মিডিয়া ও ফিলিস্তীন সম্পর্কে অপপ্রচার এবং ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা।
লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ১৩ জুলাই, ২০১৪, ১০:৩০:১৬ রাত
২০০১ সাল। আমি তখন ওকলাহোমা সিটি ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট। প্রতি সপ্তাহান্তে একটা ডলার স্টোরে কাজ করি। কাজে যাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে ট্যাক্সি কল করতে হয়। ওকলাহোমা আমেরিকার সেই অংশে অবস্থিত যেখানে সাদা খৃষ্টান বর্ণবাদীদের আধিপত্য। একদিন ট্যাক্সি আসলে দেখলাম ড্রাইভার সাদা এবং মনে হল তিনি আমাকে দেখে পসন্দ করেন নি।
তিনি আসলে কোন রাখ-ডাক না করে তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশই করে দিলেন। তিনি বললেন, “আমি মনে করতাম ইমিগ্র্যান্টরা নিউ ইয়র্ক এবং ক্যালিফোর্নিয়াতেই শুধু আসে। তারা এখন ওকলাহোমাতেও আসতে শুরু করেছে।”
যাই হোক, হাজার হলেও আমি তাঁর কাস্টমার। তাই আমার সাথে তিনি ফ্রেণ্ডলী হবার চেষ্টা শুরু করলেন। তাই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কোত্থেকে এসেছেন?” আমি জবাব দেবার আগেই তিনি নিজেই বললেন, “আমাকে অনুমান করতে দিন। আপনি নিশ্চয় ভারতীয়।” আমি দুষ্টামির স্বরে বললাম, “হ্যাঁ, আমার দাদা ভারতীয় ছিলেন, আমার বাবা ছিলেন পাকিস্তানী, আর আমি বাংলাদেশী।” বেচারা পুরো হতভম্ব হয়ে পড়লেন। বললেন, “এটা কী করে সম্ভব যে একই পরিবারের তিনটা পরম্পরা তিনটা ভিন্ন দেশের নাগরিক?”
আমি বললাম, “আসলে আমরা সবাই একই এলাকায় জন্মেছি এবং বড় হয়েছি। আমার বাপ ও দাদা ওখানেই মারা গেছেন। ব্যাপার যা হয়েছে তা হলঃ আমার দাদার সময়ে আমাদের এলাকাটা পুরোটা ভারত ছিল; এরপর আমার বাবার সময়ে দুটো দেশ হয়েছে - পাকিস্তান ও ভারত। আমরা পাকিস্তানের অংশে ছিলাম। পাকিস্তান আবার বিচ্ছিন্ন হয়েছে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। আর আমি জ্ঞান হবার পর যে দেশ দেখেছি তা হল বাংলাদেশ।” তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “বাপরে, বড় জটিল আপনাদের ইতিহাস।”
ভদ্রলোক এখন আমার সাথে কথা বলে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছেন। এটা ওটা আরো কিছু কথা বলার পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার ধর্ম কী?” মনে রাখতে হবে যে ওকলাহোমা বাইবেল বেল্টের রাজ্য। এর জনশক্তির প্রতি চার জনের একজন বিদেশে মিশনারী কাজে অংশগ্রহণ করে। ওকলাহোমা সিটিকে গীর্জার শহর বললে অত্যুক্তি হবে না। আমি জবাবে বললাম, “ইসলাম।” তিনি ইসলাম বুঝেন না। কী করা যায় তাকে বুঝানোর জন্য? শেষে আমি বললাম, “আমি মুস্লিম।” হুঁ, তিনি কিন্তু মজলেম চিনেন। ধারণা করতে পারেন কী রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে? তিনি পুরো চুপ মেরে গেলেন। আমার সাথে দীর্ঘক্ষণ আর কোন কথাই বললেন না। তার পর হঠাৎ করে বললে উঠলেন, “যারা মানুষ হত্যা করে তাদের সাথে আমার কোন কোন কিছু করার নেই।” চিন্তা করুন, তখনো কিন্তু ৯/১১ এর ঘটনা ঘটে নি। এটা ছিল ২০০১ এর এপ্রিল মাস। যদি ৯/১১ এর পরের ঘটনা হত তাহলে আমার কী অবস্থা হত অনুমান করা যায়?
আমি ভাবলাম ভদ্রলোককে এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। তিনি যে দিকে ইঙ্গিত করে ওই কথা বলেছিলেন তা হল ফিলিস্তীন। তখন অধিকৃত ফিলিস্তীনে “শাহাদাত অপারেশন” [Martyrdom Operation] চালাচ্ছিল হামাস। আমি বললাম, “আপনি বোধহয় ফিলিস্তীনীদের আত্মঘাতি অপারেশনের কথা বুঝাচ্ছেন।” তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি তাদের কথাই বলছি।”
“কিন্তু আপনি কি কখনো চিন্তা করেছেন তারা কেন এমন করে?”, আমি বললাম।
“কেন তারা এমন করবে? এমন তারা করতে পারে না। এটা মারাত্মক অন্যায়। তারা মানুষ খুন করছে।”
“কিন্তু আপনার কি চিন্তা করা উচিৎ নয়, কেন কিছু লোক নিজেদের গায়ে বিস্ফোরক বেধে উড়িয়ে দিচ্ছে আর সাথে অন্য কয়েকজনকে হত্যা করছে?”
“আমার এত কিছু চিন্তা করে কাজ নেই। তারা মানুষ হত্যা করছে, এটাই আসল কথা।”
“না, এটাই আসল কথা না। আপনাকে চিন্তা করতে হবে। আপনি কি তাদের ইতিহাস জানেন? এটা তাদের পিতৃ-পুরুষের ভূমি। এখানেই হাজার বছর ধরে তারা বসবাস করছে। হঠাৎ বাইরে থেকে আসা কিছু লোক তাদের ভূমি দখল করে তাদের উৎখাত করে দিয়েছে। এখন তারা কী করবে?”
“এমন হলে তাদের উচিৎ তাদের নিজেদেরকে গড়া। তাদের ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষিত-কর্মঠ করে গড়ে তোলা যাতে তারা তাদের ভবিষ্যতকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু তারা অবশ্যই মানুষ খুন করতে পারে না।”
“এটা বলাতো খুব সহজ। তাদেরকে যদি সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাহলে তারা কী করবে?”
“না তাদেরকে চেষ্টা করতে হবে নিজেদের ভবিষ্যত গড়ার জন্য। তার জন্য মানুষ খুন করতে হবে না।”
“এটা ওকলাহোমায় বসে বলা আপনার জন্য খুব সহজ। কিন্তু তাদের বাস্তবতা ভিন্ন। আপনি এখানে নিরাপদে নিজের কাজ নিজে করতে পারেন। সেখানকার ব্যাপারটা এমন নয়।”
“কিন্তু তারা মানুষ খুন করবে কেন?”
“আচ্ছা ধরেন, আমি সমস্যাগ্রস্ত হয়ে আপনার বাড়িতে আসলাম। আপনি আমাকে আশ্রয়ও দিলেন। এরপর আমি আপনার বাড়ি দখল করলাম। তারপর আমার জ্ঞাতিগোষ্ঠি আরো অনেক কে নিয়ে এসে আপনাকে এবং আপনার জ্ঞাতিগোষ্ঠির সবাইকে ভিটে বাড়ী থেকে উৎখাত করলাম; আপনার মা, বাবা, ভাই-বোন, সন্তানাদি, আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করলাম। এখন আপনি কী করবেন?”
কোন দ্বিধা ছাড়াই তিনি বলে ফেললেন, “আমি প্রথম সুযোগেই আপনাকে হত্যা করব।”
আমি বললাম, “ফিলিস্তীনীরা শুধু এ কাজটাই করছে বা করার চেষ্টা করছে।”
তিনি নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “আপনি ঠিকই বলেছেন। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা ইনফরমেশন পাই টেলিভিশন থেকে।”
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১৫৮১ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দেশের চাকুরিতে একজন অস্ট্রেলিয়ান প্রকেীশলি একবার বলেছিলেন আমাকে তাদের দেশে ইসরাইল বা ইহুদিদের বিরুদ্ধে কিছু বলা নাকি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমি প্রশ্ন করেছিলাম তাহলে এটি কিভাবে মত প্রকাশের স্বাধিনতা হয়। তিনি অবশ্য বলেছিলেন সামাজিক ভাবে ইহুদিদের বেশিরভাগ মানুষই অপছন্দ করে। আমি অষ্ট্রেলিয়ায় প্রতি বছর পালিত
"আনজাক" দিবস সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দার্দানেলিস এর আনজাক এ মৃত অষ্ট্রেলিয়ান সেনারা কি দেশের প্রতিরক্ষায় না অন্য দেশ দখল করতে গিয়ে নিহত হয়েছিল। তিনি হেসে জবাব দিয়েছিলেন এই ধরনের প্রশ্ন তার মনেও এসেছিল স্কুল জিবনে। কিন্তু তখন যদি এই প্রশ্ন করতেন সকলে তাকে দেশবিরোধি বলত।
আর এই মিডিয়াভিত্তিক জ্ঞানের প্রভাব শুধু মার্কিন বা অস্ট্রেলিয়াতেই নয়। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত ব্যাক্তির মধ্যেই আছে।
ভালো লাগলো। নিয়মিত লিখবেন
অনেক ধন্যবাদ আপনাদের দু'জনকে।
যেমন- এখন কোন মুসলিম নেতা যদি জিহাদ ঘোষণা করে সবাইকে এক হওয়ার আহবান জানায় দেখা যাবে অনেক মুসলিম নেতারা প্রশ্ন তুলবেন জিহাদের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট নিয়ে। কারণ তারা পৃথিবীর আরাম আয়েশে মজে গেছে। আবার কেহু স্বার্থের জন্য মুখ খুলবেন না।
আজ আমাদের এক নেতৃত্বের তত্বাবধানে আসা বড়ই প্রয়োজন। আল্লাহ আমাদের বুঝার তৈফিক দান করুন।
জাযাকাল্লাহু খায়রা।
@আবূ সামীহা ভাই, প্রায় ১ বছর ১ মাস পর আপনার লেখা পেলাম। দ্বীনী ভাইদের জন্য আপনি নিয়মিত লিখবেন এই আশা করছি। অভিজ্ঞতাটি ২০০১ সালের। এই তের বছরে অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নাই। তবে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে গেছে ও ঘটছে। জাজাকাল্লাহু খাইরান।
ভাগ্য ভাল, ওরা আপনাকে ওকলাহামাতে ঢুকতে দিয়েছে। মক্কা/মদীনায় হলে তো, আপনি নিজেই জেহাদী জোশে ঐ ড্রাইভারদের কল্লা ফেলে দিতেন।
মারিয়া
পরীবানু
মরুর মুসাফির
পরীবানু ,সততার আলো
অশ্বথমা
অপ্রতিরোধ্য স্বাধীন সমালোচক
পরমা ,নীলমণীলতা
বিলকিস লায়লা
দস্তার
রুপবান
মুক্তিযুদ্ধ ৭১
দ্রাবীড় বাঙাল
লেয়লা ইসলাম
বিলকিস
বাংলা ৭১
ভিক্টোরিয়া
হেলেনা
পল্লব প্রভাতে
খালেদ
রুশো তামজিদ
বারাংগনা
মধুবালা
সখি
ফয়সাল১
মাঝি-মাল্লা, ,
লায়লার
লায়লা০০৭
রাতুল দাস
চকো চকো
সায়েদ-রিয়াদ
বিভ্রান্ত নাবিক
ফাজিল
অপ্রতিরোধ্য স্বাধীন সমালোচক
মুক্তিযুদ্ধ ৭২
দ্রাবীড় বাঙাল
পিচ্চি পোলা
কাওসাইন হক
চাষা
jahed_ullah
নীরু
সাদা মন
সাদা মন
চোথাবাজ
আমি বিপ্লবী
সততার আলো সকাল সন্ধ্যা
এই নেরিকুত্তার এত নিক
অপ্রিয় সত্য কথা,খেলাঘর বাধঁতে এসেছ,আকবার ,স্বাধীনতা,জুলিয়া,
মারিয়া
পরীবানু
মরুর মুসাফির
পরীবানু ,সততার আলো
অশ্বথমা
অপ্রতিরোধ্য স্বাধীন সমালোচক
পরমা ,নীলমণীলতা
বিলকিস লায়লা
দস্তার
রুপবান
মুক্তিযুদ্ধ ৭১
দ্রাবীড় বাঙাল
লেয়লা ইসলাম
বিলকিস
বাংলা ৭১
ভিক্টোরিয়া
হেলেনা
পল্লব প্রভাতে
খালেদ
রুশো তামজিদ
বারাংগনা
মধুবালা
সখি
ফয়সাল১
মাঝি-মাল্লা, ,
লায়লার
লায়লা০০৭
রাতুল দাস
চকো চকো
সায়েদ-রিয়াদ
বিভ্রান্ত নাবিক
ফাজিল
অপ্রতিরোধ্য স্বাধীন সমালোচক
মুক্তিযুদ্ধ ৭২
দ্রাবীড় বাঙাল
পিচ্চি পোলা
কাওসাইন হক
চাষা
jahed_ullah
নীরু
সাদা মন
সাদা মন
চোথাবাজ
আমি বিপ্লবী
সততার আলো সকাল সন্ধ্যা
এই নেরিকুত্তার এত নিক
-আমরা বিত্তবান মুসলমানরা দেশে দেশে এই সমস্যাটা বুঝতে পারছি না আজো।
আমাদের দেশে যখন দিগন্ত উন্মুক্ত ছিল, তখন অন্য চ্যানেলগুলো মিথ্যা রিপোর্ট তৈরী করলেও অন্ততঃ একবার ভাবতো। দিগন্তকে অবরুদ্ধ করার পর সে ভাবনাও এখন তাদের নেই। বিশ্বের হাল তো আরো করুণ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন