ইবনু জুবায়েরকে আসমা বিনতে আবু বকরের উপদেশ, শিবিরের সতর প্রদর্শনী বিক্ষোভ, আক্রান্তদের প্রতিশোধ ও শাহবাগে বাগীদের আনন্দমেলা শেষের অপমান ও জিল্লতি
লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১১:১২:৪৮ রাত
মুসলিম উম্মতের দন্ডমুন্ডের কর্তৃত্ব তখন অত্যাচারী উমাইয়া বংশীয় রাজাদের হাতে| মুসলমানদের জীবন ও সম্পদের পবিত্রতা তারা লংঘন করেছে| খুলাফা আর-রাশিদুনের পরে ইসলামের প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে অত্যাচারী নিরংকুশ রাজতান্ত্রিক প্রথায় পর্যবসিত করে দিয়েছে তারা| রসুলুল্লাহর (স) প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হুসাইন ইবন আলী ও তাঁর পরিবারের সাথে নিষ্ঠুরতার চরম পরাকাষ্টা দেখিয়েছে তারা| এমন সময়ে তাদের অত্যাচার থেকে উম্মতকে মুক্ত করতে ও রসুলুল্লাহর আনীত দীনের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে জনগণের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ইসলামে জন্মগ্রহণকারী প্রথম শিশু, রসুলুল্লাহর ফুফাত ভাই ও তাঁর হাওয়ারী জুবায়ের ইবন আল- আওয়াম এবং রসুলুল্লাহর হিজরতের সাথী আস-সিদ্দিক আবু বকরের কন্যা দুই নিতাকের অধিকারিনী আসমার নাড়ি ছেড়া ধন আব্দুল্লাহ ইবন জুবায়ের| (আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন তাঁদের প্রতি এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি)|
তাঁর কাছে আনুগত্যের শপথ (বাইয়াত) গ্রহণ করেন হিজাজ, মিসর, ইরাক এবং শামের বিরাট একটা অংশ| কিন্তু ধুরন্ধর উমাইয়ারা আস্তে আস্তে অনেক কিছু আবার তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়| আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ান ইরাক ও পারস্যের গভর্নর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ আস-সকাফিকে নির্দেশ দেন ইবন জুবায়েরকে দমন করতে| এখানে হাজ্জাজ মসজিদে হারামের চত্বরে ইবন জুবায়েরকে অবরুদ্ধ করলে তিনি তাঁর মা রসুলুল্লাহর (সঃ) সাহাবিয়্যাহ আসমার (রাঃ) কাছে উপদেশ নিতে আসেন| তাঁদের দীর্ঘ সংলাপের এক পর্যায়ে অন্ধ ও বয়োবৃদ্ধা আসমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) হাত দিয়ে ছেলের গায়ে স্পর্শ করে বললেনঃ
- আব্দুল্লাহ, তুমি এ কী পরেছো?[১]
- আম্মা এ তো আমার বর্ম।
- বেটা, যারা শাহাদাতের আকাঙ্খী এটা তাদের পোশাক নয়।
- আপনাকে খুশি করা ও আপনার হৃদয়ে প্রশান্তি দানের উদ্দেশ্যে আমি এটা পরেছি।
- তুমি এটা খুলে ফেল। তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার সাহসিকতা ও আক্রমনের পক্ষে উচিৎ কাজ হবে এমনটিই। তাছাড়া এটা হবে তোমার কর্মতৎপরতা, গতি ও চলাফেরার পক্ষেও সহজতর। এর পরিবর্তে তুমি লম্বা পাজামা পর। তাহলে তোমাকে মাটিতে ফেলে দেয়া হলেও তোমার সতর অপ্রকাশিত থাকবে।
মুমিনের কাছে তাঁর ঈমান ও আমল সবচেয়ে বেশি গুরত্বপূর্ণ। ময়দানের কঠিন সময়েও তারা মাথা ঠিক রাখে এবং আল্লাহর না-ফরমানি মূলক কোন কাজ করে না। আর তাই আসমা বিনত আবূ-বকরকে [রাদিয়াল্লাহু আনহুমা] তাঁর প্রাণাধিক পূত্রকে অন্তিম মুহুর্তেও সতর ঢেকে রাখার উপদেশ দিতে দেখছি আমরা। ইসলামী ছাত্রশিবিরের তরুণ কর্মীরা সাঈদী সাহেবের মুক্তির দাবীতে নিজেদের গায়ে স্লোগান লিখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এতে এদের অনেকেরই সতর উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল, যা নিতান্তই অনাকাঙ্খিত। আর এটাকে পুঁজি করে শিবিরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতেও চেষ্টা করেছেন অনেকে। শিবিরকে এজন্য অনেক বেশী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আবেগ ও কর্তব্যের মাঝে ভারসাম্য বিধান করতে হবে। জীবনের কঠিনতম মুহুর্তেও যেন আল্লাহর নাফরমানি হয়ে না যায় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। আল্লাহ তোমাদের মাফ করুন।
আল্লাহ আমাদের প্রতিশোধ নিতে অনুমতি দিয়েছেন, কিন্তু বাড়াবাড়ি করার অনুমতি দেন নি। তিনি বলেছেনঃ “আর যারা তাদের প্রতি যখন সীমালংঘনকারীরা আঘাত হানে তারা তখন আত্মরক্ষা করে। আর মন্দের প্রতিফল তার অনুরূপ মন্দ, কিন্ত যে কেউ ক্ষমা করে আর সদ্ভাব সৃষ্টি করে, তাহলে তার পুরস্কার রয়েছে আল্লাহর নিকটে। নিঃসন্দেহ অন্যায়কারীদের তিনি ভালবাসেন না। তবে যে কেউ আত্মরক্ষা করে তার প্রতি অত্যাচার হবার পরে -- তবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই।” [২] তাই যারা তোমাদের প্রতি বাড়াবাড়ি করেছে তাদের জবাব দানের পূর্ণ অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু নিজেদের থেকে বাড়াবাড়ি করার কোন অধিকার দেন নি। আল্লাহ তোমাদের রক্ষা করুন। এ ব্যাপারে তোমাদের প্রতি উপদেশাত্মক দুটো লিখা লিখেছিলেন “হলদে ডানা।” [৩]
শিবির বাংলাদেশের জন্য আল্লাহর রহমত। বাংলাদেশের তরুণরা যখন অন্যায় ও অশ্লীলতায় ভেসে যাচ্ছিল, নাস্তিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষ-জাতীয়তাবাদ যখন তাদের চিন্তা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল তখন “এসো আলোর পথে” বলে আহবান করে তাদের হাতে “মুক্তির পয়গাম” ধরিয়ে দিয়ে যে আলোর মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছিল শিবির তার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে মুক্তির পথে অবিরাম চলা শুরু করেছে অসংখ্য তরুণ। আমরাও ধর্মনিরপেক্ষ-জাতীয়তাবাদের শয়তানী মরীচিকাকে মাড়িয়ে শামিল হয়ে গিয়েছিলাম সে আলোর মিছিলে। এ জন্য তোমরা যখন হক্বের পথে থেকে অন্যায়ের মুক্বাবিলায় এগিয়ে চলবে, তখন ইবনে যুবায়েরের মায়ের মত অসংখ্য মা-ই আল্লাহর দরবারে হাত তুলে তোমাদের জন্য সেভাবেই দু’আ করবেনঃ
“হে আল্লাহ্! রাতের অন্ধকারে মানুষ যখন গভীর ঘুমে অচেতন থাকে তখন তার রাত জেগে জেগে দীর্ঘ ইবাদত ও উচ্চ কন্ঠে কান্নার জন্য আপনি তার উপর রহম করুন। হে আল্লাহ! রোজা অবস্থায় মক্কা ও মদীনাতে মধ্যাহ্নকালীন ক্ষুধা ও পিপাসার জন্য তার উপর রহম করুন। হে আল্লাহ! পিতামাতার প্রতি সদাচরণের জন্য আপনি তার উপর করুণা বর্ষণ করুন।” [৪]আল্লাহ ও তাঁর রসূল এবং দীন-ই-হক্বকে যাঁরা ভালবাসেন তাঁরা তোমাদের জন্য এমন ব্যাকুলভাবেই দু’আ করবেন। অবশ্যই নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ-জাতীয়তাবাদীরা তাতে শামিল হবে না; আর হবে না কায়েমী স্বার্থের ধ্বজাধারী কিছু ফিরক্বাবাজ মুসলিমও। আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত তোমাদের লাশও হয়তো ময়দানে সেভাবে পড়ে থাকবে যেভাবে ইবন যুবায়ের এর চামড়া ছাড়ানো লাশকে মক্কার রাস্তায় শুলিতে ছড়িয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল; আর আল্লাহর দুশমন হবার অপবাদ আরোপ করবে অত্যাচারী হাজ্জাজের চেয়েও নিকৃষ্টদের উত্তরসূরীরা।
আর শাহবাগে সমবেত হওয়া বাগীদের [বিদ্রোহী] নিয়ে উৎকন্ঠার কিছু নেই। আল্লাহ তোমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চান। তোমাদের নিশ্চয় খন্দকের দিনগুলোর কথা স্মরণ আছে। তিনি সেখানে ১০ হাজার শত্রু পরিবেস্টিত তোমাদের পূর্বসূরীদেরকে সাংঘাতিকভাবে পরীক্ষা করেছেন। তিনি তাঁদেরকে সেখানে প্রচণ্ডভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছেনঃ
“যখন তারা তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল উচ্চ ভূমি ও নিম্নভূমি থেকে এবং যখন তোমাদের দৃষ্টিভ্রম হচ্ছিল, প্রাণ কন্ঠাগত হয়েছিল এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা বিরূপ ধারণা পোষণ করতে শুরু করছিলে। সেখানেই মুমিনদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং তাদেরকে সাংঘাতিকভাবে কাঁপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর যখন মুনাফিক্ব ও যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা বলাবলি করছিল, “আল্লাহ ও তাঁর রসূল আমাদের সাথে প্রতারণা বৈ অন্য কোন ওয়াদা করেন নি।” ........ অন্যদিকে মু’মিনরা যখন শক্রবাহিনীকে দেখল, তখন বললঃ “আল্লাহ ও তাঁর রসূল এরই ওয়াদা আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সত্য বলেছেন। এতে তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণের মাত্রাই শুধু বৃদ্ধি পেল।” [৫]এই কঠিন পরীক্ষা শেষেই আল্লাহ তা’আলা এমন সেনা বাহিনী প্রেরণ করলেন যা কারো গোচরীভূত ছিল না।
“হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যখন শত্রুবাহিনী তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল, অতঃপর আমি তাদের বিরুদ্ধে ঝঞ্জাবায়ু এবং এমন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলাম, যাদেরকে তোমরা দেখতে না। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন।”[৬]
তাই তাদেরকে আল্লাহর আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত থাকতে দাও। ওরা জুমু’আর সালাতের সময় শাহবাগে বসে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে গান বাজনা আর আনন্দে উন্মাতাল হয়ে। ওদের তা করতে দাও। তোমরা ধৈর্য ধারণ কর আর নিজেদের কর্তব্য করে যেতে থাকো। আল্লাহর না ফরমানী মূলক কিছু হয়ে গেলে তার জন্য তওবা কর, আর মুক্বাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকো। আল্লাহ নিশ্চয়ই বিদ্রোহীদের দেখে নিতে সক্ষম।
====
নোটঃ
১। আব্দুল মাবূদ, মুহাম্মাদ (২০০৩)। “আসহাবে রসূলের জীবন কথা [১ম খণ্ড]।” ঢাকাঃ বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, পৃষ্ঠা ২১২-২১৩।
২। আল-কুর’আন, সূরা আশ-শুরা (৪২)ঃ আয়াত ৩৯-৪১।
৩। ছাত্রশিবিরকে লাইনচ্যুত হতে দেয়া যাবে না।
মিছিল করেন, কিন্তু ভাংচুর করবেন না.।
৪। আব্দুল মা’বূদ, মুহাম্মাদ। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২১৩।
৫। আল-কুর’আন, সূরা আহযাব (৩৩)ঃ আয়াত ১০-২২।
৬। আল-কুর’আন, সূরা আহযাব (৩৩)ঃ আয়াত ৯।
বিষয়: রাজনীতি
১৮১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন