কিছু ভালবাসার মানুষঃ নাসের ভাই, নিজামী ভাই ও কামারুজ্জামান ভাই
লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ০৫ নভেম্বর, ২০১৪, ০৯:৩২:৫৫ সকাল
বড় সড় নেতাদের অথবা টাকা-পয়সা বা খ্যাতির মালিকদের থেকে দূরে থাকা আমার অভ্যাস। এটা সাধণা করে অর্জন করা কোন অভ্যাস না। ছোট বেলা থেকে প্রচণ্ড লাজুক থাকায় নিজের নিতান্তই পরিচিত বন্ধু-বান্ধব ছাড়া অন্যদের সামনে মারাত্মক রকমের অন্তর্মূখী হয়ে থাকতাম আমি। এই চল্লিশের ঘরে এসেও এখনো অনেকের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে লজ্জার প্রথম ধাক্কা সামলে বেরিয়ে আসা আমার জন্য কঠিন হয়ে যায়। আমার শিক্ষকতা জীবন এর এখন প্রায় ১৮ বছর। এরপরও নতুন কোন ক্লাস নিতে গেলে লজ্জার কারণে নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের কীভাবে মুক্বাবিলা করব সে চিন্তায় অস্থির থাকি।
ইসলামী আন্দোলনে শরীক হবার তৌফিক্ব যদি আল্লাহ তা‘আলা মেহেরবানী করে না দিতেন তাহলে সমাজের কোথায় গিয়ে অবস্থান করতাম তা তিনিই জানেন। কিন্তু তাঁর অনুগ্রহে তিনি তাঁর দীনের পূর্নাঙ্গ রূপ বুঝতে চেষ্টা করার মত তৌফিক্ব দিলে অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে যাঁরা আমাকে তাঁদের ভালবাসায় সিক্ত করেছেন। নগণ্য আমাকে তাঁরা হৃদয় উজাড় করা দরদ দেখিয়েছেন, যদিও আমি তাঁদের সরাসরি সংশ্রব থেকে পালিয়ে থাকতে চেষ্টা করেছি।
দেশে থাকতে যে মানুষটির সাথে মোটামুটি পুরো একদিন সাময় কাটাতে হয়েছে তিনি হচ্ছেন আবূ নাসের মুহাম্মদ আব্দুজ-জাহের ভাই। জাহাঙ্গীর নগরের আমরা চারজন IIUM-এ চান্স পাওয়ার পর মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য আমাদের কিছু কাজের জন্য আমাদেরকে তাঁর কাছে যেতে হয়েছিল। আমাদের একজন বন্ধু KaziShahadat Kabir Rimon ভাইয়ের এক আওয়ামী চাচাত ভাইও আমাদের সাথে ছিল। দিনের শেষে আমাদের কাজ হয়ে গেলে আমরা যখন ফিরে আসছিলাম তখন ঐ চাচাত ভাই বলছিলেন, “এঁকে দেখেত গোলাম আজমের খালাত ভাই বলে মনে হল না।” আওয়ামীদের কাছে গোলাম আজম এক ঘৃণিত নাম। কিন্তু এই আওয়ামী সমর্থক নাসের ভাইকে দেখেছে মানবতার সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি হিসেবে। আমরা বললাম, “আহা!তুমি যদি গোলাম আজমকে দেখতে, তাঁর পাশে বসতে অথবা সরাসরি তাঁর কথা শুনতে!”
সেই নাসের ভাইয়ের সাথে দেখা ২০০১ সালে ব্রুকলিনে। আমি সবে ব্রুকলিন এসেছি। মুনার এক প্রোগ্রামে নাসের ভাই এবং নাজির আহমেদ সাহেব এসেছেন। আমি আমার স্বভাবসুলভ পলায়নপর আচরণের কারণে এঁদের কাছ থেকে পালিয়েই আছি। কিন্তু আমার এক চাচাত ভাই ঠিকই নাসের ভাইকে গিয়ে বলে দিয়েছে আমার কথা। সে বলেছে “এই যে সিরাজ! জাহাঙ্গীর নগরে পড়ত, পরে মালয়েশিয়া ছিল।” তিনি মাত্র মালয়েশিয়া সফর করে এসেছেন। আমাকে চিনলেন। তিনি জড়িয়ে ধরে হেসে বললেন, “তোমরা কী করে এসেছ? তোমাদেরকে মালয়েশিয়ার ভাইয়েরা এত ভালবাসে কেন? তারাতো তোমাদের কথাই শুধু বলে।” হৃদয় মথিত হয়ে রক্তগুলো যেন অশ্রুর রূপে চোখ দিয়ে তখন ঝরতে লাগল।
মালয়েশিয়ায় থাকতে আমার মত অন্তর্মূখী মানুষটাকেও একটা পর্যায়ে এসে সেখানকার বাংলাদেশি ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের সংগঠনের সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। আর সে অবস্থায় বাধ্য হয়েই স্বল্প সময়ের জন্য হলেও দেশ থেকে আশা বড় দায়িত্বশীলদের অনেকের সরাসরি সংশ্রবে আসতে হয়েছিল। কুয়ালালামপুরে আমার উপর দায়িত্ব পড়েছিল দেশ থেকে আসা নিজামী ভাই ও কামারুজ্জামান ভাইকে KL Tower ও PetronasTwin-Tower সহ আরো কিছু জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবার। তাঁদের সহজ সরল জীবন-যাপন ছিল মুগ্ধ করার মত।
জামা’আতে ইসলামী বাংলাদেশ তখন একটা ইংরেজী বুলেটিন বের করত। এরকম একটা বুলেটিন একবার আমার Reporting & Writing for Mass Media এর প্রফেসর সাইয়েদ শওকত আলী শাহের হাতে দেয়া হয়। বুলেটিনে ছিল নিজামী ভাইয়ের ছবি। তিনি নিজামী ভাইয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে ছিলেন অনেক্ষণ,আর আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠে বলেছিলেন, “ইনি নিজামী ভাই?” কারণ ছবিতে নিজামী ভাইয়ের দাড়ি পাকা। নিজামী ভাই যখন অধ্যাপক শাহ এর সভাপতি ছিলেন তিনি সেই সময়ের কথা স্মরণ করার চেষ্টা করছিলেন; আর ছবির সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ দেখা নিজামীকে মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। দেখলাম তাঁর চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে উঠেছে। তখনই জেনেছিলাম অধ্যাপক শাহ ইসলামী জম’ঈয়তে তালাবার কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য ছিলেন তখন, যখন নিজামী ভাই নিখিল পাকিস্তান ইসলামী জম’ঈয়তে তালাবার কেন্দ্রীয় সভাপতি। আমরা দেখলাম আমরা এক প্রাণ। সেই সীমান্ত প্রদেশের শওকত আলী শাহ ও পূর্ব বাংলার মুতিউর রহমান নিজামীরা একসাথে কাজ করেছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দীনকে গালিব করার নিয়্যতে। তাঁদের মাঝে জাতীয়তাবাদী বিষবাষ্প কোন সংকীর্ণতার দেয়াল তুলে দিয়ে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে পারে নি।
২০০০ সালে মালয়েশিয়ার পাট চুকিয়ে পশ্চিমে পাড়ি দেয়ার আগে দেশে গেলাম। আমাকে মালয়েশিয়ান ভাইদের পক্ষ থেকে নিজামী ভাইয়ের সাথে কিছু বিষয়ে কথা বলতে বলা হয়েছিল। আমি জামাত অফিসে গিয়ে নিজামী ভাই সম্পর্কে জানতে চাইলাম। কিন্তু আমি যতই নিজামী ভাই বলি না কেন জামাত অফিসে লোকেরা বলেন আমীরে-জামায়াত। আমি আমার পূর্বতন অভ্যাস ছাড়তে পারছিলাম না। তিনি ততদিনে আসলে জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হয়ে গেছেন। অফিসের একজন ভাই বললেন আমীরে জামায়াত মসজিদে ই’তিকাফে আছেন। সেখানে তাঁর সাথে দেখা করলাম। তিনি কিছু উপদেশ আমাকে দিলেন; আবার সাথে সাথে অনুরোধ করলেন আমি যেন তারেককে [উনার ছেলে ড, নকীবুর রহমান] কিছু নির্দেশনা দেই, যা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি।
কামারুজ্জামান ভাই তাঁদের অন্যতম যাঁরা আমার প্রতি তাঁদের ভালবাসার কথা ব্যক্ত করেছেন। জীবনে যাঁদেরকে আমি ইতিবাচক চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়ে হৃদয়ে আশা জাগাতে দেখেছি তিনি তাঁদের অন্যতম। দেশে থাকতে কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কখনো কথা হয় নি। মালয়েশিয়ায় সেই একবার মাত্র দেখা হয়েছিল। কিন্তু আমেরিকায় কয়েকবার দেখা হয়েছে। উনি দেখা মাত্রই চিনেছেন। দেশের অবস্থা নিয়ে আমরা যারা বিদেশে থাকি তারা খুব হতাশ থাকি বিভিন্ন কারণে। কিন্তু যখনই উনি কোন আলোচনা রাখতেন তখন তা হত হতাশার দিক কাটিয়ে ইতিবাচক নির্দেশনার আলোকচ্ছটা। উনাকে নিয়ে বাংলাদেশের উপর আমরা পালটক চ্যাটরুমে একবার একটা আলোচনার ব্যবস্থা করেছিলাম। সেখানেও তিনি বাংলাদেশ নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা করেছিলেন। তিনি কিছু বিষয়ে কথা বলেছিলেন যেগুলো নিয়ে তাঁর সে সময়ের চিন্তার সাথে আমার দ্বিমত আছে। তবুও তাঁকে শ্রদ্ধা করি। তিনি ভালবাসতেন আমাদের অন্তর দিয়ে। আমার ব্যাপারে তিনি কয়েকজন ভাইকে বলে গিয়েছিলেন যেন আমার মেধাকে ভালভাবে কাজে লাগানো হয়। আমি লজ্জায় মরে যাবার অবস্থায় পৌঁছেছি তখন। দুনিয়াকে সামাল দেবার জন্য কামলা-গিরি করতে গিয়ে মেধার আর ব্যবহার হল কোথায়? তার উপরে আমি আসলে একটা মিডিওকার পাব্লিক, মেধাবী-টেধাবী কিছু না।
আল্লাহ, এই মানুষগুলোর অনেক কিছুর সাথে হয়ত আমার মতের মিল নেই। কিন্তু আমি জানি এবং বিশ্বাস করি তাঁরা খালিস ভাবেই তোমার দীনের বিজয় কামনা করেন এবং সেজন্য নিজেদের বুঝ ও সামর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টাও তাঁরা করেছেন বলেই আমি বিশ্বাস করি। আমি তোমার কাছে দু’আ করি তুমি তাঁদেরকে রক্ষা করো। ইজ্জত-মর্যাদার মালিক, তুমি তাদের ইজ্জতকে উঁচু কর! তাঁদেরকে তোমার দীনের সাক্ষী হিসেবে আমৃত্যু অটল রাখো। মৃত্যুর পর তাঁদেরকে আম্বিয়া, সিদ্দীকুন, শুহাদা ও সালিহীনদের সাথে স্থান দিও। তাঁদের শত্রুদেরকে হিদায়াত দাও, না হয় বেইজ্জতির-জিল্লতির জিন্দেগী দাও। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১২৩৪ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
প্রিয় কিছু মানুষদের আলোচনা সুন্দর ভাবে উপস্হাপন করার অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!
মিথ্যার বেড়াজাল ছিন্ন করে সত্যের বিজয় একদিন হবেই!
ইসলামী আন্দোলনের বীর সিপাহসালার সহ সকল কে ইহ-পর কালীন চুড়ান্ত সাফল্য আল্লাহ দান করুন-এই দোয়া আমার।
হে আল্লাহ তুমি তাঁদেরকে রক্ষা করো। ইজ্জত-মর্যাদার মালিক, তুমি তাদের ইজ্জতকে উঁচু কর! তাঁদেরকে তোমার দীনের সাক্ষী হিসেবে আমৃত্যু অটল রাখো। মৃত্যুর পর তাঁদেরকে আম্বিয়া, সিদ্দীকুন, শুহাদা ও সালিহীনদের সাথে স্থান দিও। তাঁদের শত্রুদেরকে হিদায়াত দাও, না হয় বেইজ্জতির-জিল্লতির জিন্দেগী দাও। আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন