কপালে টিপ পরা ও সাজ সজ্জা করা
লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৮:২২:১৫ সকাল
আল্লাহ, সুবহানাহু ওয়া-তা‘আলা সুন্দর ও তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। তিনি সৌন্দর্যোপকরণগুলো তাঁর বান্দাহদের জন্য হালাল করেছেন। তিনি বলেছেন [তাঁর কালামের তরজমা]ঃ আপনি বলুন, “কে হারাম করল আল্লাহর দেয়া সাজ-সজ্জাকে, যা তিনি বান্দাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্যবস্তুসমূহকেও?” আপনি বলুনঃ “এসব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্যে এবং কিয়ামতের দিন খাঁটিভাবে তাদেরই জন্যে। এমনিভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি তাদের জন্যে যারা বুঝে।” [কুর’আন, ৭:৩২]। তবে এই সৌন্দর্যোপকরণ আল্লাহর দেয়া ও নবীর [ﷺ] দেখানো নির্দিষ্ট সীমার ভেতরে থেকেই ব্যবহার করতে হবে।
কিছু মুসলিমদের কাছে নিজেদের কামনা-বাসনার অনুসরণ তাদের নবীর [ﷺ] শিক্ষার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। এদের মধ্যে অজ্ঞতা আছে, সাথে আছে একগুঁয়েমী। অজ্ঞতা থাকা খারাপ কিছু না। সবাই একই সময়ে সব কিছু জানবে তা সম্ভব না। তাই মুসলিম জানার চেষ্টা করবে অজ্ঞতা দূর করার জন্য। কিন্তু নিজের অজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে নিজের খেয়াল-খূশী বা বাসনার অনুসরণ করা বিশ্বাসীর বৈশিষ্ট না। এজন্য আল্লাহ সাবধান করেছেনঃ “আপনি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছেন যে তার কামনা-বাসনাকে/খেয়াল-খূশীকে [হাওয়া/desire] ইলাহ [উপাস্য] হিসেবে গ্রহণ করেছে?” [কুর’আন, ৪৫: ২৩] আমাদের দীন কারো ভাল-লাগা বা না-লাগা অথবা খেয়াল-খূশীর উপর নির্ভর করে না। দীনের ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও রসূলুল্লাহর [ﷺ] সুন্নাহ।
কপালে টিপ পরা সনাতনী হিন্দু ধর্মীয় একটা সংস্কৃতি। কিন্তু শহুরে শিক্ষিত ও কিছুটা ধর্মহীন বাঙালী মুসলিম মহিলাদের মধ্যে ইংরেজ শাসনামলের শেষদিকে এসে এই সংস্কৃতি বাসা বাধতে থাকে। আর এখনতো এটা বাংলাদেশি মুসলিম মহিলাদের বেশিরভাগের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। ইসলামপন্থীদের একদলের মধ্যেও এই পরধর্মীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার জন্য বাতিক চেপেছে। তারা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে জানার আগ্রহ না দেখিয়ে বরং অজ্ঞতাপ্রসূত বিষয়টাকে বৈধ হিসেবে গ্রহণ করে নিতে চাইছে।
বেশ কিছুদিন আগে একজন ভাই ফেইসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলেন এই বিষয়ে। সেখানে আমি কয়েকটা মন্তব্যের জবাব দিয়েছিলাম। সেগুলোকেই এখানে একসাথে পোস্ট হিসেবে পেশ করছি।
মূল পোস্টকারীর কথাঃ
টিপ নাকি পড়া যাবে না, এটা নাকি এককালে দেহপসারিনীদের প্রতীক। এদিকে লিপস্টিকও দেয়া যাবে না। পশ্চিমে নাকি একসময় এটাও দেহপসারিনীদের প্রতীক।
তাহলে তো নামাজও পড়া যাবে না। নামাজ ফার্সি শব্দ। এটার উতপত্তি পারস্যে। পারস্যের অধিবাসীরা আগে অগ্নিপূজক ছিল। অগ্নিপূজাকে তারা নামাজ নামে ডাকত। ইসলামের আগমনের পর সালাত হয়ে গেল নামাজ। এখন নামাজ পড়া কি যাবে?
আমার মন্তব্যঃ
কপালে টিপ দেয়া বা বিন্দি লাগানো নিঃসন্দেহে নাজায়েজ, কারণ এই কাজ অমুসলিমদের একটা ধর্মীয় আচার৷ ঠোঁটপালিস লাগানো প্রসাধনীর অংশ, যা স্বাভাবিকভাবে জায়েয৷ কিন্তু এটা দিয়ে গায়র-মাহরাম পুরুষের সামনে নিজেকে প্রদর্শন করা হারাম৷ নামায বলতে পারসিকরা ইবাদত বুঝাত, যেটা আমাদের সমাজে সালাত অর্থেই ব্যবহৃত হয়৷ তাই এতে কোন সমস্যা নেই৷ কিন্তু সালাত ব্যবহার করা উত্তম৷
কপালে টিপ দেয়া মহিলাদেরকে আমার সনাতনী হিন্দু ছাড়া আর কিছু মনে হয় না৷
একজন মন্তব্যকারীর আমাকে উদ্দেশ্য করে মন্তব্যঃ
অমুসলিমদের ধর্মীয় সাদৃশ্য গ্রহন করতে ইসলাম আমাদের নিষেধ করে। তবে টিপ লিপস্টিক অথবা যেকোন প্রসাধনী কেবল জীবনসঙ্গীর সাথে শেয়ার করলেও নাজায়েজ হবে কেন??
আমার জবাবঃ
লিপস্টিক প্রাসাধনী - তাই এটা হারাম নয় বলে আমি আগের মন্তব্যেই উল্লেখ করেছি, যদি গায়র-মাহরামের সামনে না হয়। টিপ হারাম, কারণ ওটা প্রসাধনী নয়, ওটা ধর্মীয় আচার থেকে উদ্ভূত ট্র্যাডিশন। ধর্মীয় আচার আর সাধারণ সৌন্দর্য বর্ধক প্রসাধনী ভিন্ন বিষয়।
সেই ভাইয়ের পাল্টা মন্তব্যের একটা অংশঃ
স্বামী স্ত্রীর একান্ত বিনোদনে টিপ নিয়ে এতটা ধর্মীয় সিরিয়াসের পক্ষে আমি নই।বরং লিপস্টিক যে আরও ভয়াবহ হতে পারে সেটাই ভাবছি--
ঠোটের লিপস্টিক মৃত্যুর কারন!!! মেয়েরা সাজবে কিন্তু লিপস্টিক মাখবে না তা কি হয়? কিন্তু এই শখের লিপস্টিকই হতে পারে আপনার মৃত্যুর কারণ।
আমার জবাবঃ
আপনি লিখেছেন, "স্বামী স্ত্রীর একান্ত বিনোদনে টিপ নিয়ে এতটা ধর্মীয় সিরিয়াসের পক্ষে আমি নই।"
কারো কোন কিছুর পক্ষে থাকা না থাকা নিয়ে দীন হয় না। দীনের কিছু মূলনীতি আছে। সে মূলনীতির আওতায় কোন কিছু নিষিদ্ধ হলে তা নিষিদ্ধ। রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, "যে ব্যক্তি কোন জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করল, সে তাদের দলভূক্ত; আর যে কোন ক্বওমকে ভালবাসে তাদের সাথেই তার হাশর হবে।"
কপালে টিপ পড়া সনাতনী হিন্দুধর্মের একটা আচার। এটা হিন্দুরা (ভারতবাসীরা) সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যই পরত না। দুই ভ্রুর মাঝখানে যেই জায়গা তাঁকে হিন্দুরা মনে করত জ্ঞানের গোপন আসন। তাই এটাকে নিজের মেধা পুজার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত ভারতবাসী সেই বৈদিক যুগ থেকেই। এছাড়াও এটাকে শিবের ৩য় নেত্র হিসেবে দেখা হয় এবং ধ্যানকালীন সময়ে বন্ধ চোখের কারণে মনযোগ দেয়া হয় এই ভ্রুমধ্য স্থান থেকে, যেখানে টিপ লাগানো হয়।
এখন এই ধর্মীয় আচারকে অনুকরণ করতে যদি আপনার কোন সমস্যা না হয় তাহলে আমার কিছু করার নাই।
আপনি আরো লিখেছেনঃ "লিপস্টিক যে আরও ভয়াবহ হতে পারে সেটাই ভাবছি।"
আপনি এক্ষেত্রে অনেক উদাহরণও দিয়েছেন। উদাহরণগুলোর সাথে আমার কোন দ্বিমত নেই। এবং আমি এও জানি যে বর্তমান সময়ের রাসায়নিক প্রক্রিয়াজাত অধিকাংশ প্রসাধনী শরীরের জন্য ক্ষতিকারক।
কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য নারীর ঠোঁট রাঙানো হারাম নয়, যদি সে তা জাহিলী পদ্ধতিতে প্রদর্শন করে না বেড়ায়। এখন সে কি বিষাক্ত উপাদানে তৈরি রঙ দিয়ে রাঙাবে নাকি স্বাভাবিক প্রকৃতিজাত কিছু দিয়ে রাঙাবে সেটা তার ব্যাপার। যদি জেনেশুনে সে বিষাক্ত উপাদান ব্যবহার করে তাহলে সে তার নিজের শরীরের ক্ষতি করল। কিন্তু অন্য ধর্মের আচারের অনুকরণ করে সে তার দীনেরই ক্ষতি করবে যা তার পরকালের জন্য ক্ষতিকর।
আমি এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে চাই না। রসূলুল্লাহর [ﷺ] একটা হাদীসের ভাষা হচ্ছেঃ
"হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। এ দুয়ের মাঝে কিছু বিষয় হচ্ছে সন্দেহযুক্ত। যে এই সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকে বেঁচে থাকল সে মূলত তার দীন ও ইজ্জতের হিফাজত করল।” মা’আসসালামাহ!
আরেকজন আমার মন্তব্যের একটা অংশ "কপালে টিপ দেয়া মহিলাদেরকে আমার সনাতনী হিন্দু ছাড়া আর কিছু মনে হয় না” লক্ষ্য করে পাল্টা নিম্নোক্ত মন্তব্য করলেন,
হিন্দু শব্দের উৎপত্তি কোথা থেকে? হিন্দু আসলেই কোন ধর্ম?
হিন্দু হওয়া অনেক সহজ দেখছি। টিপ দিবে অমনিই সনাতনী হিন্দু। টিপ দেয়া নারীদের হিন্দুরা হিন্দু হিসেবে নিবে কি? আমরা যেভাবে কালেমা পড়লে কালেমাকে মুখে স্বীকৃতি অন্তরে বিশ্বাস কাজে বাস্তবায়ন করলে মুসলিম বলি। ?
আমার জবাবঃ
হিন্দু কোন ধর্মের নাম না। হিন্দু মানে ভারতবাসী। সেই অর্থে আমি, আপনি, ভারতীয়, পাকিস্তানী, নেপালী, শ্রীলংকান, বাংলাদেশি, সবাই হিন্দু। এজন্য আমি আমার মন্তব্যগুলোতে ক্লিয়ার করেই লিখেছি "সনাতনী হিন্দু।" সনাতনী হিন্দু হচ্ছে ঐ সমস্ত ভারতবাসী যারা বৈদিক ধর্মের অনুসারী। আর কপালে টিপ পরা "সনাতন হিন্দু ধর্ম" বা বৈদিক ধর্মের একটা আচার। তাই এটা বিশ্বাসীদের জন্য নিষিদ্ধ।
এখন কথা হচ্ছে, যে মুসলিম বা “অ-সনাতনী হিন্দু” মহিলা কপালে টিপ পরে সে কি হিন্দু হয়ে গেল? হিন্দুরা কি তাকে তাদের দলভূক্ত হিসেবে গ্রহণ করে নেবে?
এটা একটা অবান্তর প্রশ্ন এবং নিতান্তই বালখিল্য ধরণের। রসূলের (সঃ) হাদীস অনুযায়ী সে ঐ জাতির মধ্যে শারিরীকভাবে শামিল হয়ে যাবে বা তারা তাকে অটোম্যাটিকালী তাদের মধ্যে গ্রহণ করে নেবে এমন কথা বলা হয় নি। যা বলা হয়েছে তা হল, সে আত্মিকভাবে তাদের দলভূক্ত, সে তাদের দীনের অনুকরণ করছে।
আর তাই ক্বিয়ামতের দিন সে তাদের সাথেই উঠবে, যদি না সে তওবা করে। তার আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবার ব্যাপারটাই মূখ্য। আর তাই তা নিষিদ্ধ। যে মুসলিম মহিলার রসূলুল্লাহর (সঃ) নির্দেশের প্রতি ভালবাসা আছে এবং আখিরাতের ভয় আছে
সে অবশ্যই নিজের কামনা/বাসনা বা ব্যক্তিগত ভাল লাগা না-লাগার [প্রবৃত্তি] উপর নির্ভর করে চলবে না। যারা নিজেদের বাসনাকে খোদা বানিয়ে নিয়েছে সে তাদের দলভূক্ত হবে না।
"আপনি কি তাকে দেখেন না, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি আপনি তার যিম্মাদার হবেন?[২৫ঃ ৪৩]
আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যে তার খেয়াল-খুশীকে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে? আল্লাহ যথার্থ জ্ঞানের ভিত্তিতেই তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মহর এঁটে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপর রেখেছেন পর্দা। অতএব, আল্লাহর পর কে তাকে পথ প্রদর্শন করবে? তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না? [৪৫ঃ২৩]
তিনি তখন জানতে চাইলেনঃ
বৈদিক ধর্ম থেকে খুজলে এর কোন রেফারেন্স পাব?
আমার জবাবঃ
প্রচূর রেফারেন্স আছে। নীচের কথাগুলো উইকিতে পাওয়া যাবেঃ
১। বৈদিক যুগ থেকেই টিপ বা বিন্দি ব্যবহার করা হত নিজের বুদ্ধিবৃত্তির উপাসনার লক্ষ্যে। তাই এটা নারী এবং পুরুষ উভয়েই ব্যবহার করত। আক্বল বা বুদ্ধিবৃত্তির উপাসনা এজন্য করা হত যাতে এটাকে ব্যবহার করে নিজেদের চিন্তা, কথা, কর্ম, অভ্যাস এবং সর্বোপরি নিজেদের চরিত্রকে খাঁটি করা যায়। একটা শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তি সাহায্য করে জীবনে মহৎ সিদ্ধান্ত নিতে, সাহসিকতার সাথে জীবনের চ্যালেঞ্জ মুকাবিলা করতে এবং উত্তম বিবেচনাকে উপলব্ধি করতে ও গ্রহণ করতে। এটা এই বিশ্বাসে করা হত যে এর ভিত্তিতে গড়ে উঠে একজন শক্তিশালী ব্যক্তি, শক্তিশালী পরিবার ও শক্তিশালী সমাজ।
২। টিপ আরো ব্যবহার করা হত এজন্য যে, দুই ভ্রু এর মাঝের এই স্থানটিতে ধ্যানের সময় একজন ব্যক্তি মনোনিবেশ করে, যাতে সে একাগ্রচিত্ত হতে পারে।
৩। স্বামী মুক্তানন্দ লিখেছেন, নিজের অন্তস্থিত গুরুর সম্মানার্থে মঙ্গল কুমকুম বা চন্দন তিলক ভ্রুমধ্যস্থানে লাগানো হয়। এটাই হচ্ছে গুরুর আসন। এখানে রয়েছে একটা চক্র [মানুষের শরীরে আধ্যাত্মিক শক্তির কেন্দ্র] যাকে বলা হয় অজনা চক্র বা নির্দেশনা কেন্দ্র। এখানেই আপনি সাধনা জগতে উর্ধ্বারোহণের স্তর সহস্রারে আরোহণের জন্য গুরুর নির্দেশনা লাভ করেন, যা আপনাকে আত্মোপলব্ধি দান করবে। ভ্রুমধ্যের যে শিখা দেখা যায় তা হচ্ছে ‘গুরু জ্যোতি’।
(From Finite to Infinite, by Swami Muktananda, SYDA Foundation, S. Fallsburg, NY, 1989, pp. 88–89)
৪। যোগসাধনার বিশ্বকোষীয় অভিধান [The encyclopedic dictionary of Yoga ] থেকে আমরা জানতে পারি যে অজনা চক্রকে তৃতীয় নেত্রও বলা হয়। এই কেন্দ্র পবিত্র অক্ষর ॐ [ওম] এর সাথে সংযুক্ত; আর এতে অধিষ্ঠিত আছে পরম শিব। (Encyclopedic dictionary of Yoga, by Georg Fuerstein, Paragon House Publ, NY, 1990, p. 15).
তিনি আরো লিখেছেনঃ
"ধর্মে ধর্মে অনেকগুলো মিল আছে? যেমন সত্য কথা বলা। এই ব্যপারে যদি শরীয়ার দৃষ্টিভঙ্গী বলতেন ভাল হত। গুরুজনকে সম্মান করা অন্য ধর্মেও আছে । তাইলে এটা কি মুসলিম রা বাদ দিবে?"
আমার জবাবঃ
ধর্মে ধর্মে মিল থাকা এক কথা, আর কোন ধর্মের বিশেষ আচারকে গ্রহণ করা আরেক কথা। “আচার" শব্দটা দিয়ে কী বুঝায় আশা করি তা বুঝেন, যদিও এর অনেক মানে আছে। একটা “ধর্মীয় আচার” [religious ritual] আর সাধারণ নৈতিক আচরণবিধি এক বিষয় নয়। সত্য কথা বলা একটা সাধারণ নৈতিক আচরণ যা দুনিয়ার সব জাতিগোষ্ঠি মূল্যায়ন করে। তবে ইসলামে এসে এটা আখিরাতের সফলতা/বিফলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ইসলাম এটাকে ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছে। আমি কুরআন হাদীস থেকে এ ক্ষেত্রে কোন উদ্ধৃতি এখানে দিচ্ছি না, কারণ এ বিষয়ে এত অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে যা ইসলামের একজন সাধরণ পাঠকেরও সহজে চোখে পড়ার কথা।
একইভাবে গুরুজনকে শ্রদ্ধা করা ও ছোটদেরকে স্নেহ করার বিষয়টাও সার্বজনীন একটা নৈতিক আচরণ বিধি দুনিয়ার সব জাতিই এটার মূল্যায়ন করে। কিন্তু এক্ষেত্রেও ইসলাম এটাকে ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছে। রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “যারা ছোটদের দয়া-স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না তারা আমাদের অন্তর্ভূক্ত নয়।”
তাই সাধারণ নৈতিক আচরণ বিধিতে বিভিন্ন ধর্মে সাধারণ শিক্ষার মিল থাকলেও ইসলামে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের (সঃ) নির্দেশের কারণে অন্যরকম শর’ঈ মর্যাদা লাভ করেছে, যার সাথে মানুষের আখিরাতের সফলতা/বিফলতা জড়িয়ে আছে। কারণ এখানে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের (সঃ) আনুগত্য ও অবাধ্যতার বিষয় জড়িত। মুসলিমরা এগুলো বাদ দিবে কীভাবে যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল এগুলোর নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্যদিকে যখন কোন একটা কাজ/আচার/পোষাক/ইত্যাদি কোন বিশেষ জাতি-গোষ্ঠির “ধর্মীয় আচার” এর অংশ হিসাবে চিহ্নিত হয় তখন তা থেকে বিরত থাকতে রসূলুল্লাহ (সঃ) সুস্পষ্ট করে নির্দেশ দিয়েছেন। এবং এ ধরণের অনুকরণের আখিরাতে মন্দ পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করেছেন। আবূ-উমামা সুদাই ইবন আজলান আল-বাহিলী (রাঃ) এর বর্ণনা করা হাদীসটা আমি আগেই উল্লেখ করেছিঃ “যে কেউ কোন জাতির অনুকরণ করল সে তাদের অন্তর্ভূক্ত, আর যে কাউকে ভালবাসল তার হাশর তাদের সাথেই হবে।”
আমি আমার আগের মন্তব্যগুলোতে দেখিয়েছি যে কপালে টিপ পরা সনাতনী হিন্দু ধর্মের একটা আচার। আর রসূলুল্লাহর [ﷺ] এই হাদীসের আলোকে তা নিষিদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা খেয়াল রাখা দরকার এমন কি ইবাদতের ক্ষেত্রেও যেখানে আমাদের সাথে অন্যদের মিল হয়ে যায় সেখানেও রসূলুল্লাহ (সঃ) সতর্কতার নীতি অবলম্বন করতেন। আশুরার রোজা ইয়াহুদীদের সাথে মিল হয়ে যাচ্ছিল বলে রসূলুল্লাহ ৯ তারিখেও রোজা রাখার ইচ্ছা করেছিলেন।
যে মুসলিম মহিলার রসূলুল্লাহর (সঃ) নির্দেশের প্রতি ভালবাসা আছে এবং আখিরাতের ভয় আছেসে অবশ্যই নিজের কামনা/বাসনা বা ব্যক্তিগত ভাল লাগা না-লাগার [প্রবৃত্তি]উপর নির্ভর করে চলবে না। যারা নিজেদের বাসনাকে খোদা বানিয়ে নিয়েছে সে তাদের দলভূক্ত হবে না।
"আপনি কি তাকে দেখেন না, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি আপনি তার যিম্মাদার হবেন?[২৫: ৪৩]
আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যে তার খেয়াল-খুশীকে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে? আল্লাহ যথার্থ জ্ঞানের ভিত্তিতেই তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মোহর এঁটে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপর রেখেছেন পর্দা। অতএব, আল্লাহর পর কে তাকে পথ প্রদর্শন করবে? তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না? [৪৫: ২৩]
বিষয়: বিবিধ
৫৯৪৫ বার পঠিত, ৩১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সাজগোজের জন্য টাকা না দিলে সে স্বামীর জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে ।
এসব সাজগোজ শরিয়ত মোতাবেক কি না সেটা তাদের কাছে মোটেও বিবেচ্য হয় না । তাদের চাই লেটেস্ট ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা এবং দেদারসে স্বামীর টাকা উড়ানো ।
ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সব জায়গাতেই মেয়েরা এই রাজ চালায় ।
আল্লাহ সহায় হউন!
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আলোচনার জন্য শুকরিয়া, জাযাকাল্লাহ
সংস্কৃতির এমন এক জগাখিচুড়ি আমাদের দেশে/সমাজে চালু হয়েছে যে, বৈধ-অবৈধ বাছ-বিচারের অনুভূতিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে!
"সবাই করছে" ধরণের কুযুক্তি মোকাবিলা করে নিজ পরিবার ঠিক রাখা বড্ড কঠিন হয়ে পড়েছে! এমনকি দ্বীনের জ্ঞান দেবার বয়সের আগেই অপসংস্কৃতির আঘাতে শিশুমন বিকৃত হয়ে পড়ছে!
আল্লাহতায়ালা রক্ষা করুন!!
দিন দিন মানুষ দীনী বিষয়ে অনুভূতিহীন হয়ে পড়ছে।
একমত।
ব্রুফ্লাক বা ভ্রুর পশম উঠিয়ে তা চিকন করা, পরচুলা লাগানো, ট্যাটু করা বা শরীরে উল্কি করা, দাঁত কেটে সরু করা এসবই হল কৃত্রিম রূপচর্চা, যা আজ আমাদের নারীদের মাঝে বিউটি পার্লার নামক কালচারের মাধ্যমে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। যে সকল নারী এসব রূপচর্চায় জড়িত ও যারা এতে সাহায্যকারী, সকলকে রাসূল ﷺ অভিশপ্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যখন থেকে বনূ ইজরাইলের নারীরা এসবে জড়িয়ে পরে তখনই তাদের ধ্বংশের দ্বার উন্মুক্ত হয়।
তবে লিপিস্টিক হালাল বলাটা যুক্তিসংগত নয়। নিজেদের মতের বিপরীতে আমাদের দেখা উচিত আলিমরা এব্যাপারে কি বলেছেন? রাসূল (সাঃ) এর কোন স্ত্রী বা মহিলা সাহাবীগণ এমন কোন প্রসাধনী ব্যবহার করেছেন, এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়না। আমি সাজসজ্জা নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম
http://www.bdfirst.net/blog/blogdetail/detail/3557/warrior2013/70748#.VmfLiF7pbK8
এখানে এই ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছিও। লিপস্টিকের ব্যাপারে অনেক বিতর্ক আছে। অধিকাংশ আলেমই হারাম বলেছেন, তবে কেউ কেউ শর্তসাপেক্ষে হালাল বলেছেন। এসব শর্ত পুরণ করেও আবার লিপিস্টিক বানানো কঠিন।
# গবেষণায় দেখা গেছে লিপিস্টিক ঠোটের ত্বকের সুরক্ষাস্তর রিমুভ করে ফলাফলস্বরূপ ঠোটের ত্বক শুকিয়ে যায়, ফাটল ধরায়, ঠোট ফুলে যায়। কারণ এসব কৃত্রিম উপাদান দ্বারা তৈরী করা হয়। তাই এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর জিনিস। আর শরীরের জন্য সমস্ত ক্ষতিকারণ জিনিসই আল্লাহ পবিত্র কোরানে হারাম করেছেন।
# লিপিস্টিক তৈরীর অন্যতম উপাদান শুকরের চর্বি, যা হারাম। যদি কেউ দাবি করে তারা শুকরের চর্বি ব্যবহার করেনা, তবে সেটিও সন্দেহজনক কারণ আমরা দেখছিনা আর সন্দেহজনক জিনিস মুমিনরা এড়িয়ে চলে।
# সবচেয়ে কথা এটা সুন্নাহ সম্মত না, ইহুদি-খৃষ্টানদের কালচার। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা বিধর্মীদের কৃষ্টি-কালচার অনুসরণ করোনা, প্রতিটা ব্যাপারে তাদের বিরোধীতা কর। কিয়ামতের অন্যতম আলামত হল আমরা তাদের কৃষ্টি-কালচারের প্রত্যেকটি জিনিস অন্ধভাবে গ্রহণ করব, এমনকি তারা গুঁইসাপের গর্তে প্রবেশ করলে আমরাও তার অনুসরণ করব, কাজেই এটাও হারাম নিঃসন্দেহে।
আর অল্প কিছু আলেম শর্তসাপেক্ষে এটি হালাল বলেছেন, প্রথম কথা তারা এটি ব্যবহার করে বাইরে যেতে পারবেননা শুধুমাত্র হাজবেন্ডের সামনে মাখতে পারবেন। লিপিস্টিক তৈরী হতে হবে প্রাকৃতিক উপাদানে যাতে কোন হারাম কাঁচামাল থাকতে পারবেনা এবং শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারবেনা। এসব শর্ত পুরণ করা মোটেও সহজ কাজনা। বর্তমানে মিডল ইস্ট, ইউরোপ-আমেরিকায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু ছোট উদ্যোক্তা দাবি করেন তারা হোমমেড হালাল প্রাকৃতিক লিপিস্টিক উৎপাদন করেন যা শরীরের জন্যও ক্ষতিকর নয় তবে তাদের মার্কেটও খুব ছোট ছোট মুসলিম কমিউনিটির মাঝেই সীমাবদ্ধ। তবে তাদের দাবি কতটুকু সত্যি? তা আল্লাহ ভাল জানেন। কাজেই এসব বর্জন করাটাই উত্তম। যেসব নারী এসব ব্যবহারের ঘোর পক্ষপাতী যদিও তারা ধার্মিক, তারা আসলে পশ্চিমা চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত। "আমি পর্দানশীলা হলেও স্মার্ট"- তাদের এই চিন্তাটার মাঝেই গলদ আছে।
১। ইসলাম ধর্মে প্রানির "ছবি তোলা/ছবি টাঙ্গানি" নিষিদ্ধ। নিরিপায় মুমিনরা অবস্থা বেগতিক আঁচ করতে পেরে এখন ত্যানা মারা যুক্তি আল্লা/মোহাম্মদের নিষিদ্ধকে নাকচ করে দিয়েছে।
২। ইসলাম ধর্মে মাহরাম(টেন্ডল) ছাড়া মেয়েদের একাকি চলা ফেরা নিষিদ্ধ। কিন্তু ঠেলায় পরে ইসলামের মুমিনা নারীরা আল্লা/মোহাম্মদের কার্ফিউ বাতিল করে বাসে, ট্রেনে, হেটে..... একাই চলা ফেরা করে।
৩। ইসলাম ধর্মে অর্থ বিষয়ক আদালতে নারী স্বাক্ষ পুরুষের অর্ধেক। অথচ আজকের দিনে নারীরা অর্থ বিষয়ক আদালতের খোদ বিচারক।
৪। ইসলাম ধর্মে নারীর প্রকাশ্য সাজসজ্জা(পাউডার, লিপিষ্টিক, ভ্রু প্লাক, ভ্রু আঁকা...... নিষিদ্ধ। কিন্তু আজকাল মুমিনা নারীরদের মাঝে এই বিষয়গুলো ১০০% জনপ্রিয়।
৫। আল্লা/মোহাম্মদ অন্যদের অনুকরন করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু আজকের দিন ৯৫% মুসলিম অন্যদের অনুকরনে টাই/স্যুট, ইংরেজি শিক্ষা, গনতন্ত্র, ফেসবুক, ব্লগ ছাড়া এক দিনও চলে না।
৬। ইসলাম ধর্মে নারী নেতৃত্ব হারাম। কিন্তু আজকের দিনে মেয়েরা দেশ পরিচালনা থেকে দৈনন্দিন কর্মকান্ডে অনেক ক্ষেত্রেই হর্তা/কর্তা।
সুতরাং মেয়েদের টিপ পরার ব্যপারে আল্লা/মোহাম্মদ বাচালের মত কি বলেছেন, না বলেছেন তাতে কার কি এলো/গেল??
"ইসলাম প্রাকৃতিক জিনিস দিয়ে স্বাভাবিক রূপচর্চা ও সাজসজ্জায় নিষেধ করেনি তবে কৃত্রিম রূপচর্চায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।"
কিন্তু হারাম উপাদান দিয়ে তৈরি কৃত্রিম ঔষধ আল্লার মুমিনরা গিলে খায়।
উত্তর গুলো বাস্তবিকই ভাল লাগল৷ ধন্যবাদ৷
তবুও কি তারা টিপ পরতে পারবে না ?
যেমন পুতুল সনাতনীদের কাছে পূজার বস্তু কিন্তু মুসলিমদের কাছে শুধুই খেলনা ,সিঁদুর তাদের কাছে ধর্মীয় বস্তু কিন্তু একজন মুসলিম সেটাকে ঔষূধ হিসেবে ব্যাবহার করতে পারে আরো ও আছে যেমন তুলসী পাতা ।
আপনার লেখাটা অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়লাম। অনেক কিছু জানলাম। চমৎকার যুক্তি, সাথে কুরআন হাদীসের রেফারেন্স।
মন্তব্য করতে লগইন করুন