মীলাদুন্নবী আর সীরাতুন্নবী পালন করাই রাসুলের (সাঃ) এর ভালবাসার উত্তম নমুনা!
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৩:৩৩:৫৬ দুপুর
আমরা অনেকে মীলাদুন্নবী আর সীরাতুন্নবী নবী নিয়ে ঝগড়া করি। কেউ মীরাজুন্নবী করেন কেউ হায়াতুন্নবী করার জন্য জিদ ধরেছেন। মূলত রাসুলের (সাঃ) প্রতি আন্তরিক ভালবাসা যথাযথ না হলে, উপরের সব কিছুই পণ্ডশ্রম হবে। রাসুল (সাঃ) কে কিভাবে ভালবাসতে হবে, তা দেখার জন্য লক্ষাধিক সাহাবীদের জীবন আমাদের সামনে আছে।
মীলাদুন্নবী বলি আর সীরাতুন্নবী (সাঃ) বলি, তা পালন করার জন্য অনুষ্ঠান করতে কারো বাধা থাকার কথা নয়। তবে অবশ্যই তা পালন করতে হবে, যেভাবে কোরআন হাদিসে বলা আছে সেভাবেই। অথবা সাহাবীরা যেভাবে করেছেন সে মানদণ্ডে। হাদিস কোরআনের হুবহু অনুসরণ করলেই মীলাদুন্নবীর স্বীকৃতি দান হয়।
বিতর্ক এড়াতে উদাহরণের মাধ্যমে কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করা হল:
১. রাসুল (সাঃ) এর প্রতি বাহ্যিক ভালবাসার প্রতি আন্তরিক স্বীকৃতির নাম যদি মীলাদুন্নবী হয়, তাহলে রাসুলের প্রতি ভক্তি ভালবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে সর্বাগ্রে যার না আসে সে হল, আবু লাহাব এর পর যার নাম আসে তিনি হলেন, আবু তালিব!
২. আবু লাহাবের দাসী রাসুলের (সাঃ) জন্মের খবর দেওয়া মাত্র, অতি উৎফুল্ল হয়ে আবু লাহাব দাসীকে ঘটনাস্থলেই আজাদ করে দেন। আবু লাহাবের সাথে ঐ মুহূর্তে যত অর্থ কড়ি এবং স্বর্ণ ছিল তার সবই সেই দাসীকে দান করে দেন। আবু লাহাব বন্ধুদেরকে মেহমানদারী করেন এবং নবজাতককে আদর চুম্বন করেন। রাসুলের ব্যক্তি জীবনের প্রতি আবু লাহাবের আকর্ষণ এত বেশী ছিল যে, যার কারণে রাসুল (সাঃ) এর দুই কন্যাকে আবু লাহাব নিজের পুত্র বধূ হিসেবে বরণ করে নেন। সে হিসেবে আবু লাহাব ছিলেন রাসুল (সাঃ) এর বেয়াই!
৩. আবু তালিব, রাসুল (সাঃ) কে রক্ষায় সীসার প্রাচীরের মত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রাসুলের ভালবাসায় তিন বছর বন্ধী জীবন মেনে নিয়েছেন। কাঁটা গাছের পাতা, শুকনো গাছের নরম ডাল পালা খেতে গিয়ে শরীরকে নষ্ট করে দেন। সেই ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে আবু তালিব মারা যান। আবু তালিব শিশু রাসুলের (সাঃ) পুরো দেহে চুম্বন দিয়েছেন! তিনিই ছিলেন রাসুল (সাঃ) এর স্বীকৃত অভিভাবক এবং আপন চাচা। তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কেউ রাসুলের (সাঃ) গায়ে চিমটি মারার সাহস দেখায়নি!
৪. তার পরও এরা দুজন জাহান্নামে যাবে! কারণ রাসুলের প্রতি শুধু ভালবাসা থাকলেই তাকে রাসুল প্রেমিক বলা যায়না। রাসুল প্রেমিক হতে গেলে তাঁর আদর্শকে নিজের জীবনে হুবহু বাস্তবায়ন করতে হয়। কোন ব্যক্তি রাসুলকে (সাঃ) ভালবেসে কয়টি গরু জবাই করল, কত লক্ষ সালাম পৌঁছাল, তাতে কিছুই এসে যায়না। যেভাবে আবু তালিবের ভালবাসা, রাসুলের প্রতি তার প্রতিদান, অবদান, স্নেহ, বাৎসল্য কোন কিছুই কাজে আসেনি!
৫. পিতাকে চৌকিয়ে বসিয়ে, তার সন্তানেরা চৌকির চারিদিকে ভদ্রভাবে দাঁড়িয়ে, পিতাকে সম্মান প্রদর্শনার্থে যদি সুর করে বলতে থাকে:
বাবা তোমায় লাখো সালাম,
বাবা তুমি অনেক মহান,
বাবা তুমি চরম দয়াবান,
বাবা তুমি বেঁচে থাক চিরকাল...........
বাবার জীবনের প্রতি মূল্যায়ন না দিয়ে, তার পছন্দের প্রতি সম্মান না দিয়ে, তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, আকাঙ্ক্ষাকে কদর না করে সন্তানেরা যদি বাবাকে এই ধরনের সম্মান দেয়! তাহলে তাদের বাবা এ ধরনের সম্মান প্রাপ্তিতে কি খুশীতে গদগদ হবেন? নিশ্চয়ই খুশী হবেনা না! অধিকন্তু বেয়াদবীও মনে করতে পারেন। এই জাতীয় সম্মান যদি নিজের বাপের ক্ষেত্রে অমর্যাদাকর হয়, তাহলে কেন আমরা রাসুল (সাঃ) কে সম্মান প্রদর্শনের নামে, সূর করে সালাম পাঠাই? এটা কি অমর্যাদাকর নয়?
৬. বালাগাল উলা বি-কামালিহী, কাশাফাদ্ দুজা বি-জামালিহী......... এটা মহান কবি শেখ সাদি (রহঃ) এর একটি কবিতার চরণ। সেভাবে ছালাতুন ইয়া রাসুলুল্লাহ আলাইকুম, ছালামুন ইয়া হাবিব উল্লাহ আলাইকুম ও একটি কবিতার চরণ! একই ভাবে 'তালায়াল বাদরু আলাইনা' একটি সংগীত। 'তুমি যে নূরের রবী, নিখিলের ধ্যানের ছবি' কবি গোলাম মোস্তফা রচিত করিতার চরণ।
'তালায়াল বাদরু আলাইনা' সংগীত টি ছাড়া বাকী সব সঙ্গীত গুলোর জন্ম হয়েছে রাসুলের ইন্তেকালের শত শত বছর পরে। এসব কবিতার কথা সাহাবী, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন কেউ জানতেন না! কেননা তাঁদের জীবদ্দশায় এসব সৃষ্টি হয়নি! তাহলে কেন আমরা এসব কবিতাকে রাসুলের (সাঃ) প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য, অন্যতম নমুনা হিসেবে বাছাই করছি! কেন আমরা গোঁ ধরছি, একে অপরকে আহত করছি এই বলে যে, এসব করা না হলে সে মুসলমান থাকবে না এবং রাসুলের প্রতি যথাযত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবেনা?
৭. রাসুল (সাঃ) প্রতি আনুগত্যের একটি উদাহরণ: একদা রাসুল (সাঃ) জুতা পায়ে অবস্থায় নামাজে জামায়াতের ইমামতি করছিলেন। নামাজের মাঝখানে তিনি জুতো জোড়া খুলে নামাজ অব্যাহত রাখলেন। সাহাবীরা (রাঃ) এটা দেখে তাঁরাও তাদের জুতো খুলে রাখলেন। নামাজ শেষে রাসুল প্রশ্ন করলেন, কেন তোমরা জুতো খুলে রেখেছ? সাহাবীরা (রাঃ) জানাল, আপনাকে খুলতে দেখেই আমরাও খুলেছি। রাসুল (সাঃ) হেঁসে উত্তর দিলেন, 'আমি নামাজ রত অবস্থায় জিব্রাঈল (আঃ) এসে বলল, আপনার জুতোর নীচে নাপাকী লাগানো আছে, তাই জুতো খুলেছি'। এখানে লক্ষণীয় হল, কোন প্রশ্ন ও চিন্তা ব্যতিরেকে সাহাবীরা (রাঃ) অন্ধের মত রাসুলের আনুগত্য করত। এখন দেখতে হবে সাহাবীদের মত আমরা এভাবে রাসুলের আনুগত্য করি কিনা, করলে কতটুকু করি।
৮. রাসুল (সাঃ) প্রতি ভালবাসার উদাহরণ: ওয়ায়েজ ক্বরনী (রহঃ) সদূর ইয়েমেনে বসে, লোকমুখে শুনেছেন যুদ্ধে (ওহুদ যুদ্ধে) রাসুলের (সাঃ) দাঁত পড়ে গেছে! ওয়ায়েজ ক্বরনী চিন্তা করলেন, যদি রাসুলের দাঁত না থাকে, তাহলে তাঁর দাঁত থাকার মাঝে কি গুরুত্ব বহন করে? তিনি পাথর দিয়ে নিজের মুখে আঘাত করে, একটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলেন! পরমুহূর্তে মনে পড়ল, রাসুলের (সাঃ) এর কোন দাঁতটি ভেঙ্গেছে তিনিতো জানেন না। তাই পাথরের আঘাতের পর আঘাতে তাঁর প্রতিটি দাঁতই তিনি ভেঙ্গে ফেলেছেন? আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ওয়ায়েজ ক্বরনীর মত আমাদের দাঁত ভাঙ্গতে বলেন নি। তিনি আবদার করেছেন, 'আমাকে ভালবাসলে আমার পছন্দকে তোমার পছন্দ করে নাও, আমার শত্রুকে তোমার শত্রু জ্ঞান করো, আমার বন্ধুকে তোমার বন্ধু বানিয়ে নাও আর সকল অবস্থায় আমার নির্দেশনাকে নির্ভুল ও সঠিক বলে মেনে নাও'। উপরের মানদণ্ডে রাসুলের ভালবাসায় আমরা কতটুকু এগিয়ে আছি। কেয়ামতের দিন যদি রাসুল (সাঃ) প্রমাণ হিসেবে আমাদের জীবন থেকে একটি উদাহরণ আশা করেন, তাহলে কয়টি দেখাতে পারব?
৯. নেতাকে অনুসরণের একটি দুনিয়াবী উদাহরণ: সুন্নাত অর্থ হল রাস্তা, পথ, আদর্শ, মডেল ইত্যাদি। রাসুলের সুন্নাত অর্থ হল রাসুলের মডেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীও কারো জন্য আদর্শ মডেল! আওয়ামীলীগে নেতার প্রতি ভালবাসা ও আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য প্রচুর অনুসারী আছে। শেখ মুজিবের অনুসারীরা তাঁর মত কোট পড়ে। তাঁর মত করে চুল আঁচড়ায়। অবিকল তার চশমার মত একটি চশমা জোগাড় করে। মোঁচ থাকলে সেভাবে তাঁর মত রাখতে চেষ্টা করে। নেতারা বক্তব্য রাখার সময় শেখ মুজিবের মত করে কথা বলতে চেষ্টা করে। অন্তরে মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধা, বাহিরে মুজিবের অবয়ব ধারণ। মুজিবের প্রতি অবহেলা, কারো অসদাচরণে তারা নিজের মত করেই, শতভাগ দায়িত্ব নিয়েই প্রতিবাদ করে। একজন মুজিব সেনা হিসেবে গৌরব করা, মুজিবের সার্থক অনুসারী হিসেবে বীরত্ব প্রকাশ করার মাধ্যমে প্রমাণ করে তারা শেখ মুজিবের সার্থক অনুসারী! আর এই ধরনের কর্মীদের কে আরবিতে পরিচিতি করতে গেলে বলতে হবে, 'তারা মুজিবের সুন্নাতের অনুসারী'। সুন্নাত অনুসরনের উদাহরণ দেবার জন্য বাংলাদেশে এরে চেয়ে সেরা কোন উদারহণ নাই।
উপসংহার: মহিলার কানে দুল থাকলে বলা হয় 'বিবি হাজেরার মডেল'। পুরুষের কানে দুল থাকলে বলা হয় 'ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মডেল'। পুরুষের হাতে চুড়ি কিংবা ফিতা থাকলে বলা হয়, 'হিন্দুদের রাখী বন্দনের মডেল'। মুখে দাড়ি, মাথায় পাগড়ী থাকলে বলা হল রাসুলের (সাঃ) মডেল! এসব মডেল কে আরবী ভাষায় সুন্নাত বলা যেতে পারে। মানুষের প্রতিটি কাজ, তার চিন্তা, চেতনা, অভিলাষ, আহ্লাদ সব কিছুই কোন না কোন সুন্নাত কে ঘিরেই গড়ে উঠে। কেয়ামতের দিন এসব সুন্নাতকে বিরাট ভাবে মূল্যায়ন করা হবে। প্রতিটি ব্যক্তির সুন্নাতই তার দুনিয়াবী জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা দিবে।
তাই আসুন, আমরা রাসুলকে অনুসরণ ও ভালবাসার নমুনা পেশ করার জন্য অবিকল রাসুলের মত রূপ ধারণ করি। তবেই তাঁর প্রতি ভালবাসার দাবী সত্য বলে প্রতিষ্ঠা হবে। রাসুলকে খুব ভালবাসি এটা মুখে না বলে, দাঁড়িয়ে সুর করে সালামের মাধ্যমে প্রকাশ না করে বাস্তব জীবনে হুবহু পালন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করি। তবেই মীলাদুন্নবীর দাবী সার্থক হবে, নতুবা নয়।
বিষয়: বিবিধ
৭০৮৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যে পোস্ট স্টিকি হবার মত ছিল সেটা কি না ১৫ মাসেও কোন কমেন্ট পায় নাই ?!?!
রাসূল (সাঃ) তার মৃত্যুর পর তার কবরকে মূর্তি বানাতে নিষেধ করেছিলেন ।
রাসূলের প্রতি সাহাবাদের যে দরদ ছিল তার চেয়ে কি যারা রাসূলকে দেখেনি তাদের দরদ বেশী ?
বর্ণনার সাবলীলতা উপস্হাপিত বিষয়ে পুর্ণ উপলব্ধির আবহ সৃষ্টি করেছে!
অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইরান হে শ্রদ্ধেয়!
মন-মননে পুর্ণ ভালবাসা রেখে বাস্তব কর্মে তা ফুটিয়ে তোলাই প্রকৃত ভালবাসা!
শুধুই আনুষ্ঠানিক ভালবাসার কোনই মুল্য নেই!
মন্তব্য করতে লগইন করুন