আরবাকান ও আরদোয়ান
লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ১৯ জুলাই, ২০১৬, ০৮:০৭:০৯ সকাল
প্রত্যেক প্রজন্ম পরম্পরার সামনে ইতিহাসের এক একটা ভিন্ন অধ্যায় থাকে। সে অধ্যায়গুলোর নায়কগণও হন ভিন্ন ভিন্ন। আমরা যারা গত শতকের ৮০ এর দশকের শুরুতে কৈশোরে পদার্পণের পর পরই ইসলামী আন্দোলনের দা‘ওআত পেয়েছিলাম তাদের সামনে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসের অধ্যায়গুলো ৯০ দশকের মাঝামাঝি এসে যাঁরা ইসলামী আন্দোলনে শরীক হয়েছে তাদের চেয়ে ভিন্নভাবে প্রতিভাত হয়েছে।
আমি ইসলামী আন্দোলনের দা‘ওয়াত পাই ১৯৮০ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পরার সময়ে মাত্র ১১ বছর বয়সে। তার মাত্র এক বছর আগে ইরানে বিপ্লব হয়ে হয়ে গেছে। শত বছরের রাজতান্ত্রিক সরকার যা আমেরিকার পুতুল হিসেবে কাজ করছিল তাকে উৎখাত করে ইসলামী-প্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আর একই বছর আরব-জাতীয়তাবাদী-সমাজতন্ত্রী সাদ্দাম হোসেন ইরানের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। সেই একই বছর আফগানিস্তানে মুহাম্মদ দাঊদ খান ও নূর মুহাম্মদ তারাকীদের হাত ধরে কমিউনিস্ট হাফিজ়ুল্লাহ আমীনরা ক্ষমতা দখল করলে তাদের রক্ষা করতে সেনা পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। শুরু হয় আফগান জিহাদ। সে সময়ে আরো আমাদের সামনে যা ছিল তা হল ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার আন্দোলন, কাশ্মীরের স্বাধিকার আন্দোলন, আরাকান, মিন্দানাও ও দক্ষিণ থাইল্যাণ্ড [পাত্তানী] এর মালয়ী মুসলমানদের স্বাধীনতা আদায়ের সশস্ত্র সংগ্রাম। আমরা স্বপ্ন দেখতাম বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের, খিলাফত আলা মিনহাজিন-নুবুয়্যত প্রতিষ্ঠার। আর এই স্বপ্নের ক্ষুদ্র একটি অংশ হিসেবে ছিল বাংলাদেশের জমীনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা। (তাই খালি খিলাফতের নামে ইসলামী আন্দোলনের কাজ বাংলাদেশে দেখে আমার কাছে অবাকই লেগেছিল। সংবিধানের নিচের কথাগুলো আমাদেরকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিলঃ
===========
আমরা ইসলামী বিপ্লব সাধনের প্রচেষ্টায় তৎপর ছাত্রগণ নিজেদেরকে একটি সংগঠনে সংঘবদ্ধ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে-
একঃ আল্লাহর আনুগত্য এবং রাসূল (রা) এর অনুসরণই আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে। আমরা সকল প্রকার আনুগত্য ও দাসত্ব পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্ব অবলম্বন করব। সর্বপ্রকার মত, পথ ও বিধান ত্যাগ করে একমাত্র রাসূল (স) এর আদর্শ জীবন ও পদাঙ্ক অনুসরণ করব। আমাদের এ আনুগত্য ও অনুসরণ জীবনের কোন একটি বিভাগের জন্য হবে না,বরং জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত হবে।
দুইঃ আমরা আমাদের জীবনকে ইসলামের আলোকে উদ্ভাসিত করে তুলব এবং মানবসমাজকে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূল (সা) এর অনুসরণের দিকে ডাকব। আমাদের সংগ্রাম, সার্বিক প্রচেষ্টা-একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত থাকবে, যেন পৃথিবীর বুকে আল্লাহর বাণী সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করে,রাসূল (সা) এর প্রদর্শিত বিধান পৃথিবীর বুকে সঠিক অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানব জাতি ইসলামের ভিত্তিতে তাদের সামগ্রিক জীবন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
এবং তিনঃ বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের পদক্ষেপ হিসেবে আমরা সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্য নিয়োজিত করব।
============
জাতীয়তাবাদী বিষবাষ্প মুক্ত নিখাদ কিছু কথা। এজন্য দুনিয়ার দিকে দিকে মুসলমানদের প্রতিটি সংগ্রামকে আমরা একান্তই আমাদের নিজস্ব করে চিন্তা করেছি। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ইসলামী জাগরণের অগ্রদূতদের খবরও আমরা রাখতাম। তুরস্কে মুস্তফা কামাল দীন-ইসলাম এর প্রভাবকে ধুলোয় মিটিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেই তুরস্কের শহরগুলোতে এবং সরকারী অফিস আদালত ও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কারো দ্বারা ইসলামের প্রভাব প্রকাশিত হওয়া ছিল নিতান্তই অকল্পনীয় অপরাধ। কিন্তু সে দুঃসাহসী অপরাধই করে বসেছিলেন ইস্তানবুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র নাজমুদ্দীন আরবাকান। উসমানী আমলের বিচারক [কাজ়ী] মুহাম্মদ সবরীর পুত্র নাজমুদ্দীন ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে নামাজ আদায় করতে শুরু করেন এবং তাঁর দেখাদেখি আরো কিছু তরুণ তাঁর নেতৃত্বে নামাজ় আদায় করতে শুরু করেন। ফলে তিনি হয়ে যান তাদের হোজ্জা [খোয়াজা বা খাজার তুর্কী উচ্চারণ] বা ইমাম/মোল্লা। নাজমুদ্দীন পরে জার্মানীতে মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং এ পি-এইচ, ডি, করেন এবং আরো একটা মাস্টারস ও পি-এইচ,ডি, করেন সউদী আরবের কিং সঊদ ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে। তিনি সে সময় পর্যন্ত তুরস্কের সব চেয়ে কম বয়সে (মাত্র ২৭ বছর) ইস্তাম্বুল টেকলনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে এসোসিয়েট প্রফেসর হন।
১৯৬৯ সালে নাজমুদ্দীন সেক্যুলার জীবন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন। সে বছর তিনি "মিল্লী গুরুশ" নামক দর্শন প্রকাশ করেন। মিল্লী গুরুশ মানে “জাতীয় দর্শন/দৃষ্টিভঙ্গী”। এখানে মিল্লী/জাতীয় বলতে তিনি তুর্কী জাতীয়তাকে বুঝাননি, বরং ইবরাহীমী মিল্লাতকে বুঝিয়েছেন। আর এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি গড়ে তোলেন মিল্লী নিজ়াম পার্টি", যা ব্যান্ড হয়ে গেলে তিনি নতুন দল মিল্লী সালামত পার্টি গড়েন। তিনি রিপাব্লিকান পিপলস পার্টির বুলন্দ আজেবিদ এর সাথে কোয়ালিশন সরকারেও অংশ নেন। ১৯৭৪ এর সাইপ্রাস সংকটে আরবাকানই তুর্কী সেনা [সাধারপণ তুর্কিরা এদেরকে মুজাহিদীন আখ্যা দেয়, যা সেক্যুলার তুর্কিতে অকল্পনীয় ছিল] পাঠিয়ে গ্রীকদের দাপট থেকে সাইপ্রাসের তুর্কী মুসলমানদের রক্ষা করেন যার ফলে টার্কিশ-সাইপ্রাস আলাদা হয় এবং এখনও আছে। ১৯৮০ এর সামরিক অভ্যুত্থান কোয়ালিশন সরকারকে উৎখাত করে এবং আরবাকান ও তাঁর মিল্লি সালামত পার্টিকে নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৮৭ সালে তাঁর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে তিনি রেফাহ পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৯৫ এর সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। ফলে তিনি ১৯৯৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের প্রধান হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর স্বল্প সময়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে তিনি তুরস্ককে মুসলিম বিশ্বের কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। তিনি গড়ে তোলেন D-8 (ডেভেলপিং-৮) নামে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৮টি দেশের উন্নয়ন জোট, বাংলাদেশও যার অংশ ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অবশ্যই মুসলমানদের অগ্রগতিকে ভাল চোখে দেখে না। ফলে আবারও আর্মি অপ্রকাশ্য ক্যু এর মাধ্যমে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। তারপর সাংবিধানিক আদালত সেক্যুলারিজমকে অবদমন করার অভিযোগ এনে তাঁর পার্টি ও তাঁকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করে। তার তত্ত্বাবধানেই আবার গড়ে উঠে ফজ়িলত পার্টি। পরে সাংবিধানিক আদালত ফজ়িলত পার্টিকে নিষিদ্ধ করে তখন এর সদস্যরা ভাগ হয়ে যায় এবং নতুন করে আদালত ওয়া কালকিমনা পার্টি [AK Party] গঠন করা হয় আরদোয়ান ও আব্দুল্লাহ গুলদের নেতৃত্বে এবং সা’আদত পার্টি গঠন করা হয় রেজাই কুতানদের নেতৃত্বে। আরবাকান সা’আদত পার্টির উপদেষ্টা থেকে যান। তিনি ২০১১ সালে ইন্তিকাল করেন।
আরদোয়ানরা মূলত আরবাকানের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। আরদোয়ানরা ময়দানে নেমেই একটা উর্বর জমি পেয়ে যাননি, বরং হোজ্জা যে সংগ্রামী জীবন যাপন করেছেন তা তুরস্কের মুসলমানদের ইসলামী জ়িন্দেগী যাপনের আকংখাকে জাগিয়ে দিয়েছে, আর তারই ধারাবাহিকতায় সাফল্য লাভ করেছেন আরদোয়ানরা। তিনি ছিলেন একাধারে একজন রাজনৈতিক, সমাজ বিজ্ঞানী ও যন্ত্রকৌশল বিজ্ঞানী [মেকানিক্যাল সায়েন্টিস্ট]। জ্ঞান অর্জনকে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি যখন মালয়েশিয়া সফর করছিলেন তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে [IIUM] এসেছিলেন ভাষণ দিতে। মালিক ফয়সল হলে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন - তুর্কি ভাষায়, ইংরেজীতে নয়। তাঁর ভাষণ সাথে সাথে অনুবাদ করা হচ্ছিল। কিন্তু তাঁর বক্তৃতার অধিকাংশ অংশ জুড়ে থাকা “আলিম ও ইলিম” [বিজ্ঞানী ও জ্ঞান] শব্দগুলো অনুবাদ ছাড়াই আমরা বুঝতে পারছিলাম।
এই হচ্ছেন হোজ্জা, আরদোয়ানের চেয়েও তাই আমাদের স্মৃতিতে আরবাকান অনেক বেশি প্রভাবশালী। ২০১১ সালে তিনি যখন মারা যান তখন তিনি মূলত তাঁর দেশের অবিসংবাদিত পিতৃপুরুষে [Virtual Father of His Nation] রূপান্তরিত হন। এজন্যই হয়তো তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর আগে আধুনিক তুরস্কের ২য় প্রেসিডেন্ট (কামাল আতাতুর্কের পর) ইসমত ইনুনো নাজমুদ্দীন আরবাকান সম্পর্কে বলেছেন যে তুরস্ক তাঁর আধুনিক ইতিহাসে একজনই সাহসী সন্তানের জন্য দিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় দাফন করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি ওসিয়্যত করে যান তাঁকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়। তারপরও তাঁর জানাজ়ায় তুরস্কের সব রাজনৈতিক নেতারা অংশগ্রহণ করেছেন। আরদোয়ান ও আব্দুল্লাহ গুল তাঁর লাশের খাটিয়া বহন করেছেন। সুলতান ফাতিহ মসজিদ থেকে গোরস্তান পর্যন্ত যেতে তাঁর জানাজ়ায় অংশগ্রহণকারী মানুষের মিছিল প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ হয়ে যায়। ইসলামের ইতিহাসের একজন সত্যিকার সাহসী মানুষ হচ্ছেন হোজ্জা ডক্টর নাজমুদ্দীন আরবাকান। আর আমাদের সময়ে তিনিই ছিলেন তরুস্কের ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১৪৮০ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আরবাকান ও এরদুগান ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্লোগান এর পরিবর্তে মানুষের কল্যান এর দিকে বেশি নজর দিয়েছেন। আর তার ফলে ইসলামই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাজহাবি বিরোধ থেকে তারা গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন কে। তার পুরুস্কার ও তারা পেয়েছেন। এই উদ্যোগ কে তারা ভয় করে বলেই জামায়াত-ইসলামি নিয়ে না যত চেষ্টা বেশি নযর ইসলামি ব্যাংক এর দিকে।
আব্দুল্লাহ গুলদের সম্পর্কে লিখেন। যিনি
পেনসেলভিনিয়ায় থাকেন। আমার কাছে গুলকে আকবরী ইসলামের মত মনে হচ্ছে।
উনার সম্পর্কে লিখেন
মন্তব্য করতে লগইন করুন