গুল চোষা দিয়ে খাদ্য শুরু করলেন। এ ধরনের সুন্নতি খাদ্য পরিবেশন সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বে পরিচিত ছিলাম না! তাই বাবার চোখের দিকে তাকালাম, দেখলাম তার চোখ-মুখ গোস্বায় একাকার হয়ে আছে! মনে করলাম আমার খাদ্য প্রস্তুতিতে দেরী দেখে তিনি উত্তেজিত হয়েছেন, মুহূর্ত মাত্র দেরী না করে আমিও হুজুরের মত খাদ্য কচলাতে শুরু করলাম। বাবা উত্তেজিত হয়ে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন, মায়ের সামনে গিয়ে চিৎকার করে বললেন, শুয়োর! এতদিন যা শিখালাম, তাও শেষ হয়ে যেতে দেখলাম! বুঝলাম না, বাবা কেন মাকে বকাবকি করল, তাছাড়া আমিতো অবিকল হুজুরের মতই করেছি। যা করতে আমাকে আদেশ করা হয়েছিল। তারপর দিন থেকে হুজুরের খানা মসজিদের হুজুরী খানায় পৌছিয়ে দেওয়া হয় এবং আমাকে শুধুমাত্র আরবি পড়ানোর মাঝে তাঁর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকে।
সপ্তাহ দুয়ের পরে বাবা জিজ্ঞাসা করল, হুজুর কি কি পড়িয়েছে? বললাম হুজুরের দুইটি বই শেষ করে ফেলেছি! বাবা তো খুশীতে হতবাক! দুই সপ্তাহে দুই বই! তো, বল কি কি পড়েছ। গলা খাকড়িয়ে গাওয়া শুরু করলাম,
‘দমে দমে ডাকরে মন আল্লারে,
দম থাকিতে ডাকরে মন আল্লারে,
দমের বাড়ি দমের ঘর,
দম ছাড়িলে সবাই পর,
দম হারাইলে কেউ নয় জগৎ সংসারে......... দমে দমে ডাকরে মন আল্লারে।
বাবা ততোধিক অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, মাইজ ভাণ্ডারী গানের মত সূর করে এটা কোন ধরনের পড়া? বাবা একে একে আমার সব শুনলেন। তারপর বললেন, এর ছেয় ভাল কিছু এই হুজুর থেকে আশা করতে পারিনা। আমি আবার বললাম, আল্লাহ যে দয়াবান সে ধরনের গজল পড়াও হুজুর শিখিয়েছে? বাবা জানতে চাইলেন সেটা কি ধরনের? গলা খেঁকিয়ে আবারো শুরু করলাম,
গরু লাদে লাদা, লাদা,
ছাগল লাদে বড়ি,
মানুষ লাদে লড্ডা, লড্ডা,
পাখি লাদে উড়ি।
বল ছোবহানাল্লাহ..........!
আল্লার মহিমা বর্ণনার অদ্ভুত ধরনের কবিতা শুনে, বাবা আমাকে কিছু বললেন না। মাকে বললেন, এই ছেলেকে একটি কবিতা মুখস্থ করাতে আমার গলদঘর্ম হয়, আর মসজিদের গায়ক হুজুরের নিজের রচিত সব কবিতা, গান চৌদ্দ দিনেই মুখস্থ করে ফেলেছে! বাবা মসজিদ কমিটির সবাইকে বুঝালেন এই হুজুর গানের সুরে যে শিক্ষা দিচ্ছে এটা কোন ইসলামী শিক্ষা নয়। তাকে আজই বিতাড়ন করা উচিত! ইতিমধ্যে বাবা ব্যতীত সবাই হুজুরের আশ্চর্যজনক ইসলামী শিক্ষায় পুলকিত হলেন। তারা করিৎকর্মা হুজুরের এই ধরনের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং হুজুরের ভক্তে পরিণত হলেন। আমার সম বয়সী বন্ধু বান্ধবেরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান বাদ দিয়ে, হুজুরের ধর্মীয় সংগীতে মনোনিবেশ করল! আঞ্চলিক ভাষায় ভাল গানও থাকলেও, ছেলেরা গাইত বিব্রতকর গুলো। খারাপের স্থলে হুজুরের ভাল গান দখল করাতে, সবার পিতা-মাতাও খুশী হলেন। আঞ্চলিক ভাষার বাজে গানের চেয়ে ছেলেরা আল্লাহর গান গেয়ে ছওয়াব কুড়াচ্ছে। বাবা হুজুরের খাওয়া বন্ধ করে দিলেন, আমাদের বাড়ীতে হুজুরের প্রতি সমর্থন থাকলেও, কেউ নিজের বাড়ীতে খাওয়াতে রাজি ছিলনা বলে, হুজুর আমাদের মসজিদ ছেড়ে অন্য মসজিদে আস্তানা পাতলেন। আমার বাবা এই ব্যক্তিকে একেবারেই দেখতে পারতেন না, এই হুজুরকে এলাকা থেকে বিতরণের কথা বললে অন্যরা বলে উঠত, এই হুজুরকে তো আপনিই এনেছেন সুতরাং তাকে আমরা এলাকা ত্যাগে বাধ্য করতে পারিনা!
হুজুর এলাকার এক বিধবা রমণীকে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতে বসলেন! তার পর থেকে তিনি এলাকাতে জামাই হুজুর হিসেবে পরিচিতি পেলেন। এক বিকেলে আমাদের বাড়ীর পার্শ্বের মাঠে, তিন মহিলা এক ব্যক্তিকে হেস্তনেস্ত করা অবস্থায় দেখা গেল! মা বললেন কাউকে তো চিনতে পারছিনা, এই মহিলারাই বা কে আর ঐ ব্যক্তিটাই বা কে? তুমি গিয়ে দেখে আস, নতুবা কাউকে খবর দাও। দৌড়ে গিয়ে দেখলাম আমাদের জামাই হুজুরকে তিন মহিলা টানাটানি করতে গিয়ে লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি সবগুলো ছিঁড়ে ফেলেছে। হুজুরের এই করুণ দশায় আমার মায়া হল, চিল্লানো শুরু করলাম। হুজুর হেস্তনেস্তর মাঝেও ইশারায় আমাকে না চিল্লাতে বলল। মহিলা তিন জন আমাকে বলতে রইলেন, চিল্লা আরো জোড়ে চিল্লা! এই পরিস্থিতিতে হুজুরের আশু মুক্তির জন্য আমি আরো জোরে চিল্লিয়ে গ্রামের বহু মানুষ জোগাড় করে ফেললাম! গ্রামবাসীকে মহিলারা জানাল, এই ব্যক্তি হল গায়ক-কবি, কবিতা লিখে প্রেসে প্রকাশ করে বাজারে বিক্রি করে। আগে দাড়ি ছিলনা এখন লম্বা সাদা দাড়ি রাখছে। কোন জায়গায় বেশী দিন থাকলে, সেখানেই একটি বিয়ে করে। আমরা তিন জন এই কবির বউ, শুনেছি এখানে আরো এক বউ আছে। আগে তারে পিটাইয়া লই, তারপরে বিচার হইবে। যাক, গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করে এবং চতুর্থ বউয়ের গলাধাক্কার মাধ্যমে এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়। আমার বাবা দ্বিতীয় বার বোকামি করার মানুষ ছিলেন না। এবার এমন এক বৃদ্ধ হুজুর কে আবিষ্কার করলেন যিনি ভারতের দেওবন্ধ মাদ্রাসায় পড়েছেন, আরবি, ফার্সী, উর্দু ভাষায় এমনকি ইংরেজি ব্যাকরণেও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করবেন, মসজিদে শুক্রবারে ঈমামতি করবেন, আমাদের বাসায় খাবেন এবং আমাকে পড়াবেন। পরবর্তীতে এই হুজুরের সান্নিধ্য আমার জীবনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।
সৌভাগ্য হোক আর দুর্ভাগ্য হোক আমার বন্ধুরা সবাই গান গাইত! ফলে শৃগালের দলের সাথী হিসেবে আমিও গান না গেয়ে থাকতে পারতাম না। মাইকে শুনেই গান মুখস্থ করে ফেলতাম, আর চড়া গলায় অন্যদের মত প্রাকটিস করতাম। গান গাওয়াতে অন্যদের কোন সমস্যা ছিলনা কিন্তু আমার সমস্যা ছিল দুটো। আঞ্চলিক গান গাইলে মায়ের হাতে মারের ভয় ছিল, আল্লাহর গান গাইলে বাবার হাতের ভয় থাকত। তাই বাড়ির বাহিরে কোথাও একাকী যায়গা পেলে সেখানে মন খুলে গলা ছেড়ে গান গেয়ে, কুলি করে ঘরে ফিরতাম! আজকে সেই বৃদ্ধ হুজুরের অভিষেক! আমি মনের অজান্তে ভুলেছিলাম, তাই রাস্তায় গান গেয়ে বরাবরের মত বাবাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেললাম। ভাবলাম ভাগ্যিস ভুলে আল্লাহর গান গাইলে বাবার হাতে কি দশাটাই না হত। বাড়ীতে যাবার পথেই, হুজুর আমার সব শুনলেন, তিনি বাবাকে বললেন, গান গাওয়া কোন খারাপ কিছু নয়। এটা বৈশিষ্ট্য গত প্রবণতা, এটা কোনদিন জোড় করে বন্ধ করা যায়না। তার চেয়ে ভাল হয়, সে গান গাইতে থাকুক আপনি বরং তার গান গাওয়ার রাস্তাটি ঘুরিয়ে দিন। পরদিনই বাবা আমাকে এক ব্যক্তির নিকট নিয়ে গেলেন এবং আমার গান গাওয়ার প্রবণতার কথা বুঝিয়ে বললেন। গুরুজি বিশেষ যত্নের সাথে আমাকে ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া গান শিখিয়ে দিলেন। আব্বাস উদ্দিন, আবদুল আলীম, ফেরদৌসি রহমান ও নীনা হামিদের গানে ও কণ্ঠে বাজে গান বাজত না। ফলে আমার গান গাওয়ার সখ পূরণ হল, সব পরিবেশে, সকল স্থানে সে গান গাওয়া গেল, সে গান যতই গাওয়া হল কেউ কখনও মন্দ আর মন্দ বলেনি।
আমার বাবা আমার বন্ধুদের মাঝে অন্যতম ছিলেন। বাবা সাথে থাকলে আমি বন্ধুর অভাব বোধ করতাম না। রাজ্যের যত প্রশ্ন তাঁকে করা যেত, কখনও বিরক্ত হতেন না। তিনি ছোট মানুষে যেভাবে বুঝতে পারে সেভাবে বুঝাতে চেষ্টিত হতেন। যার কারণে ছোট্ট কালেও আমার কাছে বুড়োদের চেয়ে বেশী তথ্য জ্ঞান ছিল। ফলে বড়রা এমনকি স্কুল শিক্ষকগণও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ইতিহাসের বই পড়ার প্রতি বাবার যথেষ্ট ঝোঁক ছিল। বই পেলেই পড়তেন, বইটি কে লিখেছেন এটা নিয়ে কোন বাছ বিচার করতেন না, তিনি জানতে চাইতেন কি লিখেছে। তাঁর বই পড়ার একটি অদ্ভুত নিয়ম ছিল। তিনি সকল বই শুয়ে শুয়ে পড়তেন এবং পড়ার সময় ফ্রাই করা সিমের বিচি, বুট, বাদাম, চনাচুর সহ নানা দানাদার খাদ্য খেতেন। চোখে চশমা ও হাতে বই নিয়ে তিনি যখন শুয়ে পড়তেন, তখন আমার মা এক বাটি ফ্রাই দানা তাঁর পেটের উপর রাখতেন। তিনি পেটের উপরে রক্ষিত বাটি থেকে একটি একটি দানা মুখে রাখতেন আর গভীর মনোনিবেশ সহকারে বই পড়তেন। তখন আমি তাঁর কোমরের উপরে পা তুলে জড়িয়ে শুয়ে পড়তাম ও তার পেটের উপরে রক্ষিত বাটি থেকে একটি করে বিচি নিজের মুখে ভরতাম আর তাঁর পড়ার বিষয়ের উপর চোখ রাখতাম। আমি এভাবে থাকলে তিনি বড় আওয়াজে পড়তেন নতুবা মনে মনে পড়তেন। আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত হই, তখন অবোধ্য অনেক গুলো বই বাবাকে পড়ে শুনাতাম, তিনি শুনতেন। আমার এখনও মনে আছে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াকালে, আমার বড় ভাইয়ের ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের শ্রীকান্ত বইয়ের নতুন দা অংশটি পড়ে বাবাকে শুনিয়েছিলাম। গভীর রাত্রে বাবার এমন হাসি পেয়েছিল, মায়ের বারবার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল, মা খুব রাগ করেছিল সেদিন। আর না পড়ার জন্য মা আমাকে ধমক ও বকা দিয়েছিল। মায়ের রাগে বাবার হাসি আরো বেড়েছিল! বাবা মায়ের এই সুখময় স্মৃতিটি আজো বারে বারে মনে পড়ে।
আমার বই সংগ্রহের অভ্যাস ছিল সে সব বই তিনি আদ্যোপান্ত পড়তেন। শহরে থাকা অবস্থায় আমি যত বই কিনতাম, ছুটিতে গ্রামে গেলে সে সব নিয়ে যেতাম। তিনি এসব বই পড়তেন ডাইজেস্ট, রহস্য পত্রিকা, কিশোর উপন্যাস, থ্রিলার, গোয়েন্দা কাহিনী, সাহিত্য-উপন্যাস, বিদেশী গল্প, ইসলামী সাহিত্য, রামায়ণ, মহাভারত, বাইবেল, সহ আমার সংগৃহীত সব বই তিনি পড়তেন। যে কথাটি না বুঝতেন সেটা পরের বারে বাড়ী আসলে, আমাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতেন। ব্যাপারটি ছিল ঠিক আমার ছোট কালের উল্টো, ছোটকালে আমি জানতে চাইতাম, এখন তিনি জানতে চান। বাবা একটা কথা বহুবার জানতে চাইলেও ব্যাখা করার ক্ষেত্রে আমার বিরক্ত আসত না, কেননা বৃদ্ধকালে তিনি একটা প্রশ্ন বহুবার করতেন। ইউরোপে থাকা অবস্থায় তিনি বহু পৃষ্ঠার লম্বা লম্বা চিঠি লিখে জানতে চাইতেন, আমি কি কাজ করি? কাজের ধরণ কোন প্রকারের? ১৯৯০ সালের পর থেকে দুনিয়াতে এমন কিছু পেশা, পদবী ও চাকুরীর সৃষ্টি হয়েছে, যার নাম বললে, তার আগের শিক্ষিত মানুষদের কাছে চাকুরীটা কিসের সেটা বোধগম্য হওয়াটাও কঠিন ছিল। তিনি লিখতেন, তাঁর কাছে যেন আমার চাকুরীর ধরনটা এমন ভাবে ব্যাখা করি, যাতে করে তিনি অন্য কাউকে পরিষ্কার করে বুঝাতে পারেন। এসবের মাধ্যমে মূলত তিনি জানতে চাইতেন, আমি কোন হারাম ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত কিনা। হারামের ব্যাপারে তিনি অসম্ভব রকমের গোঁ ধরার মানুষ ছিলেন। প্রয়োজনে না খেয়ে মরে যাবেন, তারপরও সে ব্যাপারে কোন কম্প্রোমাইজ ছিল না। আমাদের তিন ভাইকে বিয়ে করিয়েছেন শ্বশুর বাড়ীর একটি ক্ষুদ্রতম উপহার গ্রহণ ছাড়াই! নতুন বউয়েরা শ্বশুর বাড়ীতে নিত্য ব্যবহার্য কিছু প্রসাধন সামগ্রী ছাড়া মাত্র চারটি শাড়ী, ব্লাউজ ও পেটিকোট আনতে পেরেছিল! ভাইদের বহুবার ব্যবসা পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছেন। আমার ফাইন আর্টস পড়ার শখ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাঁর আবদারে সেই সাবজেক্ট বাতিল করে পাসকোর্সে পড়ার জন্য কলেজে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী বাবাকে কোনদিন কাণ্ডজ্ঞানহীন মনে করিনি বলেই এসব নিঃসংকোচে মেনে নিয়েছিলাম।
আমার আমুদে ও অতিশয় সৎ বাবার বৃদ্ধকালের কথা মনে পড়লে আমাকে রীতিমত কাঁদায়। আমি এখনও কাঁদি এই লিখার সময়ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিনা। এই পৃথিবীতে তিনি আমার সৌভাগ্য ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার প্রতীক ছিলেন। একদা বাড়ীর সবার পীড়াপীড়িতে দেশের খুবই সম্মানী ও ভাল বেতনের চাকুরী ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি দিয়েছিলাম। প্রবাস আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল, এখনও তার বাহুবন্ধন থেকে মুক্তি পাইনি। ইউরোপ থেকে দেশে গিয়েছি বিয়ে করার জন্য। পরিকল্পনা ছিল ইউরোপে আর ফিরে যাবো না, বিয়ে করেই আবুধাবিতে গ্রাফিক্স নির্ভর একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলব। বাড়ীতে গিয়ে দেখি তিনি আর পড়তে পারতেন না, অনেক কথা বলতে গুলিয়ে ফেলতেন, একটা কথা বহুবার জিজ্ঞাসা করতেন। তবে নামাজ পড়াতে কোন সমস্যা হত না। আমি কোথাও বসলে তিনি আমার কোলে মাথা রেখে শুইতে চাইতেন। আমি শুইলে ঠিক আমার ছোট কালের মত আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে চাইতেন। এটা তো আমার সমস্যা হবার কথা নয়, আমি আবার বাবার মনের ভেতরে ঘুরপাক খাওয়া কথাগুলো অন্তঃকরণে অনুধাবন করতাম। তাই আমি তার ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই আচরণ করতাম।
বিয়ে করে নতুন বউ এনেছি, সময় কম মাত্র ২৭ দিন পরেই বিদেশে চলে আসব। বাবা তখনও আমার সাথে থাকার জন্য পিছনে লেগে থাকত। আমার বৃদ্ধা মা বাবাকে বুঝাতেন এখন নতুন বউ এসেছে তাদের একটু সময় দেওয়া দরকার। মা বললে বুঝতেন কিন্তু ঘুমানোর সময়ে ঠিকই আমার ঘরে চলে আসতেন। আমি চিন্তা করতাম এটা দেখে আমার নববধূ কি মনে করতে পারে! সে বাবাকে পাগল মনে করে বসে কিনা! পাগল মনে করে বাবাকে অবহেলা করবে কিনা! শ্বশুর বাড়ীকে উপদ্রব মনে করে কিনা ইত্যাদি। সে ও এই বাড়ীতে নতুন, কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা, আমাকে কি বলবে কিংবা আমাকে কি প্রশ্ন করবে। আমার বাবা-মায়ের কাছে আমি যেহেতু বেশী প্রিয় ছিলাম, তা রক্ষার্থে বিয়ের আগে আমি হবু বধূকে একটি এসাইন্টম্যান্ট দিয়েছিলাম এভাবে; ‘আমি প্রবাসে যাচ্ছি, আমার বাবা-মা খুবই ভাল মানুষ, তারা লোভী নয়, চাহিদার জন্য খোটা দানকারী হিসেবে পাবে না এবং কিছু একটি সহসা পাবার জন্য বিরক্ত কারীও হবে না। তুমি যদি আমার বাবা-মাকে নিজের বাবা-মায়ের মত দায়িত্ব নিয়ে দেখাশোনা করো; তাহলে যদি তোমার বাবা মায়ের তেমন সেবা যত্ব ও সহযোগিতা কোনদিন দরকার হয় আমিও তার চেয়ে বেশী প্রতিদান দিতে চেষ্টিত হব’। সেজন্য আমি চিন্তিত ছিলাম, আমার বাবা যেভাবে আমাকে সর্বদা কাছে পেতে চাচ্ছে, সেটাকে কে ঝামেলা মনে করে কিনা। আল্লাহ মেহেরবান ছিলেন, আমার নববধূ গিয়ে বাবাকে সময় দেওয়া শুরু করল। সে নিজেই বাবার সাথে অনেক গল্প শুরু করল। বাবা নববধূর চাকুরীর ব্যাপারে, তার ছোটকাল, বান্ধবীরা কেমন সেসব জানতে চাইলেন। এভাবে তার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠল এবং আমার সাথে ঘুমিয়ে থাকার প্রবণতা টা কেটে গেল। এবার বাবা নতুন নতুন বউয়ের কাছে এক দাবী জানাল, ‘তুমি আমার ছেলেটিকে আর বিদেশে যেতে দিওনা, তুমি তাকে বাধা দাও’। বাবা এবার বিদেশে না যাবার জন্য আমাকেও ধরে বসলেন। তিনি বলতে রইলেন, ‘তুমি এবার বিদেশে গিয়ে কোন সুবিধা করতে পারবে না, তাই বিদেশ যাবে না’। বাবাকে বললাম, আমি অচিরেই ফিরে আসব, তাছাড়া তোমার জন্য সর্বদা দোয়া করব। ওদিকে বিদেশে যাবার দিন সকালে, দাদার কবর জেয়ারত করতে গেলাম, এটা আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য, যাবার দিন, আসার দিন কবর জেয়ারত করা। রওয়ানা হবার আগ মুহূর্তে বাবাকে আবারো জড়িয়ে ধরলাম, তিনি ছোট শিশুর মত আমার বুকে সেঁটে রইলেন। বার বার চুমু দিলাম, মনে হচ্ছিল বার বার চুমোটা করতে থাকি। মা এগিয়ে এসে ছুটিয়ে দিলেন এবং দোয়া নিয়ে বিদায় নিলাম।
বাবার সাথে এটাই শেষ দেখা। তখন মোবাইল সহজলভ্য ছিলনা। বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম, তিনি একটি পিচ্ছিল স্রোতস্বিনীতে লাটি হাতে দাড়িয়ে, আগে পিছে যেতে পারছেন না। প্রশ্ন করলাম আপনি এখানে কেন এসেছেন? উত্তর দিল তোমাকে খুঁজতে এসেছি! আমি তাঁকে সেখান থেকে তুলে তীরে আনলাম। ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্ত্রী সাথে কথা বলতে শহরে আমার পাশের বাসায় ফোন করলাম। তাকে পেলাম না, উত্তরে জানলাম আমার পিতা ইন্তেকাল করেছেন, তাই সে গ্রামে গিয়েছে। সে গ্রামের বাড়ীতেই ছিল, টাকা নেবার জন্য শহরে এসেছিল। আমার স্ত্রী আমার বাবা-মায়ের জন্য সর্বোচ্চ ভালবাসাটাই প্রদান করেছিল। তাদের কোন আবদারই সে অপূর্ণ রাখেনি। আমার বাবাকে বেশীদিন পায়নি তবে মাকে দুই বছরের জন্য পেয়েছিল। আমার মা-বাবা দুজনেই পুত্রবধূদের অসম্ভব ভালবাসত, ভাবীরাও তাঁদের ভালবাসত। বাবার মৃত্যু সংবাদ আমাকে পৃথিবীতে অসহায় করে দিয়েছিল। আমার মা বাবার চেয়েও বেশী প্রিয় হবার পরও, মায়ের জন্য যত না কেঁদেছি, তার চেয়েও বেশী কেঁদেছি বাবার জন্য। বাবার আরো দুটি সন্তান থাকলেও, আমি নিশ্চিত জানতাম, বাবার মৃত্যু শয্যায় জীবনের অন্তিম লগনে যদি পৃথিবীর কোন একজন মানুষের কথা ভেবে থাকে, সেটা ছিলাম আমি। মায়ের স্মৃতিগুলো পারিবারিক ও গ্রাম কেন্দ্রিক হলেও বাবার স্মৃতি ছিল সর্বত্র। ফলে প্রতিটি স্মৃতিই আমাকে দীর্ঘদিন কাঁদিয়েছে। সেবার বিদেশ এসে বাবার অনুরোধ উপেক্ষা করার শাস্তি কড়ায় গণ্ডায় পেয়েছিলাম। সেই বিদেশ যাত্রা আমার জন্য ক্ষুদ্রতম কোণ কল্যাণ বয়ে আনে নি। বিদেশে চরম বেকায়দায় পড়ে গেলাম। ইউরোপের চাকুরী ছেড়ে এসেছি, যে ব্যক্তি আবুধাবিতে ইনভেষ্ট করবে বলেছিল তিনি হার্ট এটার্কে মারা যান, ফলে ভিসা নিয়ে অর্ধপথে আইনগত মুসিবতে পড়ে যাই, আমার বড় সন্তানটি মারা গেল অবশেষে বাবাও মারা যান। ১৮ মাস আইনগত জটলায় বাড়ী যেতে পারিনি, চাকুরীর ডিমান্ড থাকা স্বত্বেও তাও করতে পারিনি! রাজ্যের যত অকল্যাণ ছিল সব যেন আমাকে পিছু ধাওয়া করল। অতঃপর আল্লাহ আমাকে আরেকটি পুত্র সন্তান দিয়েছেন; তার চেহারা, চরিত্র, স্বভাব পুরোটাই আমার বাবার মত। ফলে দৈনিক বাবাকে মনে পড়ে, প্রতিনিয়ত বাবার জন্য দোয়া করার সুযোগ ঘটে। আর ভয়ে ভয়ে থাকি আমিও যদি জীবনের শেষ বাঁকে, বাবার আবদার না করার অপরাধে, অবিকল আমার বাবার মত পরিণতি ও পরিস্থিতির মুখোমুখি হই! তখন আমার মত হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ থাকবেনা।
বিষয়: Contest_father
২৭১৬ বার পঠিত, ২৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আপনার বাবাকে বেহেস্তবাসী করুন।
আল্লাহ আপনার স্ত্রীকে ইহপরকালে কামিয়াবী দান করুন ।
ধন্যবাদ
আচ্ছা ভাই একটু দোয়া করে দিনতো, আপনার মরহুম চাচাকে নিয়ে কিছু একটা লিখতে পারি কিনা...
আল্লাহ আমাদের চাচা চাচীকে জান্নাতের মেহমান করে নিন, এ দোয়া করি। ভাতিজার বর্তমান ছবিটা পাঠান একসময় মেইলে
আপনি আমাকে যে পরিবেশে দেখেছেন ও পেয়েছেন, সে পরিবেশে একজন গায়ক হিসেবে পরিচিতি পাওয়াটা আমার দৃষ্টিতে মোটেও সম্মানের নয়। তাই হয়ত জানতেন না, গান নিয়ে আমার গৌরব করার মত কিছুই নাই, আফসোসও নাই, তাই বলিনি। প্রসঙ্গ এসেছে বলে কথা বের হয়ে পড়েছে। নজরুলের 'লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া, মজনু গো আঁখি খোল' গানটি গেয়ে বেশী সংখ্যক পুরষ্কার পেয়েছিলাম। এখন এই সব গান আমি কোথায় গাইতে পারি? নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছেন।
ম্যানিলার দূর প্রবাসে বসে আমার বাবার কাহিনী পড়ে আপনি ও ভাবী হাঁসি ও দুঃখ দুটোই পেয়েছেন জেনে খুশী হলাম। আল্লাহ আপনাদের উভয়ের আব্বু-আম্মুকে রহম করুন।
আপনি একজন ভাল লেখক, উঁচু মানের ব্লগার, ব্লগ জগতের প্রথম দিকের মানুষ। আপনার লিখনী থেকে অনেক পাঠক উপকৃত হবে, তাই আশা করি অচিরেই লিখাটি লিখবেন ও পোষ্ট করবেন। অনেক ধন্যবাদ।
বাবাকে নিয়ে লিখা গল্পে আপনার জীবনের অনেক কিছুই জানলাম। ভাল লাগল। সবেচেয়ে বড় কথা হল আপনার বাবা একজন দারুন পাঠক ছিলেন। আর পাঠক মানেই জ্ঞানী। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন