জ্বিনের খপ্পরেই সব গুন গোল্লায় গেল! (ধারাবাহিক)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ১২ আগস্ট, ২০১৩, ০২:০২:১৬ দুপুর
আস্তে আস্তে আমার তাবিজ গত নানা গুঞ্জরন থিতিয়ে আসল। বন্ধুরা কৌতূহলে দুই একটি প্রশ্ন করলেও আমার সাদামাটা উত্তরে তাদের আগ্রহ কমে গেল। তারপরও আমার ভাবুক প্রকৃতির স্বভাবটাকে অনেকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখত। গ্রামের সকল মানুষ আমাকে এমনিতেই পছন্দ করত। ভাল শিষ্টাচার পাইয়ে দিতে আমার মায়ের দিন রাত প্রচেষ্টা থাকত। তিনি আমার দৈনন্দিন ভুলগুলো নজরে রাখতেন, রাত্রে শোয়ার সময় আদর করে একাকী আলোচনা করতেন এবং আমার ভুলগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে, আগামীকাল থেকে এসব ভুল না করানোর জন্য ওয়াদা নিতেন। মাকে খুব ভালবাসতাম বলে, তাঁর ওয়াদার কথা আমার মনে থাকা পর্যন্ত সেই ভুলটি দ্বিতীয়বার করতাম না। হাই স্কুলে উঠেই মসজিদে এতেকাফে যাওয়ার অভ্যাস করি। এসব কারণে মুরুব্বীরা আমাকে খুবই পছন্দ করত। আমাদের বাড়ীর সামনেই স্কুল, মসজিদ, বড় পুকুর ও কবরস্থান। মনের ভিতরে যথেষ্ট সাহস রাখতাম! গ্রামের কোন মানুষ মারা গেলে অন্ধকার রাত্রে কবরস্থানের আশে পাশে ঘুরঘুর করতাম। এই প্রত্যাশায়, যদি দৈবাৎ কোন জ্বিনের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে যায়! জ্বিনের ভয় হতনা! কেননা হুজুরের বাণীতে শতভাগ নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, সুরা ফাতেহা, ইখলাস, ফালাক, নাস পড়ে শরীরে ফুঁ-দিলে সাপ-কুকুরে কামড়াতে পারে বটে জ্বিনের বাপের ও সাধ্য নাই কাউকে স্পর্শ করা!
লক্ষ্য করতাম! বাজার ফেরৎ একাকী পথচারী গভীর রাত্রে কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাবার সময় কলিজার ভয় দুর করতে ভাটিয়ালী কিংবা পল্লী-গীতির টান মারতেন! নিস্তব্ধ রজনীতে গ্রামের মানুষ বিনা পয়সায় তাদের বেসুরো গলায় সুরেলা গান আনন্দ চিত্তে উপভোগ করতেন। কদাচিৎ কেউ চলমান গানের মাঝে হঠাৎ করে ছন্দপতন ঘটিয়ে চিৎকার করে বলতেন ‘ওরে বাবারে, ভূত’! গ্রামের মানুষ পথিকের সাহাযার্থে হারিকেন বাতি, চেরাগ নিয়ে দৌড়ে যেতেন। তবে সেসব সাহায্যকারীদের মাঝে সর্বদা আমিই অগ্রগণ্য থাকতাম। বলা বাহুল্য, অন্ধকার রাত্রে জ্বিনের সন্ধানে কবরস্থানে ঘুর ঘুর করা অবস্থায়, পথিক আবছা আবছা আমার অবয়ব দেখে, আমাকেই জ্বিন-ভূত ভেবে চিৎকার করে উঠতেন! টর্চ লাইট তখনও সবার জন্য সহজলভ্য ছিলনা, ফলে মানুষকে অন্ধকারেই আসা যাওয়া করতে হত। অভিজ্ঞতায় দেখেছি নিকষ কালো ঘন অন্ধকারে বের হওয়া মাত্র, নিজের হাত খানা এক বিঘত নিকটে আনলেও কেউ তা ভালভাবে দেখতে পায় না। তবে ঘন অন্ধকারে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে আকাশের তারার আলোর মাধ্যমে রাস্তা কিছুটা পরিষ্কার দেখা যায়। এটাই ভূত দেখার উপযোগী পরিবেশ! অমাবস্যার আকাশে মেঘ থাকলে ভূত দেখা দূরে থাক, পথ দেখাও দুষ্কর হয়। একদা এমনি এক রাত্রে, হাট থেকে ফিরার পথে; জন্মান্ধ ব্যক্তির সাথে মুখোমুখি ও নাকে নাকে তালি খেয়ে দুই জনে এক সাথে চিৎকার করে উঠেছিলাম! অন্ধ ব্যক্তি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আমার চোখ নাই? বললাম! চোখ তো আছে কিন্তু কিছুই তো দেখা যাচ্ছেনা! তিনি খেদোক্তি করে বললেন এরকম অন্ধকারেই তিনি ৬০ খানা বছর পার করেছেন কখনও কারো সাথে তালি খায় নাই। উপদেশ ও পরামর্শ দিলেন ভবিষ্যতে যাতে, হারিকেন নিয়েই রাস্তায় নামি! কেননা চোখ ওয়ালাদের আলোর দরকার হয়, অন্ধের জন্য কোন আলোর দরকার নাই! ‘অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর’ কথাটি শুনেছি। চক্ষুষ্মান ব্যক্তির প্রতি অন্ধের উপদেশ শুনে আমিও পাথর হয়ে ‘থ’ দাড়িয়ে রইলাম!
যাক, অন্ধের কথা বলে দুর্নাম করা আমার লক্ষ্য নয়, আমি বলছিলাম কবরস্থানে জ্বিনের তালাশে ঘুর ঘুর করার কথা! আমার মা-বাবা আলবৎ এসব আন্দাজ অনুমান করতে পারতেন! তাঁরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন, কি করা যায় এই ভেবে! অবশেষে আমাকে পাহারা দেওয়া আর পড়ানোর মত দুটি কাজ একত্রে সম্পন্ন করার জন্য, ঘরে লজিং মাষ্টার রেখে দিলেন! মাষ্টার মহোদয় রাজার হালতে থাকতেন এবং স্বভাবে আধা নাস্তিক প্রকৃতির ছিলেন! জ্বিন-ভূতের আদিম গাল-গল্পে বিশ্বাস করতেন না! সন্ধ্যা রাত্রে পড়ার ফাঁকে টয়লেটে যাবার নাম করে স্যার থেকে সাময়িক ছুটি নিতাম। শয়ন কক্ষের সাথেই পায়খানা করার ব্যবস্থা তদানিন্তন গ্রামীণ জীবনে চালু ছিলনা! শহরের মানুষের এসব ভদ্রজনোচিত আচরণ গ্রামের মানুষেরা তখনও রপ্ত করেনি। গ্রামে বাড়ির বাহিরেই টয়লেটের ব্যবস্থা থাকত। এই সুযোগ ব্যবহার করেই রাত্রিকালে কবরস্থান পরিদর্শনের সুযোগটি হাতিয়ে নিতাম! কদাচিৎ আমার দ্বারা পথচারীদের ভয়ের কাণ্ড ঘটে যেত! মাষ্টার মহোদয় একরাতে বাসায় ফেরার সময় নতুন কবরের চারিদিকে ঘুর ঘুর করা জ্বিন নিজ স্ব-চক্ষে দেখতে পান! আল্লার প্রতি অবিশ্বাস থাকলেও নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করা যায়না? চাক্ষুষ জ্বিন নিজের চোখে দেখতে পেয়ে তিনি ভয়ে মূর্ছা গেলেন! পর দিন থেকে, জ্বিনের উপদ্রবে আক্রান্ত বাড়ীতে তিনি আর লজিং অব্যাহত রাখলেন না! পরিশেষে, আমার শান্ত স্বভাব, ভাবুক প্রকৃতি, জ্বিন-ভুত আতঙ্কের মোকাবেলায় আমার সহসা উপস্থিতি এবং সাহায্যকারী দের মাঝে আমাকে সর্বদা অগ্রগণ্য দেখে; অনেকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, আমার উপরই জ্বিন ভর করেছে। ফলে, অনেকেই বাবাকে পরামর্শ দিতেন, ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি জ্বিন মুক্ত করুন! এলাকার বদনামী ঘুচবে, বাবাকে আরো মনে করিয়ে দিলেন যে, ওদের মেয়ের বিয়েটি ভেঙ্গে যায় যায় অবস্থায় লটকে আছে জ্বিন উপদ্রুত বাড়ী হিসেবে বদনামীর কারণে! জ্বিনেরা একদিন ছেলেটাকে নিয়ে যাবে, তাই চিকিৎসায় দেরী করলে সব হারাবেন!
বাবাকে সবাই ‘হাঁট’ বসানোর পরামর্শ দিলেন! আমি মা-বাবাকে বুঝালাম অনেক টাকা খরচ করে হাঁট বসানোর দরকার নাই। জ্বিন-ভূত সম্পর্কিত ব্যাপার আমি বই পড়েছি, কিছু ঘটনা মানুষের মুখে শুনেছি, তাছাড়া এলাকায় প্রচুর বৈদ্যদের কৌতূহলী জীবন যাপন দেখে, নিতান্ত আগ্রহের কারণেই জ্বিনের সন্ধান করতে কবরস্থানে যেতাম। আমার উপর কোন জ্বিনের বদ নজর নাই, কিংবা আমি জ্বিনের আছর গ্রস্ত কোন বালকও নই বলে দাবী করলাম। বাবা আমার কথা সন্তোষজনক ভাবে শুনলেন এবং বললেন এসব কাজ খুবই বিপদজনক তাই আগ্রহ পরিত্যাগ করাই উত্তম। তিনি নতুন কথা যোগ করে বললেন, বাবা নিজেই এই ধরনের আগ্রহ নিয়ে কাজ করাতে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন! আগ্রহ থাকলেও, অধিক বয়সে যেন করি, কক্ষনো অল্প বয়সে নয়। বাবা আমার কথায় আশ্বস্ত হলেও মা বললেন ভিন্ন কথা! তাঁর সাফ কথা, আমি গুছিয়ে পেঁচিয়ে যে কথাগুলো বাবাকে গিলিয়েছি, ওগুলো সব জ্বিনদের শেখানো কথা! তিনি আরো যোগ করে বললেন, আমি একাকী কারো সাথে জটিল ভাষায় কথা বলি, কখনও উত্তেজিত হয়ে বকাবকি করি। এগুলো সব জ্বিনদেরই প্ররোচনা! মাকে বুঝাতে ব্যর্থ হলাম যে, কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা মুখস্থ করে, তা কবির ছোট ছেলে সব্যসাচীর মত উচ্চারণ ও অঙ্গভঙ্গি অনুশীলন করেছিলাম। এটা না জ্বিনদের সাথে কথা বলা! না বকাবকি! এটা কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার কঠিন শব্দগুলোর আবৃতি ও উচ্চারণ মাত্র! মা কিছুটা ক্ষান্ত হলেও আমার কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস রাখলেন না! তাই তিনি আমার কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য গ্রামে অবস্থান করা পারাতো শিক্ষিত ভাই, আবুল বশর বি,এ,বি,এফ! (ব্যাচেলর অব আর্টস বাট ফেল) এর শরণাপন্ন হলেন! আবুল বশর আমার মুখে বাধাহীন ভাবে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা শুনে চোখ কপালে উঠিয়ে বললেন, এই কবিতা অক্ষরে অক্ষরে শিখতে ও হুবহু না দেখে বলতে এম, এ পাশ করা ব্যক্তির দাঁত ভেঙ্গে যাবে! সেই জটিল কবিতা কারো সহযোগিতা ছাড়া সে কিনা অবলীলায় অনর্গল বলে যাচ্ছে! ফলে আমাকে যে জ্বিনে ধরেছে সে কথা প্রায় সত্যের কাছাকাছি আসল! তাছাড়া আমার উপর ভর করা জ্বিন যেমন তেমন সাধারণ জ্বিন নয়! পুরো দস্তুর শিক্ষিত জ্বিনের পাল্লায় পড়েছি বলেই সাব্যস্ত হল..............!
মানুষের সমালোচনার মুখ বন্ধ করতে একটি চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার কথা বাবা ভাবতে রইলেন। লোক দেখানো চিকিৎসা করতে গেলেও সমান খরচ। বাবা আমার অন্তহীন মতি গতি বুঝতে পারতেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা-ধন্ধে ভুগতেন যে, সমস্যাটি আমার স্বভাব গত নাকি জ্বিনের উপদ্রবের কারণে। তবে তিনি ধারনা করতেন যে, সেটি নিতান্ত কৌতূহলের কারণেই হবে, একদিন এমনিতেই এসব চুকে যাবে। তিনি মাকে বুঝাতে গেলে মুসিবতে পড়ে যান, মা উল্টো দোষ দিয়ে বলেন, তুমি এসবকে হাল্কা ভাবে নিয়ে ছেলের জীবনটাকে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছ! যার সন্তান নাই সেই বুঝে সন্তান না থাকার ব্যথা! যাক, সিদ্ধান্ত আগেই চূড়ান্ত হয়েছিল যে, এই জ্বিন তাড়াতেই হবে। অবশেষে খারাপ জ্বিন থেকে আমাকে মুক্ত করতে মালেক মৌলভীকে আবারো তলব করা হল। তিনি যথারীতি কিতাবাদি নিয়ে আমাদের বাড়ীতে হাজির। বিষয়বস্তু সব শুনে তিনি হাজিরাতে নিমগ্ন হলেন। দীর্ঘক্ষণ ধ্যানের পরে তিনি ঘোষণা করলেন এটা একটা খারাপ জ্বিনের কাণ্ড। সেটা যেমনি শক্তিশালী, তেমনি ধুরন্ধর। এই এলাকায় যত জ্বিন আছে তাদের সকলের সর্দার। এই সেই জ্বিন যে, দীর্ঘদিন আমাকে পুকুরের ঘাটে, জমিনের আলে, মাঠের ধারে সমস্যা করত; এখন সে তার আসল রূপে প্রকাশ করেছে! মা প্রশ্ন করলেন, আমার ছেলেকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা থেকে সেই জ্বিন কবে, কিভাবে বিরত হবে? আর কেনই বা সে তাঁর ছেলের পিছু নিয়েছে? মৌলভী নিশ্চিত করলেন, এই বারে সে এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে, তবে সেজন্য অনেক টাকার দরকার হবে। মা বললেন পুরো জীবনে আপনাকে টাকা কম দিলাম কবে? কত লাগবে একবারেই বলেন, আমি চাই আমার ছেলে মুক্ত জীবনের বাতাস নিচ্ছে।
মৌলভীকে পুনরায় হাজিরাতে বসতে হবে, সেজন্য নতুন করে ওজুর দরকার, ফলে পুকুরের ঘাটে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি ওরে বাবারে বলে চিল্লিয়ে উঠলেন। সবাই দৌড়ে গেলাম, তিনি পুকুরের ঘাটে পা রাখা মাত্র অমনি ধপাস করে আছড়ে পড়লেন! সেকি যেমন তেমন আছাড়! একেবারে পুকুরেই নিমজ্জিত হয়ে গেলেন! হাতের একটি আঙ্গুল ভেঙ্গে ফেলেছেন! তাঁর এই বিদঘুটে পতনে মা তার উপর বেজায় বিরক্ত হলেন। মা বললেন, এই পুকুরের এক ঘাটে পিছলা খাবার কারণে আপনি আমার ছেলেকে বহুবার তাবিজ দিয়েছেন! আর আপনি আজ সেই পুকুরের ঘাটে জ্বিনের ধাক্কায় রীতিমত আছাড় খেয়ে পানিতে চুবে গেছেন! বুঝা যাচ্ছে সেই বজ্জাত জ্বিন থেকে আপনিও মুক্ত নন, তাহলে আপনি কিভাবে আমার ছেলেকে রক্ষা করবেন? বেচারা মৌলভী আছাড় খাওয়ার মাধ্যমে আমার মায়ের অতিরিক্ত সহানুভূতির মাধ্যমে টাকার অংকটা ভালই আশা করেছিলেন! সহানুভূতির স্থলে তিনি উল্টো অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হলেন অধিকন্তু বদ জ্বিন দৌড়ানোর তাঁর পুরো এসাইন্টমেন্টটাই ও বাতিল হয়ে গেল! আছাড় খেয়ে ভাঙ্গা আঙ্গুল ঠিক করানোর জন্য মায়ের নিকট থেকে প্রয়োজনীয় টাকা নিয়ে তিনি সেই যে গেলেন বাকী জীবনে আর কোনদিন আমাদের বাড়ী মুখো হননি! অবশ্য তাঁর আর আসার দরকারও হয়নি কেননা ততদিনে তাঁর স্থলে নতুন আরেকজনের উত্থান ঘটে যায়। চলবে..........
লেখক আমিরাত প্রবাসী।
বিষয়: বিবিধ
২৫২০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন