ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের এত ডিমান্ড কেন?

লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ১২ মে, ২০১৩, ০১:১৮:৫৫ দুপুর

ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ শব্দটি ইংরেজী Secularism থেকে উৎপত্তি। যারা এই মতবাদে বিশ্বাসী তাদের কে ইংরেজিতে Secular বলা হয়। বাংলায় ক্ষেত্র ও পরিবেশ ভেদে এর অর্থ দাঁড়ায় আধুনিক, মুক্তমনা, প্রগতিশীল ইদানীং কালে নতুন শব্দ যোগ হয়ে জন্ম নিয়েছে সুশীল! এই মতবাদ কোন আদর্শিক ধ্যান ধারনার উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়নি। Communism সাম্যবাদ, Socialisms সমাজতন্ত্র, Islamism ইসলামী মতবাদ যেভাবে একটি আদর্শকে কেন্দ্র করে গঠিত হয়েছে; Secularism বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ সে ধরনের কোন আদর্শের উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়নি। তাই ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ কোন আদর্শিক মতবাদ নয় এবং এই মতবাদ মানুষকে কোন আদর্শের দিকে আহবান ও করে না। খৃষ্ট ধর্ম ও গির্জা পতিদের মাঝে চরম রাষ্ট্রীয় হট্টগোল ও ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কাজ সমাধা করতে; তদানীন্তন সময়ের উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে Secularism তথা ধর্মনিরপেক্ষ নামক এই নতুন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে।

খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দী থেকে গির্জা ও রাষ্ট্রের মাঝে ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে ব্যাপক দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। বিভিন্ন ক্রুসেডে ভূমিকা রাখার কারণে প্রথম দিকে গির্জার পাদ্রীদের ক্ষমতা অসম্ভব ধরনের বেশী ছিল। গির্জার ক্ষমতার কাছে সম্রাটের ক্ষমতা ছিল নস্যি। উদাহরণ হিসেবে ১০৭৭ সালে পোপ হিল্ডার ব্রান্ড, সম্রাট চতুর্থ হেনরিকে, অবনত মস্তকে পোপের দরবারে হাজির হতে আদেশ করেন। সম্রাট হেনরি সে আদেশ অবিকল পালন করতে বাধ্য হন। পোপের সভাসদদের অনুরোধে, অগত্যা নিতান্ত নিরুপায় হয়ে, পোপ সম্রাটকে মাথা সোজা করার অনুমতি দেন। সম্রাট মাথা সোজা করে খালি পায়ে পোপের নিকট হাজির হয়ে যাবতীয় অন্যায়-অপরাধ ও ভুল-ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চান; সকলের অনুনয়ে পোপ তাঁকে ক্ষমা করেন ও তাঁর পাপ মার্জনা করেন। এসব কারণে রাষ্ট্র শক্তি বরাবরই ধর্মবেত্তা গনের উপর ক্ষ্যাপা ছিল। অন্যদিকে গির্জা অধিপতিরা সরাসরি বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানেরও বিরোধী ছিল। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ‘ব্রনোকে’ জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় এই অপরাধে, তিনি বিশ্বাস করতেন ‘এই পৃথিবী ছাড়া আরো পৃথিবী থাকতে পারে, যেখানে মানুষের অস্তিত্ব পাওয়া যেতে পারে’। বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বিজ্ঞানী ‘গ্যালিলিওকে’ জীবন্ত পুড়িয়ে মারার আদেশ হয় এই অপরাধে যে, তিনি বিশ্বাস করতেন ‘পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে’। অবশ্য পরে তিনি জীবন ভিক্ষা চেয়ে ক্ষমা পান। এই সমস্ত ঘটনার ফলে, রাজনৈতিক ও আধুনিক মনস্ক মানুষ, পোপদের উপর অসম্ভব ক্ষুব্ধ ছিলেন। দেখা গেছে গির্জা ও রাষ্ট্রের মাঝে সংঘাতে কখনও গির্জা কখনও রাষ্ট্র বিজয়ী হয়েছে। সবশেষে গির্জার ক্ষমতার উপর রাষ্ট্রশক্তি চূড়ান্ত ভাবে বিজয়ী হয়। এটি ইতিহাসে গির্জা বনাম রাষ্ট্রের লড়াই হিসেবে পরিচিত। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, এই দুই শক্তির লড়াইয়ে নিষ্পেষিত জনগণকে উদ্ধার কল্পে, ‘মার্টিন লুথার কিং’ একটি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁর এই সংস্কার প্রচেষ্টাকে ইতিহাসে আপোষ আন্দোলন নামে অভিহিত করা হয়েছে। ফলে আধুনিক জমানায় আবারো এই মতবাদ শাসকদের দৃষ্টিতে আসে। উপরের এত সব বিশ্লেষনে এক কথায় বলতে গেলে, ‘খৃষ্ট ধর্মে গির্জা এবং রাষ্ট্রের মাঝে সংঘাত থেকে, জনগণকে রক্ষা কল্পে মানব রচিত যে মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে তারই নাম ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ’।

আমাদের দেশের নির্বাচনে ভোট কারচুপি নিয়ে যখন কেউ কাউকে বিশ্বাস করছিল না, তখন নিজেরা চিন্তা করে আবিষ্কার করেছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। পৃথিবীর সকল দেশে এই আইন নিয়ে কৌতূহল আছে বটে, তবে কেউ এটা অনুসরণ করেনি। কেননা আমাদের দেশের মত উদ্ভূত পরিস্থিতি তাদের দেশে সৃষ্টি হয়নি, তাই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি সেখানে বাস্তবানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। এতে কেউ আবার তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে ঈষৎ পরিবর্তন করে আরো বিশ্বস্ত করতে চাইল, কেউ এসে তাকে এক ধাক্কায় মূলোৎপাটিত করল! এটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। ঠিক সে ভাবেই ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। এই মতবাদও সমগ্র ইউরোপের জন্য এক ধরণের তত্ত্বাবধায়ক নীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ইউরোপের সে সমস্ত দেশে, গির্জা ও রাষ্ট্রের মাঝে দ্বন্দ্ব ছিল প্রকট। সেখানেই জনগন সমস্যা সমাধান কল্পে এই মতবাদকে স্বাগতম জানিয়েছে। এখানে লক্ষণীয় যে, গির্জার ভুল আচরণ ও বাড়াবাড়ির কারণে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। তবে দীর্ঘ বছরের দুঃসহ কষ্ট ও অরাজকতার জন্য মানুষ এজন্য খৃষ্ট ধর্মকে দায়ী করেনি বরং তারা এজন্য দায়ী করেছিল পোপ অথবা গির্জার ভুল শাসনকে! উপায়হীন হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের মাধ্যমে তারা তাদের ধর্মগ্রন্থকে বাঁচাতে, খৃষ্টের প্রতি সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে মাঝামাঝি পর্যায়ের এই মতবাদকে গ্রহণ করেছিল। এর পরেও ফ্রান্স, ব্রিটেন, আমেরিকা খৃষ্ট ধর্মকে উৎখাত না করে তাকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রীয়ভাবে সেকুলার হলেও মার্কিন ডলারে ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’ কথাটি লিখিত হয়েছে। ব্রিটেনের রাজাকে অ্যাংলিকান চার্চের অনুসারী হতে হয় এবং খ্রিষ্টান বিশপদের জন্য হাউজ অব লর্ডসে ২০টি আসন সংরক্ষিত আছে। তাদের দেশের সংবিধান রক্ষায় বাইবেলে হাত রেখে শফত নিতে হয়। আমাদের সংবিধানে যখন বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, আল্লার উপর আস্থা ও বিশ্বাস ছিল; কোরআন হাতে তখনও কেউ আল্লার সাথে শফত করেনি। বর্তমানে আল্লার উপর আস্তা-বিশ্বাস কোনটাই নাই, তাই কোরআন অথবা আল্লাহর কাছে শফত নেওয়ার চিন্তা এখন মূল্যহীন। কারণ শফতের জন্য শর্ত হল এই, যাকে সাক্ষ্যি রেখে শফত নিতে হয়, তিনি হবেন সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান! তিনি যাবতীয় কৃতকর্মের জবাবদিহি আদায়ের ক্ষমতা রাখেন।

বর্তমান যুগের ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ মূলত: ফ্রয়েড ও ম্যকিয়াভ্যলীর দ্বারা বেশী প্রভাবিত হয়েছে। আমাদের দেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতি দেখলে মনে হয়, আমরা সবাই ম্যাকিয়াভ্যলীর সার্থক শিষ্য। ম্যকিয়াভেলীর দর্শন হল ‘ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা জিনিষ’। তিনি নীতি-নৈতিকতাকে দুই ভাগে ভাগ করে বলেছেন, একটি হল রাষ্ট্রীয় নীতি অন্যটি হল ব্যক্তিগত নীতি। তিনি বলেন, ধর্ম হল ব্যক্তিগত ব্যাপার এর সাথে রাষ্ট্রের কোন সম্পর্ক নাই। রাষ্ট্র থাকবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে, সব কিছুর মোকাবেলায় রাষ্ট্রের অধিকার থাকবে আগে। মানুষের পার্থিব ও জাগতিক জীবনের জন্য ধর্মের কোন দরকার নাই। রাষ্ট্রের জন্য ধর্মভীরু ও সৎ লোকের কোন প্রয়োজন নাই। রাষ্ট্রে তাদের কোন উপকারিতা নেই, এই জন্য যে তারা সর্বদা ধর্মের বিধিবিধানের উপর কঠোর ভাবে অনুগত থাকে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নৈতিক নীতিমালা ও ঔচিত্যবোধকে ধার্মীক ব্যক্তি উপেক্ষা করতে পারেনা। কেননা রাজা-বাদশাহ, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের শৃগালের মত ধূর্ত হতে হয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ও রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, ধোঁকা, খেয়ানত, প্রতারণা, মুনাফিকী করতে হবে। যেহেতু ধর্ম পালনকারী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এই কাজ কখনও করতে পারেনা, তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের প্রয়োজন থাকতে পারেনা এবং তাদের ভূমিকা গ্রহণযোগ্য ও হতে পারেনা!

মেকিয়াভ্যালী আরো বলেছেন লেখক, সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা তাদের যাদুকরী বক্তৃতা, লেখনী ও সম্মোহন সৃষ্টিকারী বাগ্মিতা ও কাব্যের সাহায্যে; প্রাচীন নীতি-নৈতিকতা ও সামাজিক বিধি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমগ্র দেশে বিদ্রোহ সৃষ্টি করবে। প্রাচীন রীতিতে যাকে অন্যায় ও পাপ মনে করা হয়, শিল্পীরা সেটাকে মনোজ্ঞ ও চিত্তাকর্ষক করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করবে। মানুষের প্রকৃতি ও মানবীয় স্বভাবকে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্ত করতে হবে। সকল মানবীয় ধ্যান ধারণার অনুভূতিকে হৃদয় থেকে বের করে, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের উপযোগী করে তোলাই হবে শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রধান কর্তব্য ও দায়িত্ব। পাঠক বৃন্দ হয়ত চিন্তা করবেন, দীর্ঘক্ষণ কেন ম্যাকিয়াভ্যালীকে নিয়ে লিখছি, তিনি তো কারো মাঝে জীবিত নাই। তবে সতর্ক পাঠক নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারবেন, ম্যাকিয়াভ্যালী দুনিয়াতে জীবিত না থাকলেও আমাদের মুল্লুকে যে শাসন ব্যবস্থা বজায় আছে, তা ম্যকিয়াভ্যালীর দেখিয়ে দেওয়া বুদ্ধি অনুসারেই চলে! তার তত্ত্বের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন দেখি আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে! এখানে উল্লেখ্য রাষ্ট্রে ম্যকিয়াভ্যালীর পরিপূর্ণ দর্শন বাস্তবায়িত হওয়ার পথে একমাত্র বাধা হল, সৎ-চরিত্রবান, নীতির প্রশ্নে দৃঢ়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রূঢ় আচরণকারী, নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষগুলো। পৃথিবীতে বলিষ্ঠ নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ তৈরি করে একমাত্র ইসলাম। সেজন্য ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ প্রতিষ্ঠায় প্রতি পদে পদে বাধা-প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় ইসলাম।

সাধারণ মানুষ এই মতবাদের কথা শুনলে প্রথমে বুঝে নেয়, এর অর্থ হল যার ধর্ম সে তার নিজের ইচ্ছেমত পালন করবে। তাতে কেউ বাধা দিতে পারবেনা এবং রাষ্ট্র এতে নাক গলাবে না। শুনতে সুন্দর এবং যে কোন ধর্ম পালনে এই মতবাদকে নিরাপদ ও সঠিক বলে মনে হতে পারে। তবে সকল সমস্যা লুকিয়ে রয়েছে এই মতবাদের গঠন প্রক্রিয়া ও নেতাদের চিন্তাতে। বাহ্যিক ভাবে ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদ সরাসরি ধর্মের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেনা। ম্যাকিয়াভ্যলীও ধর্মের অনুশাসন কারী ব্যক্তিদের ধ্বংস করতে চায় নাই, ধর্মীয় অনুশাসনে অভ্যস্ত সৎ, ধার্মিক, নীতি পরায়ণ, দুর্নীতি মুক্ত মানুষদের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে বলেছেন। যেহেতু ধর্মই উপরোক্ত নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ তৈরি করে, সেহেতু কৌশলে ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। যে সকল ধর্মে মজবুত নৈতিকতা নাই, অনৈতিক পরিবেশে চলতে তাদের সমস্যা হয়না, সে সব ধর্ম এই মতবাদের মাঝে নিজেদের বিলিয়ে দেয় ও রাষ্ট্র যন্ত্রের সুফল ভোগ করে। তবে ইসলাম এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম, যেহেতু ইসলাম অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দেয়না উপরন্তু বাধা সৃষ্টি করে, তাই ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের সাথে ইসলামের সাথে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে। সেই মানদণ্ডে এক কথায় বলতে গেলে, ‘ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ হল সেটি, যেটি ধর্মীয় প্রবণতাকে মানুষের ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ জীবনের সকল দিক ও বিভাগ থেকে আল্লাহ ও রাসুলের (সাঃ) প্রভাবকে নিঃচিহ্ন করে দেয়’। কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায়: ‘ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদ ধর্মের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেনা। তবে এই মতবাদ শিক্ষা ও প্রশাসন কে এমন ভাবে সাজায়, যেখানে ধর্ম সম্পর্কে জানার কোন সুযোগ রাখা হয়না’। মূলতঃ এই মতবাদে রাষ্ট্রে ধর্মীয় বিষয়কে চরম অবজ্ঞা করা হয়, তার গুরুত্বকে উপেক্ষা করা হয়, যাতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এসব অর্জন করে নেবার প্রতি ইঙ্গিত থাকে। ফলে নতুন প্রজন্ম ব্যবহারিক জীবনে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের সুযোগ পায়না এবং অগ্রসর হয়ে ধর্ম সম্পর্কে জানতে ও উৎসাহী হয় না। চিন্তাশীল পাঠক নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন, বর্তমান সরকার তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে শুরুতেই ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচনের নিমিত্তে, প্রথমে শিক্ষা ব্যবস্থা অতঃপর সিলেবাসে হাত দিয়েছে!

ভারত, ব্রিটেন, আমেরিকায় ধর্মনিরপেক্ষতার রূপ এক ধরণের হলেও; ইতিহাসে দেখা যায়, মুসলিম দেশ সমূহে ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলাম ধর্মের টুঁটি চেপে ধরে ইসলামকে উৎখাত করার জন্য। এর প্রথম উদাহরণ হচ্ছে তুরস্ক, তদানীন্তন মুসলিম বিশ্বের ঐতিহ্যের সংরক্ষক, বিশাল উসমানীয় সাম্রাজ্যের শেষ ভাগে ক্ষমতায় আসেন কামাল পাশা। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ প্রতিষ্ঠার নামে, চারটি ধাপে পুরো দেশ থেকে ইসলাম ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। ল্যাটিন ভাষায় আজান দেওয়া, খোতবা পড়া, নামাজ পড়তে বাধ্য করা ছিল তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতা বাদের শেষ সফলতা। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে এসবে বাধা না দেওয়ার কথা থাকলেও, তুরস্ক থেকে ইসলাম এভাবে বিদায় নিয়েছিল যে, তুর্কি মুসলিম আর ইউরোপীয় খৃষ্টানদের মাঝে তফাৎ করা কষ্ট হত! বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের স্ত্রী’র মাথায় এক টুকরা রুমাল দেখে সামরিক বাহিনী নিশ্চিত হন যে, তিনি ভিতরে ভিতরে ইসলাম পন্থি! জামাল নাসেরের ধর্ম নিরপেক্ষতার চোবলে ইসলামী ঐতিহ্য ধ্বংসের আরেকটি উদাহরণ হল মিশর। এদেশের মসজিদ মাদ্রাসার ঈমাম মুয়াজ্জিনের মুখ থেকে দাড়ি পর্যন্ত বিদায় নিয়েছিল! ঐতিহ্যের ধারক প্রাচীন ইসলামী ইউনিভার্সিটি আল আজহারের কোরআন ক্লাশের শত শত ক্লিন শেভ ছাত্রদের দেখে মানুষের মতিভ্রম হত। ভাবত! এরা কি আন্দালুসিয়ার অধিবাসী যারা নতুনভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে?

ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ ভারতের জন্য সমস্যা হয়নি কেননা হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, জৈন, শিখ, জরথুস্ত সহ সকল ধর্ম ব্যক্তিগত পর্যায়ে পালন করলে চলে। সে সব ধর্ম দাবী করেনা যে আমরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন মেকানিজম সুচারুরূপে চালাতে পারে। এক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম ভিন্ন, ইসলাম জীবন সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রের প্রতিটি সমস্যায় নাক গলায়, সেখানে ভূমিকা রাখতে চায়, মতামত পেশ কিংবা মতামত গ্রহণ করতে চাপ প্রয়োগ করে। যার কারণে ক্ষমতাসীন মহলের জন্য এটা বরদাশত করা কঠিন হয়ে যায়। অন্যদিকে রাষ্ট্রের অভিভাবক নির্বাচনে ইসলাম সৎ, যোগ্য, জ্ঞানী, ন্যায় পরায়ণতা, ধার্মিক, জনহিতৈষী, আমানতদার ব্যক্তিদের গুরুত্ব দেয়। ইসলাম নেতা নির্বাচনে, অন্যায় দমনে সাহসী, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়, আমানত রক্ষায় আপোষহীন, অধিকার প্রতিষ্ঠায় কঠোর, লোভ-লালসা থেকে উদাসীন, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুকে প্রাধান্য দেয় এমন ব্যক্তিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি যে, উপরোক্ত ইসলামী মৌলিক গুনগুলোর প্রয়োজনীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়! তাদের দৃষ্টিতে এসব তো কোন গুনের নাম নয়! বরং এই বদ খাসিয়ত মানুষকে বেকুব, গোঁয়ার, পশ্চাৎপদ, সেকেলে, প্রাচীন ধ্যান ধারনায় আগ্রহী করে তুলে! এদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা গেলে রাষ্ট্র হাজার বছর পিছিয়ে যাবে। এই গুণাবলীর মানুষ ইসলাম ধর্ম প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে, এই গুনের মানুষকে ইসলাম মর্যাদা দেয়, সম্মান করে। এর বিপরীত ধর্মী চরিত্রকে ইসলাম সহ্য করেনা। ভারতে যেভাবে নর্তকী, গায়িকা, নায়িকা, ডাকাত, সামাজিক ভাবে লজ্জাজনক রেকর্ডের অধিকারী ব্যক্তিও ভোটের নির্বাচনে জিতে আসে। এই চিত্র একটি পরিপূর্ণ মুসলিম সমাজে কল্পনা করা কঠিন হলেও ভোটের বাজারে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদী দের কাছে এই চরিত্র গুলোর কদর পাহার সম উঁচু।

ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি খুব সুন্দর আকর্ষণীয় হলেও, এদের চিন্তা ধ্যান-ধারনার সাথে ইসলামের সংঘর্ষ অনিবার্য। মুসলিম দেশে তারা যখন ক্ষমতা পায়, তখন সেটাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে, প্রথমেই ইসলাম ধর্মের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ইসলামী শিক্ষাকে নিরুৎসাহ, স্কুল-মাদ্রাসায় ধর্মীয় বিষয় রাখতে অনীহা, জুমার খুৎবা নিয়ন্ত্রণ, বড় বড় ইসলামী সম্মেলন করতে না দেওয়া, ইসলামী স্কলারদের কে হেয় প্রতিপন্ন করা, তাদের চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি বের করে সরকারী ভাবে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা। অন্যদিকে জাগতিক শিক্ষিত, দুনিয়ার ধান্ধায় সিদ্ধহস্ত, অযাচারে অভ্যস্ত ব্যক্তিদের সাথে ইসলাম পালনকারীদের তুলনা করে দেখানো হয়, মুসলমান মানেই গরীব, অসহায়, দীন, হীন জীবন যাপন কারী সম্প্রদায়। আরো বুঝানো হয় এসব দুর্ভোগের মূল কারণ হল ইসলামকে যথাযথ মেনে চলার খেসারত। এতে তরুণেরা প্রভাবিত হয়। একই সাথে সরকারের পক্ষ অবলম্বনকারী একদল ধর্ম বিক্রয়ী আলেম গোষ্ঠী থাকে, তারা সর্বদা সরকারী কাজকে সমর্থন করবে। যাদের মুখে থাকবে দাঁড়ি, পোষাকে হবে মুসলিম, কথায় থাকবে ইসলাম, আচরণে হবে পরিপূর্ণ ফাসিক এবং আকিদায় হবে ভয়ানক প্রকৃতির জালিম ও মিথ্যুক!

ধর্মকে স্বীকার করে এবং তাকে পঙ্গু করেই রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ চালু হয়। ধর্মের বন্ধনহীন সেই সমাজে নেতারা পরিপূর্ণ নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে বসে। নেতারা বৈষয়িক লোভে একপর্যায়ে নিজের আসল চেহারা হারিয়ে ফেলে, এবং তাদের শত শত নতুন চেহারার উদ্ভব হয়। ফলে অসহায় জনতা কোনদিন বুঝতে পারেনা তার প্রিয় নেতার আসল চেহারা কোনটি। পুরো যুবক গোষ্ঠী সমাজের প্রচ্ছন্ন মোহে নৈতিকতা হারিয়ে নিজেদেরকে সে জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়। দিন দিন জাতির নৈতিকতা চরম অধঃপতনে যায়। রাষ্ট্র শক্তি এটাকে সহজ ভাবে নেয় এবং তাতে আরো নতুন উপাদান যোগ করে। নৈতিকতা হীনতাকে মামুলী ব্যাপার ভাবতে থাকে। এই চরম বিপর্যয় পরিস্থিতিতে এক সময় ধর্ম পালনকারী ব্যক্তিরা সমাজ বিচ্যুত অপ্রয়োজনীয় হাস্যকর জীবে পরিণত হয়। তাদেরকে হয়ত সমাজ বিচ্যুত হতে হয়, নয়ত নিভৃতে বসবাস কারী হতে হয়। সেই সমাজ নৈতিকতাকে তামাশার বিষয় বানিয়ে ফেলে, ধার্মিককে হাস্যকর জীবে পরিণত করে, অন্যদিকে রাষ্ট্রে ধর্ম বেঁচে থাকে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত বৃদ্ধার ন্যায়। তাই ধর্মকে ধর্মের জায়গায় রেখে, খুব সহজে রাষ্ট্র থেকে ধর্মের প্রভাব প্রতিপত্তি ধ্বংস করা যায় বলেই, পৃথিবীতে ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদের ডিমান্ড অনেক বেশী। এই নীতি বাস্তবায়নে পুঁজি হিসেবে লাগে ধর্মকে সাইজ করার মত সাহসিকতা আর বিচিত্র হঠকারিতা!

লেখক আমিরাত প্রবাসী।

শাহবাগের জনতার মঞ্চের আবদারে, আওয়ামী সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত, জনপ্রিয় অনলাইন ম্যাগাজিন সোনার বাংলাদেশে এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল।

বিষয়: বিবিধ

৩১০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File