তাবিজের বালক! এক পিকুলিয়ার মানুষ, পর্ব-১ (রোমাঞ্চকর কাহিনী)

লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ০৯ জুলাই, ২০১৩, ০৬:৫৪:০৬ সন্ধ্যা



মালেক মৌলভী! ইতিপূর্বে আপনাদের ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, মালেক মৌলভীর প্রতি মাসের এক সপ্তাহের আয় আমার মায়ের মাধ্যমে জুটে যেত! তাঁকে কেন মৌলভী বলা হত, তার উত্তর আমি খুঁজে পাইনি। তিনি কোন মক্তব-মাদ্রাসায় ছাত্র পড়াতেন না, হাস-মুরগী জবাই পরবর্তী কারো ঘরে ফাতেহা দিতেন না (চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশ্বস্ত হুজুরের মাধ্যমে মুরগী জবাই পূর্বক রান্নার পরে ফাতেহার ব্যবস্থা ছিল, হুজুর ফতোয়া দিলেই ক্ষুধার্ত মানুষ আহার শুরু করতে পারতেন, নতুবা নয়) তাঁকে কোনদিন মাহফিলে ওয়াজ করতে দেখিনি, তিনি কোন মসজিদের ইমাম ও নন! এক মুরুব্বীকে প্রশ্ন করলে পর তিনি গোস্বা করে বললেন সেই ব্যক্তি তো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়ে না! তিনি কি করে হুজুর হবেন। এসব ব্যক্তি হুজুর নামের কলঙ্ক, ডাকার সুবিধার্থেই তাঁকে মালেক মৌলভী বলা হয়! কেননা, তাঁর মুখে লম্বা দাড়ি, সর্বদা গায়ে লম্বা কোর্তা, গলায় হাজি রুমাল, পকেটে লাল-নীল-সবুজ কলম আর বগলে থাকত একগাদা উর্দু-ফার্সি বই!

স্থানীয় বাজারে যাওয়ার সোজা রাস্তা থাকর পরও, মালেক মৌলভী কারো বাড়ীর পিছন দিয়ে, কারো বাড়ীর পাশ দিয়ে, কোন বাড়ীর একেবারে সোজা মাঝখান দিয়ে বাজারে যেতেন; আর যক্ষ্মা রোগীর মত কাশি দিতেন! হাট বাজারের দিন সন্ধ্যের বেশ আগে থেকেই গ্রামে পুরুষ থাকত না। মালেক মৌলভী এই সময়টাকে বাছাই করতেন বাজারে যাবার জন্য। গ্রামের মহিলারা তাঁর কাশি শোনা মাত্রই হাঁক ছেড়ে বলতেন, হুজুর কষ্ট করে একটু আমাদের ঘরে আসেন! মৌলভী তো এটাই প্রত্যাশা করেছিলেন! তিনি ঘরে গিয়ে বসা মাত্রই গৃহিণী প্রশ্ন করতেন, হুজুর আমার মেয়েটির জন্য কোন বিয়ের প্রস্তাব আসছে না, দেখুন তো আপনার কিতাবে এ ব্যাপারে কি লিখা আছে? তিনি যথারীতি তাঁর কিতাব খুলে, নির্ধারিত পৃষ্ঠায় আঁকা ঘর যুক্ত ছকে হাত ঘুরান কিংবা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ধ্যানে বসেন। পরিশেষে গুরুগম্ভীর ভাবে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, আপনার মেয়ে লাল আঁচল যুক্ত শাড়ি পড়ে কোন এক শনিবার সন্ধ্যায় দেরী করে ঘরে ফিরেছিল। পথিমধ্যে আঁধা জ্বিনের বদ নজর পড়ে যায়, যার কারণে বিয়ের পস্তাব আসছে না! এই দশা কাটাতে নগদ পনের টাকা, দেড় সের চাউল, ১৫টি লাল মরিচ, দেড় চামচ হলুদ গুড়া, একটি মুরগী ও ছয়টি টি ডিম দেওয়া লাগবে। রোগিণীকে গলায় তাবিজ দেন, কবজ ভেজানো পানি পান করতে দেন। একমাস পান করার পরে তিনি আবার আর একটি কবচ দিবেন, সেটা ছয় মাস ব্যবহার করতে হবে। তারপর মুসিবত কাটবে এবং বিয়ের পয়গাম নিয়ে নতুন গৃহস্থ আসবে। অজানা শনিবারের সন্ধ্যায় দেরী করে ঘরে ফিরার অপরাধে, মা মেয়েকে কিছুক্ষণ হালকা বকাঝকা করবেন। যথারীতি নগদ টাকা, জ্যান্ত মুরগী, হলুদ, মরিচ ও ডিম চালান হয়ে মালেক মৌলভীর বাজারের থলে ভারী হতে থাকে। এটাই ছিল ওনার জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম।

মৌলভীর কিতাবি হাজিরার প্রতি আমার মায়ের ছিল অগাধ আস্তা ও বিশ্বাস। তিনি নিয়মমাফিক প্রায় প্রতি মাসের কোন একদিন আমাদের বাড়ী ঘুরে যাবেই! মা প্রতিমাসে তাবিজ না নিলেও হাঁস-মুরগী, ডিম ইত্যাদি উপঢৌকন হিসেবে এমনিতেও দিতেন। তিনি ফিরে যাবার সময় আমাকে দেখে যেতেন, আমি কি করছি কিংবা কোন কাজে ব্যস্ত আছি, তার খবর নিয়ে যেতেন। প্রিয়তম মা, আমার ছোটকাল থেকেই অজানা কি এক কারণে সর্বদা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন! তাঁর এই দুঃচিন্তার ষোলআনা ফায়দা আদায় করতেন মালেক মৌলভী। কখনও মালেক মৌলভী আমাকে ডাকতেন এবং একটি ছকযুক্ত বই দেখিয়ে বলতেন তোমার ইচ্ছামত কোন এক ছকে আঙ্গুল দাও। আঙ্গুল দেবার সাথে সাথেই মৌলভী চিৎকার দিয়ে বলতেন, ইস্ কি কাণ্ডটা ঘটাইলিরে বাবা। মা হন্তদন্ত প্রশ্ন হয়ে মৌলভীকে প্রশ্ন করতেন, হুজুর আবার কি হল! যথারীতি মৌলভী বলতেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুকুরের ঘাটে সে দুষ্ট জিনের ভয়ে একটু পিছলে গিয়েছিল। ভাগ্যিস! আছাড় খায় নাই! যদি আছাড় খেত, তাহলে কি মরণ দশাটাই না হত। মায়ের বকাঝকা শুরু হত, হায়রে দুর্ভাগা ছেলে, সারাদিন ফুটবল খেলতে দিলে একটি আছাড় খাবার জোগাড় নাই আর পুকুরের ঘাটে গিয়ে ‘পিছল’ খাস! প্রতিবাদ করতে পারতাম না, কেননা আছাড় খাইলে না হয় ঘটনা মনে থাকে, পিছলা খাবার ঘটনা তো মনে থাকেনা। বিশ্বাস করতাম হরদম কত পিছলা খাই, হতেও পারে কোন এক মঙ্গলবারে হয়ত ঘাটে পিছলা খেয়েছিলাম! যথারীতি মৌলভী সাহেবের দাবী নগদ পঞ্চাশ টাকা, দুইটি মুরগী, এক কাঁদি কলা……ইত্যাদি দিতে হইবে। একটি শক্ত তাবিজ লিখতে হবে, যাতে আর কোনদিন সেই বজ্জাত জ্বিন আমাদের বাড়ীর চৌহদ্দির মাঝে না আসে। সেজন্য কুমকুম, গোচনা এবং তাজা কবুতরের রক্ত লাগবে। তাই সাথে একজোড়া জীবিত কবুতর দিতে হবে। মা পাকা গৃহস্থী ছিল বাড়ীতে কবুতর, মুরগী, ডিম, দুধ সহ যাবতীয় চাহিদা মায়ের হাতের কাছেই থাকত। ফলে বাবার কাছে হাত পাততে হতনা। তাবিজ-কবজের মূল্য হিসেবে মৌলভী সাহেবের চাহিদা গুলো এমন ছিল, স্বামীর সহযোগিতা ব্যতীত যে কোন গৃহিণীই সেটা পূরণ করতে সক্ষম হতেন।

মালেক মৌলভীর কারণে আমাকে অযথা মায়ের বকুনি খেতে হত। আমার কল্যানার্থে মালেক সাহেবের বইয়ের প্রতি পাতার প্রতিটি পৃষ্ঠা ব্যবহৃত হয়েছে। এসব পৃষ্ঠাগুলোর ছক আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তার উপর আমার গোস্বা থাকলেও মনটা বড় কৌতূহলী ছিল। আমি কবে পিছলা খেয়েছি সেটা আমার মনে না থাকলেও মালেক সাহেবের কিতাবে ধরা পড়ে যায় এটা কেমন কথা! তার দেওয়া তাবিজ ব্যবহার করতে করতে সেনের দোকানের তাবিজের কৌটো গুলো আমাদের পারিবারিক প্রয়োজনেই কেন হয়ে যেত। এক পর্যায়ে মালেক সাহেব নিজেই অষ্টধাতুর কৌটো, ত্রি-ধাতুর কৌটো, তামার, লোহার, পিতলের কৌটো সাথেই রাখতেন। এ সকল কৌটোর আজীব উপকারিতা শুনে গ্রামের মহিলারা কদাচিৎ পুরুষেরা পর্যন্ত অনেক দামে কিনে গৌরবের সাথে ব্যবহার করতেন। একদা ফুটবল খেলতে গিয়ে, অন্যের হাতের তাবিজে আমার মাংস ছিঁড়ে যায়। নতুন বজ্জাত জ্বিনের বদৌলতে এই ঘটনা, তাকে দৌড়াতে আমার হাতে, গলায়, কোমরে তাবিজ নিতে হয়েছিল। বাজারে আরেক তাবিজ বিক্রেতা আমার গায়ে বেজোড় তাবিজ দেখে রাহুর দশায় আক্রান্ত হয়ে যেতে পারি বলে আরেকটি তাবিজ দিয়ে তাবিজের সংখ্যাকে জোড়া করে দিয়েছিলেন! এসবে আমি যথেষ্ট ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। তাবিজ ব্যাবহারে বিরক্ত হলেও, মৌলভীর গোপন কথা প্রকাশ করে দেবার কিতাবের প্রতি অতি উৎসাহ লেগেই রইল।

এক সন্ধ্যায় প্রবল ঘূর্ণি ও বৃষ্টির কারণে মালেক মৌলভী তাঁর কিতাবের গাঁটরি খানা আমাদের বাড়ীতে রেখে যান। আমি এই সুযোগে কিতাবখানা মেলে ধরলাম এবং একটি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পরিচিত একটি তাবিজ লিখা শুরু করলাম। তাবিজের প্রতিটি শব্দগুলো আরবি, কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে অজানা শব্দের তাবিজ স্কুলের খাতায় প্রাকটিস করতে থাকলাম। মনে মনে বিশ্বাস চলে আসল যে, আমি তাবিজের প্রয়োজনীয় শব্দগুলো লিখতে পারছি। এবার কিছু আরবি বর্ণ লিখার চেষ্টা করতে থাকলাম। অঙ্কনের প্রতি আমার দারুণ ঝোঁক ছিল, যা দেখতাম তাই আঁকতে চাইতাম। আমার বড় এবং পরিবারে মেঝ ভাই মাদ্রাসায় পড়তেন। তিনি যখন আরবি লিখতেন তখন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে খেয়াল করতাম আরবি বর্ণমালার কোনটি কিভাবে কোন স্থান থেকে লিখা শুরু করতে হয়। হয়ত মন দিয়ে অবলোকন করার কারণে, নিজের অজান্তে মনের ভিতরে গেঁথে যাওয়া আরবি শব্দ গুলো লিখতে গিয়ে মনে হল এই শব্দের সাথে আমি যেন বহুদিন ধরেই পরিচিত ছিলাম! ঘূর্ণিঝড়ে অনেক বাড়ি ঘর, স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কয়েকদিন সব বন্ধ থাকল, মালেক সাহেবের কিতাব গুলো আমাদের বাড়িতেই ছিল। লেখার ব্যাখ্যা কিছু না বুঝলেও এই সুযোগে তাঁহার অমূল্য কিতাবের অনেক তাবিজ প্রাকটিস করে ফেলেছি এবং ভুলে-শুদ্ধে মোটামুটি তাবিজ-কবজ লিখার মত কিছুটা আরবি লিখতেও পারছি!

ঘরে বসে আপন মনে একাকী তাবিজ বানানো ও আরবি লিখা অনুশীলন চলছিল ওদিকে এই ঘটনা মুরুব্বী মার্কা অনেকের চোখে আশ্চর্যজনক ঠেকল। তাদের দৃষ্টিতে এটা একটা অতি আশ্চর্যজনক কিংবা অলৌকিক ঘটনা বটে। এই কথা এক কান দুই কান করে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। কারো দৃষ্টিতে এটা জ্বিনের আছরের কারণে হয়েছে, কারো দৃষ্টিতে এটা আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষায়িত জ্ঞান, যা তিনি তার প্রিয় বান্দাদের দিয়ে থাকেন! আসল ঘটনা আর যাই হোক, গ্রামের মানুষের কাছে এটা একটা অতিমানবীয় বিষয় হয়ে উঠেছিল অধিকন্তু ভবিষ্যতে বালকটি কিছু একটা হয়েও যেতে পারেন! আমাদের গ্রামের মসজিদ এবং এবতেদায়ী মাদ্রাসার সম্মানিত হুজুর; যিনি আমার পিতার আনুকূল্যে এই কাজে নিয়োজিত, তিনি বলে বসলেন আমি এই ছেলেকে এক বছরের চেষ্টায়ও কোরআন শিখাতে পারিনি, অথচ সেই ছেলে কিনা অবলীলায় আরবি লিখে যাচ্ছে! নিঃসন্দেহে এটা অলৌকিক কিছু একটা হবে। আমার পিতাকে পরামর্শ দেওয়া হল যাতে, এই বালককে সদা সর্বদা নজরে নজরে রাখে, হতেও পারে আচানক দুষ্ট মানুষ কিংবা জ্বিন একে তুলে নিয়ে যেতে পারে!

বাহিরের মানুষের এসব কথাবার্তার আভাষ পাচ্ছিলাম কিন্তু এসব কথার গুরুত্ব কি? কেনই বা মানুষের এত কৌতূহল! তা পরিমাপ করার বয়স তখনও আমার হয়নি। তারা আমার উদাসীন ও এলোমেলো উত্তরের যোগসূত্র খোজে পেতে বরাবর ব্যর্থ হল। বরং এটাকে অন্য জগতের কারো বলে দেওয়া জ্ঞান বলে মনে করলেন! মা-বাবা দুই জনেই দুঃচিন্তার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। কার কাছে গেলে এসব কথার উত্তর পাবেন ঠিক করতে পারছিলেন না, আবার আমাকে কারো কাছে হাওলা করবেন সেটাও সম্ভব হচ্ছিল না। আমি শাসনের ভয়-ডর ফেলে কেন তাবিজ লিখেছি, কিভাবে আরবি লিখতে পারলাম তা মা-বাবাকে পরিষ্কার করে বললাম। তারপরও তারা যেন কিসের ভয়ে আমার কথার উপর আস্থা রাখতে পারছিল না। মা বলতে রইলেন তোমার ছোটকাল থেকেই আমি দুঃচিন্তায় আছি, কেননা তুমি জান না তোমার অজান্তে কিংবা পশ্চাতে কি ঘটতে থাকে! যাক, ততদিনে মুখে মুখে দশ মুখে, শত মুখে, চারিদিকে রটে গেল অতি-প্রাকৃতিক ঘটনার কথা। আমি বাল্যকালেই পুরো এলাকায় পরিচিত হয়ে উঠলাম। আমার প্রিয় পিতা মোটামুটি বিত্তশালী ছিলেন বিধায়, কোন প্রকার লাভের-লোভের কাছে তিনি হার মানেন নি। তবে হাটে বাজারে স্কুলে যেখানেই যাই না কেন, সেখানেই হাজারো প্রশ্নর মুখোমুখি হই, আমি নিজেও জানতাম না এসবে প্রশ্নের কারণ কি? কিংবা তার সঠিক উত্তরই বা কি? অকালে মালেক মৌলভীর তাবিজের কিতাব নকল করতে গিয়ে যে মুসিবতে পড়লাম, তার খেসারত আমাকে হাটে, ঘাটে, মাঠে ময়দানে দিতেই হচ্ছিল…………….।

আগের পর্ব: এক পিকুলিয়ার মানুষ! (রোমাঞ্চকার কাহিনী- ভূমিকা পর্ব)

বিষয়: বিবিধ

৪৪৯৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

332419
২৯ জুলাই ২০১৫ দুপুর ১২:৪৩
নাবিক লিখেছেন : দারুণ!
২৯ জুলাই ২০১৫ দুপুর ০২:৫৮
274732
নজরুল ইসলাম টিপু লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ, ব্লগটি ব্যান হবার কারণে, বারবার সার্ভার পরিবর্তন করতে গিয়ে সমুদয় কমেন্ট গুলো মুছে গেছে, নাকি তুলে নেওয়া হয়েছে বুঝতে পারছি না। এমনকি পুরাতন লিঙ্ক গুলোও কাজ করছে না।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File