ঈদের দিনে বিড়ির আগুন হাওলাত! (রম্য ঘটনা)
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ০৬ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:১৩:১৫ দুপুর
আমাদের দিনে ছোটদের ঈদের সময় টাকা পয়সা খরচ করার কোন রাস্তা ছিলনা। বর্তমান যুগের মত প্লাস্টিক সামগ্রীর নানা খেলনা সামগ্রীও তখনকার দিনে ছিলনা। বয়সে যারা বড়, তারা শহরে গিয়ে সিনেমা দেখে আসত। ছোটরা আত্মীয় স্বজনের বাড়ী ঘুরে আনন্দ করত। তখনকার দিনে ছাত্ররা কলেজে যাওয়া মাত্রই হাতে সিগারেট নিত। কলেজ ছাত্র সিগারেট না খেলে কাপুরুষ ভাবা হত! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সিগারেট হাতে যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব-বোধ নিয়ে চলতে দেখতাম! অতি বুদ্ধিমান ছাত্ররা দামী সিগারেটের একটি খালি প্যাকেটে স্টার, রমনা, আবুল বিড়ি, তারা বিড়ি ও রোথম্যান্স সহ বিভিন্ন কোম্পানির মিশ্রিত শলাকা রাখতেন। পরিস্থিতি অনুসারে ব্যক্তিত্ব বাড়ানোর তাগিদে যুতসই সিগারেট বের করে আগুন ধরাত। উচ্চ বিদ্যালয়ের এসব ছাত্রদের অভিব্যক্তি নিম্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর প্রভাব পড়ত। তারাও কদাচিৎ গোপনে নদীর তীরে, ঝোপ-ঝাড়ে, বাঁশ বাগানে গিয়ে বিড়ি কর্ম সারতেন। ঈদের দিনের সুযোগে কদাচিৎ মুরুব্বীরা দেখে ফেললেও না দেখার ভান করত। বর্তমানে সিগারেট পান যেভাবে একটি বদ অভ্যাস কিংবা বিশ্রী স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয়। আমাদের সময়ে সেটা তখনও হয়ে উঠেনি। স্কুলের প্রায় সকল শিক্ষকেরা প্রকাশ্যে বিড়ি টানতেন! আমাদের হেড মাষ্টার মহোদয় পড়ানেরা ফাঁকে ফাঁকে শ্রেণীকক্ষেই হুক্কায় টান মারতেন। ছাত্রদের কাউকে স্যারের হুকোর কলকিতে আগুন ধরানো লাগত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ড ম্যাডালিষ্ট পাশ করা, আমাদের কলেজ প্যান্সিপ্যাল হুকো আর চুরুট সমান তালে টানতেন। (অবশ্য তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন না, আমার বড় ভাইয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং আমাদের পাশের গাঁয়ের মানুষ ছিলেন) যাক, বড়দের বদনাম করার উদ্দেশ্যে এই লিখা নয়, লিখাটি হল বিড়ির আগুন হাওলাতে ব্যাপারটা।
কয়েক বন্ধুর প্রভাবে এই ঈদে বিড়ি জ্বালিয়ে আনন্দ করার সিদ্ধান্ত হল। তারা আমাকে নিয়ে সন্দেহের ঘোরে ছিল, পাছে যদি ব্যাপার খানা বড়দের কাছে প্রকাশ করে দিই! পর পর কয়েকদিনের প্রশিক্ষণের পর তারা নিশ্চিত হল যে, এই কথা আমি কাউকে তো বলবই না বরং আমি নিজেও আবুল বিড়িতে আগুন ধরিয়ে ধূমপান পর্ব উদ্বোধন করব! বিড়ি-দেয়াশলাই কেনার দায়িত্ব একজন নিয়ে নিলেন। ঈদের দুপুরে সবাই একত্রিত হলাম, বাছাই করলাম হালদা নদীর তীরে পুটকি বনে ঢুকেই বিড়িতে আগুন জ্বালানোর শুভ উদ্বোধন করব। সময় পেলেই এই বনে কত লুকোচুরি খেলেছি তার ইয়ত্তা নেই অথচ আজ কেন জানি বুক ধড়পড় করছে। কোথাও জন মানুষের সাড়া নেই, তারপরও সতর্ক হতে শতভাগ চেষ্টিত হলাম। একপর্যায়ে বনের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। কোথায় বসে বিড়ি টানা হবে, সে স্থান আগেই ইঁচড়ে পাকা বন্ধুর কল্যাণে ঠিক করা ছিল। সবাই যার যার মত বিড়ি ধরিয়েছেন, আমিও আগুন জ্বালাতে প্যাকটিস শুরু করলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে কে একজন হুড়মুড় করে বনের ভিতরে ঢুকে পড়লেন। আমরা কি করব কিছু বুঝে উঠার আগেই, তিনি আমাদের ঠিক তিন হাত দূরেই আমাদের নাকের সামনেই পুরোপুরি দিগম্বর হয়ে বসে গেলেন! বুঝতে পারলাম তিনি ঈদের খানাটি পরিমাণে বেশীই গিলে ফেলেছেন তাই পথিমধ্যেই পায়খানার উপদ্রব হওয়াতে হঠাৎ সিদ্ধান্তে বনে ঢুকে পড়েছেন! তার তাজা মলের উৎকট গন্ধে আমাদের যায় যায় দশা। আবুল বিড়ির ঝাঁঝালো তীব্র গন্ধের প্রতি আক্রমণে মলের গন্ধ কিছুটা হলেও ভাটা পড়ছিল। ভাগ্যিস! বিড়ির কল্যাণে চিল্লিয়ে বমি করার ইচ্ছেটা কিছু হলেও রোধ করতে পারলাম। ওদিকে আগন্তুক প্রথম মিনিট একটু বে-ঘোড়ে ছিলেন। শরীর একটু বিপদমুক্ত হবার পর চিন্তা করলেন, তিনি কোথায় বসেছেন? জায়গাটা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দরকার। বিড়ির গন্ধের কারণে তার কিছুটা সন্দেহ তৈরি হয়েছিল! তাই স্থানটি ভাল ভাবে জরিপ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। জরীপ কাজের শুরুতেই তিনি দেখতে পেলেন, তার একেবারে সামনেই কয়েকজন ওৎপেতে বসে আছে এবং সবাই তার দিগম্বর শরীর দেখে ফেলেছেন! মুহূর্তেই তিনি লাফ দিয়ে উঠলেন, চিৎকার করে বলে উঠলেন, তোমরা এখানে কি করছ? তোমাদের হাতে বিড়ি কেন? তোমরা চুরি করে বিড়ি পান করছ এসব কথা তোমাদের পিতা-মাতা ও স্কুলের স্যারদের কাছে বলে দিব! মলের গন্ধ ও বিড়ির গন্ধের উৎকট পরিবেশে আমরা সবাই তার কাছে মাফ চাইলাম ভবিষ্যতে কখনও এই দুষ্কর্ম করব না। আজকে যাতে তিনি ক্ষমা করে দেন। তিনি আমাদের বিড়ি গুলো হাতিয়ে নিলেন সবার পকেটে যত টাকা আছে তা বের করে তার হাতে তুলে দিয়ে, কান ধরে দাড়িয়ে থাকতে আদেশ দিলেন! সবাই যার যার মত টাকা, বিড়ি, দেয়াশলাই তার হাতে গছিয়ে দিয়ে কানে হাত দিচ্ছেন। ওদিকে একজন টাকা বের না করে অতি ভয়ে বলতে রইল সে বিড়ি খায়নি। এমন সময় আগন্তুকের মনে পড়ল, আরে তিনি তো পুরোটাই উলঙ্গ! আমাদের সামনে উলঙ্গ দাঁড়িয়েই তিনি বিড়ির আদালতের বিচার করছেন! কিংকর্তব্য বিমুঢ় আগন্তুক একটু সময় নিলেন এবং লজ্জায় পড়ে দৌড় দিলেন এবং মুহূর্তের মধ্যেই সে স্থান থেকে পালালেন। আমাদের বিড়ি, টাকা, পয়সা সবই তিনি নিয়ে গেলেন। আমরা একটু চিল্লাতে পারলাম না, প্রতিবাদ করতে পারলাম না, এমনটি ঘটনাটি কোন মুরুব্বীকে বলতে পারলাম না, কেননা সেই আগন্তুক ব্যক্তিটি ছিল আমাদের স্কুলের দপ্তরি!
দুই মাস ধরে পরিকল্পনা এঁটেছিলাম, ঈদের দিন বিড়ি পান করব, এই ঘটনায় ঈদের পুরো আনন্দটাই শেষ। বিকেল বেলায় বন্ধুরা যে যার মত চলে যেতে থাকল, সন্ধ্যে অবধি তিনি বন্ধু একত্রিত ছিলাম। ইঁচড়ে পাকা বন্ধুটির কাছে আরো এক প্যাকেট বিড়ি রক্ষিত ছিল, সেখান থেকে তিনটি বিড়ি নিয়ে আসা হল। দরকার একটি যায়গা এবং একটু আগুন। সিদ্ধান্ত হল রাতের অন্ধকারেই বিড়ি পান করা হবে, কেউ কাউকে চিনবে না, পরিপূর্ণ স্বাধীনতার মাধ্যমেই বিড়ি পান করা যাবে। দরকার শুধু সময়মত একটু আগুন। সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই, রাতের আঁধার ঘন হয়েছে। বাজার থেকে কোথাও আগুন সংগ্রহ করা গেল না। কি করা যায় চিন্তা চলল। গ্রামের বাজার গুলোতে সিগারেটে আগুন ধরানোর জন্য, দোকানের সামনে একটি রসি লটকানো থাকে, তার এক প্রান্তে চলমান আগুন পাওয়া যায়। ধূমপায়ীদের পকেটে দেয়াশলাই থাকলে সমস্যা নেই, না থাকলে অভ্যস্ত ধূমপায়ীরা রসির আগুন থেকে সিগারেট ধরিয়ে কর্মমূখো হন। সিগারেট জ্বালানোর আরেকটি পথ আছে, রাস্তায় ধূমপান রত কাউকে পেলে, তার সিগারেটের আগুন হাওলাত করে, নিজের বিড়িটি জ্বালিয়ে নেওয়া যায়। আবহমান কাল ধরে বাংলার মানুষকে, বিড়ির আগুন হাওলাত দেবার ক্ষেত্রে, সকল ধূমপায়ীকে উদার অবস্থায় পাওয়া গেছে। দোকানের রসি থেকে বিড়ি জ্বালানোর পদ্ধতি আমাদের জন্য বিপদজনক হতে পারে বলে সবাই মত দিল। কেননা মুহূর্তেই সে খবর দশ কান হয়ে পিতা কিংবা স্কুল শিক্ষকের কাছে চলে যাবে। তাই এই বিপদজনক সিদ্ধান্তটি অগ্রহণযোগ্য হল। অন্য উপায়টি বাকি থাকল, রাস্তায় কারো নিকট থেকে আগুন হাওলাত করেই বিড়ি জ্বালানো। এই নির্ভরতায় তিন বন্ধু বাড়ির উদ্দেশ্যে অন্ধকারে পা বাড়িয়ে দিলাম।
দুর্ভাগ্য আমাদের! অন্ধকার জনশূন্য রাস্তায় একজন ধূমপায়ী পথিকেরও সন্ধান পাওয়া গেলনা! ওদিকে বাড়ীর দূরত্বও কমে আসছিল। একটু পরেই রাস্তার তিন মোহনা। সেখান থেকে তিন বন্ধু তিনদিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে পৃথক হয়ে যাবে। এমনি মুহূর্তে ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখা গেল সামনেই অনতিদূরে একটি আগুন কণিকা উঠা-নামা করছে। নিশ্চিত হলাম কেউ একজন সিগারেট টেনে টেনে এদিকে আসছে। আমরা তিন রাস্তায় মাথায় দাঁড়ালাম। অন্ধকারের অদেখা-অচেনা আগত ধূমপায়ী পথিক একটু দূরে থাকতেই এক বন্ধু অগ্রিম বলে বসল, ‘ভাই একটু আগুন দেন’। আগন্তুক আগুন দিতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিলেন। কেননা আগন্তুক নিজেও পথিমধ্যে এভাবে বহুবার এ সুযোগ অন্যদের থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন। আগন্তুক তিন রাস্তায় মাথায় এসে থামলেন এবং সিগারেট যাতে ভাল ভাবে জ্বলে উঠে সে জন্য পুরো সিগারেট আমাদের দিকে বাড়িয়ে দেয়ার আগ মুহূর্তে আরেকটি সুখ টান দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তাই সিগারেটে ঠোঁটে লাগিয়ে কষে একটি টান বসালেন! সিগারেট অতিমাত্রায় জ্বলে উঠল, সিগারেটের জ্বলন্ত আগুনে পথিকের চেহারার একটি অবয়ব ফুটে উঠল। আমাদের কাছে চেহারাটি বেশ পরিচিত মনে হল! সিদ্ধান্তের জন্য তিন সেকেন্ড সময় নিলাম। হায়-হায়-রে! সর্বনাশ! ইনি তো আমাদের স্কুলের গণিত শিক্ষক! যেমনি কড়া, তেমনি বদমেজাজি! উপস্থিত সিদ্ধান্তে আমাদের একজন বলে উঠল, ভাগ! সম্বিৎ ফিরে পেয়ে, এক মুহূর্তের মধ্যে তিন জন রাস্তার তিন দিকে গভীর অন্ধকারে ভৌঁ-দৌড় দিলাম। অসম্ভব নিস্তব্ধতার মাঝে হঠাৎ কি হল, শিক্ষক ব্যাপারটি বুঝতে চেষ্টা করলেন। তিনি আগুন নেবার জন্য আমাদের ডাকলেন। পুনরায় ডাকলেন! কোন সাড়া-শব্দ নাই, আগুনের প্রতি কারো আগ্রহ না দেখে তিনিও অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।
বিষয়: বিবিধ
৩০০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন