এক পিকুলিয়ার মানুষ! (ধারাবাহিক রোমাঞ্চকার কাহিনী- ভূমিকা পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ০৩ জুলাই, ২০১৩, ০৬:১২:২০ সন্ধ্যা



ছাগলের পালকে ঘাস খেতে দিয়ে, মাঠের এক প্রান্তে বসে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে মনসুর! হঠাৎ উদাস মনে দুই বন্ধুকে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা ধর! আমি যদি বাগদাদের শাসনকর্তা হই তাহলে তোরা আমার কাছে কোন পদ চাইবি’? এক বন্ধু হেসে বলে তুই হবি বাগদাদের শাসক! যা বেটা, তুই যদি শাসক হতে পারিস তাহলে আমাকে ঘোড়া শালের দারোয়ান করিস। অন্য বন্ধু হেসে বলে, আমাকে তোর বাগান দেখার দায়িত্ব দিস। মনসুর বলল! কাউকে হেয় না করে ভাল ধারনা রাখিস, উত্তম জিনিষ প্রত্যাশা করিস। একদা দুই গরিব কৃষক ব্যক্তিকে পুলিশে ধরে নিয়ে, বাগদাদের উপকণ্ঠে সুলতানের কাছে সোপর্দ করে। সুলতান তাদের পরিবারের দুঃখ দুর্দশার কথা জানতে পেরে একজনকে সুলতানের ঘোড়া শালার রক্ষকের চাকুরী দেন, অন্য জনকে প্রাসাদের পাশের বাগানের রক্ষক বানিয়ে নেন। দুই গরিব কৃষক খুবই আশ্চর্য হলেন যে, এটা কেমন ঘটনা সোজা গ্রাম থেকে ধরে এনে রাজকীয় চাকুরীর বন্দোবস্ত! ব্যাপার খানা কি? সুলতানই বা এই কাজের জন্য আমাদের বাছাই করল কেন! ইত্যাদি ভাবতেই তারা হয়রান পেরেশান। দুই দিনের মধ্যেই কৃষকদ্বয় জানতে পারেন, বাগদাদের সুলতান আর কেউ নয়, ইতিহাস খ্যাত ব্যক্তি বাগদাদের মহান শাসক উজির আল মনসুর! তাদেরই বাল্য বন্ধু! একদা তারা তামাসাচ্ছলে বন্ধুর কাছে যে প্রত্যাশা করেছিলেন, ক্ষমতা আর প্রাচুর্যের মাঝেও ক্ষমতাসীন বন্ধু তাদের ভুলে যাননি! তিনি তাদের ধরে এনে পূরণ করেছেন তাদের প্রত্যাশা। দুই বন্ধু বাকি জীবন আফসোস করে হয়রান পেরেশান হয়েছিলেন এই ভেবে যে, কেন তারা বন্ধুর কাছে তামাসাচ্ছলেও উত্তম জিনিষ প্রত্যাশা করেনি! উপরের কাহিনী দিয়ে লিখাটি শুরু করেছি, কেননা এমন প্রতিচ্ছবি আমাদের দেশে মেলা ভার। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় উদারতা ও মহত্ব শেখানোর পরিবর্তে, দুনিয়াতে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে, সেটিকে বেশী মূল্যায়ন করা হয়। পুরো জাতির প্রতিটি ছাত্র একটি চাকুরী তথা চাকর হবার আশায় গভীর অধ্যবসায়ের সাথে লেখাপড়া করে, মানুষ হবার জন্য লেখাপড়া শিখে খুব সংখ্যক শিক্ষার্থী!

প্রতিটি মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা থাকে, যা সবার সাথে শেয়ার করা যায় না। কিছু ঘটনা এমন থাকে যা প্রকাশ পেলে অনেকে সামাজিক মর্যাদা হারাবার ভয় করে। আমাদের দেশে এই সমস্যাটি অনেক বেশী। অনেক সময় দেখা গিয়েছে, কিছু ব্যক্তি অধ্যবসায় ও ভাগ্যের জোড়ে অনেক উপরে উঠে যায়। তখন তার মনোবৃত্তি স্বীয় প্রবৃত্তির কাছে হার মানে। গ্রামীণ জীবনের বাল্যকালের বন্ধুদের হেয়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কখনও বা অপমান করে। গ্রামের বন্ধুরা যখন দেখতে পায় স্কুলের তারই সহপাঠী সেই বন্ধুটি এখন অনেক বিত্তশালী, তখন গর্বে তাদের বুক ভরে উঠে এবং অন্যদের বলে বেড়ায় বাল্যকালে তিনি আমার বন্ধু ছিলেন। বিত্তশালী বন্ধু যখন এলাকায় আসে, তখন বন্ধুরা বুকভরা গর্ব নিয়ে তার সাথে দেখা করতে যায়। কিন্তু বন্ধুটি অহংবোধে গরীব বন্ধুর বন্ধুত্ব অস্বীকার করে এবং দ্বিতীয়বার যাতে সে কথা না তুলে সে ব্যাপারে হুশিয়ার করে দেন। বিত্তবান বন্ধুর কাছে উদারতা আর মহত্ব না পেয়ে গরীব অল্পশিক্ষিত বন্ধু চরম অপমানিত হন। আবার কোন ব্যক্তি ধনী লোকের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হবার পরে, গোঁয়ার্তুমি মিশ্রিত অহংকারের দাপটে আপন নিকটাত্মীয়কে পর বানিয়ে চালিয়ে দেয়। অথচ এসব অধ্যবসায়ী ব্যক্তি যদি মহত্বের পরিচয় দিত, নিজের জীবনে অজানা অধ্যবসায়ের কথা অকপটে বলত, তাহলে কত যুবক তাদের পথের দিশা পেত, তার জুড়ি মেলানো কঠিন। পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ী মর্যাদাকে রক্ষা করতে গিয়ে অনেকে অপ্রকাশিত অথচ শিক্ষণীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা প্রকাশ করেনা!

আমার জীবনে আমি একজন বন্ধুবৎসল ব্যক্তি। দীর্ঘ জীবনে নিজের কারণে কারো সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়েছে, এমন কাউকে মনে করতে পারিনি। সবাইকে আমি আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করি ফলে অচিরে সবাই অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠে। বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে যখন মূল্যায়ন হিসেবে শুনতে পাই তুমি একটা ‘পিকুলিয়ার মানুষ’। তোমার উদাহরণ তুমি নিজেই। প্রবাস জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশেও যখন নতুন বন্ধুরা বলে বসত তোমার কাজ ও চরিত্র আসলেই ভিন্নতর, তুমি একজন ‘পিকুলিয়ার’ ব্যক্তি কিনা, তাই তোমার পক্ষে অসম্ভব ও সম্ভব হয়! এটি সুনাম না দুর্নাম তা আজ অবধি বুঝতে পারিনি, এটাই আমার জীবনের চরম ব্যর্থতা! বন্ধুদের এই ধরনের তির্যক মন্তব্যে কখনও যে কম বেশী আহত হইনি, ব্যাপারখানা এমন নয়! তবে হলফ করে বলতে পারি পিকুলিয়ার বদনামী কাটাবার জন্য অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছি। এক সময় মনে হল, ব্যাপারটি দক্ষতার সাথে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি! সময়ের ঘাঁটে-বাঁকে, বাস্তব জীবনের টানা-হেঁচড়ায় ও সংসার জীবনের প্যাঁকে পড়ে যখন গৃহিণীর কাছে শুনতে পাই, ‘তুমি না একটা পিকুলিয়ার মানুষ’! তখন আর নিজেকে অবিশ্বাস করতে পারিনা যে, আসলেই আমি একজন পিকুলিয়ার (peculiar) তথা অন্য ধরনের মানুষ! ইংরেজীতে peculiar শব্দের অর্থ অন্যধরণ, অদ্ভুত, ব্যতিক্রমী, কেমনতর, অসাধারণ, অসামান্য ইত্যাদি অভিধায়ে তির্যক ভাবে যেভাবেই বলা হোক না কেন এত্তসব শুনতে শুনতে আমার গা সওয়া হয়ে গিয়েছে, তাই ভাবি অতি সম্মানী মানুষের আলখেল্লা গায়ে চড়িয়ে লাভ কি? সংসার, বস্তু ও বাস্তব জীবনের আলখেল্লার ফাঁদে আটকানো ঘটনাগুলোর রসি একটু ঢিলে করলে, জীবনের মূল প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠবে। একজন পিকুলিয়ার মানুষের চলার রাস্তা খুলে যাবে, বন্ধনহীন হবে সবার পথচলা; এতে রূঢ় বাস্তবতার করুন ছবি সবার দৃশ্যপটে ভেসে উঠবে।

আমার স্মরণশক্তি কিছুটা কম হলেও চেষ্টা করলে ভাল রেজাল্ট করতে পারতাম। দুষ্টুমির বদনাম কমবেশি ছিল। এসব দুষ্টুমি বেয়াদবির মত ছিলনা, কিছুটা বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের মাধ্যমে ঘটত। সুনাম ছিল, তাই স্কুলের স্যার এবং সমাজের মুরুব্বীদের কাছে খুবই আদরণীয় ছিলাম। আমার চোখের সামনে কারিকরি বিদ্যার কিছু ঘটতে দেখলে তা হুবহু মনে রাখতে পারতাম। ছোট কাল থেকেই অতি কৌতূহলী মন নিয়ে বড় হয়েছি। কারিকরকে কাজ করতে দেখলে, ম্যাকানিক কে কিছু জোড়া-তালি দিতে দেখলে, মা-ফুফুদের আলু ছিলতে দেখলে সব কিছু বিলক্ষণ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতাম। হরহামেশা চারিপাশে চলতে থাকা এসব কাজ সমাজ জীবনে তেমন একটা গুরুত্ব বহন করেনা। তবুও আমি এসব কাজ গভীর মনে অবলোকন করতাম! অনেকের কাছে এসবে মন দিয়ে সময় নষ্ট করার কোন মানে নেই! কিন্তু এই উত্তর আমার কাছে অবিচার মনে হত। একটি নাঙল বানিয়ে অতঃপর দুইটি গরু কে বশ করে, সেই নাঙল জোড়া গরুর পিছনে জুড়ে দিয়ে, একজন চালাক মানুষ জমির মাটির আলগা করে চাষ করে! দৃশ্যত এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা, তবু আমি এটার পিছনে ভাবতে গিয়ে সময় নষ্ট করেছি! বন্ধুদের দৃষ্টিতে এই অপ্রয়োজনীয় অতি ভাবনার কারণেই আমাকে ‘পিকুলিয়ার’ ব্যক্তি বানিয়ে ছেড়েছে। কিন্তু ঘটনার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আমি যে শান্তি পাইনা, সেটা তাদের কি করে বুঝাই? ছোটবেলা থেকেই নতুন কিছু দেখলেই ভাবনায় পড়ে যেতাম, একপর্যায়ে ভাবনার গভীরে ঢুকে যেতাম। আমার এই চরিত্র নিয়ে বাবা-মায়ের দুঃচিন্তার অন্ত ছিলনা। বাড়ীতে ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিম, বৈদ্যের হাট বসত। আমার উপর বদ জ্বীনের নজর পড়েছে, এই বদনামীর দোহাই দিয়ে মৌলভী মালেক প্রতি মাসের এক সপ্তাহের বাজার খরচ অন্তত আমার মায়ের তাবিজ কেনার মাধ্যমেই হয়ে যেত! বাবা-মা কত বিনিদ্র রজনী আমার ভাল ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে কান্না করেছেন তার ইয়ত্তা নাই, এসব এখন মনে পড়লে খুবই ব্যথা পাই।

একদিন মা প্রশ্ন করেন, বাবা তুমি কি করতে চাও? আমার সোজা সাপ্টা উত্তর ছিল, ‘আমি অবিরাম চিন্তা করতে চাই’! উত্তরে মায়ের বিষণ্ণতা আরো বেড়ে যেত। একটু চান্স পেলেই আমি চিন্তায় নিমগ্ন হতাম! এতে আমার ভাল লাগত। একদিন বাবা প্রশ্ন করেন, তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? আমি উত্তরে বলেছিলাম, ‘সাধু হতে চাই’! বাবা যেন আসমান থেকে পড়লেন! জীবন গড়ার জন্য আমি কি রকম টার্গেট বানিয়েছি! বাবার পাল্টা প্রশ্ন, কেন তুমি সাধু হবে? উত্তরে জানালাম, সাধু কমলা-নন্দ বহ্মচারী ও তার জীবন ধারা আমার খুব পছন্দ! আমরা মুসলিম হলেও, সামাজিক প্রয়োজনে বাবাকে সবার সাথে মিশতে হত। স্থানীয় হিন্দু, বৌদ্ধদের সাথে মেলামেশা ছিল। কমলা সাধু বাবাকে খুব পছন্দ করতেন এবং বাড়িতে আসতেন। আমি বাল্যকালে যে অবয়বে কমলা-নন্দকে দেখেছি, আমার পিতাও তাঁর বাল্যকালে কমলা-নন্দকে সেই অবয়বে দেখেছেন। আমার দাদার সহপাঠী কমলা সাধু দীর্ঘদিন বেঁচেছিলেন। কেন জানি সাধুর অনাড়ম্বর চাল চলন আমার ভাল লেগেছিল! এসব কারণে আমার বাবা-মায়ের দুঃচিন্তা দিন দিন বেড়েই চলত। এসব ব্যাপার নিয়ে কারো সাথে আলাপ করে, সুন্দর সমাধান করবেন ব্যাপার খানা এমন ছিলনা। বাবা আমার সাথে বন্ধুত্ব বাড়িয়ে দেন এবং বুঝাতে থাকেন, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, তাই মানুষ সাধু হবে এটা আল্লাহর পছন্দ নয়। পৃথিবীর কোন জ্ঞানী ব্যক্তি সাধু ছিলেন না! পৃথিবীকে গড়ার জন্য যারা অবদান রেখেছিলেন তাদের কেউ সাধু নন! এমনকি পৃথিবীর কোন নবীরাও সাধু ছিলেন না। দৃশ্যতঃ সাধু জীবনটা সহজ সরল মনে হলেও ওদের জীবনে হতাশা, অমিল আর সত্য মিথ্যার দ্বন্ধ প্রকট। বাবার আন্তরিক উপদেশ কাজে আসে। তিনি আমাকে বেশী করে সময় দেওয়া শুরু করলেন। আমার যত শত প্রশ্ন আছে তার সাধ্য মত উত্তর দেবার চেষ্টা করলেন। বাকি প্রশ্নের উত্তর ঘোচাতে তিনি বইয়ের সন্ধান করে দিলেন। তিনি আলবৎ বুঝতে পারলেন, বইয়ের অস্ত্রে আমাকে কাবু করা সহজ যাবে। আমি যাতে আরো বই পড়ি সেজন্য বই সংগ্রহের উৎসগুলো আমার জন্য সহজ করে দেন। বই পড়ুয়া কয়েকজন ভাল বন্ধু জুটিয়ে দেন। এতে আমার চিন্তার রাজ্যে বিচ্ছেদ ঘটল এবং বইয়ের প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হলাম। এখন আমিও বাবা হয়েছি, প্রিয়তম বাবার দুঃচিন্তা ও কষ্টের দিনগুলোর কথা বারে বারে মনে পড়ে যায়। আমার চারিপাশে এমন কোন জিনিষ বাকি নাই, যা দেখলে বাবা-মায়ের সাথে কোন এক তিক্ত-মধুর সম্পর্কের কথা মনে না পড়ে যায়।

বই ভাল লাগত, এখনও লাগে! গিন্নী বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘ইস্ আমি তোমার গিন্নী না হয়ে যদি বই হতাম, তাহলে তোমার অনেক বেশী নজরে থাকতাম’! কথার ফাঁকতালে সংসার আর পারিবারিক কথা ঢুকে গেল! যাক, সহজ বই, কঠিন বই, পৌরাণিক বই, যাদুর বই, তাবিজের বই, গল্প-উপন্যাসের বই, দার্শনিকের বই, এমনকি ধর্মীয় বই কোনটাই আমার রুচি ও রুটিন থেকে বাদ যেত না। প্রেম ও কবিতার বইয়ে আকর্ষণ কম ছিল। তবে ছয়ফূল মুলক বদিউজ্জামাল, সোনাভান, জঙ্গনামার প্যাঁচালো শব্দের পুঁথি পড়তে মন্দ লাগত না! আমার বই পড়া রোগের কথা স্কুল জীবনের সকল শিক্ষক মহোদয়গন ভাল করেই অবহিত ছিলেন। শিক্ষকেরাও আমার সংগ্রহ থেকে বই ধার নিতেন। তাঁদের সন্তানদের জন্য কোন বইটি উপযুক্ত হবে, সেটার জন্যও পরামর্শ চাইতেন। আমার এই চরিত্রকে শিক্ষকেরা ইতি বাচক হিসেবে দেখতেন, তবে আমার বই পছন্দ করার পক্রিয়ার মধ্যে বাধ সাধতেন। তাঁরা বাজারের পুরানা যুগের কবিতা, পুঁথি পড়তে নিরুৎসাহিত করে দস্যু বনহুর, দস্যু শাহবাজ, মাসুদ রানা পড়তে বলতেন! একসময় বইয়ের অভাব দেখা দিত। বাবা-মা বইয়ের জন্য টাকা দিলেও, মফস্বলের একজন ছাত্রের জন্য শহরে গিয়ে পছন্দনীয় বই সংগ্রহ করাটা কিছুটা কষ্টকর ছিল।

বইয়ের জন্য বিভিন্ন প্রকাশনীতে চিঠি লিখতাম। সেবা প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন সাহেবকে বইয়ের জন্য পত্র দিয়েছিলাম। তিনি উত্তর সমেত ডাকযোগে বই পাঠাতেন। ১৯৮৬ সালে আমার ব্যক্তিগত দুর্লভ সংগ্রহের জন্য পুরানো বইয়ের চাহিদার কথা উল্লেখ করাতে তিনি আমার জন্য ঘেঁটে ঘেঁটে ১৯৭৮ সালের আগে পরে প্রকাশিত বইগুলো পর্যন্ত ডাকযোগে পাঠিয়ে সহযোগিতা করেন! একদা এক ফেরিওয়ালার সাথে পরিচয় ঘটল, তিনি গ্রামে গঞ্জে গিয়ে কাঁচের বোতল ও পুরোনো কাগজের বিনিময়ে বাচ্চাদের ঝালমিটাই খেতে দিতেন। তিনি শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন না, তাই বইয়ের প্রকারভেদ বুঝতেন না! মণ দরে সংগৃহীত বই খাতা বাজারে বিক্রি করে দিতেন। তাঁকে ধরায় কাজ হল! তিনি কথা দিলেন যে, ওজনে সমুদয় বই বিক্রি করে দেবার আগে অন্তত তার বইয়ের স্তূপ একবার আমাকে দেখাবেন। তার জোগাড় থেকে আমার পছন্দনীয় বই গুলো ভাল দামে কিনে নিতাম। খেয়াল করে দেখলাম, এই ব্যক্তির দ্ধারা আমার কাছে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও জ্ঞানের বইয়ের চেয়ে; তাবিজ, কবজ, মন্ত্র, যাদু-টোনার বইয়ের এক সংগ্রহ গড়ে উঠল। আমার কাছে এসব দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ দেখে বাবার মাথায় আসমান ভেঙ্গে পড়ল। তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, কিভাবে ছেলের মাধ্যমে নিজের ঘরে, নিজের অজান্তেই গোপনীয় বইয়ের এক সংগ্রহ শালা গড়ে উঠেছে! এসব বইয়ের কিছু বাংলায়, কিছু হিন্দি, কিছু উর্দু, কিছু পার্লিতে লেখা। স্থানীয় ভাষায় পার্লির নাম ‘মঘা’ শাস্ত্র’। বাংলা ব্যতীত অন্য বইগুলো বুঝা দুরহ ছিল, তবে এই বই গুলোতে তাবিজ, কবজের বিভিন্ন চিহ্ন আঁকা ছিল। এসবের নানা চিত্র মানুষের বাড়ী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা জটিল রোগীর ঘরে টাঙ্গানো দেখেছি। এসব কাউকে ধুয়ে পানি পান করতে দেখেছি, কাউকে পেঁছিয়ে তাবিজ হিসেবে ধারণ করতে দেখেছি! ঝালমিঠা বিক্রেতা বিরাট অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত, বাচ্চাদের মিঠাইয়ের লোভ দেখিয়ে বই সংগ্রহ করত। বাচ্চারা মিঠাই খাওয়ার লোভে, মুরুব্বীদের অজান্তে বইগুলো ফেরিওয়ালার কাছে হস্তান্তর করে দিত! সে সবের অনেকগুলো বই আমার হাতে চলে আসে। পরবর্তীতে এসব বই আমার জীবনকে চরম ঝুকিময় করে দিয়েছিল। ততদিনে আমি মাসুদ রানা থেকে চোখ ফিরিয়ে তাবিজের বইয়ের প্রতি দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে ফেলি!

যাক, জীবনের এই পর্যায়ে এসে সময়ের হিসেব মিলাতে গিয়ে দেখি অনেক গড়মিল! অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতায় নিজেকে পেঁছিয়ে ফেলেছিলাম। সবশেষে আজীবন পিতা-মাতার সবচেয়ে আদরণীয় সন্তান হয়ে থাকতে পেরেছিলাম। ব্যক্তি জীবনে একজন সুখী মানুষ হিসেবে এসব এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। তারপরও ভাবলাম আলখেল্লার ভিতরের কিছু অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলে হয়ত অনেকে উপকৃত হতে পারে। তাই নিজের গায়ে আঁচড়ের ঝামেলা মাথায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ধারাবাহিক ভাবে কিছু তথ্য প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করব। যদি আল্লাহ আমাকে সাহায্য ও সুযোগ করে দেন।

পরবর্তী পর্ব: তাবিজের বালক! (ধারাবাহিক রোমাঞ্চকার কাহিনী, পর্ব - ১)

বিষয়: বিবিধ

৪৪৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File