দু’জন মুসলিম বোন, প্রচণ্ড শীত আর আমাদের অপারগতা

লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ৩১ ডিসেম্বর, ২০১২, ১০:৩৭:২৭ সকাল

মাগরিবের সালাত শেষে মসজিদে বসেই ছাত্র-ছাত্রীদের খাতা দেখব বলে রয়ে গেলাম। খাতা দেখার আগে ল্যাপটপে কয়েকটা বিষয় দেখে নিচ্ছিলাম। কিন্তু প্রচণ্ড ক্লান্তিতে মাথাটা মসজিদের কার্পেটে এলিয়ে দিতেই ঘুমের জগতে হারিয়ে গেলাম। মসজিদের অন্য মুসল্লীরা ততক্ষণে সালাতের হলের দরওয়াজাটা লক করে দিয়ে চলে গেছেন। মাঝখানে দরজায় করাঘাতের কয়েকবার শব্দ শুনলেও ঘুমের ঘোরে ঠিক ঠাহর করতে না পেরে ঘুমেই রয়ে গেলাম।

‘ইশার জামা‘আতের আধা ঘন্টা আগে ইমাম সাহেব এসে দরজা খুলে আমাকে ডেকে উঠালেন। বললেন, মসজিদের বাইরের অংশে দুজন বোন অপেক্ষা করছেন। তারা কিছু বলছিলেন যা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। আমি বাইরে এসে দেখতে পেলাম দু’জন মুসলিম বোন। তারা আবার পরস্পরেরও বোন। তাঁরা যা বললেন তা হল, তাঁদের কোন বাসা ভাড়া করা নেই। কুইন্সের লং আইল্যান্ড সিটির একটা বাসায় তাঁরা কিছুদিন ছিলেন। সম্প্রতি ঐ বাসার মরোক্কান অভিবাসীরা ফিরে এলে তাঁদেরকে বাসাটা ছেড়ে দিতে হয়। দু’জন মিলে কয়েকদিন বাসা খোঁজ করেও এখনো পান নি। তাঁরা থাকতেন উইসকনসিন। নিউ ইয়র্কে পরিচিত কেউ না থাকায় হঠাৎ ঝামেলায় পড়ে গিয়েছেন। তাই রাতটা তাঁরা মসজিদে থাকতে পারবেন কিনা তার অনুরোধ করছিলেন। উল্লেখ্য যে মসজিদের দোতলা পুরোটাই বোনদের জন্য। তাঁরা সেখানে সালাত আদায় করা সহ বিভিন্ন ক্লাস ও শিক্ষণীয় প্রোগ্রামে মিলিত হয়ে থাকেন। তবে থাকার জন্য কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই।

মসজিদের কমিটির ভাইয়েরা আমার কথা শুনলেও মসজিদ কমিটির সভাপতির অনুমতি ছাড়া আমরা এই দু’বোনকে থাকার অনুমতি দিতে পারছিলাম না। ‘ইশার জামা‘আতে সভাপতি আসলে তাঁর সাথে কথা বলে জানাব বলে আপাতত দু’বোনকে অপেক্ষা করতে বললাম। একজন সিয়ার্সে চাকরী করেন, তাই তিনি সেখানে গেলেন। আর একজন মসজিদের দোতলাতেই অপেক্ষা করছিলেন। বাসায় এসে সামীহার মায়ের কাছে শুনলাম আসরের সময়ই সে একটা মেয়েকে দেখেছে সালাতের শেষে কুর’আন তিলাওয়াত করতে। সাথে ব্যাগও ছিল। সে মনে করেছিল কোন মুসলিম ছাত্রী মসজিদে বসে হয়তো পড়াশুনা করছিল। পরে চলে যাবে। সামীহার মা গিয়েছিল বাচ্চাদের প্রোগ্রামে। সে যে বর্ণনা দিয়েছে তাতে বুঝলাম আমাদের দেখা বোনদের একজন। ইমাম সাহেব বললেন যে তিনি এঁদেরকে আরো বেশ কয়েকদিন জোহর ও আসরের সময় মসজিদে আসতে দেখেছেন।

‘ইশার জামা‘আতে আমি ভালভাবে মনোযোগ দিতেও পারছিলাম না। বার বার মনে হচ্ছিল এই বোনদেরকে কোথায় ছেড়ে দেব আমরা এই রাতে। বাইরে প্রচণ্ড শীত। রাতের সেই সময়ে [সন্ধ্যে ৭:০০] তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রী ফারেন হাইট, যা হিমাঙ্কের নীচে। রাত বাড়তে থাকলে তাপমাত্রা আরো কমবে এবং শীতের প্রকোপ আরো বাড়বে। পুরুষ মানুষ হলে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে দিলে কোন সাবওয়ে স্টেশনে বসে রাত পার করে দিতে পারত। কিন্তু আমাদের বোনদেরকে আমরা এভাবে বের করে দিতে পারি না। অথচ মসজিদে মুসাফির বা আশ্রয়হীনদের থাকারও কোন ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে আমার নিজের বাসার অবস্থাও এমন নয় যে দু’জন বোনকে রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবো। সভাপতি জামা‘আতে না আসলে আমরা একা সিদ্ধান্ত দিয়ে ঝামেলায় পড়তে চাচ্ছিলাম না। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ উদ্ধার করলেন। মসজিদের এক মুসল্লী ভাই আবুল কাসেম সাহেব তাঁর বাসায় এই বোনদের আজ রাতে থাকার ব্যবস্থা করতে রাজী হলেন। আবুল কাসেম সাহেবের নিজের বাড়ী। তিনি আমাদের মত ভাড়া বাড়ীতে থাকেন না। আল্লাহ তাঁকে উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করুন।

আমি ‘ইশার জামা‘আত শুরু হবার আগে থেকেই ভাবছিলাম এই বোনদের নিয়ে কী করতে পারবো তা নিয়ে। আমাদের অবস্থা এমন যে আমরা দু’জন বোনের থাকার ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। অথচ আমাদের দু’বোন মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ডিগ্রী প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রাচীনতম ‘ইউনিভার্সিটি অফ কারাওয়্যিন।’ ওঁরা ছিলেন তিউনিসিয়ার কায়রাওয়ান শহরের বাসিন্দা। পরে মরক্কোর ফেজে চলে গিয়েছিলেন তাঁরা। এবং সেখানেই দুই বোন ফাতিমা আল-ফিহিরিয়্যা ও মরিয়ম আল-ফিহিরিয়্যা প্রতিষ্ঠা করেন জামে আল-কারাওয়্যিন। এখন তাঁদেরই দেশের এ বিপদাপন্ন দু’বোনকে আশ্রয় দিতে না পারা হত আমাদের চরমতম ব্যর্থতা। আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন।

মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে মুসলিম পুরুষদের তরবারি যখন ভোঁতা প্রমাণিত হয়েছিল তখন আমাদের ঐ সমস্ত বোনদের প্রচেষ্টায় - যাদেরকে মোঙ্গলরা জোর করে দখলে নিয়েছিল - মোঙ্গল বিজয়ীরা ধীরে ধীরে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। মদীনার বাজারে এক মুসলিম মহিলাকে বে-আব্রু করার জন্য ইয়াহুদীদের গোটা বনি ক্বায়নুকা গোত্রকেই করা হয়েছিল বহিষ্কার। অথচ আমাদের বোনরা আজ নির্যাতিতা হচ্ছে, কিন্তু কিছুই করার যেন নেই আমাদের। মুসলিম দেশের সরকারগুলোর কথা ছিল এদের রক্ষা করার। অথচ বাংলাদেশে কোন ধরণের কোন অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতা ব্যতিরেকেই ২০ জন মুসলিম বোনকে সরকার গ্রেফতার করে নির্যাতন চালাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক স্থানেই আমাদের বোনেরা আজ নির্যাতিত।

নিজেদের ঘরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক মুসলিম বোন পালিয়ে যান বিভিন্ন স্থানে। আমেরিকাতেও এ রকম ঘটনা ঘটে অনেক মুসলিম মেয়েদের ক্ষেত্রে। পরিবারের অনেক কিছুর সাথে তাল মিলাতে না পেরে ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকেই ঘর ছাড়ে। এদের আশ্রয় জোটে অনেক সময় সরকারী আশ্রয় কেন্দ্রে অথবা কখনো কোন গির্জার আশ্রয় কেন্দ্রে। জেলে ইসলাম গ্রহণ করেন প্রচুর ভাইয়েরা আমেরিকায়। এরা ইসলামের সৌন্দর্য এবং আনসার ও মুহাজিরদের উন্নত ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের কথা পড়ে থাকে। কিন্তু আত্মীয়-পরিজন এবং আশ্রয়হীন এরা জেল থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে আনসারদের মত মুসলিমদের আর খুঁজে পান না। শেষ পর্যন্ত সেই সরকারী আশ্রয় কেন্দ্র অথবা গির্জার আশ্রয় কেন্দ্রই হয় তাদের ভরসা। আমাদের মসজিদগুলো শুধুই ইবাদতের জায়গা। এখানে লোকেরা নামাজ, মাহফিল আর জিকরের জন্যই আসে শুধু। অথচ মুহাম্মাদ (সঃ) এর মসজিদে আশ্রয়হীনরা আশ্রয় পেত। তাদের থাকার এবং খাবারের ব্যবস্থা ছিল। মসজিদ আরো কত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ছিল। আমাদের একদল আলিম নামধারী ব্যক্তিতো রসূলুল্লাহর (সঃ) সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা সত্বেও আমাদের বোনদের জন্য মসজিদে প্রবেশকে হারাম করে দিয়েছে, আশ্রয় দেয়াতো দূরের কথা।

ইনশা’আল্লাহ, আমাদের মসজিদের জন্য বড় স্থান নিতে পারলে আমরা আশ্রয়হীনদের জন্য ক্ষণস্থায়ী আশ্রয়স্থলেরও ব্যবস্থা করবো। এতে করে, আল্লাহ চাহেতো, আমাদের আশ্রয়হীন ভাইবোনদের একটা গতি হবে। আগামীর আমেরিকায় মুসলমানদের সব প্রতিষ্ঠানেই এ সুবিধা থাকা দরকার।

বিষয়: বিবিধ

১৪৬৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File