জ্বিনের ফাজলামী বন্ধে সুন্দর শাহের সিলায় গমন! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-৩ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ২৬ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:৫৩:৫৭ দুপুর
ভোটা মামা ও শাহ সাহেবের দরগাহে মা কয়েকবার মানত করে ব্যর্থ হয়েছেন। ভোটা মামা পাগল ছিলেন, অর্ধ উলঙ্গ থাকতেন, খাদ্যের অভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির গাছের পাকা ফলে হাত দিতেন। ফলে তিনি বহুবার নির্যাতিত হয়েছেন। লোকমুখে শোনা যায় যারা তাঁকে নির্যাতন করেছে, তারা সবাই পরবর্তী কালে নির্যাতনের প্রায়-চিত্ত হিসেবে মৃত্যু পর্যন্ত নানাবিধ কষ্ট পেয়েছেন। ভোটা মামা জীবদ্দশায় অন্ন বস্ত্রের অভাবে কষ্ট পেলেও, মৃত্যুর পরে সেখানকার কিছু মানুষের অন্ন বস্ত্রের অভাব মিঠে যায়। তাঁর মাজার পাকা হল, কবরে গিলাফ লাগানো হল, প্রতি বছর মহা ধুমধামে ওরস উদযাপিত হতে লাগল! মানুষ নিজের মনস্কামনা পূরণের লক্ষ্যে পুরো বছর অবিরত মানতের উপহার সামগ্রী নিয়ে আসে, এতে অনেকের কপাল খুলে যায়! পাশের গ্রামের পীর, শাহ সাহেব মারা গেলে পর, তাঁকেও ভোটা মামার পাশেই কবরস্থ করা হয়। এতে তাঁর জীবিত সন্তানেরা বেকার হয়ে পড়ে এবং দুনিয়াবি ফায়দা তুলতে ব্যর্থ হন। তাঁরা বলা শুরু করলেন যে, কবরের ভিতরে শাহ সাহেব ও ভোটা মামা সর্বদা তর্ক বিতর্ক করতে থাকেন, এতে অন্যদের সেখানে অবস্থান করা দুষ্কর হচ্ছে। তাই শাহ সাহেব তাঁর সন্তানদের স্বপ্নের মাধ্যমে বলেছেন, তাঁর লাশ যেন সেখান থেকে তুলে বাড়ীর সন্নিকটস্থ, রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে দাফন করা হয়! দুই মৃত পীরের বিতর্ক দূর করতে, শাহ সাহেবের সন্তানেরা এগিয়ে আসেন। লাশ দাফনের ৪০ তম দিনে মহা আয়োজনের মাধ্যমে শাহ সাহেবের লাশ উত্তোলন পূর্বক একটি জনবহুল স্থানের পাশে পুনরায় জানাজা নামাজের মাধ্যমে দাফন হয়! ফলে এলাকায় দুটি বাবার মাজার সৃষ্টির ফলে, মানুষের মানত পূরণের সুবিধা বৃদ্ধি পেল! এলাকার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই নিজেদের মানত পূরণ ও কলানার্থে দলে দলে দুটি দরগাহে বিভিন্ন সামগ্রী ও খাদ্য বস্তু নজরানা পেশ করতে লাগল। লোকমুখে জানা গেল এই দুই বাবার দরগাহে মানত দেবার পরে কেউ খালি হাতে ফিরে গেছে, এমন নজীর কোথাও নাই! দুর্ভাগ্য আমার স্নেহময়ী মায়ের! তাঁকে এই প্রসিদ্ধ দুটি দরবার থেকেও খালি হাতে ফেরৎ যেতে হয়েছে! তিনি আক্ষেপ করলেন, আমার মত এমন এক হতচ্ছাড়া ছেলের তিনি মা হয়েছেন, যার প্রতি মৃত দরবেশের পর্যন্ত সামান্য অনুকম্পা হয়না! গোস্বা করে বললেন, তোমার জীবন, জ্বিনের অনুকম্পাতেই শেষ হবে। যাক, কম অর্থকড়ি ব্যয়ে ছেলেকে জ্বিনের খপ্পর থেকে বাঁচানোর জন্য আরেকটি রাস্তা বাকি থাকল! সেটা হল সুন্দর শাহের সিলায় মানত, সেটাও করতে তিনি বদ্ধপরিকর হলেন।
সবার পরামর্শে মা আমাকে সুন্দর সাহেবের সিলায় নিয়ে গেলেন! যেখানে গেলে সমুদয় জ্বিন ভূত উদাও হয়ে যায়। সেখানকার নিয়ম হল কোন কিছু মানত করে, সিলায় যেতে হবে; নিজেদের জবাই করা প্রাণী নিজেরা খাবে এবং অন্যদেরকেও খাওয়াতে হবে, তাহলেই মানতও পূরণ হয়ে যায়। একদা মা, খালা, চাচী, জেঠি মিলে, এক ছোট খাট তীর্থ দল আমাকে নিয়ে, সুন্দর শাহের সিলায় হাজির হল। হালদা নদীর বাঁকের এক তীরে নেপচুন চা বাগান অন্য তীরে সুন্দর শাহের সিলা অবস্থিত। সিলার সামনে দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম যাবার অতীব সুন্দর কাঁচা রাস্তা আছে। দারুণ মনোমুগ্ধকর স্বাস্থ্যকর স্থান! গরম কালেও গরম থাকেনা, শীত কালেও আবহাওয়া সুখকর। পিকনিকের জন্য অতীব উৎকৃষ্ট স্থান হবে। হালদা নদীর উজান-ভাটিতে প্রায় ৬০ কিলোমিটার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে, তবে এত সুন্দর স্থান দ্বিতীয়টি দেখিনি। সুন্দর শাহ! বুঝা গেল তিনি সুন্দর আকৃতির মানুষ ছিলেন এবং স্থান নির্বাচনেও সুন্দর রুচি-বোধের পরিচয় দিয়েছেন কিন্তু তাঁর পবিত্র নামের শেষে ‘সিলা’ কথাটার অর্থ বুঝলাম না! মনে কৌতূহল বোধ করে মুরুব্বীদের প্রশ্ন করলাম, ‘সিলা’ কি জিনিষ? বিস্তারিত জানতে গিয়ে শুরুতেই জ্যাঠাই মায়ের ধমক খেলাম! তিনি সোজা বলে দিলেন এখানে আজে বাজে প্রশ্ন করা যাবেনা! চোখ আছে দেখবে, আর কান আছে শুনবে, মুরুব্বীরা যা বলে সেটা হুবহু মেনে চলবে। কোথায় কিভাবে চলতে হবে, কি বলতে হবে সবকিছু তোমাকে যথাসময়ে বলা হবে। তিনি আরো হুশিয়ার করলেন যে, তোমার অতিরিক্ত কৌতূহলের কারণে আজকে পরিবারটির যায় যায় দশা। জেঠাইমা আমার অতি প্রিয় ব্যক্তিদের একজন, তাঁর এমন কঠোর রুদ্র-মূর্তি আগে কোনদিন দেখিনি। তাই বোবার মত অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
সিলার একটা নিয়ম-রীতি আছে, কোন অনিয়ম কিংবা রীতি প্রথায় ভুল করলে প্রথম বার যত হাঁস-মুরগী জবাই হয়েছে দ্বিতীয় বার তার দ্বিগুণ দিতে হবে, তৃতীয়বার ত্রিগুণ না হয়ে ছাগল দিতে হবে অতঃপর চতুর্থ বারে গরু দিয়ে চরম খেসারত দিতে হবে। এভাবে মানত পুরো না হওয়া পর্যন্ত, রীতির ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে কিছু বোধগম্য না হলে, খাদেম সাহেব থেকে জেনে নিতে বলা হয়েছে। আমাকে স্মরণ করানো হল, মানত পূরণ করতে গিয়ে যদি রীতি-নীতির বিরুদ্ধে কিছু করে বসি, তাহলে মানত তো পুরা হবেই না অগত্যা মানতের জরিমানা গুনতে হবে। আমাকে তখনও কোন রীতিনীতি শিক্ষা দেওয়া হয়নি। খোলা যায়গায় পরিত্যক্ত লেবু গাছ থেকে লেবু পারতে গিয়ে মুরুব্বীদের কঠোর শাসনের মুখোমুখি হলাম! তাঁরা শেষবারের মত সাবধান করে দিলেন এসব কাজ করা চলবেনা। সিলার অল্পভাষী খাদেম মুচকি হেঁসে ঘোষণা বললেন, আমার অপরাধ এখনও মানত ভঙ্গের পর্যায়ে যায়নি, তবে সাবধান না এই ছেলের হাতে মানত ভাঙ্গতেও বা কতক্ষণ! খাদেমের হাতে হাঁস-মুরগী জবাই হল, জঙ্গল থেকে লাকড়ি সংগ্রহ পূর্বক রান্নাও হয়ে গেল। খাদেম ফাতেহা দিলেন, তাঁকে বখশিশ প্রদান পূর্বক, আমাদের রান্না করা খাবার আমাদেরকে খাবার অনুমতি দিলেন! খাদ্য পর্ব শেষ হবার পরেই সিলার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল! তখনই বুঝতে পারলাম এখনও আসল জায়গায় যাওয়া হয়নি। হালদা নদীর ধার ঘেঁষে খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল, সেটার একস্থানে প্রায় ৩০ ফুট উপরে একটি গুহা! সেখানে উঠার জন্য মাটি কেটে অমসৃণ ও হালকা পিচ্ছিল সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটাই সুন্দর শাহের সিলা! একদা এই গুহার ভিতর দিয়েই, পাহাড়ের পেট ছিঁড়ে, সুন্দর শাহ ১০ মাইল দূরের আরেকটি গুহামুখ দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে ছিলেন! প্রশ্ন করলাম, সুন্দর শাহ কেন পালিয়েছিলেন? কে তাঁকে দৌঁড়াল? কথা শেষ হবার আগেই মায়ের কান মলা সহ চপেটাঘাত খেলাম! পুনরায় মনে করিয়ে দেয়া হল কোন কৌতূহল নয়, কোন প্রশ্ন নয়, নতুবা পুরো যাত্রাই বরবাদ হবে।
পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে সোজা উপরে উঠে গুহায় ঢুকতে হবে; বের হবার সময় পিছনে না তাকিয়ে উল্টো হেঁটে ধাপে ধাপে নীচে নামতে হবে। ভয় পাওয়া যাবেনা, চিৎকার করা যাবেনা। গুহার উচ্চতা খুবই কম তাই মাথায় আঘাত খাওয়া যাবেনা, সন্তর্পণে এক জোড়া মোমবাতি ও এক জোড়া আগর বাতি জ্বালিয়ে, গুহার একটু মাটি জিহ্বায় লাগিয়ে, পিছনের দিকে না তাকিয়ে উল্টো নামতে পারলেই কর্ম সাবাড়! যত বিপদ আসুক, কোন অবস্থাতেই গুহা মুখকে পিছন দেওয়া যাবেনা। ছহি সালামতে আমাকে কিভাবে উঠতে হবে ও নামতে হবে, তা যেন সুচারুরূপে সম্পন্ন হতে পারি, সে লক্ষ্যে দুলাভাই আমাকে ঘটনাস্থলেই বাস্তব প্রশিক্ষণ দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন! তিনি প্রশিক্ষণের নিমিত্তে খুবই আদবের সহিত অতি সন্তর্পণে চার কদম পর্যন্ত উঠলেন! পঞ্চম ধাপে কদম রাখতে যাবেন, তখনই তিনি টাল হারিয়ে ফেললেন! নিজেকে কোনভাবেই সামাল দিতে পারলেন না, টাল-মাটাল অবস্থায় এমন ভাবে পলট খেলেন, সোজা গিয়ে হালদা নদীর পানিতে! বুবু স্বামীর এই অধঃপতনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন! তিনি বলতে থাকলেন, তুমি এত বড় মানুষ! চাচী মায়ের জ্বিন তাড়ানোর পুরো ব্যবস্থাটিকেই শেষ করে দিলে! কি কাণ্ড-জ্ঞান হীন মানুষ তুমি! তরতর করে সুপারি গাছ বাইতে পার আর এখানে পাঁচটি সিঁড়ি উঠতে পারলে না! এতগুলো শাশুড়ির সামনে মাত্র পাঁচ হাত উপর থেকে হাস্যকর অধঃপতনে দুলাভাইয়ের মুখ থেকে কোন কথা বের হল না। বেচারা বেজায় শরমিন্দা হয়ে ঘোষণা দিলেন, বাকী জীবনে আর কাউকে তিনি কিছু শেখাতে যাবেন না। বুবু বললেন, তাই ভাল, অযোগ্য হিসেবে প্রমাণিত হবার চেয়ে, যোগ্যতার বাহাদুরি না দেখানোই উত্তম। নাহ্! দুলা ভাইয়ের এই পতনে তেমন কোন সমস্যা হয় নাই, কেননা তিনি তো আর মানত করেন নি! মানত করেছেন আমার মা আর পরীক্ষা দিতে হবে আমাকেই! যাক, ঠিক ঠাক মত সবাই উপরে উঠে গেলাম। বহু কষ্টে মুখে ক্লিপ মেরেছি, গুহা সম্পর্কিত অনেক প্রশ্ন জমে ইতিমধ্যেই পেট টই-টম্বুর হয়ে আছে, শুধু পটাশ করে ফাটার বাকি!
পুরো গুহা অন্ধকার, দিয়াশলাই জ্বালানো শুরু হয়েছে, যে যার মত করে মোমবাতি-আগরবাতিতে আগুন লাগাচ্ছে। আর সেই মুহূর্তে দেখলাম মাথার উপরে কি যেন ধুপধাপ করছে। একজন বলল বাদুর, হয়ত ভয় পেয়েছে। আমি উপরে তাকাতেই দেখি কয়েকটা বাদুর গুহার ছাদে লটকে আছে। নিজের অজান্তে মুহূর্তেই মুখের ক্লিপ ভেঙ্গে গেল। বাদুর! বাদুর! বলে চিৎকার করে উঠলাম। বাদুর দল ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে চিল্লানো শুরু করল; আতঙ্কিত বাদুরের কয়েকটি উড়ন্ত অবস্থায় সবার গায়ে তরল কিছু ঢেলে দিয়ে পালিয়ে গেল! উষ্ণ, আঠালো, ঝাঁঝালো তরলের স্পর্শে সবাই নিজেদের অপবিত্র মনে করল। কেউ নাক ধরল, কেউ মুখে হাত দিল। এক চরম হট্টগোল বেধে গেল! যথানিয়মে কারো কার্য সম্পাদন সম্ভব হল না, ফলে পুরো মিশনটিই বরবাদ হয়ে গেল। মা, চাচী, জেঠি সবাই আমাকে বকাবকি করতে থাকলেন। আফসোস করলেন, এক অকর্মা দল নিয়ে এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে। আমাকে লক্ষ্য করে বকাবকির পরিবেশ বেশ ভারী হয়ে উঠল, এক পর্যায়ে তা উপদেশের পরিবেশে রূপান্তরিত হল। আমার চেয়ে কম বয়সী, আমাদের ঘরের চাকরানী টি পর্যন্ত আমাকে উপদেশ খয়রাতের সুযোগ হাতছাড়া করল না। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল, ভুল তো একটা করেছি, তাই বহু কষ্টে নিজের ঠোট দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে পরিবেশ ঠিক রাখলাম! নিজে নিজে চিন্তা করলাম, পৃথিবীতে মনে হয় শুধুমাত্র একা আমিই দোষ করি, অন্যরা যেন কোন দোষ-ত্রুটি করতেই জানে না! যেহেতু মানত ভঙ্গ হয়ে গিয়েছে সেহেতু সামনের বারে দ্বিগুণ জরিমানা নিয়ে আবারো সিলায় আসতে হবে, তাই এভাবেই সুন্দর শাহের সিলা দর্শনের প্রথম দফা শেষ হল।
পরের বারে সিলায় মানত পালন যথাযথ হয়েছিল। কেননা ইতি পূর্বেকার ভুলে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কয়েকদিন ধরে সবাই আমাকে অনুশীলনে সহযোগিতা করেছেন। তারপরও একটি ছোট্ট ভুল আমি করেছিলাম, যার কারণে মায়ের সন্দেহ ছিল এই ছোট্ট ভুলের অজুহাতে জ্বিন আমার পিছু ছাড়বে না। সিলায় গিয়ে দেখলাম কিছু দিনের ব্যবধানে সেখানে নিয়মের কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। যে লেবু গাছ থেকে লেবু ছিঁড়ে অন্যায় করেছিলাম, সে স্থানটি পরিপূর্ণ ফাঁকা! গাছগুলো কেটে সেখানে একটি পাকা ঘর উঠেছে। ঘরের মাঝখানে এক কোমর পরিমাণ উঁচু কবর আকৃতির রঙ্গিন স্তম্ভ বানানো হয়েছে। খাদেমের ছেলেকে স্তম্ভের উপর বসে পাতার বাঁশি নিয়ে খেলতে দেখলাম। আমিও যুক্ত হলাম তার সাথে। প্রত্যুষে সিলায় নতুন একটি দলের আগমনে খাদেম খুশী হয়ে দৌড়ে সেই ঘরে ঢুকে গেলেন। আমার সামনে ছেলেকে স্তম্ভের উপরে বসা দেখে, বকাবকি করে স্তম্ভ থেকে নামিয়ে দিলেন এবং নতুন আগন্তুকেরা দেখে মত করে খুবই ভদ্রতা ও ইজ্জতের সহিত দুই জোড়া মোমবাতি ও আগরবাতি ধরিয়ে দিলেন। তড়িঘড়ি করে খাদেমের বউ, লম্বা ঘোমটা টেনে একই কাজ করলেন! এ দৃশ্য দেখে আমার চাচি-মা তাঁর ভাণ্ড থেকে সেখানে এক জোড়া মোমবাতি নজরানা পেশ করলেন! অদূরে আরেকটি ঘর উঠার কাজ চলছে, তবে সে ঘরের মাঝখানে আরেকটি কবরের আলামত দেখা যাচ্ছে। সেটাকে দৃশ্যমান করতে চিকন রশিতে রঙ্গিন কাগজ পেঁচিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আমাদের গ্রাম্য এক চাচা জিনিষটা কি, প্রশ্ন করতে গিয়ে তিন জন থেকে তিন ধরনের উত্তর পেলেন। তিনি আমার মায়ের কাছে ব্যাপারটি পরিষ্কার করতে গিয়ে, নিজের অভিজ্ঞতা ও আগে প্রাপ্ত তিন প্রকার তথ্য মিলিয়ে চতুর্থ প্রকার আরেকটি উত্তর খাড়া করে তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন! মা তাড়াতাড়ি দুই জোড়া মোম বাতি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন!
যাক, যথারীতি শিন্নী বণ্টন, হাস-মুরগী জবাই, ফাতেহা ও খাওয়া পর্ব শেষে সিলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সিলার গুহাতে যখন ঢুকতে যাই, তখন গুহায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাতি জ্বালানোর পরে দেখি, চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার, মোম আর আগর বাতির গন্ধে পুরো গুহায় এক প্রকার আবেগী পরিবেশ বিরাজ করছিল। আমার মনে তখনও হালকা ভীতি-যুক্ত কৌতূহল কাজ করছিল, আমার লক্ষ্য যতটুকু পারা যায় গুহার শেষ পর্যন্ত দেখা! যে সুরঙ্গ দিয়ে সুন্দর শাহ পালিয়ে যেতে পারল, সে সুরঙ্গ দিয়ে আমার পক্ষেও অনায়াসে যাওয়া সম্ভব হবে! যত ভিতরে যাই দম বন্ধ হবার উপক্রম। আলো-বাতাস নাই, শ্বাস নেওয়া কষ্টকর, ভ্যাপসা গরম, ঘামে একাকার, বিদঘুটে ধরনের দুর্গন্ধ! হয়ত বাদুরের উচ্ছিষ্টের গন্ধ হবে! হামাগুড়ি দিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম, বাম হাতের চাপে কিছু একটা যেন গলে গেল! দুর্গন্ধটা বাড়তে থাকল! অনুভব করালাম হাত বেয়ে কিছু যেন উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। লেদা পোকার মত কিছু পেঁচিয়ে উঠার মত অনুভূতি! ভাবলাম মরা ইঁদুর কিংবা মরা বাদুরের পচা লাশ হতে পারে! আগেও অন্যত্র প্রায় একই ধরনের আরেকটি ঘটনার অভিজ্ঞতা ছিল। ঘেন্নায় পুরো শরীর রি রি করে উঠল, মুহূর্তেই হ্যাঁচকা টান মেরে হাত ঝেড়ে নিলাম। ডান হাত দিয়ে পকেটে লুকানো ক্ষুদ্র টর্চ লাইট বের করে বাটনে চাপ মারলাম। ঠিকই তো! মরা ইঁদুর! হাতের এক চাপে পুরো লাশটি একবারে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে! চারিদিকে পোকা কিলবিল করছে।
মনে হলো পুরো সব নাড়ি ভুঁড়ি এখুনি বের হয়ে আসবে। মুহূর্তেই পিছনে আসলাম, বহু কষ্টে জিহ্বা আয়ত্তে রাখলাম। চিৎকার দিলাম না, জানি আমার একটি মাত্র চিৎকারে আবার নতুন করে ইতিহাস রচিত হবে। কষ্ট হলেও টর্চ লাইটের আলো সামনে নিক্ষেপ করলাম, পুরো গুহার শেষ পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মনের অজান্তে বললাম, ঐ ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে সুন্দর শাহ কিভাবে পালিয়ে গেলেন! যেখান দিয়ে এই ইঁদুরটি পর্যন্ত পালাতে পারেনি! গতবারে বাদুরের মল-মূত্রে সবার পুরো শরীর আঠালো ও পুতি-গন্ধময় হয়েছিল, আজও বাদুরের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। তাই সবাই যার যার মত করে আনুষ্ঠানিক সওয়াবের কাজ সেরে বের হয়ে গেলেন। আমিই সবার পিছনের রয়ে গেলাম, আমার পিছনেই মা। শেষ ব্যক্তি হিসেবে আমি আস্তে আস্তে গুহা থেকে বের হয়ে গেলাম। সবার চেহারা দেখে বুঝা গেল আমার উঠা নামা সহ সকল কিছু যথাযথ হয়েছে। আমি ভয় পাইনি, চিৎকার করিনি বলে প্রশংসা শুনলাম। অধিকন্তু গুহার অভ্যন্তরে আমার সামনে হালকা উজ্জ্বল কুদরতি আলো দেখতে পেয়েছিলেন বলে, অনেকে বলাবলি করতে থাকল। এসব প্রশংসা শুনে আমি খুশিতে গদগদ হয়ে মুখ ফসকে বলে বসি, এই গুহা কি আগে থেকেই ছিল? যার ছিদ্র দিয়ে সুন্দর শাহ পালিয়েছে! নাকি সুন্দর শাহ নিজের হাতে গুহা বানিয়ে, সেটার ছিদ্র দিয়ে প্রাণ ভয়ে পালিয়েছিল? মুহূর্তেই পুরো পরিবেশ আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক হয়ে গেল! মায়ের কান মলা, অন্যদের হা-হুতাশের মাধ্যমে পরিবেশটাই বিদঘুটে হয়ে গেল। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে, সুন্দর শাহের সিলার মুখে দাঁড়িয়ে, তাচ্ছিল্য বাক্য, সুন্দর শাহ সম্পর্কে এভাবে অসুন্দর, আপত্তিকর মন্তব্যে সবাই বিরক্ত হয়ে গেল। সবাই বলাবলি করতে লাগল এই ছেলেকে জ্বিন মুক্ত করতে আরো শক্ত চিকিৎসা দরকার। মায়ের মুখে আসমানের কালো মেঘে ছেয়ে গেল, পরিতাপ বেড়ে গেল, তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন, বাবাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ‘হাঁট’ বসিয়েই অপঃ জ্বিনকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে। চলবে............
আগের পর্ব: জ্বিনের খপ্পরেই সব গুন গোল্লায় গেল! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-২ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)
প্রথম পর্ব শুরু: এক পিকুলিয়ার মানুষ! (রোমাঞ্চকার কাহিনী- ভূমিকা পর্ব)
বিষয়: বিবিধ
৩০০২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন