হেফাজতে ইসলামীর দাবী দেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিবে! তাহলে বর্তমান যুগটা কি স্বর্ণ খচিত যুগ?
লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম টিপু ০৯ এপ্রিল, ২০১৩, ০২:২৯:২৮ দুপুর
হেফাজতে ইসলামীর দাবী মানা হলে দেশ মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ফিরে যাবে। নারীর স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হবে। নারীরা কল-কারখানায় চাকুরী করতে পারবে না। শিক্ষা দীক্ষায় নারীরা মনোনিবেশ করতে পারবে না। এসব বলে দেশের কিছু বর্ণচোরা বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া কর্মী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন। হেফাজতের তেরটি দাবীর একটি দাবীকে নিয়ে তুমুল কাণ্ডকারখানা করার প্রয়াস পাচ্ছে। এই দাবীকে সামনে নিয়ে এত বেশী জোরালো চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যাতে করে বাকী দাবীগুলো সম্পর্কে মানুষ আগ্রহ বোধ না করে। আসুন হেফাজতে ইসলামীকে মধ্যযুগে ফিরে থেকে বিরত করার জন্য সেই দাবীটি নিয়ে পর্যালোচনা করা যাক। দাবীটি নিম্নরূপ।
“ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে”।
শুরুতেই কিছু প্রশ্ন তাদের উদ্দেশ্যে, যারা মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ফিরে যেতে চায় না:
১. ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতার নামে তারা বেহায়াপনা, অনাচার ও ব্যভিচার চায় কিনা? তারা তাদের সমাজে ও পারিবারিক জীবনে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সহ পরিবার পরিজন নিয়ে এসব আচরণ ইতিমধ্যে শুরু করেছেন কিনা? যদি নিজেরা অনুশীলন করে থাকেন তাহলে কোন কথা নাই যদি না করে থাকেন তাহলে বিরোধিতা কেন করছেন? কোন মতলবে? পরিষ্কার করাটা আপনাদের দায়িত্বে বর্তায়!
২. প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধে বিচরণ করার সুযোগের জন্য আপনাদের এত আকাঙ্ক্ষা কেন? আপনারা ব্যক্তি জীবনে নিজেদের পরিবার ও সন্তানদের জন্য এমন একটি সমাজ কামনা করেন কিনা? যেখানে নিজেদের কন্যা পুত্ররা স্বাধীনতার নামে অবাধ বিচরণ করবে আর পিতা-মাতা হিসেবে তা তাকিয়ে উপভোগ করবেন? যদি কামনা করেন তাহলে আলাদা বিষয়, যদি কামনা না করেন তাহলে হেফাজতের দাবীর মাঝে অসঙ্গতি কি পেলেন?
৩. হেফাজতে ইসলামীর দাবী দ্বারা নিচের কথাগুলো প্রমাণিত হয়না, যে-
- তারা গার্মেন্টস এ নারী শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করতে চায়।
- নারীরা স্কুল কলেজে ভর্তি হতে পারবে না।
- নারীরা সমাজের উন্নয়নের কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারবে না।
- নারীরা চাকুরী করতে পারবে না।
- নারীরা ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে না।
৪. মোমবাতি প্রজ্বলন বাংলাদেশের কোন জাতি স্বত্বার সংস্কৃতি নয়! বাংলাদেশের কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কৃষ্টি নয়! কেউ মাজারে, কেউ বাজারে মোমবাতি জালায়। একদা জাতীয় সংসদ মোমবাতি জালিয়ে চলেছিল। বিদ্যুতের অভাবে কেউ বাড়ীতে মোমবাতি জালায়। মোমবাতি জালিয়ে বিসিএস পরীক্ষা নিয়েছিল সরকার। এসব প্রয়োজন, বিপদে পড়ে জালায়, কেউ তা অস্বীকার করেনা। তবে সেটা সংস্কৃতির অংশ নয় হলফ করে বলা যায়। সেটাকে আইন করে বিতাড়িত করলে কিংবা অপছন্দ করলে কারো আহত হবার কারণ থাকেনা। দাবী মানা কিংবা না মানা কারো ব্যাপার হতে পারে, তবে কেউ যদি নিষিদ্ধের দাবী তুলে তাহলে তা মধ্যযুগে ফিরে যাবার সাথে বায়বীয় তামাসা ছাড়া আর কিছুই নয়!
- আজ বাংলাদেশের নারীরা ইট ভাঙ্গার কাজ করছে।
- আজ বাংলাদেশের নারীরা রাস্তায় মাটি কাটার কাজ করছে।
- আজ বাংলাদেশের নারীরা রিক্সা চালাচ্ছে।
- আজ বাংলাদেশের নারীরা মিল-কারখানায় শ্রমিকের কাজ করছে।
এসব কাজ নারীর জন্য সম্মান বয়ে আনে না। বরং পুরুষেরা নারীদের ন্যায় সঙ্গত অধিকার দিতে চায়না বলেই নারীরা এ জাতীয় কঠিন কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। এ জন্য সমাজ দায়ী, সরকার দায়ী এবং মানুষের মানসিকতা দায়ী। এসবের সাথে অবাধ মেলামেশার দাবীর যোগসূত্র কোথায়?
পেটের তাগিদে নারীরা যদি পুরুষের কাছে আসতেই হয়, সেটার নাম ‘অধিকার’।
নারীদের কে নারীর স্থানে কাজ করার সুযোগ না দেবার নাম, ‘অধিকারে হস্তক্ষেপ’।
পুরুষ যদি তাদের অধিকার ফিরিয়ে না দেয় সেটার নাম ‘জুলুম’।
নারীর কাজের প্রতি পুরুষ, আর পুরুষের কাজের প্রতি নারীর আগ্রহ বোধের নাম ‘অবাধ্যতা’।
অবাধ্যতা যেখানে, বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা সেখানে, তাই নাগরিকেরা বিশৃঙ্খলা আর জুলুমের শিকার।
এসব ঘটনা মোটেই ইসলাম ধর্মের অনুশাসন কিংবা হেফাজতে ইসলামীর দাবীর কারণে হয়নি।
চিত্তের তাগিদে নারীরা যদি পুরুষের আছে আসে, সেটার নাম ‘বেহায়াপনা’।
চিত্ত সুখ পুরণার্থে পুরুষ যদি নারীর সাথে জড়িয়ে যায় সেটার নাম ‘অনাচার’।
চিত্ত সুখ পুরণার্থে যদি অন্যায়, অবৈধ ও অন্যায্য সুযোগ গ্রহণ করা হয় তার নাম ‘ব্যভিচার’।
চিত্ত সুখ পুরণার্থে যদি সমাজ, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ধর্মকে অবজ্ঞা করে তার নাম ‘অযাচার’।
যে সকল ব্যক্তিরা হেফাজতে ইসলামীর দাবির বিরোধিতা করছে তারা সবাই উপরের চারটি পর্যায়ের কোন একটির পর্যায়ভুক্ত। তাদের জ্ঞান, ধ্যান, ধারনা, বিদ্যা, বুদ্ধি, যুক্তি নারীকে ব্যবহার কেন্দ্রিক। তাদের পাণ্ডিত্যে একজন কিশোরী ও যুবতীর প্রতি যত আগ্রহ; একজন বৃদ্ধা, শিশু, বালিকার প্রতি ততোধিক অনাগ্রহ।
হেফাজতে ইসলামের এই দাবী পূরণ হলে দেশ মধ্যযুগে ফিরে যাবে না। বরং বলা চলে এই দাবী বাস্তবায়ন হলে নারীরা তাদের অধিকার ফিরে পাবে। ইসলাম পেটের অধিকার আগে সংরক্ষণ করে, তারপর পিটের অধিকার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে। ইসলাম গার্মেন্টস, কল কারখানা, শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণকে বাধা দিবে না। বরং সেখানে অসহায় নারীদের জন্য, নারী অভিভাবক দিয়ে নারীর অধিকার সুদৃঢ় করবে। নারী শ্রমিককে কর্ম হারা করা ইসলামের লক্ষ্য নয়, বরং তার কর্মক্ষেত্রকে উৎপাত, উত্ত্যক্ত ও কটূক্তি কারী থেকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হবে।
ইসলাম অবশ্যই নারী-পুরুষের জন্য যাতে আলাদা আলাদা কর্মক্ষেত্র তৈরি করা হয়, সে দাবী জানায়। আরব দেশেও নারীরা গাড়ী চালায়, ব্যবসা চালায়, চাকুরী করে, লেখাপড়া করে। সেটা নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণের মাধ্যমে নয়, বরং সম্মানজনক পৃথক ব্যবস্থায়। নারী পুরুষের অবাধ মেলা মেশায় না গিয়ে যেখানে সমাজ চালানোর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে সেখানে, হেফাজতে ইসলামে দাবী ভুল হল কোথায়?
পরিশেষে: আমি হেফাজতে ইসলামীর কোন কর্মী নই, সমর্থক নই। তাদের কয়েকটি ধারার বিরোধিতা দেখে আমিও আগ্রহী হয়েছি পড়তে। বিস্তারিত পড়ার পর এই বিষয়ে লিখাটা আমার জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই লিখলাম, দায়িত্ব পালন করলাম, তবে অনেক কর্তব্য বাকী রয়েছে। হেফাজতে ইসলাম হউক আর জামায়াতে ইসলাম হউক যারা সরাসরি কোরআন আর হাদিসের দাবী বাস্তবায়ন করতে প্রচেষ্টা চালায়। একজন মুসলিম হিসেবে সে দাবীগুলোর পক্ষে কথা বলাও প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। যত নিন্দাবাদ আসুক, যত ভয় ভীতি আসুক, আসুন জাতিকে পরাশক্তির বেষ্টনী থেকে উদ্ধার কল্পে, একটি ইসলামী সমাজ, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ধর্ম বিশ্বাস পুরণার্থে এসব দাবীর পক্ষে কথা বলি। এটাই একজন প্রকৃত মুসলমানের দাবী এবং একজন দেশপ্রেমিক প্রকৃত নাগরিকের পরিচয়।
বিষয়: বিবিধ
১৯৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন