জামায়াতে ইসলামীর সমালোচনা ও তার প্রতিক্রিয়াঃ আমার পর্যবেক্ষণ
লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ২২ মার্চ, ২০১৬, ০৮:০৯:২৯ সকাল
বাংলাদেশে তথা ভারতীয় উপহাদেশে বিংশ শতাব্দীতে ইসলামের পূনর্জাগরণের জন্যই মূলত জামায়াতে ইসলামীর সৃষ্টি হয়েছিল। আল-উস্তাজ আল-ইমাম আবুল আ’লা আল-মওদূদী (রহিমাহুল্লাহ) দীন প্রতিষ্ঠার কাজের অগ্রগামী দল [vanguard-pioneers] হিসেবে একটা সালিহ জামা’আতের প্রয়োজনীয়তা থেকে এই সংগঠনটি গড়েন। তিনি তরজুমানুল-কুর’আনে এক নিবন্ধ লিখেন “এক সালিহ জামা’আত কি জুরুরত” [একটি সত্যনিষ্ঠ দলের প্রয়োজন] শিরোনামে। আর সেই আহবানে সাড়া দিয়ে সারা হিন্দুস্তান থেকে দীনী কর্মিরা গড়েন জামাআত-ই-ইসলামী। মূলত জাহিলী মতাদর্শগুলোর চতুর্মূখী আক্রমন থেকে ক্বওমকে সচেতন করে এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় ও দীনের মূল স্পিরিটকে যিন্দা করে দীনকে বিজয়ী করাই ছিল এ জামা’আতের মূল লক্ষ্য।
উস্তাজ মওদূদীর (রহিমাহুল্লাহ) কাজ শুরু করার সময় থেকে যদি আমরা ধরি তাহলে এখন প্রায় ১০০ বছর অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে। ১৯৪১ সালে জামা’আত প্রতিষ্ঠা করা হলেও তাঁর (রহিমাহুল্লাহ) চিন্তাধারার প্রকাশ শুরু হয় সেই খিলাফত আন্দোলনের সময় থেকেই। তাঁর মাস্টারপিস “আল-জিহাদ ফিল-ইসলাম” ১৯২৭ সালেই প্রকাশিত। এটি শুধু ইসলামের জিহাদের ধারণাকেই পরিষ্কার করে নি বরং আন্তর্জাতিক আইনের একটা মাস্টারপিসও এটি যাতে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করা হয়েছে।
যাই হোক, একটা শতাব্দী পার হতে যাওয়া এই আন্দোলন স্বাভাবিকভাবে অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে, এটি একটি জেনারেশন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যারা আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দীনের বিজয়ের আকাঙ্খা ছাড়া আর কিছু জীবনে পোষণ করে না; এর কর্মিরা ইসলামী জীবন-যাপনের ব্যাবহারিক রূপের বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি [institution building] করেছে; আধুনিক জাহিলিয়াতগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর অসারতা প্রমাণ করে বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার রচনা করেছে; সাধারণ মুসলমানদের কাছে ইসলাম জানা ও কুর’আনকে বুঝার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে তাদের মধ্যে আগ্রহ জাগিয়েছে; আর ত্যাগ ও কুরবানীর পরম পরাকাষ্ঠার অসংখ্য উদাহরণ পেশ করেছেন জামাআত কর্মিরা, ইত্যাদি।
অন্যদিকে সময়ের আবর্তনে আন্দোলনে অবক্ষয় [degeneration] হয়েছে, যা নিতান্তই স্বাভাবিক। সেজন্য সমালোচনাও হচ্ছে। অবশ্য জামাআত তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই সমালোচনার মুখে আছে। বিংশ শতকের শেষ দিকে এসে এবং একবিংশ শতকের শুরুতে এ সমালোচনার পরিমাণ বেড়েছে। সব সমালোচনার উপর বাংলাদেশে জামাআতে ইসলামীর সমালোচনার ঝুড়িতে যোগ হয়েছে একাত্তরের আত্মঘাতী যুদ্ধের বিষয়টাও। এখানে আমি জামাআতের ইসলাম বিরোধি সমালোচকদেরকে বাদ রাখছি। আমি জামা’আতের ইসলামপন্থি সমালোচকদেরকে তিন ধরণের দেখতে পাই।
একঃ যারা জামা’আত বিরোধি। এইগ্রুপটা ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক জামাআতের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ নিয়ে আছে, যার অধিকাংশই অবশ্য ভিত্তিহীন। এরা জামাআতে ইসলামীর সমালোচনা দেখলে খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। মনে করে জামাআতকে দাবিয়ে দিতে পারলে তাঁরা নিজেরা ময়দান দখল করতে পারবেন। এদের মধ্যে দেওবন্দী, সালাফী, জিহাদী, মাজারী, ইত্যাদি সবাই আছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ এতই চরমপন্থী যে তাদের নিজেদের আদর্শ বিরোধি কোন কিছু দিয়ে যদি ইসলাম বিরোধিরাও জামাতের সমালোচনায় লিপ্ত হয় তাহলে এরা তাকেও সমর্থন করে।
দুইঃ এরা সাবেক জামাতী। এই দলটা কখনো জামাআতে ছিল। এরা বিভিন্ন পলিসি ভিন্নতা ও অন্যান্য কারণে জামাআত ত্যাগ করেছে এবং এর সমালোচকে পরিণত হয়েছে। এদের কেউ কেউ এখনো জামাআত শিবিরের অংশও আছে। এদের অনেকে আবার মূলত মডার্নিস্ট ও জাতীয়তাবাদী দর্শন লালন করেন। এই শেষোক্ত গ্রুপ্টা ইসলামের সাথে ১০০% আপোষ করতে পারে নি। এরা ইসলাম-পসন্দ, তবে জাহিলিয়াতকে পুরোপুরি অনুধাবন না করার কারণে একে ত্যাগ করতে পারে না। এই গ্রুপটা আবার সেই একাত্তরের যুদ্ধটা নিয়ে ভীষণ হীনমন্যতায় ভোগে। তাদের জাতীয়তাবাদী অন্তর এটা মেনে নিতে পারে না যে জামায়াতে ইসলামী একটা প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রকে আঞ্চলিক ও গোত্রিয় জাতীয়তাবাদী আহবান দিয়ে বিভক্ত করার বিরোধি ছিল। যারা বিচ্ছিন্নতার ডাক দিয়েছে তারা ছিল সুপরিচিত ইসলাম-বিদ্বেষী এবং তাদেরকে সুষ্পষ্টভাবে সহায়তা করছিল মুসলমানদের পরিচিত দুশমন মুশরিকরা (ভারত) ও নাস্তিকরা [সোভিয়েত ইয়নিয়ন]। এই গ্রুপটার সমালোচনাতে ৭১ একটা বিরাট ইস্যু হিসাবে থাকে সবসময়ই।
তিনঃ এই গ্রুপটা মূলত জামাআতের অবক্ষয় নিয়ে চিন্তিত টাইপের সমালোচক। এরা বিভিন্ন ধরণের - কেউ জামাআতের বাইরের কিন্তু শুভাকাংখী, কেউ সাবেকী কিন্তু এখনো জামায়াতের সাথে আত্মার বন্ধন অনুভব করেন; আবার কেউ বর্তমানের - এর ভেতরের। এদের উদ্বেগ হল জামায়াতের লক্ষ্যচ্যুতি ও প্রতিষ্ঠাকালীন পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া। এরা মূলত জামাআতকে ভালবাসেন; এর অবদানকে স্বীকার করেন; ইসলাম বিরোধিদের মুক্বাবিলায় ও বাংলার মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার অগ্রসেনানী হিসেবে জামাআতকে মনে করেন। তাই এর অবক্ষয়ে এরা ব্যাকুল হয়ে উঠেন। আর তাদের এই ব্যাকুলতা কখনো কখনো অত্যন্ত কঠোর সমালোচনা হিসেবে প্রকাশ হয়ে পড়ে।
সমালোচনার মুক্বাবিলায় হার্ডকোর জামাতিদের প্রতিক্রিয়াঃ
জামাআত সমর্থকরা অনেক সময়ই সমালোচনাকে মোটেই সহ্য করতে পারেন না। এটা ঠিক যে নিঃসন্দেহে জামাআতের অনেক সমালোচনাই অন্যায় সমালোচনা। কিন্তু তাই বলে সব ক্ষেত্রেই একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে না। উদাহরণ স্বরূপ Ali La Pointe এর একটা পোস্টের একটা অংশ যা আমি কোট করে পোস্ট করেছিলাম তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যেতে পারে। আলীর পোস্টটা ছিল মূলত বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্কট নিয়ে এবং মুসলমানদের ভবিষ্যত নিয়ে। বাংলাদেশের রক্ষক হিসেবে অনেক আইডিয়া ও আইডিওলজির সাথে জামায়াতের কথাও সে সেখানে এনেছে। “জামায়াতে ইসলামীরে আমি মোটামুটি আদর্শবিচ্যুত একটা দল মনে করি। ………" এইটা দিয়ে শুরু হওয়াতে সম্ভবত একদল প্রচণ্ড খূশি হয়েছে এবং আরেক দল প্রচণ্ড ক্ষেপেছে। জামায়াত বিরোধি ইসলামিস্তোরা খুব খুশি হয়েছেন, অন্যদিকে জামাতিরা গিয়েছেন ক্ষেপে। কথাটা কঠোর হলেও ভেতরের কথাগুলো পড়লে যে কেউ বুঝবে জামায়াতের বিরাট অবস্থানকে সে কিভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আদর্শবিচ্যুত হলেও এদেশে ইসলাম ও এদেশের মুসলমানদের আযাদী রক্ষার ক্ষেত্রে জামাআতই এখন পর্যন্ত একমাত্র ঢাল হিসেবে আছে, যদিও এতে অসংখ্য ফুটো তৈরি হয়েছে। সে আশংকা করেছে এই ঢালকে ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা গুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে অথবা হয়তো ইতোমধ্যে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু আমাদের জামাতি ভাইদের প্রতিক্রিয়া সবসময়ই যা হয় তা হলঃ ময়দানে আসেন, তাইলে বুঝবেন। উনাদের অবস্থান হল যেন যেই ভাইয়েরা এরকম লিখেছেন তারা ময়দানের বাইরে থাকেন। তারা সম্ভবত ত্যাগ ও কুরবানী দেয়া থেকে বিরত রয়েছেন। ময়দানে থাকা মানেই আপনি সঠিকভাবে আছেন ব্যাপারটা এমন না। ময়দানে থেকেও আপনি হয়তো আপনার লক্ষ্যের বিপরীত কিছু হাসিল করতে পারেন। এইটা উনারা বুঝতে চান না।
আমার পর্যবেক্ষণঃ
একটা সংগঠনে চিন্তার ঐক্য জরুরী। কিন্তু সেটা আসে অনেক চিন্তার পর্যালোচনার মাধ্যমে। আধুনিক ব্যবস্থাপনায় এটাকে বলে গ্রুপ-কোহেসিভনেস [Group Cohesiveness]। এইটা একটা ভাল দিক। কিন্তু এইটা যদি কুকুনে (cocoon) আবদ্ধ সীমাবদ্ধ চিন্তার সমষ্টি হয় তখন সমস্যা হয়। এ ধরণের চিন্তা হল ব্যবস্থাপনার ভাষায় গ্রুপথিংক [Groupthink]। এটা একটা সংগঠনকে পশ্চাদপদ করে দেয়। নিজেদেরকে তখন ত্রুটিহীন মনে হয় ও নেতাদেরকে মনে করা হয় তাঁরা ভুল করেন না। এভাবে একটা সংগঠন হয় পশ্চাদদিকে চলতে থাকে অথবা স্থবির হয়ে পড়ে। আর স্থবির হওয়া মানেও কিন্তু পশ্চাদগামী হওয়া আসলে, কারণ সারা দুনিয়া তখন সামনে চলছে। একটা সংগঠনকে প্রতিনিয়ত তাজদীদ [renewal বা নবায়ন] এর মাধ্যমে চলতে হয়। এই নবায়ন করতে ব্যর্থ হলে তা এন্ট্রোপি [ক্রমান্বয়ে অস্তিত্বহীন] এর দিকে ধাবিত হয়। এ যদি এন্ট্রোপি এড়াতেও পারে তবুও শেষ পর্যন্ত সমকালীন কর্মধারায় আস্তে আস্তে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এই বিষয়টা জামাত নেতৃত্ব ও কর্মীবাহিনীকে বুঝতে হবে।
জামায়াতে ইসলামী ইসলামের তাজদীদের অনেক কাজ করেছে। এ স্বীকৃতিতো দিতেই হবে। কিন্তু সময়ের আবর্তনে ইসলামের তাজদীদের যে কাজ এটা হাতে নিয়েছিল তা কাগজে কলমে থাকলেও এর কর্মধারায় আস্তে আস্তে তার অনুপস্থিতি পরিস্ফুট হয়ে উঠছে। তাজদীদের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তনের চেয়েও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই হয়ে গিয়েছে মূখ্য। আর এটাকেই অনেক ভাইদের কাছে ময়দানে কাজ করা মনে হচ্ছে। এখন যা দরকার তা হল জামাআতের নিজস্ব তাজদীদের।
আমার কাছে যা মনে হয় তা হল ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য বর্তমান জামাতের আসলে সুস্পষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে একটা পদ্ধতিগত স্থবিরতায় উপনীত হয়েছে সংগঠনটি। ভোটে দাঁড়ানো ও ভোটে নির্বাচিত হয়ে ইসলামের আলোকে মানুষের খিদমত করা খারাপ কিছু না। তবে যদি মনে করা হয় খালি ভোটের মাধ্যমে দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে, তবে তা এক ধরণের পাগলামী বই অন্য কিছু না। আমি যা দেখি তাহল অসংখ্য জামা’আত-শিবির কর্মীর [কর্মী বলতে এখানে, কর্মী, সাথী, সদস্য, রুকন, ইত্যাদি সবই বুঝানো হচ্ছে] মাঝে আদর্শের যথাযথ জ্ঞান নেই। অথচ শিবিরের কর্মসূচীর একটা হল - সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ ব্যক্তিদেরকে যথার্থ প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে জাহিলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের যোগ্য করে গড়ে তোলা। আমি আমার কিছু পোস্টে জাতীয়তাবাদী চেতনা দ্বারা ইসলামী আন্দোলন আক্রান্ত হবার কথা বলেছিলাম। কিন্তু জামাত-শিবির কর্মীরা সেটাকে বুঝেছে বি,এন,পি, এর সাথে জোট করার বিষয় হিসেবে। অন্য বিষয়গুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম।
সময়ের আবর্তনে অনেক ইসলামী আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। সেগুলো আবার ইতিহাসের গতিধারায় হারিয়ে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। আন্দোলন হারিয়ে যাবে, কিন্তু ইসলাম হারাবে না। ইসলামের স্পিরিটটাই এমন যে এ আবার নতুন আন্দোলনের জন্ম দেবে। এভাবে সময়ের পরিক্রমায় ইসলামের তাজদীদের কাজ চলতেই থাকবে। কাল একটা আন্দোলন এ কাজ করেছে; আজ আরেকটা আন্দোলন তা করছে, আগামীকাল নতুন একটা আন্দোলন তা করবে। এক সময় উমর ইবনু আব্দুল আজীজ (রহিমাহুল্লাহ) তাজদীদের কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের অল্প কিছু কাল পরেই সেই তাজদীদের প্রভাব হারিয়ে গেছে। ইমাম আশ-শাফি’ঈ [রহিমাহুল্লাহ] হিজ্রী ২য় শতকে তাজদীদের কাজ করেছেন। অন্যান্য আইম্মাগণ করেছেন। তারপর ইবন তাইমিয়াহ [রহিমাহুল্লাহ] তাজদীদের কাজ করেছেন। আমাদের উপমহাদেশে আকবরের ভ্রান্তির সময়ে শায়খ আহমদ সরহিন্দি [রহিমাহুল্লাহ] তাজদীদের কাজ করেছেন, এরপর ইয়ামা শাহ ওয়ালী উল্লাহ দিহলাবী [রহিমাহুল্লাহ] করেছেন। আর শেষোক্তজনের ভাবধারাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলবী [রহিমাহুল্লাহ] এর নেতৃত্বে জিহাদ ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হয়েছে। সময়ের আবর্তনে একটা আন্দোলন হারিয়ে গেছে; কিন্তু তাদের প্রভাব ও ভাবধারায় নতুন আন্দোলনের জন্ম হয়েছে।
সময়ের পরিক্রমায় একটা আন্দোলন যখন নিজের তাজদীদ করতে পারে না এবং নিজেদেরকে সবসময়ই সঠিক থাকার আত্মতুষ্ঠিতে ভোগে তখন এটা আস্তে আস্তে এন্ট্রোপিতে চলে যায়। জামাত এর অবস্থাও অনেকটা ওরকম হতে যাচ্ছে বলে আমার মনে হয়। যদি জামাত নিজেদের মধ্যে তাজদীদ করতে ব্যর্থ হয়, তাদের কর্মী-বাহিনীর আদর্শিক জ্ঞানের পরিশুদ্ধি করতে না পারে, ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য প্রয়োজনীয় নতুন পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় এবং শুধুই গতানুগতিক ভোটের রাজনীতিই করতে থাকে তবে ইসলামী আন্দোলন হিসেবে এটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। হ্যাঁ, “ইসলাম-পসন্দ রাজনৈতিক দল” হিসেবে এটা হয়তো আরো অনেকদিন টিকে থাকবে; কিন্তু একটা সর্বব্যাপী বিপ্লবী ইসলামী আন্দোলন হিসেবে এর কোন প্রভাব থাকবে না। ইসলামের শত্রুদের কাছে এটি আরো অনেকদিন ইসলামের একটা মজবুত দুর্গ হিসেবে প্রতীয়মান হতে থাকবে এবং তাদের আক্রমনের লক্ষ্য জামাত থেকেই যাবে। কিন্তু এ আক্রমন ধীরে ধীরে এ কেল্লার দেয়ালে ফাটল ধরাবে, তারপর এটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এরপর সময়ের পরিক্রমায় নতুন আন্দোলন গজাবে, শাখা প্রশাখা মেলবে, বাতিলের লক্ষ্যে পরিণত হবে। আল্লাহ চাহেনতো তাদের মাধ্যমে ইসলামকে বিজয়ী করবেন; না হয় সময়ের পরিক্রমায় এ আন্দোলনও এন্ট্রোপির পথ ধরবে। কিন্তু জামাত যদি নিজেদের তাজদীদ করতে পারে, কর্মী বাহিনীর আদর্শিক জ্ঞানের রি-ওরিয়েন্টেশন করতে পারে এবং ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য নির্বাচন ছাড়াও আরো ফলপ্রসূ কর্মসূচী নিয়ে আগাতে পারে তবে এ এন্ট্রোপি থেকে রক্ষা পাবে এবং ইসলামী আন্দোলন হিসেবে সমাজকে এটা আরো অনেক কিছুই দিতে পারবে।
শেষ কথা হলঃ ইসলাম কখনোই বিজয়ী হবে না, যতক্ষণ না ইসলাম পন্থীরা নিজেদের মধ্যকার মতভেদগুলোকে স্বীকার করে নিয়ে পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি বাদ দিবে এবং বাতিলের মুক্বাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। সুতরাং জামাত-শিবির ময়দান থেকে চলে গেলে অন্যদের খুব খুশি হবার কিছু নেই।
বিষয়: বিবিধ
১৫৯৭ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাইজান,
’ময়দানের অবস্থা না বুঝে সমালোচনা’র বিরোধীতা এজন্যই করছি; যেখানে সমালোচনাকারীদের জানা থাকা উচিৎ- জেল-জুলুম-হুলিয়া মাথায় নিয়ে কর্মিরা দিশে হারা, কোথাও ২/৪জন একত্রে বসার সুযোগ নেই, নিজে কোন রকম আত্মরক্ষা করে চললেও পরিবার পরিজনকে নিয়ে টানা টানি করে পুলিশ আর সরকারী গুন্ডারা,তারপাও জীবন বাজি রেখে তাদের যতটুকু সাধ্যে কুলোয় তা করে যাচ্ছে। আমি অন্তত এসবের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। জামায়াত শিবির কর্মিরা এখনো বিশ্বাস করে তাদের জন্য রাজনীতি মাত্র ১৫/২০% এর বেশী নয়, বাকীটা আত্মগঠন। আমি বিশ্বাস করি সংগঠিত ভাবে না হলেও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তাদের অনেকেই জ্ঞান চর্চায় নিবেদিত রয়েছেন।
েআরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো- বিপদের মুহুর্তে বন্ধু/প্রাক্তন বন্ধু/মহব্বতকারীদের নিকট থেকে কোন সমালোচনা মোটেই নয়, এসময় বন্ধুদের উচিৎ নিজেদের সমালোচনার গবেষণা স্তগিত রেখে অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাদের মানষিক উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করা। বিপদের উপর জবাবাদিহিতার মধ্যে নিক্ষেপ করা বুদ্ধিমানে কাজ বলে আমি মনে করিনা। বেঁচে থাকলে সমালোচনা অনেক করা যাবে,জামায়াত-শিবির কর্মিরা সমালোচনার উর্ধে মোটেই নয়।
একজন জ্ঞানী মানুষ হিসেবে আপনার প্রতি যথাযত সম্মান রেখেই বলছি- স্থান-কাল-পাত্রের বিবেচনা একটি মূখ্য বিষয়।
এসব সমালোচনার কারনে বিরোধীরা সুখ অনুভব করে লাইকে লাইকে ভরিয়ে দেয়,এতে সাধারণ সমর্থকরাও যথেষ্ট বিভ্রান্ত হয়। কর্মিদের মনোবল ভেঙে যায়।
আশাকরি আমাদের জ্ঞানী বন্ধুগণ বিষয়টি উপলব্ধি করবেন।
ধন্যবাদ এবং মন্তব্য মনোকষ্টের কারণ হলে ক্ষমা প্রার্থী।
এখন কিংবা গত কয়েক বছর ধরে আদর্শের সঠিক লাভের জন্য চর্চা করাটা যে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার জ্বলজ্যান্ত সাক্ষী আমি বা আমরা। এই অবস্থায় কিছুটা গ্যাপ পড়বে, এটাই খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতেও যে সময়টা খেলাধুলা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত মাতামাতি-সময় ব্যয়, ফেসবুকে নিত্য নতুন ছবি আপলোডের বন্যা বইয়ে দিয়ে লাইক কমেন্ট পাবার আশায় লালায়িত হয়ে ঘণ্টার পর সময় কাটানোতে তো জুলুম নির্যাতনে বিধ্বস্ত চেহারা পরিলক্ষিত হয়না। কেন?
যদি জুলুম নির্যাতনে অসহায়, বিষণ্ণ আমার পক্ষে আদর্শের জ্ঞান চর্চা কঠিন হয়ে পড়ে তাহলে উপরে উল্লেখিত কাজগুলো করতে আমার এতো আনন্দ আসে কোথা থেকে?
আমিও বিশ্বাস করি, কিছু ভাই ব্যক্তিগতভাবে চর্চাটা চালিয়ে যায়, কিন্তু সংখ্যাটা দিনকে দিন যে ছোট হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
জলজ্যান্ত একটি উদাহরণ দিচ্ছিঃ
সেদিন বাসার সন্নিকটে ওয়াজ হচ্ছিল যার প্রধান অতিথি ছিলেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। বিশেষ অতিথির তালিকায় ছিলেন ডিএমপি'র ডেপুটি কমিশনার পদবীর একজন পুলিশকর্তা। পুলিশকর্তা তার বক্তৃতায় বললো, "আমি ক্বওমী মাদ্রাসাকে ভালোবাসি কারণ এখানে মওদূদীবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষা দেয়া হয়।"
"ইসলাম কখনোই বিজয়ী হবে না, যতক্ষণ না ইসলাম পন্থীরা নিজেদের মধ্যকার মতভেদগুলোকে স্বীকার করে নিয়ে পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি বাদ দিবে এবং বাতিলের মুক্বাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। সুতরাং জামাত-শিবির ময়দান থেকে চলে গেলে অন্যদের খুব খুশি হবার কিছু নেই।"-সঠিক কথাটিই বলেছেন।
জাযাকাল্লাহ খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন