আমরা কি শোক পালন করব?
লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ১৬ আগস্ট, ২০১৬, ০৯:৫৫:৪২ সকাল
তখন আমার ৬ বছর বয়স। গ্রামের ৬ বছরের পোলাপান মোটামুটি বড়ই ধরা যায়। আমরা তখন স্কুলে যাই - একবছর আগে শিশু শ্রেণি শেষ করে প্রথম শ্রেণিতে পড়ি। আশপাশের অবস্থা মোটামুটি বুঝতে পারি। তো একদিন বাড়ির সামনের দিকের বড় একটা পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে এক মুরুব্বীকে খুব খুশিতে চিৎকার করে বলতে দেখলাম, "আঁই কইলাম হেইতে মইরব। অন মইজ্জে। আঁরা বাঁচি গেই গয়। দেশের মানুষ বাঁচি গিইয়ে।" [আমি বলেছিলাম সে মরবে। এখন ঠিকই মরেছে। আমরা বেঁচে গেছি; দেশের মানুষ বেঁচে গেছে।] আস্তে আস্তে গ্রামের সব মানুষকে উৎফুল্ল হতে দেখলাম। সবার মনে খুশি।
তার আগের বছর যখন আরেকটু ছোট ছিলাম তখন দেখতাম অনেক মানুষকে ভিক্ষা করতে। আমাদেরও দূর সম্পর্কের কিছু আত্মীয়কে দেখতাম ভিক্ষা করতে। অথচ এঁরা ছিলেন একসময় সচ্ছল জীবনের অধিকারী। আমার বাপ বিদেশি সওদাগরী জাহাজে [মার্চেন্ট নেভি] চাকরী করতেন বলে আমাদের ঘরে মোটামুটি চাল-ডাল কেনার টাকা ছিল। তাই এ সমস্ত আত্মীয়রা ও অন্যান্য অনাত্মীয় সাহায্যপ্রার্থীরা আসতেন। এই সময়ের আগে গ্রামে যারা ভিক্ষা করতে আসত তাদেরকে আমরা সাধারণত একমুঠ চাল দিতাম। আর রাতে ভিক্ষা করতে যারা আসত তাদেরকে রান্না করা ভাত দিতাম। কিন্তু এই বছর এসব ভিক্ষুকরা চাল বা ভাত চাইতো না। তারা জানত সেই ভিক্ষা দেয়ার সাধ্যও মানুষের নাই। তাই তারা এসে ফেন [ভাতের মার] চাইত। কিন্তু সে ফেন দেয়ার সাধ্যও অনেকের তখন ছিল না। আস্তে আস্তে রাস্তার দু'ধারের কচু-ঘেচুর যে সমস্ত ঝোঁপঝাড় ছিল সেগুলো সাফ হয়ে যেতে থাকল। ক্ষুধার্ত মানুষ কোন কিছু একটা পেটে দিয়ে জীবন বাঁচানোর দূরন্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।
তারপর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। দেশের মানুষের জীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছিল। স্বাধীনতা, মুক্তি, অর্থনৈতিক সহজতা, ইত্যাদি আস্তে আস্তে আসতে লাগল। এরমাঝে নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে ক্ষমতায় জেঁকে বসলেন এক জেনারেল। বলা হল তিনি স্বৈরাচারী। আমরা তখন কৈশোরে পদার্পণ করেছি। আমরাও একসময় তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে গেলাম। তাঁর পেটোয়া বাহিনী এখানে ওখানে একটূ দাপট দেখালেও মানুষ আন্দোলন করার অধিকার হারায় নি। পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয় নি। আর কেউ হঠৎ নিখোঁজ হয়ে আর ফিরে আসেনি এমনটা হয় নি। তারপর একসময় জনতার আন্দোলনে তাঁর সহকারীরা তাঁকে সাহায্য করতে অস্বীকার করলে তিনি বিদায় হন ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে।
এরপর আবার সময় গড়ায়। শেষাব্দি ১৯৯৬ সালে কোন না কোনভাবে আমার শৈশবে যাঁর নিহত হবার খবরে মানুষকে আনন্দে বিভোর হতে দেখেছি, যার অব্যবস্থাপনার জন্য লাখ লাখ মানুষ অনাহারে থেকেছে দিনের পর দিন এবং হাজার হাজার মানুষ জীবনের পাট চুকিয়ে দিয়ে বিদায় হয়েছে দুনিয়া থেকে সেই ব্যক্তির দল ক্ষমতায় আসল। তার মেয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতীতের অপকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আরেকবার সুযোগ দেবার আহবান জানিয়েছে। আমি তখন বিদেশে। ভোটের আগে দেশে গেলাম। দেখলাম সেই মুরুব্বী, যিনি ঐ ব্যক্তির নিহত হবার খবরে আনন্দ প্রকাশ করছিলেন তিনিও এই দলের প্রার্থীর সাপোর্টার। আমি ভাবলাম দুনিয়া পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
১৯৯৬ সালে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ দূতাবাসের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হয়; আমি তখন মাস্টার্সের ছাত্র। IIUM এর বাংলাদেশি শিক্ষক ও ছাত্ররাই মূলত এই অনুষ্ঠানগুলোতে ভূমিকা রাখত; কারণ শহরের আশ-পাশে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় কম্যুনিটি আমরাই ছিলাম। এবারের অনুষ্ঠান ভিন্ন রকমের। মুজিবের কন্যা ও তার পার্টি ক্ষমতায়। দেখলাম অনেক আলোচক। যাদেরকে আমরা আগে একরকম দেখতাম, তারা সবাই বদলে গেলেন। খোলস পালটে নতুন রূপ ধারণ করলেন। যেই শব্দ এর আগে আমরা শুনতাম না হঠাৎ সে শব্দ চারিদিকে বাজতে লাগল। শব্দটা হল বঙ্গবন্ধু। অনেক বক্তার মূখ থেকে সেই শব্দের খই ফুটতে লাগল। এমন কি IIUM এর রাজনীতি বিজ্ঞানের এক শিক্ষক যিনি তাঁকে গালাগাল করতেন ও বি, এন, পি, পন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনিও বঙ্গবন্ধু বলে খই ফুটাতে লাগলেন। নতুন প্রজন্মের পক্ষ থেকে আমাকে বক্তৃতা দিতে বলা হলে আমি বেকায়দায় পড়ে গেলাম৷ যেই লোকটাকে আমরা “শেখ মুজিব” নামে চিনতাম তাকে বঙ্গবন্ধু কীভাবে বলি? আমি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে তাকে কখনো বঙ্গবন্ধু বলতে শুনি নাই, কিছু আওয়ামী চামচা ছাড়া। শেষ পর্যন্ত, দেশ, স্বাধীনতা ও উন্নয়ন নিয়ে বক্তৃতা দিয়েই আমার কথা শেষ করেছি যেখানে ঐ শব্দ উচ্চারণ করতে হয় নি। এখন তো যাকে তাকে বলতে শুনি বঙ্গবন্ধু। আর আমাদেরকে তার জন্য কাঁদতে বলা হয়। কিন্তু সেদিন ১৯৭৫ সালে মানুষ হেসেছিল তার হত্যাকাণ্ডে; কারণ ১৯৭৪ এর দূর্ভিক্ষে তাঁরা ভূগেছে এই ব্যক্তির দূঃশাসনের জন্য এবং ৭২-৭৫ এ তাঁর প্রশাসনের অরাজকতা এদেশের মানুষের জীবনে একটা দূঃস্বপ্ন হয়ে ছিল।
বিষয়: বিবিধ
১৫২৯ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন