মানব কল্যাণে মোরগের অবদান (রম্য রচনা)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ১৮ মার্চ, ২০১৪, ০২:৩৮:২৩ দুপুর
একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে মোরগ থেকে শিক্ষার তেমন কিছু নেই, তবে একজন জ্ঞানী মানুষ মোরগ সম্পর্কে সামান্য জানলেও, চোখ কপালে তুলবে; নিজেকে অপরাধী মনে করবে, ভাববে সৃষ্টি এবং স্রষ্টার প্রতি কত অবহেলাই না করা হয়েছে! মোটা বুদ্ধির জ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীর সকল কিছুর উপর মধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করলেও মোরগের মাথা নাকি এই আকর্ষণ থেকে মুক্ত! শূন্যের উপর মুরগীর শরীর ডানে-বামে ঘুরালে, কিংবা উপরে নীচে করলে; মুরগীর পুরো শরীর নড়াচড়া করে কিন্তু গলার সাথে সংযুক্ত মাথাটি নড়াচড়া করেনা! মোরগ ব্যতীত আরো কিছু বন্য পাখির ক্ষেত্রে এটা দেখা গেলও; মানব জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আমাদের সাথে বেড়ে উঠা, অবহেলিত এই মোরগ প্রতিদিন দেখার পরও চক্ষুষ্মান অনেকেই বিজ্ঞানের এই বিপরীত ধর্মী আচরণ কোনদিন লক্ষ্য করেনি! বিজ্ঞানীরা মোরগের মাথার স্থির থাকার ঘটনায় হতভম্ব হয়েছেন। মোরগের মাথার ঝুটিতে যদি একটি ক্যামরা বাঁধা হয়, তখন যদি ভূপৃষ্ঠে ভূমি কম্প হয়, মোরগের শরীর নড়তে থাকবে কিন্তু মাথা নড়বে না, ফলে ভূ-কম্পনের তাণ্ডব, সঠিক ও বস্তু-নিষ্টভাবে ক্যামরা বন্ধী হবে। ভূ-কম্পনের প্রথম অনুভূতি মোরগের কাছে সবার আগে ধরা পড়ে বলেই সে আতঙ্কিত হয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। সে জন্যই আল্লাহ বিভিন্ন ভাবে বলেছেন, ‘মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ, তারা চিন্তা ভাবনা করেনা, তারা আমার সৃষ্টি নৈপুণ্য নিয়ে গবেষণা করেনা, এরা কখনও নির্বোধ গাধার মত’।
মোরগ নিয়ে সমাজে অনেক গল্প প্রচলিত থাকলেও, মোরগ নিয়ে চিন্তাশীল সম্প্রদায়কে কৌতূহলী হতে দেখা যায় না। প্রাইমারী স্কুলে গরু, ছাগল, ঘোড়া, গাধা এমনকি চোরের রচনা পড়ানো হলেও, কখনও মোরগের রচনা পড়ানো হয়েছে, এমনটি শোনা যায়নি! কেননা, মোরগ চক্ষুষ্মান মানুষের কাছে এখনও মূল্যবান প্রাণী হয়ে উঠতে পারেনি! তাছাড়া মানুষ, মোরগের কাছে আলাদা কোন বিশেষত্বও দেখতে পায়না, নিতান্ত লাভজনক ব্যবসায়ীক কারণেই মোরগকে পছন্দ করা হয়। গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে গরু, ছাগল, ঘোড়া, গাধা, উট কদাচিৎ মানুষের চুমো খাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে থাকে! তবে কপাল খারাপ মোরগের! চুমো খাওয়া দূরে থাক, অহর্নিশি মানুষের লাথি, ছড়ির আঘাত, ঝাঁটার গুঁতো খেয়েই গেরস্থের বাড়ীতে জীবন যাপন করতে হয়! অথচ পৃথিবীতে জীবন রক্ষায় ও মানব সভ্যতা বিনির্মাণে মোরগের মত একটি ক্ষুদ্র প্রাণীর যত অবদান রয়েছে, অন্য কোন প্রাণীর দ্বারা তা হয় নাই।
সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘একটি মোরগের আত্মকাহিনী’ লিখে কবিতার জগতে অমর হয়ে আছেন। বোধহয়, বাংলাভাষায় তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি মোরগ নামের অবহেলিত প্রাণীটিকে কে সাহিত্যের পাতায় প্রথম স্থান দিয়েছেন! তবে পরিতাপের বিষয়, মোরগের অর্জিত খ্যাতির উপর ভর করে, পৃথিবীর কত মানুষ খ্যাতিমান হয়েছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই! তুরস্ক, আফগান ও মধ্য এশিয়ায় মোরগ লড়াই প্রায় জাতীয় পর্যায়ের খেলার অন্তর্ভুক্ত! বাংলাদেশে বাহ্মন বাড়ীয়ার সরাইল এলাকায় এখনও মোরগ লড়াই একটি প্রসিদ্ধ খেলা হিসেবে চালু আছে। শোনা যায়, মোঘল আমল থেকেই দেওয়ানেরা এ খেলা চালু রেখেছিলেন! এখন স্থানীয় অধিবাসীরা এটি মঙ্গলের আশায় খেলেন, আর নিজেদের মোঙ্গল ভাব দেখান। একটি মোরগকে অন্য মোরগের বিরুদ্ধে ক্ষেপীয়ে তুলে লড়াই বাধানো হয়। দুই মোরগের মরণপণ লড়াইয়ের হার-জিতে মোরগের পাওনা থাকে শূন্য! জিত হয় মোরগ মালিকের, অর্জন করে নগদ পুরষ্কার!
লম্বা পা, ঈগলের মত চোখ, স্বল্প পালকের দুর্লভ প্রজাতির বাংলাদেশের হাস্লী মোরগ এই খেলার জন্য সেরা। মোরগের নিজস্ব ফ্লাইং কিকের স্টাইল গুলোকে মানুষ বিভিন্ন নামে চিত্রিত করে। মোরগের উড়ন্ত লাথি গুলোকে ‘নিম, কড়ি, বাড়ি, ফাক, ছুট, কর্নার’ নামে অভিহিত করা হয়! চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে আরেকটি বুনো মোরগ পাওয়া যায়, যার নাম ‘আছিল’। অসম্ভব তেজস্বী ও যোদ্ধা প্রকৃতির এসব মোরগ দারুণ ভাবে উড়তে পারে। এদের পিছনের আঙ্গুলটি ইঞ্চির চেয়ে বেশী লম্বা, দেখতে বড় সড় সূচালো পেরেকের মত! শূন্যের উপর উড়ন্ত অবস্থায় দিক পরিবর্তন করে আক্রমণে বেজায় পারদর্শী! যার কারণে বেজী, খেঁক শিয়াল, পাতি শিয়াল, কদাচিৎ বুনো শৃগাল পর্যন্ত এই পেরেক আক্রমণের ভয়ে লেজ তুলে পালায়! এরা আক্রান্ত হলে নিজেকে বাঁচানোর জন্য পাল্টা হামলা করে বসে, একবার লড়াই বাধলে, আমরণ লড়তে থাকা এদের স্বভাব! পাহাড়ে থাকতে হয় বলে, আল্লাহ তাদের পেরেক জোড়াকে আত্মরক্ষার অস্ত্র বানিয়েছেন। তাদের আক্রমণে চোখ, কান তো বটেই, মুহূর্তেই চামড়ার গোশত পর্যন্ত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়!
ভারতের বালেশ্বর ও উত্তর ওড়িষ্যার জনপদে মোরগ লড়াই একটি খুবই জনপ্রিয় খেলা। বীভৎস কায়দায় সে খেলা চলে! মোরগের পায়ে ষ্টেইনলেস স্টিলের ধারাল নখ ও ছোট্ট ছুরি কায়দা করে বসানো হয়। মোরগ নিজেও জানেনা তার একটি ছোট্ট লাথিতে, প্রতিপক্ষের কি ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে! যুদ্ধালো মোরগ যখন প্রতিপক্ষকে জোরালো ল্যাঙ মারে, মুহূর্তেই প্রতিপক্ষ মোরগের বুক ফালা ফালা হয়ে যায়। কদাচিৎ প্রতিপক্ষ মোরগ বুঝে উঠার আগেই, ধড় থেকে মাথা কিংবা দেহ থেকে পা মুহূর্তের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়! প্রাণ স্পন্দন থেমে না হওয়া অবধি এ লড়াই চলতে থাকে। এখানেও সেই আগের কথা, মোরগের মৃত্যুতে মানুষ বিজয়ী হয়। করুণভাবে নিহত মোরগের লাশের মালিক বনে যায় ভাগ্যবান বিজয়ী ব্যক্তি! এভাবেই অসহায় প্রাণীদের নির্দয় ভাবে ব্যবহার করে, ধী শক্তি সম্পন্ন মানুষ নিজেদের খ্যাতি বাড়ায়, বড়ত্ব দেখায়! ১৯৬০ সালে ভারত সরকার ‘পশু ক্লেশ নিবারণ আইন’ পাশ করে মোরগ লড়াই নিষিদ্ধ করে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই আইন পাশের পরে মোরগ লড়াই আরো বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। মানব কুলের একটা ধর্ম ‘যেখানে নিষিদ্ধ বিষয়, সেখানেই সে আকর্ষিত হয়’।
চীন দেশে মোরগ একটি অতি সম্মানের প্রতীক, সেদেশে ১২টি চান্দ্র রাশিতে এক বছর হয়, তার মধ্যে একটি চান্দ্র রাশির নাম ‘মোরগ’। চীনারা বিশ্বাস করে মোরগের পাঁচটি গুনের কারণে সে সবার কাছে আদরণীয় ও সম্মানিত। তাদের ধারনা, ‘মোরগের লাল ঝুটি পাণ্ডিত্যের লক্ষণ! সে শত্রুকে প্রতিহত করতে ভয় পায়না! সে অতি দয়ালু, তাই সে সহজে তার খাবার অন্যকে দেয়! সে প্রত্যূষে সবার ঘুম ভাঙ্গায়! সময় মতই সে তার দায়িত্ব পালন করে’। চীনের কিংবদন্তী নেতা মাও সে তুং আধুনিক চীনের স্বপ্ন দেখে ঐতিহাসিক কবিতায় উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘মোরগের জোরালো ডাক, চীনা জনগণের জন্য এনেছে মুক্তি ও স্বাধীনতা’! এই কথাটি চীনে প্রবাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মোরগ নিয়ে পৃথিবীর বহু দেশে ছড়িয়ে আছে রাজ্যের সব উপকথা ও কাহিনী। শুধু কি তাই, আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ) প্রথমে মুরগী পালন দিয়েই এই দুনিয়ার জীবন শুরু করেছিলেন!
মানব সভ্যতা বিকাশে মোরগের অবদান জানার আগে, মোরগ সম্পর্কে কয়েকটি কথা পূর্বে জেনে নেওয়া দরকার। আমাদের দেশে শখ করে কিংবা চাহিদা পূরণের জন্য মোরগ পালনের প্রবণতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগে গ্রাম থেকে শহরে মুরগী ও ডিম রপ্তানি হত, এখন বিদেশ থেকেই আমদানি করতে হয়। মোরগ এখন গৃহস্থের বাড়ী থেকে বিদায় নিয়ে বাণিজ্যিক লাভের আশায় খামারি ব্যবসার অংশ হয়ে গিয়েছে! ফলে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাণীটির অনেক খাসিয়ত, চরিত্র ও ব্যবহার জানা, বর্তমান সময়ের মানব সন্তানের কাছে অজানাই থাকবে। ফার্মে পালিত কম বয়সী মোরগ-মুরগী দেখে মোরগের পূর্ণ চরিত্র বুঝা যাবেনা, তাই পালন করা মোরগের প্রচলিত কিছু চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল। হয়ত যারা পালিত মুরগী দেখেছেন, তাদের জন্যও নতুন কিছু জানা হবে।
মুরগী গৃহস্থের পচা, বাসী, উচ্ছিষ্ট খাদ্য কণা খেয়ে গৃহস্থকে মিতব্যয়ী রাখে। এছাড়াও বাড়ির আশে পাশের ঝোপ জঙ্গলের পোকা মাকড় খেয়ে গৃহস্থের বাড়তি উপদ্রব কমায়। খাদ্য তালাশের কারণে, গৃহস্থের বাড়ীর চারপাশের হালকা পচা মাটি, নখ দিয়ে উল্টিয়ে শুকিয়ে ঝরঝরে করে ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধ করে। গৃহস্থের ফেলে দেবার মত উচ্ছিষ্ট খানা খেয়েই মুরগী তার বংশ বৃদ্ধি অব্যাহত রাখে, ডিমের উৎপাদন বাড়ায়। সর্বোপরি গৃহস্থের জোগান দেয়া খাদ্যের সাথে, সে নিজেও সম পরিমাণ খাদ্য জোগাড় করে খায়, যার পুরো সুফল গৃহস্থের ঘরে যায়। মুরগী নোংরা থেকে খাদ্য খেলেও পরিষ্কার যায়গায় পায়খানা করা তার বদ স্বভাবের একটি। নিজের বংশ ধরকে স্বাবলম্বী করতে মা মুরগী ২ মাস পরেই বাচ্চাদের পিটিয়ে-ঠুকরিয়ে আলাদা থাকতে বাধ্য করেন। সন্তানদের বেয়াদবি ও বিরক্তির জন্য বাচ্চার মাথার ঝুঁটিতে, বে-আকলির জন্য লেজের মাথায় তেলের ডিব্বার উপরে ঠোকর মেরে শাসন করে! মা মুরগী নিজে না খেয়েই বাচ্চাদের উদর পূর্তি করায়, বুকে নিয়ে গরম রাখে, নিরাপত্তা দেয়। খাদ্য খেতে কিংবা খাদ্য জোগাড় করতে বুদ্ধি শেখায়। মা মুরগী নিজের বাচ্চাদের মাঝে লড়াই বাধিয়ে যুদ্ধে পারদর্শী করায়। বাচ্চারা সর্বক্ষণ যুদ্ধে লিপ্ত থাকলে, বে-আকলীর কারণে লেজের ঢিবিতে ঠোকর মেরে নিবৃত করে। মুরগীর ডিম্বকোষে ডিম আসলে মনের আনন্দে, কঁঅ... রবে আওয়াজ করে, ঝুটি রঙ্গিন হয়, চোখ হয় লাল। ডিম পারার অব্যাহতি পরেই খুবই চিল্লাচিল্লি শুরু করে, এটা গৃহস্থের পেরেশানির কারণ হয়, শৃগালও মুরগী বাড়ীর ঠিকানা জেনে যায়। মুরগীর চিল্লানির আওয়াজ শুনে মোরগ পুলকিত হয় ও এক প্রকার আশ্চর্যবোধক উত্তর দেয়, ফলে মুরগীর চিল্লানো বন্ধ হয়। মুরগী চায়, সে যে ডিম পেরেছে এই খবর মোরগ জানতে পারুক। তবে বে-আকল মুরগী গৃহস্থের অসন্তুষ্টির কারণ হয়! তার বাচ্চারা মায়ের মত আকল হীন হয়, পরিষ্কার জায়গা নোংরা করে, বাচ্চারা স্বাবলম্বী হয় না বলে খাদ্যের জন্য গৃহস্থকে বিরক্ত করে।
নূতন মোরগ পুরানো মোরগের সাথে পরিচিত হবার পদ্ধতিটি একটু ভিন্ন প্রকৃতির! প্রতিটি নতুন আগন্তুক মোরগকে বাড়ীর পুরানো মোরগদের সাথে লড়াই করে নিজের অবস্থান নির্ণয় করতে হয়। লড়াইয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হয় গ্রামের অন্য সকল মোরগের মধ্যে তার অবস্থান কোন পর্যায়ে! পুরুষ মোরগ খাদ্যের প্রতি খুবই উদাসীন! বাহ্যিক ভাবে চালচলন রাজকীয় মনে হলেও, ভিতরে কিন্তু একেবারেই ফাঁকা। মোরগ অসম্ভব কামুক প্রকৃতির, তাই ঘর থেকে বের হয়ে প্রথমেই সে চিত্ত বিনোদনের কাজটি সেরে নেয়! তারপর পুরো শরীর নাড়া দিয়ে ধুলো, বালি, ক্লান্তি, ক্লেশ সব ঝেড়ে নেবে; অতঃপর ‘কূক কুড়ূক কুক’ ডাক দিয়ে কোন অসহায় প্রতিদ্বন্দ্বীকে তাড়া করবে; এরপর যখন খানায় মনোনিবেশ করবে, ততক্ষণে গৃহস্থের থালায় খানা শেষ! বাহিরে ছিটকে পড়া খাদ্য কণার দু’একটি খেয়ে সারাদিন উপোষ থাকবে। দৈবাৎ একটি ভাল খাদ্য কণা পেয়ে গেলে, সেটা নিয়ে কট্ কট্ আওয়াজ করে এবং নিঃসঙ্গ, আগ্রহী মুরগীকে প্রলুব্ধ করে। যে মুরগী খেতে আগ্রহী তাকে প্রাপ্ত খাদ্য কণা উপহার দেয়। এতে মোরগ বুঝে নেয় যে, মুরগী তাকে পছন্দ করেছে! এতে মোরগ খুব খুশী হয় এবং আন্তরিকতার নিদর্শন স্বরূপ মোরগের একটি পাখা নিজের পায়ের সাথে লাগিয়ে, মাটি বরাবর বিছিয়ে, মুরগীর দেহের চারিদিকে একটি অর্ধ বৃত্ত নাচ দেয়। এর অর্থ হল আজকে তুমি আমার দখলে! তোমার উপর কেউ নজর দিলে তার কপালে খারাবী আছে। প্রতি আধা ঘণ্টা কিংবা এক ঘণ্টা পর পর মোরগের কাম ভাব জেগে উঠে! চিত্ত ঠাণ্ডা না হওয়া অবধি সে শান্ত হয়না এবং খাওয়া ছেড়ে দিয়ে চরম পেরেশানি নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে। ‘বাল্যকালে মোরগের অসম্ভব কামুক প্রবৃত্তি দেখে ভাবতাম, আল্লাহ মোরগকে এমন খোলামেলা বেতমিজ বানানোর হেতুটা কি?
যখন পূর্ব আকাশের লালিমা দেখা দেয়, তখন মোরগ পুরো মানব জাতিকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। চারিদিকে আবদ্ধ একটি ছোট্ট ঘরে থেকে, মোরগ আকাশের লালিমা দেখতে পায়না। আল্লাহ তাকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন যদ্বারা সে সকাল-সন্ধ্যা-রাত্রির তফাৎ অনুভূতি দিয়েই বুঝতে পারে। এটা মানবজাতির জন্য এক অসাধারণ সহযোগিতা! রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ‘মোরগ যখন কল্যাণের ফেরেশতাকে দেখতে পায়, তখন সে ডাক দিয়ে উঠে, তখনই তোমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও’। একদা ঘড়ি খুবই দুর্লভ বস্তু ছিল, জেঠাইমায়ের ঘরে রক্ষিত দেওয়াল ঘড়িটি যথাসময়ে চাবি না দেবার কারণে বেশীর ভাগ সময় বন্ধ থাকত। মেঘযুক্ত রোজার সন্ধ্যায় জেঠাই মা বলতেন, বাহিরে গিয়ে দেখ্তো তোমাদের শরীরের লোম দেখা যায় কিনা? খোলা চোখে যদি লোম দেখা যেত, তাহলে ইফতারির সময় হয়নি। বৃষ্টি-যুক্ত রোজার বিকালেই সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে, তখন জেঠাইমা বলতেন দেখতো মোরগ-মুরগী তাদের ঘরে ঢুকছে কিনা? ইতিবাচক উত্তরে ইফতার সারতেন। কখনও জেঠাইমাকে সহযোগিতার জন্য বলতাম, মুরগীকে জোড় করে তাদের ঘরে ঢুকিয়ে দেব কিনা? তিনি বলতেন না না ও কাজ করোনা! তাহলে তো কষ্টের রোজাটাই মাটি হবে। যদি মোরগ-মুরগী স্ব-ইচ্ছায় তাদের জন্য বানানো নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকে তাহলে বুঝবে সন্ধ্যা হয়েছে এবং ইফতার করা যাবে।
ছোটকালে বাড়ীতে সর্বদা ৪ জন চাকর-চাকরানী থাকার পরও, মা আমাকে হাঁস-মুরগীর সেবক বানিয়েছিলেন। সকাল সন্ধ্যায় হাঁস-মুরগীকে খানা দেওয়া, ঘরে ঢুকানো, ডিম সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা, ডিমে তা দেবার জন্য বাসা তৈরি করা, গুনে গুনে হিসাব রাখার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। মেঝ ভাইয়ের কাজ ছিল গরু-ছাগলের যাবতীয় দেখা শোনা করা। চাকর-চাকরানী থাকা সত্ত্বেও আমাদের দুই ভাইকে দিয়ে মা এগুলো নিয়মিত করাতেন। যদি হঠাৎ করে মেহমান বেড়াতে আসত, ঘরে অনেক হাঁস-মুরগী আর ডিম থাকার কারণে ঘণ্টা দু’য়েক এর মধ্যেই সবার জন্য খাদ্য প্রস্তুত করা সম্ভব হত! সকল গৃহস্থের পরিবার এমনই ছিল, তখন কারো ঘরে ফ্রিজ না থাকলেও মেহমান নিয়ে দুঃচিন্তা হতনা। আমি অবনত মস্তকে মায়ের আদেশ পালনে বাধ্য ছিলাম। তিনি বলতেন, পারিবারিক কাজ না জানলে, গৃহস্থের মূল্যবান প্রাণীদের প্রতি মমত্ব না থাকলে, বাবার সম্পদের সুখের গুঁতোয় নাকি সংসার জীবন ধ্বংস করে দিব!
পৃথিবীর সবাই ডিম পারে, আর সব স্ত্রী দেহে রয়েছে ডিম্বাশয়; ডিম্বাশয়ে জন্মে ডিম। ফুল, ফল, প্রাণী, মানুষ সবার কাছেই ডিম্বাশয়, ডিম্বকোষ রয়েছে। ফুলের ডিম উন্মুক্ত ও খোলা থাকে। মানুষ ও প্রাণীর ডিম থাকে দেহের ভিতরে থলের মাঝে! ডিম যথাসময়ে ব্যবহার না হলে, একটা নির্দিষ্ট সময়ে তা নষ্ট হয়ে যায়! কিভাবে ডিম নষ্ট হয়, বাহিরে থেকে তা কেউ দেখতে পায়না। মাছের ডিম গুচ্ছ অবস্থায় থাকে, ডিম বের হবার পর নিষিক্ত হয়, অনিষিক্ত ডিম কাজে আসেনা। হাতির মত বিরাট প্রাণীর ডিমের ব্যাস মাত্র ৩ সেন্টি হলেও মুরগীর মত নগণ্য প্রাণীর ডিমের ব্যাস কখনও ৬ সেন্টি পার হয়ে যায়! হাতির তুলনায় মুরগীর দৈহিক আকার ক্ষুদ্র হবার পরও মুরগীর ডিম অপেক্ষাকৃত বড়। নিষিক্ত ও অনিষিক্ত ডিম, উভয় অবস্থায় মানুষের উপকারে আসে। সকল প্রাণীর ডিম পেটের ভিতরেই জন্মে এবং পেটের ভেতরেই তা নষ্ট হয়ে যায়। মুরগীর ডিম পেটের ভিতরে সৃষ্টি হলেও, সেই ডিম বের হয়ে আসাটা অপরিহার্য। ডিমকে এভাবে বের করে আনার এই প্রক্রিয়া মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, একমাত্র মানুষের উপকারের জন্যই করেছেন। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিরাট অনুগ্রহ ও দয়া।
আল্লাহ মুরগীর ডিমের উপর মানুষের হাতকে করেছেন ক্ষমতাবান। মানুষ নিজের ইচ্ছামত সময়ে ডিম ফুটিয়ে, সদ্য বাচ্চা বের করে চাহিদা পূরণ করে। মানুষ পৃথিবীতে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত খুন করে চলছে কোটি কোটি প্রাণী! তার মাঝে অধিক হারে মানুষের হাতে অকালে মৃত্যুবরণ কারী একমাত্র প্রাণীটির নাম মোরগ! দৈনিক এত অধিক হারে মৃত্যু বরণকারী প্রাণী হিসেবে দুনিয়াতে মোরগের স্থান সর্বোচ্চ। ফার্মে জন্ম নেওয়া একটি বাচ্চা, তার যৌবন আসার অনেক আগেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। একটি খাঁচায়, এক মাসের ছোট্ট ক্ষণস্থায়ী জীবনে, মায়ের অনাদরে; দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের কঠিন বজ্র-তালুতে বিলীন হচ্ছে তাদের অসহায় জীবন। মানুষের ক্ষোভের যেন এখানে শেষ নয়! মুরগীর বাচ্চার নরম মাংসকে সিদ্ধ করে, চিবিয়ে, ছেঁচিয়ে, পুড়িয়ে, জ্বালিয়ে, ভর্তা করে খায়; আর পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। পৃথিবীর ৬৫০ কোটির বেশী মানুষ দৈনিক তাদের জঠর জ্বালা নিবারণ করছে শত শত কোটি মুরগীর ডিম, তাদের তাজা প্রাণ ও মাংসল দেহ দিয়ে। মানব সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয় আমিষের জোগান দিয়ে মানব জাতিকে কর্মক্ষম রেখেছে এই মোরগ! সুতরাং অস্বীকার করার কোন সুযোগ নাই, মানব সভ্যতা রক্ষায় মোরগের আত্মত্যাগ ও তাদের অবদানের কথা।
মুরগীর ডিমের অভাবে, দুনিয়ার বেকারিগুলো অচল হয়ে পড়ত। বিস্কুট, কেক, রুটি, পাউরুটি, বন, মিষ্টি সহ হাজার হাজার প্রকারের খাদ্য সামগ্রী তৈরি করা সম্ভব হতনা। সহজে বহনযোগ্য, লম্বা স্থায়িত্ব, সকল জলবায়ু উপযোগী, সুস্বাদু আমিষ হিসেবে মুরগীর ডিমের কোন বিকল্প নাই। সহজে রপ্ত যোগ্য, স্বল্প সময়ে উপস্থিত লোভনীয় খাবার তৈরিতে মুরগীর ডিমের তুলনা নাই। অকর্মণ্য ব্যক্তিও মুরগীর ডিম দিয়ে খাদ্য তৈরি করতে পারে। মুরগীর ডিমের অভাবে মানবজাতিকে বড় বেকায়দায় পড়তে হত। মুরগীর গোশত যদি না থাকত, কেন্টাকী, বার্গার, ম্যাকডোনাল্ডর্স সহ হাজারো কোম্পানির জন্ম হতনা। ফাস্ট ফুড বলতে কোন কথা ডিকশনারিতে থাকত না। স্যান্ডউইচ, হট ডগ, নাগেটস, মিট বল সহ মুরগীর মাংস নির্ভর আরো হাজারো খাদ্য সামগ্রীর কোম্পানির সৃষ্টি হত না। গরীব-মিসকিন মেহনতি মানুষ গরু-ছাগলের মাংস খেতে না পারলেও একটু চেষ্টায় কম খরচে মুরগীর মাংস জোগাড় করতে পারে। গরু, ছাগল, ভেড়া, মাছ না খাওয়া শিশুরা পর্যন্ত মুরগীর মাংস খুব ভালবাসে। মুরগীর মাংস পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মুক্ত, সহজে হজম যোগ্য; রোগী, শিশু থেকে শুরু করে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকেও এর মাংস খাওয়ানো যায়। মানবজাতির আমিষের চাহিদা মেটাতে পুরো ধনী-গরিব সকলকে ঠেস দিয়ে ধরে রেখেছে এই মোরগ। সৃষ্টির এই নিপুণ কারুকাজ আল্লাহ একমাত্র মানুষের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেছেন ‘কৌতুক কিংবা তামাচ্ছলে তিনি কিছুই সৃষ্টি করেন নাই। আর সকল সৃষ্টিকে একমাত্র মানুষের কলানাথেই নিয়োজিত রেখেছেন’। সবাই ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক মানব সম্প্রদায়ের কল্যাণে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। মুরগীর গোশত দিয়ে মৃত মানুষের জেয়াফত দেয়া হয়, কখনও মুরগীর মাগফেরাতের জন্য জেয়াফত হয়না। তাই আসুন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হই, তার দেওয়া অগণিত নেয়ামত ভোগ করে তাঁরই শোকরিয়া জ্ঞাপন করি। মোরগ সহ সকল সৃষ্টির প্রতি দয়ালু ও স্নেহবান হই, উত্তম ভাবে তাদের হেফাজত করি। আল্লাহ মোরগ জাতিকে সৃষ্টি না করলে মানুষ চরম অভাবগ্রস্ত হত, আর “আর মোরগ যদি অসম্ভব কামুকই না হত, তাহলে দৈনিক কোটি কোটি মোরগের চাহিদাও পূরণ হতনা”।
বিষয়: বিবিধ
৪৭৭৮ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রাতা মোরগ জিন্দাবাদ।
শুনে ছিলাম, একবার বনের পশু-পাখী সবাই মিলে গাধাকে রাজা বানাল। আর রাজা মশাই তার সেক্রেটারি হিসাবে মুরগী কে নিয়োগ দিয়াছিলেন। সরল রাজা মুরগীর ভদ্রতায় বিমোহিত হয়ে , বনের সকল প্রাণীকে মুরগীর ডিম পাড়তে বলে ছিলেন, যাতে রাজ্যে কোন বেধা-বেধ না থাকে এবং শান্তির সুবাতাস সবসময় বহমান থাকে। কিন্তু কিছু বিদ্রোহীর কারণে তিনি এই আইনটি পাশ করতে পারেননি এক পর্যায়ে নিজেই ক্ষমতা হারান।
'' হাতির মত বিরাট প্রাণীর ডিমের ব্যাস মাত্র ৩ সেন্টি হলেও মুরগীর মত নগণ্য প্রাণীর ডিমের ব্যাস কখনও ৬ সেন্টি পার হয়ে যায়! ''
০ হাতির ডিমের চেয়েও যদি বড় হয়ে থাকে তাহলে তো ঘোড়ার ডিমের চেয়ে বড় হবেই !
সৃষ্টির এই নিপুণ কারুকাজ আল্লাহ একমাত্র মানুষের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।
ধন্যবাদ
নিরিহ প্রানী মোরগ কে ক্ষেপিয়ে আবার তার জন্য ধারাল অস্ত্র তৈরি করে মজাপায় মানুষ। আবার তাকে কেটেও খায় মানুষ। সেটা কি সৃষ্টির সেরা জীব না সর্বনিকৃষ্ট জীব।
তবে চট্টগ্রামের আসিল মোরগ একটু বড় হলে তার স্বাদই আলাদা। ফার্মের ব্রয়লার খেতে খেতে এখন অনেকেই দেশি মোরগ এর গোস্ত চিবাতেই পারেনা।
অনেক ধন্যবাদ
অন্যন্যা জাতি ও দেশের কথা বলতে পারবো না। আমাদের বাংলাদেশেরর কথাই বলছি। সম্ভবত মানুষের সব চেয়ে বেশী উপকারী এবং কাজে আসে যে প্রাণীটি তা হচ্ছে মোরগ। বাল্যকালে খুব ভোরে ঘুম জেগে উঠতাম কুক কু রোক কুক ডাকে। অনেক সময় গ্রামীন অনেক রাশভারি মহিলার হাতে মোরগের তেমন লালন পালন হয়ে উঠতো না। অনেককে দেখেছি আফসোস করতে তাদের ঘরে মোরগের বংশ বিস্তার না ঘটার কারণে। এক্ষেত্রে আমার আম্মাজান যতেষ্ট ব্যতিক্রম ছিলেন। আম্মার হাতে,তত্ত্বাবধানে প্রচুর মোরগ/মোরগী হতো। বাড়ীর পাশে লাগোয়া "আড়াইল"টা সব সময় ভর্তি থাকতো মোরগ/মুরগীর কিচির মিচির আওয়াজে। তখন মেহমান অথিতি আসলে হাঠ বাজার থেকে মাছ গোস্ত আনার প্রয়োজন হতো না। আড়াইলের মুরগী এবং ডিমের বিভিন্নভাবে পরিবেশনের মাধ্যমে মেহমানদারী সেরে ফেলা হতো।
বর্তমান যুগের নারীরা অনেক আধুনিক এবং শিক্ষিত হয়ে যাওয়ার কারণে অনেকদিন থেকেই দেশীয় কুরা কপালে ঝুটে না অনেকে কাছে। আধুনিক রমনীরা মুরগী লালন পালনকে খুব অসহ্য মনে করেন বাড়ী ঘরের সৌন্দর্য নষ্ঠ হয়ে যাওয়ার আশংকায়। অনেকেই আবার অধিক পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দোহায় দিয়ে মুরগী পালনকে ঘৃণা করে থাকে। কিন্তু আর্শ্চয্যের বিষয় হচ্ছে ঘৃণাকারী মানুষগুলোর দৈনন্দিন দুবেলা ভাত মুরগীর গোস্ত ছাড়া হজম হয় না।
অনেকেই আবার অধিক পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দোহায় দিয়ে মুরগী পালনকে ঘৃণা করে থাকে। কিন্তু আর্শ্চয্যের বিষয় হচ্ছে ঘৃণাকারী মানুষগুলোর দৈনন্দিন দুবেলা ভাত মুরগীর গোস্ত ছাড়া হজম হয় না।
একেবারে শতভাগ সত্য একটি কথা উল্লেখ করেছেন। সবার গোশত খাওয়ার জন্য কাউকে না কাউকে এই দায়িত্ব পালন করতে হয়, তবে যারা খাদক তারা কিন্তু এটা থেকে অনেক দূরে। গরু-ছাগল, হাস-মুরগী পালন আমার কাছে খুব ভাল লাগে। অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন