সহস্র বৎসরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হইতে হইলে আপনাকে যেইরূপ হইতে হইবে
লিখেছেন লিখেছেন দ্বীপবালক ১৩ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৮:৪৩:৩৭ রাত
আপনার জন্মদাতা পিতা কোনজন, ইহা সাধারণত জানা যাইবেনা; তবে কলিকাতার আদালতে আপনাকে দত্তক লইবার দস্তাবেজ থাকিবে। ইহা অবশ্য কোন সমস্যা নয়; কারণ জন্মের জন্য মানুষ নিজে দায়ী নহে, দায়ী হচ্ছে কর্মের জন্য। কিন্তু অন্যদিকে আপনার বংশধরগণ দাবী করিবে আপনার পূর্বপূরূষগণ প্রকৃত্পক্ষে আরব হইতে আগত ম্লেচ্ছ ধর্মগুরু।
আপনি কৈশোরে কীভাবে বাড়িয়া উঠিয়াছেন সেই সম্পর্কে হয়ত কেহ জানিবেনা; কিন্তু যৌবনে আপনি কলিকাতাস্থ ইসলামিয়া মহাবিদ্যালয়ের মত কোন পাঠশালায় অধ্যয়ন করিবার সময় সোহরাওরার্দীর মত কোন উর্দূ-ভাষী সাম্প্রদায়িক মুসলিম রাজনীতিকের চেলা হিসেবে আভির্ভূত হইতে পারেন
।
আপনি সহপাঠীদের পকেট হাতাইয়া লইতে পারেন রীতিমতন; কিন্তু আপনার খুঁটির জোরের কারণে কেউ টু শব্দটিও করিতে পারিবেনা।
আপনার অর্থ উপার্জনের কোন সুনির্দিষ্ট নাও থাকিতে পারে; তথাপি গোয়ালন্দ ঘাটে নৌকাগুলোতে দস্যুবৃত্তির মতন অঘটনে নেতৃত্ব দিবার মত উড়ন্ত সংবাদ আপনার ব্যাপারে বাতাসে ভাসিয়া বেড়াইবে।
আপনি যাহাদের নেতৃত্বে রাজনীতি করিবেন আস্তে আস্তে তাহাদেরকে সরাইয়া উপরস্থ পদ দখল করিবেন। আপনি আইনসভায় ভাষ্যকার হত্যার মত কর্মকাণ্ডেও নেতার ভূমিকায় আভির্ভূত হইতে পারেন।
আপনি ভারতবর্ষের যবন-ম্লেচ্ছদের অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে বিকাইয়া দিবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইতে পারেন; কিন্তু বলা হইবে আপনাকেই শাসকগোষ্ঠি ষড়যন্ত্র করিয়া ফাঁসাইতে চাহিতেছে। আর ইহাতে আপনি একটানে বাঙালীদের প্রথম সারির নেতা বনিয়া যাইবেন।
গণতন্ত্রের মানসপূত্র বলিয়া আপনার উর্দূ-ভাষী গুরু পরিচিত হইলেও আপনি মূলত বাংলা ভাষা-ভিত্তিক ফ্যাসিবাদী সাম্প্রদায়িক চরিত্রের প্রকাশ ঘটাইবেন। নির্বাচনে বিরোধিদের অংশগ্রহণকে আপনার গুণ্ডাবাহিনী মানিয়া লইবেনা। পল্টনে আপনার প্রতিপক্ষের কোন শক্তি সভা করিতে চাহিলে আপনি পূর্বেই আপনার চেলাদিগকে নির্দেশ দিবেন সেইস্থানে আক্রমন করিবার। ফলে নিহত হইবে মানুষ ও বহিবে রক্তবন্যা।
নির্বাচনে যেইভাবেই হউক আপনার দল জিতিবে। অতঃপর আপনি এমন সব দফা পেশ করিবেন যাহাতে কার্যত একটা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও ঐক্য আর অটুট থাকিবে না। ফলে সামরিক শাসকরা আপনাকে লইয়া ক্রীড়ায় মত্ত হইবে। আপনিও কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত লইতে পারিবেন না। ইহারই মধ্যে আবার বালখিল্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বখাটে আপনাকে “–বন্ধু” জাতীয় কোন উপাধিও দিয়া দিতে পারে।
এক সময় আপনার গুণ্ডাবাহিনী কাহারো দ্বারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িবে অবাঙালী যবন-ম্লেচ্ছদিগের উপর। আরম্ভ হইবে রক্তের হোলী খেলা। সামরিক বাহিনী তখন জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষার নামে কর্মে লিপ্ত হইবে; শুরু হইবে আরেক হত্যাকাণ্ডের নাটক, যাহাতে জীবন হারাইবে বহুৎ বাঙালী সামরিক কর্মকর্তা, পুলিশ, সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা। আর আপনি পালাইয়া যাইবেন সামরিক হিফাজ়তে।
ইহার পর উর্দি পরা কোন বাঙালী সামরিক কর্মকর্তা এইখানে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করিবেন এবং আপন প্রাণ রক্ষার্থে তাহারই পূর্বের সহকর্মীদের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হইবেন। শেষে বলা হইবে ঐ ঘোষণা আপনার নির্দেশেই দেওয়া হইয়াছিল এবং আপনারই দলের কেহ সেইটা আসলে দিয়াছিল। অতঃপর দীর্ঘকাল যুদ্ধ ও খুনের ঘটনার শেষে ভারতবর্ষীয় যবন-ম্লেচ্ছদের অর্জন করা রাষ্ট্রটার বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলটা বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে স্বাধীন হইয়া যাইবে। কিন্তু আপনি জানিতে পারিবেন না।
আপনি ফিরিয়া আসিয়া দেখিতে পাইবেন স্বাধীন দেশ, যাহার সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা ছিল না। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে আপনাকে ফুলাইয়া ফাঁপাইয়া কিছু বলিতে হইবে। আর আপনি চিরকালই পড়াশোনায় একটু অপরিপক্ক থাকিবার কারণে যথাযথ ইংরেজীও জানিবেন না। ফলে লক্ষের অনুবাদে আপনি মিলিয়ন বলিয়া ফেলিবেন; আর সেই কথা বেদ-বাণী হইয়া প্রচার লাভ করিতে থাকিবে।
আপনি বাকপটু হইলেও শাসনকার্য পরিচালনা করিবার ব্যাপারে অজ্ঞতার কারণে শুরু হইবে নৈরাজ্য। নৈরাজ্য থামাইবার জন্য আপনি সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিলে তাহারা ব্যাংক ডাকাতদের উপর গুলি ছুঁড়লে আপনার কোন সোনার পূত্র গুলিবিদ্ধ হইতে পারে। ফলে আপনি সামরিক বাহিনীকে তাহাদের ছাউনীতে ফেরত পাঠাইয়া দিবেন।
রাজনৈতিক বিরোধীদের মুকাবিলা করিতে ব্যর্থ হইয়া আপনি বিশেষ বাহিনী গঠন করিবেন, যাহারা ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করিবে সদ্য স্বাধীন দেশটাতে। ৩০ হাজার রাজনৈতিক বিরোধিকে হত্যা করিবে তাহারা; আর আপনি তখন দম্ভভরে ঘোষণা করিবেন, “অমুক আজ কোথায়?”
পার্বত্য উপজাতিরা আপনার কাছে তাহাদের অধিকারের দাবী লইয়া আগমন করিলে আপনি বলিবেন, “যা, যা! বাঙালী হইয়া যা;” অথচ আপনার চেলারা কত ইনাইয়া বিনাইয়া বলিবে যে আপনি নাকি একটা দামী কথা কহিয়াছেন, যাহার অর্থ হইলঃ মানুষ নাকি জাতি বদলাইতে পারেনা। কী মারাত্মক বৈপরিত্য!
আপনার দলের লোকগণ চুরি বিদ্যায় মারাত্মক পারদর্শী থাকিবার কারণে জনগণের সম্পদ লুট করিতে থাকিবে ব্যাপকভাবে; এমনকি আপনি নিজেও চোরের খনি পাইয়াছেন বলিয়া অনুশোচনা করিতে থাকিবেন। ফলে সৃষ্টি হইবে কৃত্রিম সংকট। মজুতদারীতার মারাত্মক প্রভাবে সৃষ্টি হইবে খাদ্য সংকট। শুরু হইবে দূর্ভিক্ষ। খাদ্যাভাবে রাস্তার পাশের কচু-ঘেঁচু সব ভক্ষন করিবে মনুষ্যগণ; আবর্জনার ভাগারে উচ্ছিষ্ট লইয়া কামড়াকামড়ি করিবে মনুষ্য, সারমেয় আর কাকপক্ষী। মৃত্যু আসিয়া গ্রাস করিবে লক্ষ লক্ষ আদম সন্তানকে। বস্ত্রের অভাবে বাসন্তীরা জাল দিয়া লজ্জা নিবারণ করিবার অপপ্রয়াস চালাইবে। কিন্তু আপনি তখন স্বর্ণের মুকুট পরাইয়া রাজপূত্রের বিবাহের ব্যবস্থা করিবেন।
আপনার রাজনৈতিক কোন দূরদৃষ্টি ও লক্ষ্য না থাকায় তথাকথিত সাম্যবাদীরা আপনার স্কন্ধে আরোহণ করিবে। তাহারা আপনাকে দেশের অবিসংবাদিত নেতা হইবার স্বপন দেখাইবে। গণতন্ত্র নামক খোঁড়া যে গর্ধভটা কোনমতে জীবনধারণ করিয়া চলিতেছিল তাহারা আপনাকে দিয়া উহাকে বধ করিবার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করিবে। আর উহার সাথে সম্পর্কিত সকল মূল্যবোধকে টুটি চাপিয়া ধরিয়া ফ্যাসিবাদী একদলীয় স্বৈরশাসনের একটা নেকড়েকে চাপাইয়া দেওয়া হইবে রাষ্ট্রীয় দস্তাবেজে একটা সংশোধনী আনয়নের মাধ্যমে। চারিদিক হইতে স্লোগান উঠিবেঃ “এক নেতা, এক দেশ; —বন্ধু, বাংলাদেশ।” আপনি ভাবিবেন, “আহ, কী শান্তি!”
ঐদিকে বঞ্চিত ও নিগৃহীত জনতা ইশ্বরের দরবারে আর্তনাদ করিতে থাকিবে তাহাদের জন্য তাঁহার পক্ষ হইতে বন্ধু ও সাহায্যকারী পাঠাইবার জন্য। পরোয়ারদিগার তখন দয়া পরবশ হইয়া আপনার দলেরই কিছু তরুণ সামরিক কর্মকর্তাকে বাহির করিয়া আনিবেন জঞ্জাল পরিষ্কার করিবার জন্য। যেই অসংখ্য নারী, পুরুষ ও শিশুর করুণ আর্তনাদে বাংলার বাতাস ভারী গুমোট হইয়া গিয়াছিল তা হঠাৎ এক ভোর রাত্রিতে যান্ত্রিক বন্দুকের ঠা ঠা শব্দে ভাঙ্গিয়া খান খান হইয়া যাইবে। আর ভোরের আলো ফুটিয়া উঠিলে আনন্দিত মানুষের মিছিলে ভরিয়া যাইবে নগর, বন্দরের রাজপথ সমূহ , আর গ্রামের সাধারণ সড়ক এবং মেঠো পথগুলোও।
আপনার দলের লোক হইয়াও এবং আপনারই সংসদের স্পীকার হইয়াও এক উকিল বিলাতে বসিয়া ঘোষণা করিবেন “জাতি ফিরাউনের হাত থেকে মুক্তি পেল।” এই দেশের মুক্ত মানুষগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া আপনার শাশন অধ্যায়ের কালো দিনগুলো ভুলিয়া গিয়া শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখিতে শুরু করিবে। আর এই স্বপ্ন দেখানোর কাজ করিয়া তাহাদের হৃদয় দখল করিবে এক সামরিক কর্মকর্তা; যিনি তাঁহার দুঃখী স্বজনের জন্য ব্যথার অশ্রু লুকাইতেই হয়তো কালো চশমার আড়ালে ঢাকিয়া রাখিবেন আপন চক্ষুদ্বয়। ইহার পর আপনার কথা কেহ আর বলিবেনা। কাউকে “—বন্ধু” শব্দ উচ্চারণ করিতে শোনা যাইবেনা; বরং আপনার জন্য ঘৃণাই শোনা যাইবে শুধু।
তাহার পর দীর্ঘ ২১ বৎসর অতিক্রান্ত হইয়া গেলে আপনার কন্যা জনগণের কাছে আপনার কৃত কর্মের জন্য ক্ষমা চাহিবে। জনগণ ক্ষমা করিয়া দিয়া তাহাকে আবার ক্ষমতায় মসনদে বসিবার সুযোগ করিয়া দিবে। ইহার পর হঠাৎ করিয়াই আবার দালালরা আপনার জয়গান গাওয়া শুরু করিবে। কথায় কথায় “—বন্ধু, —বন্ধু” রব উঠিবে চতুর্দিকে। নামকরণের হিড়িক পড়িয়া যাইবে। কেহ কোথায় একটা জরিপ চালাইবে; আর আপনি হইয়া যাইবেন সহস্র বৎসরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। শুভকামনা আপনার জন্য।
বিষয়: বিবিধ
১২০৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন