জামায়াত কে 'আন্ডার ইষ্টিমেট' করাই সরকারের কাল হয়েছে! এখন সর্বনাশের বাকি
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৫:৩৭:৩০ বিকাল
সরকার কর্তৃক জামায়াতকে সমাবেশ করতে দেবার নয়টি কারণ ও দশটি ফলাফল নিয়ে রচনাটি রচিত
গত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে জামায়াত একটি সমাবেশের ঘোষণা করেছিল। সেই সমাবেশের অনুমতি চেয়ে পুলিশের কাছে আবেদন করেছিল। জামায়াত তখন একথা ও বলেছিল যে, যদি সমাবেশের অনুমতি না দেয় তাহলে পরদিনই হরতাল ডাকবে। পুলিশ জামায়াতের আবেদনে কোন সাড়া দেয়নি, অধিকন্তু খুবই তাচ্ছিল্য সহকারে সংবাদ মাধ্যমকে জানায় যে, জামায়াতের অফিসে ফোন করে কাউকে পায়নি, তাই কথাবার্তা বলা যায়নি। বলা বাহুল্য জামায়াতের প্রতিটি অফিস পুলিশি নির্যাতনে দুই মাস ধরে বন্ধ। সঙ্গত কারণে জামায়াত পরদিন হরতাল আহবান করে। জামায়াতে অভূতপূর্ব কড়া হরতালে সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে, জনজীবন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। বগুড়ায় দুই জন জামায়াত কর্মী সহ সর্বমোট চার জন নিহত হয়। সুশীল সমাজ ও তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি না দেবার কারণে সরকারকে আদরণীয় ধোলাই করেন। অর্থাৎ তাদেরকে হরতাল করতে দেবার চেয়ে হাজার খানেক মানুষের সমাবেশ করতে দেওয়া অনেক উত্তম ছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় সপ্তাহ না যেতেই জামায়াত ৪ ফেব্রুয়ারি আরেকটি সমাবেশের ডাক দেয়। একই সাথে জামায়াত ঘোষণা দেয়, সমাবেশের অনুমতি না দিলে হরতাল ডাকা হবে। পুরো দিন দোটানায় দিন পার হয়, অন্যদিন পুলিশ বক্তব্য দিলেও এই দিন কোন নড় চড়ের লক্ষণ দেখা গেলনা। দিনের শেষে সন্ধ্যায় হঠাৎ করে পুলিশ জামায়াত নেতাকে ফোন করে বলে দেন আগামী কাল সমাবেশ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে পুলিশ স্থান পরিবর্তন করে দেন, এবং সময়সীমা বেধে দেন। একটি সমাবেশের জন্য ব্যাপক পূর্ব প্রস্তুতির দরকার হয়। জামায়াতকে সেটা না দিতে সরকারের এই সিদ্ধান্ত। মূলত জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি প্রদান করা নিয়ে অনেক কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা ঘটে। এই অনুমতি প্রদানে বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ পর্যন্ত আশ্চর্য হয়ে পড়ে, যার রেশ এখনও যায়নি। জামায়াত-বিএনপি তো বটেই খোদ আওয়ামীলীগের অনেক নেতা পর্যন্ত হতচকিয়ে যায় সরকারী এই সিদ্ধান্তে। তবে লক্ষণীয় বিষয় ছিল যে, সরকারী দলের কোন নেতা এই অনুমতি প্রদান নিয়ে সমালোচনা করেনি। তার পরদিন পত্র পত্রিকায় আসল বিষয় ছিল এটি।
যাক, সরকারের খুবই উঁচু মহল নিরাপত্তা সংস্থার পরামর্শে কয়েকটি কারণে জরুরী ভিত্তিতে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিল। তবে পরবর্তীতে দেখা গেছে, যে সব কারণকে সামনে রেখে সরকার এই পলিসি খেলেছিল তার প্রতিটি পয়েন্টে সরকার চরমভাবে ধরা খেয়েছিল। সে সব কারণ গুলো বিস্তারিত তুলে আনা হল।
সরকারের আশাগুলো ছিল এমন:
১. হঠাৎ প্রস্তুতিতে জামায়াত কি পরিমাণ লোক সমাগম করতে পারে তার একটি সাংগঠনিক ভিত্তি জানা ও আন্দাজ অনুমান করা। সরকার নমনীয় হয়েছে বলে তাদের মনে একটি আশার আলো জাগিয়ে তোলা। তোমরা নবীনদের সাথে সরকারের কোন ঝামেলা নাই, যত ঝামেলা বুড়োদের নিয়ে। তারপরও কাদের মোল্লার রায় তেমন জটিল কিছু হবেনা, কর্মীদের মনে এমন ধারনা ঢুকিয়ে দেওয়া।
২. জামায়াতের নেতা কর্মীদের মেরে-ধরে সরকার ইতিমধ্যে জেলে ঢুকিয়েছে। জামায়াতের কিছু ডেডিক্যাটেড কর্মীর কারণে হয়ত হরতাল সফল হয়। তবে পুলিশি নির্যাতনের ভয়ে, পরিবর্তিত স্থানে হঠাৎ ঘোষিত সমাবেশে তেমন লোক সমাগম হবেনা। আর যারা সমাবেশে আসবে তাদের সবাই পাক্কা জামায়াত, সুতরাং প্রয়োজন পড়লে এলোপাথাড়ি মারধর, আক্রমণ করলে জামায়াতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে, ফলে নির্বিচার আক্রমণের সুযোগ বানানো। যার কারণে সরকারের কোন নেতা এই সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ করেনি।
৩. জামায়াতের আবেদন করা স্থানে অনুমতি না দিয়ে এমন এক স্থানের অনুমতি দিয়েছে যার মুখ ভরতে প্রচুর মানুষের দরকার হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এমনিতেই কাউকে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়না কিংবা কেউ চায়না। তাছাড়া স্থানটি পুলিশি নজর দারীর জন্য খুবই উৎকৃষ্ট এবং গোলমাল হলে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ করা সহজ হবে।
৪. সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কাদের মোল্লার রায় দিবে। তবে ঘোষণা করার জন্য একটি যুতসই তারিখ খোজ করছিল। তারা সিদ্ধান্ত নেয় সমাবেশের আগেই ঘোষণাটি দিবে। এতে জামায়াত কর্মীদের প্রতিক্রিয়ার ধরন আন্দাজ করা যাবে। যেহেতু সমাবেশ স্থলে প্রচুর পুলিশ ও সংবাদ কর্মী থাকবে সেহেতু জামায়াতের উত্তেজনার মুহূর্ত গুলো জাতি দেখবে এবং আন্দোলন হলে ঘটনাস্থলেই দমিয়ে দিবে। প্রয়োজন হলে সেই স্থান, পরিকল্পিত ভাবে অনেক নেতাকে আটকানো সম্ভব হবে।
৫. গণ্ডগোল হোক বা না হোক নেতাদের কে ট্রাক করা সহজ হবে। এসব নেতারা কোত্থেকে উদয় হয় আর কোথায় অস্ত যায়? বহু দূর থেকে নজর রাখা সহজ হবে এবং সাদা পুলিশের গোয়েন্দা দীর্ঘক্ষণ পিছু নিতে পারবে।
৬. তাছাড়া এই স্থানে হাজার খানেক মানুষ জড়ো হলেও, পরিমাণে দেখতে তা অল্পই দেখা যাবে। এতে জামায়াত কর্মীরা মনোভঙ্গ হবে এবং উপস্থিত দর্শক ও টিভি দর্শকের হাসির খোরাকে পরিণত হবে।
৭. বিএনপির মাঝে সন্দেহ সংশয় ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। এমনিতেই বদনাম আছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কি আলোচনা হয়, কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা দলের নেতারা জানার আগে সরকার জেনে যায়। আরো খোলাসা করে বললে বলতে হবে, ‘বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির কোন একজন সরকারের এজেন্ট’। জামায়াতকে অনুমতি প্রদানের কথা ও সংশয় দুটোই তার মাধ্যমে দলীয় প্রধানের কাছে পৌঁছানো যাবে। মূলত এই সংশয়ের ব্যাপারটি খুবই ফলদায়ক হয়েছে। বিএনপির সেই ঘোর এখনও কাটেনি।
৮. জামায়াত যদি শান্তিপূর্ণ একটি সমাবেশ করে ফেলে সরকার দ্বিমুখী ফল নিবে। যেমন, পুলিশের অধিক সতর্কতার জন্য গোলমাল হয়নি। আমরা জামায়াতকে সমাবেশ করতে দিতে চাই, তারাই যত অসভ্যের হোতা। অধিকন্তু নেতাদের অবস্থান উদ্ধার করা সরকারের জন্য খুবই দরকারি ছিল।
৯. উপস্থিত সরকার আশা করেছিল, রায় ঘোষণার তারিখ নিয়ে অন্তত সমাবেশ থেকে কোন একটি কর্মসূচী আসুক। এতে কিছু কর্মী উত্তেজিত হয়ে ভুল করে বসবে। পুলিশ একটি সিদ্ধান্ত নিবে, সে জন্য তাদের শতভাগ প্রস্তুতি মজুদ ছিল।
ফলাফল:
১. হঠাৎ ঘোষণা পাবার পরও জামায়াত কর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠে এবং নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সমাবেশে যোগ দেবার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। তারা স্ব-ইচ্ছায় খুবই আনন্দ উৎফুল্লের সাথে সমাবেশে যোগ দিয়েছে।
২. সমাবেশে কোন অঘটন ঘটেনি, নেতা কর্মীরা সবাই সচেষ্ট ছিল একটি সুন্দর সমাবেশ উপহার দিতে। টিভিতে সুন্দর পরিবেশ দেখে কর্মীরা দলে দলে সমাবেশের শেষ পর্যন্ত আসতে থাকে।
৩. শিবির পুলিশের মাঝে এই ম্যাসেজটি পৌছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে যে, তোমাদের সাথে আমাদের শত্রুতা নাই। তোমরা আমরা ভাই ভাই। সরকার মুখে আইসক্রিম নিয়ে এসি রুমে বসে তোমাদের আর আমাদের দাঙ্গা উপভোগ করে। সরকার দলীয় কিছু অফিসার উচ্চ মাসেহারার বিনিময়ে তোমাদের এই কাজে নিবদ্ধ করে এবং আমাদের সাথে চিরস্থায়ী শত্রুতার বীজ বপন করে।
৪. শিবিরের কর্মীরা বিনীতভাবে পুলিশের হাতে তাদের লিফলেট, ফুলের ষ্টিক তুলে দিয়ে আন্তরিকতা করার ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
৫. জামায়াত নেতারা গোপন ঘরে অবস্থান না করে, যুদ্ধাপরাধের রায়ে অন্যায় ফলাফল আসলে কি পরিণতি হবে সরকারকে তা প্রকাশ্যে বলে দিতে সক্ষম হয়েছে। সরকার খুবই ধৈর্য ধরে তাদের হুমকি হজম করেছে।
৬. গণমাধ্যম জামায়াতকে নিয়ে পূর্বের মত ধারণা পোষণ করলেও টিভি চ্যানেল সহ সকল গণমাধ্যম জামায়াতের কর্মসূচী গুলো ইচ্ছার বিরুদ্ধে হুবহু প্রচার করেছে। এতে পুরো দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কর্মীরা উজ্জীবিত হয়েছে, তারা আরো খবরের জন্য সংবাদ মাধ্যমের প্রতি নজর রেখেছিল।
৭. জামায়াতের সমাবেশে ব্যাপক মানুষ উপস্থিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। প্রত্যেক নেতা কর্মীর চোখ মুখে এই অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল যে, পুলিশ হামলা করলে জবাব দিতে তারা প্রস্তুত।
৮. জামায়াত নেতারা আরো ও উজ্জীবিত হয়ে উঠেন। গতিশীল একটি দলের কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য উপস্থিত কর্মীরাই যথেষ্ট। যারা আসেনি তাদের না আসতে বারণ করা হয়। নেতাদের প্রতি কর্মীদের আস্তা ও দায়িত্বশীলতা দেখে কঠোর কর্মসূচী সফল হবার লক্ষণ দেখে।
৯. সাফল্য জনক এই সমাবেশ জামায়াতের সকল কিশোর-যুবক-পৌঢ় থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের কর্মীদের ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত করে, প্রাণশক্তি যোগাড় করে এবং আসল ময়দানে লড়াই করার জন্য নিজেদের মেপে নিতে সক্ষম হয়।
১০. হঠাৎ নীতি পরিবর্তন, সমাবেশের অনুমতি প্রদান, পুলিশী দমন অভিযান না চালানো, প্রকাশ্য জনসভায় সরকারের কড়া সমালোচনা, সরকারকে সুস্পষ্ট হুমকি প্রদান এমনকি খোলাখুলি জামায়াত নেতারা সরকারের বিভিন্ন নেতাদের দেখে নেবার ইচ্ছা প্রকাশ সহ নানা বক্তব্য নিয়ে সরকারের মাঝে বাদানুবাদ শুরু হয়। সংসদে নিজেরা নিজেদের মাঝে মনের ঝাল মেশান। এর খেসারত সরকারকে হরতালে দিতে হয়েছে। আগে জামায়াত কে নিয়ে গালভরা বক্তব্য দিলেও এবার জামায়াতে জন শক্তিকে সরকার হালকা-ভাবে নেয়নি তাই আধা সামরিক বাহিনী রাস্তায় নামিয়েছে।
পরিশেষে সরকার নিজেই স্বীকৃতি দিল জামায়াততে আন্ডার ইষ্টিমেট করা ভুল হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীকে বিচলিত করেছে এসব পরিস্থিতি। তিনি হুমকি দিয়েছেন জামায়াতের প্রতি। অথচ তাঁর হুমকির কোন মূল্য জামায়াতের নিকট নাই, কেননা অতীতে তিনি কোনদিনই একটি মুহূর্তের জন্য জামায়াত বা শিবিরের বন্ধু ছিলেন না। সরকারী ভুল সিদ্ধান্ত ও হঠকারীতায় প্রমানিত হয়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণীতে জামায়াতে ইসলামী কে অবশ্যই হিসেব করে গুনতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৭৫৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন