মায়ের ভাষা বাংলা! লড়াই করে টিকে থাকা যার লিখন
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৪:০৪:২৯ বিকাল
ভাষার সূত্র ধরে একটি জাতিকে কব্জায় রাখা অনেক সহজসাধ্য। যার ফলে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বৃটিশ সরকারের আদেশে পাঠ্যশিক্ষা সিলেবাস রচনা করতে গিয়ে, শুধুমাত্র সাংস্কৃতি শব্দ বহুল প্রবন্ধকেই প্রাধান্য দেন। এতে শুধুমাত্র হিন্দু সাহিত্যিকদের লিখাই সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত হয়। আরবী, ফারসী, উর্দু, তুর্কি শব্দযুক্ত প্রবন্ধ সমূহ তালিকা থেকে বাদ দেন। এতে মুসলিম সাহিত্যিকদের লিখা কৌশলে সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করেনি। যেভাবে বাংলা ভাষা আরবী, ফারসী থেকে উৎপত্তি হয়নি, সেভাবে বাংলায় সাংস্কৃতি শব্দের প্রভাব থাকলেও সরাসরি সাংস্কৃতি থেকেও উৎপত্তি হয়নি। এর ফলে দুই বাংলায় দুই ধরনের বাংলা ভাষা ব্যবহার শুরু হয়। সাধু চলিত নামে দুভাবে পৃথক হয়ে যায়। একটি হিন্দু তথা সাংস্কৃতি ভাষা নির্ভর, অন্যটি মুসলিম সাহিত্য নির্ভর ভাষা হয়ে যায়। ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও জনগণের শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে কখনও নতুন করে দেশ, ভূখন্ড ও জাতির সৃষ্টি হয়। সে কারণেই বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বাংলা ভাষায় নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরও; মহাত্মা গান্ধীকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন শুধু হিন্দিকেই যেন রাষ্ট্রভাষা করা হয়!
বাংলাভাষার রয়েছে একটি করুন অতীত ইতিহাস। পাকিস্থানীরা যেভাবে বাংলাভাষাকে গুরুত্ব দিতে চায়নি, বাংলার মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্যকে হেয় ও তামাসা করেছিল ঠিক সেভাবে মধ্য যুগের সেন বংশের রাজারা ও বাংলা ভাষাকে পক্ষীভাষা বলে ঘৃণা করত। পাকিস্থান সরকার যেভাবে সরকারী কাজে জন্য বাংলাকে প্রয়োজন মনে করেনি। ঠিক সেভাবে সেন বংশের রাজত্বে সরকারী কর্মচারীরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করার অপরাধে চাকুরী হারানোর সাথে নির্যাতন জুটতো। পাকিস্তানীরা যেভাবে বাংলার উপর উর্দুকে চাপাতে চেয়েছিল সেভাবেই বহিরাগত রাজা বল্লাল সেন বাংলার উপর সাংস্কৃতিকে চাপাতে চেয়েছিল। যেভাবে পাকিস্থান সরকার জোড় করে বাংলা ভাষার স্থলে উর্দুকে চাপিয়ে দিতে রফিক, সালাম, জাব্বার, বরকতের রক্ত নিয়েছিল; ঠিক সেভাবে সেন রাজারা বাঙ্গালোর থেকে শত শত পন্ডিত এনে নির্দয় ভাবে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সাংস্কৃতি ভাষাকে গেলানো হত! বাংলাকে পক্ষী ভাষা তথা মুর্খদের ভাষা বলে তাচ্ছিল্য করা হত। ভাগ্যগুনে চর্চাপদ নামে একটি বাংলা বই নেপালের রাজ দরবারে আশ্রয় পেয়েছিল, সেটাই বাংলা ভাষায় লিখিত আদি পুস্তক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশে সুলতানী আমলে মুসলিম শাসকেরা বাংলাকে আবারো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তুলে এনেছিলেন। লক্ষ্যণীয় যে, সেন রাজারা দক্ষিণ ভারতীয় ছিলেন তবে তারা বাংলা ভাষাকে উচ্ছেদ করেন। আবার সুলতানী আমলের সুলতানেরা ও বিদেশী ছিলেন, তবে তাঁরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেছিলেন! এমন কি এসব সুলতানেরা বাংলাভাষা শিখেছেন এবং সে ভাষায় সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতেন। সুলতানি আমলে কৃত্তিবাস ওঝাকে ‘রামায়ন’ ও কাশীরামকে ‘মহাভারত’ বাংলায় অনুবাদ করার জন্য রাষ্ট্রীয় অনুদান দেওয়া হয়। বাংলার মত একটি ঘৃণীত তথা পক্ষী ভাষায় রামায়ন-মহাভারতকে বাংলায় অনুবাদের অপরাধে কৃত্তিবাস ও কাশীরামকে ‘সর্বনাশা’ উপাধী নিয়ে আজীবন অভিশম্পাত পেতে হয়। শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন তার লিখিত ‘বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন “আমাদের বিশ্বাস মুসলামান কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ই, বঙ্গভাষার সৌভাগ্যের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল”।
এভাবে বিভিন্ন জাতির আগ্রাসন কে মোকাবেলা করে বাংলা ভাষা টিকে আছে। এখন পুরো দুনিয়া এই ভাষাকে সম্মান করছে অথচ আমরা জাতি হিসেবে তাকে সে ধরনের মর্যাদা দিতে পারিনি। আজ ২১শে’র বেদীতে ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলী দেওয়া হয়, সেখানেও ভূল বানান লিখা হয়। জীবিতদের সম্মান নাইবা দিতে পারলাম, শুদ্ধ শব্দ লিখে যদি রফিক, সালাম, জাব্বার দের প্রতি সম্মান দেখাতে না পারি; তাহলে ত্যাগের প্রতি বড় অন্যায় করা হবে। তাদের কল্যাণে আজ সারা দুনিয়ার মানুষ আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে সম্মানিত করেছে আর আমরা করছি অবহেলা! বাংলাদেশে আজো বাংলা টিভি চ্যানেল গুলোতে প্রতিনিয়ত ভূল উচ্চারণ শুনতে শুনতে; শুদ্ধ শব্দটিকে ভুলতে বসেছি। বিশুদ্ধভাবে বাংলা ভাষা জানা থাকা স্বত্ত্বেও হাস্যপদ উচ্চারণে, ভুল ইংরেজী বলার প্রকোপ বাড়ছে। বিদেশী ভাষা শিখার কথা বলে, নোংরা-বিশ্রী, কদর্য অঙ্গ ভঙ্গির-হিন্দি সিনেমা দেখা হচ্ছে। নিজেদের খুবই উঁচু জগতের প্রাণী বুঝাতে ইংরেজী ও হিন্দীতে কথা বলার প্রকোপ বাড়ছে। বহু ভাষাবিধ জ্ঞান-তাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মত অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও ভাষা বিজ্ঞানীও কখনও অন্যের ভাষা নিয়ে এ জাতীয় কপটতা করতেন না। তিনি প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় কথা বলতেন এবং এটা নিয়ে গর্ব করতেন। তাই এখনও সময় আছে সজাগ হবার। যথা সময়ে সঠিক মূল্যায়ন না হলে, বাংলাভাষাকে যে আকাশের উচ্চতায় সম্মান দেওয়া হয়েছে, নতুবা তা অচিরেই সম্পূর্ণ মূল্যহীন-অর্থহীন হয়ে নিজেদের পদতলে মুখ থুবড়ে পড়বে।
বিষয়: বিবিধ
১৪৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন