১৪৩৬ হিজরী সালের কুরবানী ঈদের ডায়েরী।
লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:০১:০৬ সকাল
এবার কুরবানী করতে দীর্ঘ সময় লাগিয়েছি। সকাল ১০টায় ঘর থেকে বেরিয়ে রাত সাড়ে ৩টায় গোশ্ত নিয়ে ঘরে ফিরেছি। ৪১০ মাইল [৬৬০ কি,মি,] এর মত ড্রাইভও করতে হয়েছে। চাটগাঁ থেকে ঢাকার যা দূরত্ব তার চেয়েও বেশি দূরে যেতে হয়েছে কুরবানী করতে।
১৯৯১ সালে দেশ থেকে বের হবার পরে প্রায় ১০ বছর কুরবানীর ঈদে নামাজ আদায় ব্যতীত আর কোন আনুষ্ঠানিকতা দেখা হয় নি। মালয়েশিয়ার 9 বছরে কুরবানীর সময় কখনো দেশে যাওয়া পড়ে নি। আর মালয়েশিয়ানরা আমাদের মত এত কুরবানী পাগল না বলে [শাফি’ঈ মাজহাবে কুরবানী শুধু সুন্নাহ] সেখানে কুরবানীও দেয়া হয় নি এবং দেখাও হয় নি। সে সময় অবশ্য আমার উপর কুরবানী ওয়াজিবও ছিল না। মালয়েশিয়াতে কুরবানীর ঈদকে এজন্য ঈদ ঈদ মনেই হত না।
২০০১ সালে আমেরিকা এসে ওকলাহোমা সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে আমরা ক’জন গিয়েছিলাম বাইরে একটা খামারে কুরবানী দিতে। বিশাল গরুটাকে গুলি করে শুইয়ে তারপর জবেহ করতে হয়েছে। মাজহার ভাই ছিলেন জবেহকারী। আমি এক ধরণের ভয় নিয়ে কাছেও যাই নি। এরপর এক ভারতীয়ের মুদি দোকানে এনে গোশ্ত কাটার মেশিনে টূকরো টুকরো করা শেষে ভাগাভাগি করে ঘরে নিয়ে গিয়ে রান্না বান্না।
নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে এসেও প্রথম ক’বছর নিজে কুরবানী দেই নি, কারণ আমার সামর্থানুযায়ী তা ওয়াজিব ছিল না। কিন্তু ঈদ উপভোগ করা হত। প্রচূর বাংলাদেশী দীনী ভাইদের সাথে মিলে ঈদ উদযাপনে কোন সমস্যা হয় নি। এরপর নিজে কুরবানী দিতে শুরু করলাম। প্রথম প্রথম কোন গোশ্তের দোকানে গিয়ে কুরবানী দিলাম। এখানে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ও ঠেলাঠেলির কারণে ভাল লাগত না। এছাড়াও শহরের ভেতরে দামও বেশি। দু’বছর দিলাম আল-মারওয়া হালাল মীট প্রসেসিং ফ্যাক্টরিতে। এখানকার ব্যবস্থাপনা এবং মেহমানদারিতা ভাল ও উপভোগ্য। গতবার কুরবানী দিলাম আমার সাবেক এক ছাত্রের খামারে - আপস্টেট নিউইয়র্কে। প্রথমবারের মত নিজ হাতে জবাই করে ও চামড়া ছিলে শহরে আনতে পেরেছিলাম। এ বছর ঐ ছাত্রের খামারে পশু নেই। তাই শেষ পর্যন্ত আমাদের এক ফ্রেণ্ড ৩২৬ কি,মি, দূরের এক খামারের খবর নিয়ে আসলেন এবং সেখানে ভেড়া/দূম্বা বুকিং দিয়ে আসলেন।
ঈদের দিন [২৪ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার] ছিল একটা সুন্দর দিন। আকাশ একদম পরিষ্কার, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। আমরা জামাআতের জন্য রিজার্ভ করেছিলাম প্রস্পেক্ট পার্ক প্যারেড গ্রাউণ্ডের ৮ নম্বর ফিল্ড। টার্ফের মাঠ; ফলে রাতে বৃষ্টি হলেও সকালে তেরপাল বিছিয়ে নামাজ পড়তে কোন সমস্যা নেই। গত কয়েক বছর আমি নামাজ পড়িয়েছি। গত বছর থেকে আমাদের ব্রুকলিন ইসলামিক সেন্টারের সাথে যোগ দিয়েছে তাওহীদ ইসলামিক সেন্টার। তাওহীদ ইসলামিক সেন্টার পরিচালনা করেন সাবেক যুগোস্লাভিয়া [বসনিয়ান/মন্টেনেগ্রান/মেসিডোনিয়ান] থেকে আসা ভাইয়েরা। যেহেতু তাঁরা আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন তাই আমরা অফার দিয়েছি এবার তাদের পক্ষ থেকে ইমামতি করার জন্য। এ বছর আমাদের ইমামতি করেছেন ভাই সঊদ লালিচিচ। এছাড়াও ইয়েমেনী ভাইদের পরিচালিত ফ্ল্যাটবুশ ইসলামিক সেন্টারও গত রোজার ঈদ থেকে আমাদের সাথে একই জামাআতে সালাত আদায় করেছে। সত্যিকার একটা মাল্টিকালচারাল জামাআত। বাদামী ভারতীয়দের [বাঙালী, পাঞ্জাবী, পাঠান, ইত্যাদি] সাথে যোগ দিয়েছে ইউরোপিয়ান সাদা, আফ্রিকান কাল, আরবীয় জলপাই, চীনা পীত সহ নানা বর্ণের ও সংস্কৃতির মানুষ। আল্লাহ আমাদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্ববোধকে মজবুত করে দিন। এই একই জায়গায় অনেক বছর আগে আরেকবার মুসলমানরা সমবেত জামাআতের আয়োজন করেছিল। কিন্তু কিছু বাঙালী হুজুর জামাআত শুরুর মুহুর্তে তা ভেঙ্গে দিয়ে চলে যায়, কারন ইমাম ছিলেন আরব এবং তিনি অতিরিক্ত ১২ তাকবীরে নামাজ পড়াবেন তাই। আলহামদুলিল্লাহ, এখন বাঙালী ও বসনিয়ান ইমামের পেছনে ১২ তাকবীরেই নামাজ আদায় করছে এবং ইংরেজীতে খুৎবাহ শুনছে।
জামাআত শেষে মাঠের জিনিষপত্র গুছিয়ে কুরবানীর জন্য পেনসিলভেনিয়ার অ্যাবটসটাউনের একট খামারে রওয়ানা দিতে দিতে ১০টার বেশি বেজে যায়। ৩২৬ কিমি দূরের রাস্তা। পথে এক জায়গায় তেলের জন্য এবং আরেক জায়গায় কফির জন্য থামাতে সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রা ৪ ঘন্টায় শেষ করতে হয়েছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে নিজেদের বুকিং করা পশুগুলোও সব পাওয়া গেল না। পশুর গায়ে রঙ দিয়ে নম্বর দেয়া থাকার পরও কেউ সেখান থেকে একটা নিয়ে জবেহ করে ফেলেছে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত অন্য পশু পসন্দ করতে হয়েছে। আমি একটা মোটামুটি বড়সড় মর্দা ভেড়া/দূম্বা পেলাম। বিকেল চারটায় জবেহ করে আরো ঘন্টাখানেক ফেলে রাখতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিজেদের পশুর চামড়া ছাড়ানোসহ বড় চার পিস করার কাজও নিজেকে করতে হয়েছে। সবারগুলো শেষ করে ফিরতি রওয়ানা দিতে দিতে রাতের সাড়ে আটটা। এদিকে আবার পেনসিলভেনিয়া টার্নপাইকে এক্সিডেন্টের পেছেন পড়ে সাড়ে সাত মাইল লম্বা জ্যামে পড়ে আরো ৫০ মিনিট দেরী। ব্রুকলিনে আসতে আসতে রাত ১ টা। এরপর গোশ্ত কাটিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত ৩ টা। গোসল করে বিতির পড়ে ঘুম যেতে যেতে সাড়ে ৪ টা। এক ঘন্টা ঘুমিয়ে আবার ফজরের জন্য উঠতে হল। এরপর আবার সকালে সামারাহর ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
সোজা কথায় এবারের ঈদ ছিল বিরাট একটা হ্যাকটিক বিষয়। তাই কারো সাথে যোগাযোগও করা হয় নি। এমনকি আম্মাকে কল করার সুযোগও পাই নি। শেষ পর্যন্ত আজকে সকালে আম্মাকে কল করতে পারলাম। ছেলেমেয়েদের স্কুল বন্ধ থাকার পরও তদেরকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় নি। সেজন্য তাদেরও অভিযোগ।
সামনের বার, যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখেন এবং তওফীক্ব দেন, তবে পেনসিলভ্যানিয়াতেই ল্যাঙ্কাস্টার কাউন্টির আমিশ কান্ট্রিতে কুরবানী দেবার ইরাদা রাখি, ইনশা’আল্লাহ। আমিশরা যেহেতু আধুনিক প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকে তাই তাদের সেখানকার সব খাবার ও প্রাণিগুলো স্বাভাবিক প্রকৃতিজাত বা অর্গানিক।
বিষয়: বিবিধ
১৪৬৭ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শুনেছি সেখানে নাকি ক্রিসমাসের সময় ভালই ছুটি দেয় ।
এ থেকে কি বোঝা যায় না এরা এক্সট্রিমিস্ট খৃষ্টান দেশ ? অন্য ধর্মের মানুষদের তারা খৃষ্টানদের চেয়ে খাটো মনে করে ।
এসব করেও তারা সেক্যুলার দেশ
বাংলাদেশ যে সব ধর্মের জন্য ছুটি দেয় এটা মনে হয় বেশী বেশীই করে, তাই না ? শুধু স্পেসিফিক ধর্মের লোকদের ছুটি দিলেই তো পারে ।
আমিশরা পিউরিটান নয় ঠিক। তারা হচ্ছে আনাবাপ্টিস্ট - মানে প্রাপ্তবয়স্কদের বাপ্টাইজ করে শুধু। আর তারা মডার্ণ সব ফেসিলিটিজকে এড়িয়ে চলে। তারা ইলেক্ট্রিসিটি, ফোন, যন্ত্রচালিত গাড়ি, ইত্যাদি কিছুই ব্যবহার করে না।
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগলো আপনার ঈদ বৃত্তান্ত। যদিও কুরবানী নিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সুন্দর হোক আগামীর দিনগুলো। জাযাকাল্লাহ খাইর
অনেক ধন্যবাদ। ওয়া জাযাকাল্লাহু খাইর।
এখানে ছয় তাকবীর বার তাকবীর দুটোই আছে৷ কেউ ছেড়ে চলে গেছে শুনিনি৷ তবে বাঙ্গালী মাতবরীর মসজিদে ইমামতি নিয়ে বিরোধ শুনেছি৷ বিপক্ষ মসজিদ ছেড়ে গেছে৷ ধন্যবাদ৷
এখানেও ১২ এবং ৬ তাকবীর দুটোই আছে। আমরা ভাইদেরকে বলি ইমামকে অনুসরণ করবেন। ইমাম যদি ১২ তাকবীরে পড়েন তাহলে আপনারাও ১২ তাকবীরে পড়বেন; আর ইমাম যদি ৬ তাকবীরে পড়েন তাহলে আপনারাও ৬ তাকবীরে পড়বেন। যারা চলে গিয়েছিল তারা সাধারণ মুসল্লী ছিল না। তাঁরা ছিলেন হুজুর। সেটা অনেক আগের কথা। এদের একটা গ্রুপ এখনও মনে করে ১২ তাকবীরে সালাত হবে না। যেমন আরেকদল মনে করে ৬ তাকবীরে হবে না।
আল্লাহ সবাইকে বুঝার তৌফিক্ব দিন। আমীন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনি বরং নিজেই একটা লাইসেন্স করে নিন মিট প্রসেসিংএর উপর। তাহলে ঈদের সময় অন্যের পশুও জবাই করতে পারবেন
মীট প্রসেসিং এর লাইসেন্স আমাকে দিয়ে হবে না। ঃ)
জাযাকাল্লাহু খাইরা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন