ইসলামপন্থীদের গানে দেশাত্মবোধঃ আমাদের কাল ও একাল

লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ০৪ মার্চ, ২০১৬, ০৮:৫৪:৫৬ সকাল

আমাদের এই লিখায় আমরা দেখবো কীভাবে ইসলামপন্থীদের দেশাত্মবোধের মাঝে জাতীয়তাবোধ ঢুকে পড়ে তা জাহিলিয়্যাতের দিকে মোর নিয়েছে। এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা দেশাত্মবোধক গান নিয়ে কথা বলব। আর আমাদের কাল বলতে বলতে বুঝিয়েছি বিগত শতকের ৮০ এর দশক এবং একাল বলতে বুঝিয়েছি একবিংশ শতকের শুরু থেকে নিয়ে এখন পর্যন্তকার সময়ের আবর্তন।

ইসলামী আন্দোলন মূলত তাওহীদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এটা কোন নির্দিষ্ট ভূগোলে আবদ্ধ স্থানীয় আন্দোলন না। এটা জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এটা সাধারণ ওয়াজ-নসীহতকারী বিচ্ছিন্নভাবে তাওহীদের দাওয়াত দানকারীদের থেকে ভিন্ন। মনে রাখতে হবে ইসলামী আন্দোলন খালি ওয়াজের আন্দোলন না; বরং একটা সর্বব্যাপী প্রচেষ্টার নাম যাতে সংগঠিত হওয়া, সংঘবদ্ধ জীবন-যাপন করা, ইসলামী জীবনের ব্যবহারিকরূপকে বাস্তবে প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা চালানো ও এজন্য প্রকল্প গড়ে তুলে সেগুলো চালু করা, ইত্যাদি সবই এর অন্তর্ভূক্ত। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা তাওহীদের প্রকারভেদের একাডেমিক আলোচনা না জেনেই তাওহীদে বিশ্বাসী হয়ে যায় এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের ব্যবহারিক দিকে তা এমনিতেই পরিষ্ফুট হয়ে উঠে।

জীবনের সামগ্রিক দিকে ইসলামের প্রতিফলন ঘটানোর অংশ হিসাবে ইসলামী আন্দোলনের সাহিত্য কর্মীরা গানও রচনা করেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু অনন্য সুন্দর দেশাত্মবোধক গান রয়েছে। দেশাত্মবোধ মানুষের সহজাত প্রকৃতির একটা অংশ। তাই তাদের অনেক গানের কথায় এই দেশাত্মবোধ ফুটে উঠেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই সহজাত দেশাত্মবোধ ঈমান-বিধ্বংসী জাতীয়তাবাদী জাহিলী রূপ পরিগ্রহ করতে পারে খুব সহজে। আর অধিকাংশ দেশাত্মবোধক গানেই থাকে প্রচণ্ড জাতীয়তাবাদী আবেগ। এই আবেগ আপনার প্রচণ্ড ভাল লাগবে এবং আপনাকে সাংঘাতিকভাবে আলোড়িত করবে।

যাই হোক, আমাদের কালে ইসলামী সংস্কৃতি কর্মীরা অনেক দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছেন। কিন্তু সেগুলো ছিল জাতীয়তাবাদী জাহিলিয়াত মুক্ত - অন্তত আমার শোনাগুলো। চাটগাঁর পাঞ্জেরী শিল্পীগোষ্ঠি ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়। তাদের গানগুলোতে তাওহীদ ও বিপ্লবের প্রতিধ্বনি থাকত সবচেয়ে বেশি। তৌহীদের অনুপ্রেরণায় সিক্ত শিল্পীর কলম দিয়ে দেশাত্মবোধ বেরিয়েছে কিন্তু তা ছিল জাতীয়তাবাদমুক্ত। আব্দুল-হালীম চৌধুরী, চৌধুরী গোলাম মাওলা ও অন্যান্যরা ছিলেন এসব গানের রচয়িতা। মনে রাখবেন দেশাত্মবোধ সাহাবা-ই-আজমাঈন [রাদিয়াল্লাহু আনহুম] -দেরও ছিল। কিন্তু তাঁরা আল্লাহর রাস্তায় তাঁকে কুরবানী করেছেন, আর তা কখনো জাহিলিয়্যাতে রূপ নেয়নি। আসুন আমরা আমাদের সময়ের কয়েকটা দেশাত্মবোধক গানের কথা দেখি।

১. এ আমার হৃদয় ভরা আকুল করা জন্মভূমি

এ আমার হৃদয় ভরা আকুল করা জন্মভূমি

এ আমার স্বপ্ন সুনীল ভালবাসার পূণ্যভূমি।

এখানে সাত সকালে কোকিল ডাকে

শালিক আর পায়রাগুলো যায় উড়ে যায় অনেক দূরে

লাঙ্গল কাঁধে ছোটে চাষী

তুলে সুর মনমাঝি

দাঁড় টেনে যায় আপন মনে।

বিকেলের মিষ্টিরোদে খেলার মাঠে

কানামাছি দাড়িয়া বান্ধা, লুকোচুরি ওঠে মেতে

সূর্য্য পাটে গেলে মিনারে আজান হ'লে

যায় ফিরে সব আপন ঘরে।।

----চৌধুরী আব্দুল হালিম

আরেকটা লক্ষ্য করুনঃ

২. এই তো সে দেশ

এইতো সে দেশ, সাঁঝের বেলায় যেথা

ভেসে আসে দূর হতে ভাটিয়ালী সূর

পাখিরা যায় ফিরে ডানা মেলে নীড়ে

আজান আসে ধীরে আহা মধূর।

এখানে পাখিগুলো গান গেয়ে যায়

এখানে নদীগুলো যায় বয়ে যায়

নিঝুম চরাচরে সাগর তীরে তীরে

হৃদয় যায় উড়ে দূর বহুদূর।

সবুজ সমারোহে যায় ভরে প্রাণ

হৃদয় জুরে উঠে আমার প্রভূর গান।

প্রভূর সৃষ্টিতে রহম দৃষ্টিতে

ধরণী নিয়ামতে হল ভরপূর।

---চৌধুরী আব্দুল হালিম।

৩. ভাটির দেশে জন্ম আমার

ভাটির দেশে জন্ম আমার

জন্ম নদীর দেশে

দুখের মাঝেও দিন কেটেছে

তাকেই ভালবেসে।।

পাহাড় নদী ধানের ক্ষেতের এমন মোহন ছবি

পুবের আকাশ সাজিয়ে তোলে শিশির ধোয়া রবি

পাখির গানে ফুলের ঘ্রানে

শ্যাম বনানী আমায় টানে

সবুজ গাঁয়ের সরল কৃষান দু’হাত বাড়ায় এসে।।

প্রতিদিনের ভোরের আজান

জ্বালায় প্রানে দীপ্ত শিখা

লক্ষ তিতুমীরের কথা রক্তে আমার হয় যে লিখা।।

আহার জোটার সংগ্রামে ঐ চলছে যারা ছুটে

সত্য ন্যায়ের জোর লড়াইয়ে ক্ষুধার জ্বালা টুটে

শাহজালালের সৈনিক ওরা

নবী প্রেমে পাগল পারা

জীবন বিলায় খোদার রাহে মরণ যাঁচে হেসে।।

----চৌধুরী গোলাম মাওলা-

এগুলো তৌহীদে বিশ্বাসীদের দেশাত্মবোধের নির্দোষ বহিঃপ্রকাশ। দেশাত্মবোধের সাথে সাথে সেখানে আছে ঈমানেরও রসদ।

অন্যদিকে নিচের গানটাও লক্ষ্য করুন। এটা একালের ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের কোন একজন নেতৃস্থানীয় কর্মীর লিখা।

বাংলাদেশকে আমি ভালবাসি

দেশটা আমার রক্তে কেনা

দেশটা আমার মায়ের দেনা

দেশটা আমার দুঃখী বোনের হাসি

বাংলাদেশকে আমি ভালবাসি।

আমার দেশের মানুষগুলো খুবই সাদাসিধে

হাসিমুখে বরণ করে দুঃখ-ব্যথা ক্ষিধে

ভোরের শিশির গায়ে মেখে

ফসল ফলায় চাষী

বাংলাদেশকে আমি ভালবাসি।

মায়ার বাঁধন ছড়িয়ে আছে নানা ফলে ফুলে

গাছের ডালে, পাখির গানে ভরা নদীর কুলে

ছবির মত দেশটা আমার, যেন প্রিয়ার হাসি।

বাংলাদেশকে আমি ভালবাসি।

ন’মাস ধরে যুদ্ধ করা নয়তো সহজ খেলা

ভাষার জন্য দেশের জন্য রক্ত গেল মেলা।

মুক্ত আমার দেশের মাটি, মুক্ত গানের বাঁশি

বাংলাদেশকে আমি ভালবাসি।

এটা একটা অত্যন্ত শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী গান। জাতীয়তাবাদী জাহিলিয়াত থেকে আমি সাধারণত দূরে থাকি। সেই আমিও বিহবল হয়ে পড়ি তখন, যখন এই গান প্রথম শুনি - সোনার বাংলাদেশ ব্লগে একজন ব্লগার প্রবাসীদের উদ্দেশ্য করে পোস্ট করেছিলেন। অত্যন্ত সুন্দর একটা গান - হৃদয় আকুল করা কথা, সূর ও ভিডিও। কিন্তু এখানে সাধারণ দেশাত্মবোধ ছাড়াও এর বাইরের জাতীয়তাবাদী আবেগকে উদ্বেলিত করে দেয়া হয়েছে। আর এভাবেই সময়ের আবর্তনে, হয়তো, একটা ইসলামী আন্দোলন বিকৃতির কবলে পড়ে আস্তে আস্তে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। তখন প্রয়োজন হয় তাজদীদের কাজে জন্ম নেয়া আন্দোলনের তাজদীদের অথবা নতুন আন্দোলনের যা এর প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখবে।

বিষয়: বিবিধ

১৩৬১ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

361272
০৪ মার্চ ২০১৬ সকাল ১০:৩৬
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : নিজেদের অতিমাত্রায় দেশ প্রেমিক প্রমাণ করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছি!
০৫ মার্চ ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:০২
299563
আবূসামীহা লিখেছেন : সেটাই।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
361278
০৪ মার্চ ২০১৬ দুপুর ১২:১০
দ্য স্লেভ লিখেছেন : আপনি সাধারনের ভেতর থেকেই অসাধারন চিন্তা করতে পারেন। যে গানগুলো উল্লেখ করলেন তার ভেতর সুক্ষ্ণ একটা আপত্তি রয়েছে যা হয়ত অনেক পাঠকই বুঝতে পারবে না। ...এক গানে এদেশের সাধারন চিত্র ও মনের আকূলতা ফুটে উঠেছে,সেখানে বর্ণনা সাবলীল ও সত্য,যা ব্যক্তিতে তার অঞ্জলগত পরিচয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেনা,বরং স্বাভাবিক ভালাবাসা,ভালোলাগাই মূখ্য। অপরদিকে শেষেরটিতে মনে হয়েছে এই ভূখন্ডটির অন্য রকম কিছু গর্ব আছে,যা অন্যের থেকে ভিন্ন এবং নিজেকে গর্বভরে এই পরিচয়ে পরিচিত করছে। ঠিক জাহেলীয়াতে গোত্র ও এলাকার ক্ষেত্রে এমনটি করা হত। বাঙ্গালী ও বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদ যেভাবে প্রকাশ করা হয় তা স্রেফ জাহিলিয়া। যদিও আমরা যেখানে বেড়ে উঠি সেখানকার প্রতি মমত্ববোধ স্বাভাবিকভাবেই থাকে। রসূল(সাঃ)সহ সাহাবীদেরও ছিলো।

আমরা মুসলিম,এটা হল কনসেপ্ট,আইডোলজী।যারা এমন চিন্তা করে তারা সব এক। এটিই বিশুদ্ধ চিন্তা
০৫ মার্চ ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:০৪
299566
আবূসামীহা লিখেছেন : জাতীয়তাবাদী জাহিলিয়্যাতটা এমন যে এটা খুব সুক্ষ্ণভাবে অন্তরে গেঁথে থাকে। এর বলয় থেকে বের হওয়া অত্যন্ত কঠিন।
361360
০৫ মার্চ ২০১৬ সকাল ০৭:২৬
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
০৫ মার্চ ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:০৫
299568
আবূসামীহা লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
363784
২৭ মার্চ ২০১৬ দুপুর ০৩:৫০
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : আজকের ব্লগীয় আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে শুভেচ্ছা বক্তব্য লিখবেন আপনি। সন্ধ্যা সাতটার সময় পোস্ট করার অনুরোধ থাকল।
২৭ মার্চ ২০১৬ বিকাল ০৪:৪০
301608
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : ২৭ মার্চ রবিবার বাংলাদেশ সময় সন্ধা ৭ টার আয়োজনে সকলের অংশগ্রহন কামনা করি। পরিচালক (গাজী সালাউদ্দিন) পোস্ট দেয়ার সাথে সাথে অন্যরা মন্তব্যের ঘরে অর্পিত দায়িত্ব আন্জাম দেব। পরিচালক তার পোস্টে ব্লগারের নামসহ এগুলো যোগ করে সবগুলোকে এক পোস্টে রুপায়িত করবেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File