আগা খান ও ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়: অখ্যাত গোত্রের বিখ্যাত কারবার
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ১৬ মে, ২০১৩, ০৫:৫০:৩৭ বিকাল
ঘটনার মুলে যাবার আগে বলতে হয়, শিয়া মতবাদ ইসলামী মূল স্রোতধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও খণ্ডিত একটি গোষ্ঠী। ইসলামের কিছু অংশ মানা, কিছু অংশ অস্বীকার করা, সত্যের সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ আবার মিথ্যাকে সত্য বলে চাপিয়ে দেওয়া প্রবণতাই হল শিয়া মতবাদের মূল ভিত্তি। শিয়া মতবাদ অনেক শাখা প্রশাখায় বিভক্ত, আবার সেখান থেকেও বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। সে সব মতবাদ বা গোষ্ঠীর মধ্যে একটির নাম ‘নিজারী ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়’। পৃথিবীতে এদের সংখ্যা কম হলেও আলোচনায় সর্বদা তাদের নাম সবার আগে চলে আসে। সচেতন মুসলমানেরাও এদের সম্পর্কে তেমন একটি ধারনা রাখেন না, কিংবা সঠিক তথ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকেন। মুসলমানদের আচরণের সাথে কিছুটা সাদৃশ্য থাকায়, এই সম্প্রদায়কে অনেকে মুসলিম মনে করে বিরাট ভূল করে। অথচ অনেকেই জানেন না যে, এদের কাজ ও বিশ্বাসের সাথে একমত হলেই, তার ঈমান নষ্ট হবে। আবার এদের খপ্পরে পড়লে বের হওয়াটা খুবই দুরহ! এরা খুবই শক্তিশালী, প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক। সংখ্যায় কম হলেও ক্ষমতার দাপট আকাশচুম্বী, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এদের নিয়ন্ত্রণ অবিশ্বাস্য জনক বেশী। তাদের সাথে ময়দানে লড়াই করা নয় বরং আল্লাহর প্রতি একত্ববাদ ও রাসুলের (সাঃ) প্রতি অনুগত মুসলমানদের নিজের ঈমান বাঁচানো ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে তাদের সম্পর্কে ধারনা রাখাটা খুবই জরুরী বলেই আজকের এই প্রতিবেদন।
আগা খানদের বংশীয় উৎপত্তি ও খ্যাতি:
হাসান আলী শাহ (১৮০৪ – ১৮৮১)
তিনি আগা খান-১ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এবং ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের ৪৬ তম ইমাম হিসেবে বিবেচিত। তিনি ইরানের খাহাকে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শাহ খলিল উল্লাহ ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের ৪৫ তম ইমাম। ১৮১৭ সালে প্রতিদ্বন্ধি আরেকটি শিয়া গ্রুপের ইমাম মুল্লাহ হুসাইন ইয়াজদির অনুসারীদের সাথে সংঘর্ষে, তিনি কতিপয় মুরিদ সহ নিহত হন। হাসান আলী শাহ ১২ বছর বয়সে একেবারে বাল্যকালেই তাঁর পিতা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ইসমাইলীয়া খেলাফত প্রাপ্ত হন। তাঁর মাতা ‘বিবি শার্কারা’ পুত্রকে নিয়ে দীর্ঘদিন ইরানের বিভিন্ন স্থানে স্বামী হত্যার বিচারর জন্য ধর্না দেন। বিবি শার্কারা স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ইরানের রাজা ‘ফাতেহ আলী’ শাহের কাছে নালিশ দেন। রাজা ফাতেহ আলী এই হত্যা কাণ্ডের বিচার করেন। এমনকি রাজা স্বীয় কন্যা ‘সৌরভ-ই-জাহান’ কে হাসান আলী শাহের সাথে বিয়ে দিয়ে তাঁকে ‘আগা খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অতপরঃ নতুন জামাতাকে ইরানের কোম নগরীর গভর্নর নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ইরানের কারমান প্রদেশেরও গভর্নর নিযুক্ত হন। ধারনা করা হয় আগা খান শব্দটি তুর্কি ভাষা থেকে আগত, যার অর্থ ‘মহা সম্মানিত’। হাসান আলী শাহ আরো রাষ্ট্র ক্ষমতার আশায়, আশে পাশের বিভিন্ন রাজ্যের সাথে ধন্ধ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। প্রথম দিকে রাজ্য জয়ে কিছুটা সফল হলেও চারিদিকে শত্রু বাড়িয়ে ফেলার কারণে, শেষ যুদ্ধে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের আশঙ্কায় তিনি তাঁর লোকবল নিয়ে আফগানিস্তানে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে আফগান সীমান্ত অঞ্চলের উপজাতি বিদ্রোহীদের নমনীয় রাখতে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ব্যবহার করে। ব্রিটিশের প্রতি তাঁর আন্তরিক কাজের ফল স্বরূপ, তিনি ব্রিটিশ রাজত্বের একজন নিরেট খাটি বন্ধু হিসেবে পরিগণিত হন। ব্রিটিশ রাজত্ব হাসান আলী শাহ’র বিশ্বস্ততার জন্য যথেষ্ট আস্থা-ভাজন ছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর অধঃস্থন বংশধরেরা উত্তরাধিকারী সূত্রে, নামের শেষে আগা খান লিখতে থাকেন। ব্রিটিশের কৃপায় এক পর্যায়ে তিনি তাঁর অনুসারী সহ ভারতের বোম্বে নগরীতে চলে আসেন এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আকা আলী শাহ (১৮৩০-১৮৮৫)
আকা আলী, আগা খান-২ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তিনি হাসান আলী শাহের জ্যৈষ্ঠ পুত্র এবং ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের ৪৭ তম ইমাম মনোনীত হন। তাঁর জন্ম হয় ইরানে। যেহেতু তাঁর বাবা কোম ও কারমান নগরীর গভর্নর ছিলেন এবং তাঁর মাতা রাজ কন্যা ছিলেন। সে হিসেবে ইরানী রাজ পরিবারে তিনি প্রিন্স খেতাবে বড় হয়ে উঠেন। আকা আলী তথা আগা খান – ২, ব্যক্তি জীবনে উচ্চ শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি উত্তরাধিকারী সূত্রে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রধান হন। পিতার ধর্ম প্রসিদ্ধি এবং মাতার রাজত্ব প্রসিদ্ধি তাঁকে বিশ্বময় পরিচিতি করে তুলে। তিনি পিতা-মাতার দুটি খ্যাতিকে দক্ষতার সাথে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। জন্ম লগ্ন থেকেই ব্রিটিশ রাজত্বের বাহুল্য ও আশীর্বাদ তাঁকে বেষ্টন করে রেখেছিল। একজন ধর্মীয় প্রধান হিসেবে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের পক্ষে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি প্রিন্স হিসেবে একাধারে প্রতিটি রাষ্ট্রের সম্মান নিয়েছেন আবার ধর্মগুরু হিসেবে নিরাপত্তা ও মর্যাদা গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তি হিসেবে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে পিতার চাইতেও অনেক বেশী আস্তা ভাজন হয়ে উঠেন এবং ব্রিটিশ রাজত্বের পক্ষে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। এর ফলে, ব্রিটিশের কনোলিয়াল দেশগুলো (যেসব দেশে ব্রিটিশের ক্ষমতা কার্যকর ও শাসন চালু ছিল) তথা আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যথেষ্ট প্রভাব তৈরিতে সক্ষম হন। ভারতে হিন্দু মুসলিম সমস্যায় নীতি নির্ধারক হিসেবে ব্রিটিশের বিশ্বস্ত হিসেবে, তিনি মুসলমানদের নেতা হয়ে ভারতীয় মুসলমানের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন! ১৮৮৪ সালে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ভারতের পুনেতে মৃত্যুবরণ করেন। চার বছর পরে তাঁর মরদেহ ইরাকের নাজাফ নগরীতে স্থানান্তরিত করা হয়। পরবর্তী বংশধর গন তাঁর পিতা ‘আগা খান’ পদবীর মত, আকা আলীর শাহ’র ‘প্রিন্স’ পদবীও বংশ পরম্পরায় ব্যবহার করতে থাকেন।
স্যার সুলতান মোহাম্মদ শাহ (১৮৭৫-১৯৫৭)
তিনি আগা খান – ৩ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। মাত্র ৮ বছর বয়সে শিশুকালেই পিতার নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের ৪৮ তম ইমাম মনোনীত হন। তিনি পাকিস্তানে করাচীতে জন্মগ্রহণ করেন। একজন ধর্ম গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার মত জ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জনের প্রতি তার মা সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। ইউরোপীয় শিক্ষার প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল। দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইসমাইলীয়াদের তিনি একত্রিত করেন। এ কাজে তিনি ব্রিটিশের সরাসরি সহযোগিতা ও পরামর্শ পেয়েছেন। ১৮৯৭ সালে রানী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ‘নাইট কমান্ডার’ উপাধি প্রাপ্ত হন। ১৯০২ সালে তাঁর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা আরো বেড়ে যাবার কারণে, ব্রিটিশ সপ্তম এডওয়ার্ড তাঁকে ‘নাইট গ্র্যান্ড কমান্ডার’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকেই তিনি নামের আগে স্যার সুলতান লিখতে থাকেন। স্যার শব্দটি ব্রিটিশের অন্ধ আনুগত্যের একটি সম্মানজনক স্বীকৃতি। এছাড়াও তিনি আরো অনেক খেতাব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। যেমন, নিজ সরকারের বিশ্বস্ত, চৌকস এবং সেরা কর্মকর্তা হিসেবে জার্মান সম্রাট তাঁকে খেতাব দেন। এমনকি তুর্কি সম্রাট ও পারস্য সাম্রাজ্য থেকেও তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকারোক্তি অর্জন করেন। ফলে তিনি পুরো ভারতে অসম্ভব ক্ষমতা বান ব্যক্তি এবং ব্রিটিশের নিকট শ্রেষ্ঠতম বিশ্বস্ত মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি হাসিল করেন! ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি আরব ও ইউরোপীয় ঘোড়ার সংমিশ্রণে উন্নত তেজি ঘোড়ার সংকর জাত সৃষ্টি করে দুনিয়া-বাসীকে চমক লাগিয়ে দেন। এসব ঘোড়া বাজারে বিক্রি করে, বহু মিলিয়ন ডলার অর্থ সম্পদের মালিক হন। প্রতিযোগিতার জন্য সংকর জাত ঘোড়া সৃষ্টি করার পদ্ধতি শুধুমাত্র তাঁর দখলেই ছিল। সংকর জাতের নতুন প্রজাতির ঘোড়ার সৃষ্টির পিছনে মেধা খাটাতে গিয়ে, তাঁর দৃষ্টি অন্যদিকে প্রসারিত হয়ে যায়। তিনি তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, নারী পুরুষ সবাইকে উচ্চ শিক্ষিত হতে হবে, তাহলে সম্পদ, খ্যাতি, ক্ষমতা পদতলে লুটিয়ে পড়বে। নামী-দামী বিদ্যালয়ে পড়তে হবে, তাহলে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সন্তানের সাথে পরিচিত হবে ফলে খ্যাতিমানদের সাথে বন্ধুত্ব হবে। তাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে, তাহলে পুরো পৃথিবীতে একটি ক্ষমতাশালী জাতি হিসেবে বেড়ে উঠতে পারবে।
তৃতীয় আগা খান তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও খ্যাতি দিয়েই পুরো ব্রিটিশ রাজত্বে, আফ্রিকা থেকে এশিয়ার বিশাল জনপদে, তার মতাদর্শের অনুসারীদের ক্ষমতার প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। সকল অনুসারীকে শিক্ষিত করে তুলতে তিনি শতভাগ সফল ছিলেন। আবার তাদেরকে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদে বহাল, পেশাদারী ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম কাউন্সিলে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে প্রথম প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন! পৃথ্বী কাউন্সিলের সদস্য ও লীগ অব নেশনের মেম্বার হিসেবে ভারতের হয়ে তিনি ব্রিটিশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ বহু টুকরায় বিভক্ত হয়ে যায়। মধ্য প্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, তাঞ্জানিয়া, উগান্ডা, জায়ার সহ পৃথিবীর বহু ভূ-খণ্ডের ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়কে রক্ষা, একত্রিত করা, ও স্বাবলম্বী করার কাজে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। পৃথিবী ব্যাপী পরিচিতি দিয়ে তিনি প্রতিটি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সহযোগিতা ও মনোযোগ কেড়ে নিতে পারদর্শীতা দেখান। দুনিয়া-ব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়কে একত্রিত করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিতে সক্ষম হয়েছেন। ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের রক্ষার নামে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা এই সম্প্রদায়কেই দিয়েছেন! ১৯৫৭ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা নগরীতে তৃতীয় আগা খান মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে মিশরের নীল নদ বিধৌত পর্যটন কেন্দ্র আসওয়ানে সমাহিত করা হয়। তিনি মৃত্যুর আগেই তাঁর সমাধি তৈরি করে রেখেছিলেন। মৃত্যুকালে একটি উইলে লিখে যান, ‘পারমাণবিক যুগের আধুনিকতায় সকল কিছুই বদলে গিয়েছে। তাই নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে, ইসমাইলীয়াদের রক্ষার্থে, নিজ সম্প্রদায়কে উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে, ১৩০০ শত বছরের নিয়ম রেওয়াজ ভঙ্গ করে, ছেলের ঘরের নাতি তথা করিম আগা খানতে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের ৪৯ তম ইমাম নির্বাচিত করা হইল’।
প্রিন্স করিম আগা খান – ১৯৩৬তিনি আগা খান-৪ হিসেবে প্রসিদ্ধ। যদিও তাঁর স্থান হত ৫ নম্বরে, তাঁর পিতা ও চাচাকে ডিঙ্গিয়ে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি চতুর্থ আগা খান হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ১৯৩৬ সালে সুইজার ল্যান্ডের জেনেভায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দাদার উইল মোতাবেক পিতা প্রিন্স আলী আগা খান ও চাচা প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খানকে টপকে মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৯৫৭ সালে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের ৪৯ তম ইমাম মনোনীত হন। ইউরোপের সবচেয়ে দামী প্রতিষ্ঠান সুইজারল্যান্ডের Institut Le Rosey School থেকে সদ্য বের হওয়া প্রিন্স করিম আগা খান ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় ইমাম তথা ধর্ম গুরুর দায়িত্ব পেয়ে যান। প্রধান ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পাবার দুই বছর পরে ১৯৫৯ সালে হার্ভাড ইউনিভার্সিটি থেকে কৃতিত্বের সাথে ইতিহাসে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন। তিনিই বর্তমানে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় ইমামের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক ফোবর্স ম্যাগাজিনের ২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রিন্স করিম আগা খান ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদের মালিক। পৃথিবীর সেরা দশ জন রাজকীয় ধনীর একজন তিনি। তাঁর অগণিত সম্পদ রাজির মধ্যে ব্যক্তিগত দুইটি গোলন্দাজ বিমান একটি বড় হেলিকপ্টার রয়েছে। নিজের বিমান ও নিজস্ব বাহিনী নিয়ে তিনি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেন। প্রিন্স করিম আগা খান জগত বিখ্যাত অনেক গুলো কোম্পানির মালিক ও পরিচালক। হোটেল, মিল, ফ্যাক্টরি, শিল্প কারখানা, চা বাগান সহ হেন কোন লাভজনক প্রতিষ্ঠান দুনিয়ায় বাকী নাই, যেখানে তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থান নাই। তাঁর নিজের কোন রাজ্য না থাকার পরও, পুরো দুনিয়াতে তিনি রাজার মত সম্মান কুড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে তাঁর উপাধী হচ্ছে, His Royal Highness the Aga Khan IV.
ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, দুনিয়ার বিত্ত-বৈভব ও আখেরাতের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন, দুটোই হল ইমানের মূল দাবী। তাই তাঁদের ইমামদেরকে, দুই জগতের খ্যাতি, যশ, ঐশ্বর্য, সম্পদ, সুখ লাভের জন্য; পরকালীন ধর্মীয় জ্ঞান যেমন দরকার। তেমনি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য; বুদ্ধি-ভিত্তিক দক্ষতা, তীক্ষ্ণ প্রতিভা, আধুনিক জ্ঞান, ব্যবসা-প্রশাসন ও বাণিজ্য ব্যবস্থা সম্পর্কেও পান্ডিত্য থাকতে হবে। বর্তমানে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের কাছে, ইহ জাগতিক ও পর-কালীন জ্ঞান, বিজ্ঞানে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি হিসেবে প্রিন্স করিম আগা খানের চেয়ে যোগ্য উত্তরসূরি আসলেই দ্বিতীয়টি নাই! তাঁর অগাধ সম্পদ রাজির পরিমাণ, তা অর্জন করার আধুনিক জ্ঞান, সুচারু পরিচালনা, সময়ের সাথে বানিজ্যের প্রতিযোগীতা, বিশ্বময় বাজার সৃষ্টি এবং অনুসারীদের হাতের মুঠোয় রাখতে পারার মাধ্যমে বুঝা যায়, তার যোগ্যতা দক্ষতার মান কোন পর্যায়ে! এই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ইমামদের সময়ে ধর্মীয় রীতি রেওয়াজে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজনের আলামত দেখা যায়। মাত্রাতিরিক্ত পরিবর্তনের দোলায় ইসলাম ধর্মের কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত এই গোষ্ঠীটি বর্তমানে প্রায় খৃষ্ট ধর্মের মত হয়ে গিয়েছে। তফাৎ শুধু, এদের কিছু আচরণ দেখতে এখনও মুসলমানের মত। তারা নিজেদের ইসমাইলিয়া মুসলমান দাবী করে, এবাদত গৃহ দেখতে মসজিদের মত। নিজেদের খাঁটি মুসলমান দাবী করার বিপরীতে যখন তাদের অবস্থান এমন দেখা যায় যে; ধর্মের প্রতি অনুগত, বিত্তশালী, আধুনিক শিক্ষিত কিংবা সরকারের বড় কর্মকর্তা হিসেবে! তখন সাধারণ মুসলমান দ্বিধায় পড়ে যায়, কদাচিৎ নিজের অজান্তেই কোন এক সময় তাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। দুনিয়াবি সমস্যার সাময়িক সমাধান কল্পে চিরতরে তাদের হাতে ইমান আকিদা সব বিসর্জন করে বসে। একজন দুর্বল মানুষ তো দূরের কথা অধিক সচেতন মানুষও বুঝতে পারেনা কার পাল্লায় পড়েছে এবং শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে!
আগামী পর্বে সমাপ্তি
লেখক আমিরাত প্রবাসী,
বিষয়: বিবিধ
৬১৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন