ইসরা ও মি'রাজের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং কিছু ভুল ধারণার অপনোদন
লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ০৬ জুন, ২০১৩, ০৮:০১:৪৯ রাত
বাংলাদেশসহ অনেক মুসলিম দেশেই ঘটা করে শবে মি‘রাজ পালন করা হয়ে থাকে। প্রতিবছর ২৭ রজবের রাতকে ঘটা করে পালন করা হয়। অনেকে ২৭ রজব রোজ়াও পালন করেন। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এটি শুধু মি‘রাজের রাতই নয় বরং এটি হল ইসরা ও মি‘রাজ এর রাত [ليلة الإسراء والمعراج]। এ রাতের ঐতিহাসিক গুরুত্বের সাথে সাথে সমাজে প্রচলিত হয়ে গেছে অনেক ভুল ধারণার। ভুল ধারণাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মি‘রাজের রাতের তারিখ, রসূলুল্লাহ (সঃ) কতটুকু পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন এবং আল্লাহর সাথে তাঁর দীদার। আমরা এ প্রবন্ধে এ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করবো ইনশা’আল্লাহ।
লায়লাতুল ইসরা’ ওয়াল-মি‘রাজ কী?
এ রাতের ঘটনার রয়েছে দু’টো দিকঃ একটি ইসরা’এবং অন্যটি মি‘রাজ। ইসরা [إسراء ]- মানে হল রাতে পরিভ্রমণ করা।পারিভাষিকভাবে এটি হল রসূলুল্লাহর (সঃ) মসজিদ আল-হারাম [মক্কা] থেকে মসজিদ আল-আকসা [জেরুসালেম] পর্যন্ত ভ্রমণ। এ সম্পর্কে পবিত্র কুর’আনে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেনঃ سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ [পবিত্র সেই সত্ত্বা যিনি এক রাতে তাঁর বান্দাকে পরিভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদ আল-হারাম থেকে মসজিদ আল-আকসা পর্যন্ত, যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শোনেন ও সবকিছু জানেন।১৭/১]
অন্যদিকে মি‘রাজ এর শাব্দিক মানে হচ্ছে উর্ধ্বারোহণ করা। পারিভাষিক ভাবে এটি হচ্ছে রসূলুল্লাহর (সঃ) বায়তুল বাকদিস থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত আরোহণ। এ সম্পর্কে কুর’আনে কিছু বলা নেই; আছে হাদীসে। তবে মি‘রাজের সময়ে রসূলুল্লাহ (সঃ) যা দেখেছিলেন সে সম্পর্কে কিছু বর্ণনা এসেছে সূরা আন-নজমে।
কখন ইসরা' ও মি'রাজ সংগঠিত হয়েছিল?
ইমাম ইবন কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর আল-বিদায়াহ ওয়া আন-নিহায়াহতে মি’রাজের তারিখ নিয়ে লিখেছেনঃ
১। ইবন ইসহাকের মতে নবুয়্যতের ১০ বছর পরে মি’রাজের রাতের ঘটনা ঘটেছে।
২। প্রখ্যাত তাবি’ঈ ইবন শিহাব আজ়-জ়ুহরী ও ‘উরওয়া ইবন আজ়-জ়ুবাইর (রহিমাহুমাল্লাহ) এর মতে মি’রাজের ঘটনা ঘটেছে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের ১ বছর পূর্বে রবি‘আল-আউয়াল মাসে।
৩। ইমাম ইসমাইল আস-সুদ্দীর মতে মি’রাজের ঘটনা ঘটেছে হিজরতের ১৬ মাস পূর্বে। সে হিসেবে এটা ঘটেছে রবি’ আল-আউয়াল মাসে।
৪। আব্দুল গণী আল-মাক্বদিসী (মৃত্যু ৬০০ হিঃ) এর মতে এটা ঘটেছে রজবের ২৭ তারিখে।
৫। অন্যান্য অনেক উলামায়ে কিরাম বলেছেন এটা ঘটেছে রজবের ১ম শুক্রবারের রাতে।
এছাড়া শায়খ ক্বারাদাওয়ী উল্লেখ করেছেনঃ
ইমাম আবুল খাত্তাব উমর ইবন দাহিয়া তাঁর কিতাব “আদা’ মা ওয়াজাবা ফী বায়ান ওয়াদ আল-ওয়াদ্দা’ইনা ফী শাহরি রজব” এ উল্লেখ করেছেন, “কিছু কিছু বর্ণনাকারী বলে থাকেন যে রসূলুল্লাহ (সঃ) এর এর ইসরা ও মি’রাজ রজব মাসে হয়েছে, যা নিতান্তই একটা মিথ্যা কথা।” বুখারীর ব্যাখ্যাতা আল-হাফিজ ইবন হাজার আল-আসক্বালানী (রঃ) উমর ইবন দাহিয়ার (রঃ) এই মতকে সাবিত করেছেন।
কোন সহীহ হাদীস বা কোন সাহাবী থেকে রজবের ২৭ তারিখের রাতের ব্যাপারে কোন বর্ণনা আসেনি। এটা শুধুমাত্র আগের উলামাদের মুখনিসৃত ভিত্তিহীন কথা যা সমাজে চালু হয়ে গিয়েছে।
এই কথাটা ইমাম আন-নাওয়ায়ির কিছু ফতোয়ায় তাঁর উপর আরোপ করা হয়েছে। যেহেতু তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন সর্বজন গ্রাহ্য একজন আলিম তাই এই কথাটা তাঁর নামে মশহুর হয়ে গেছে।
ইমাম আবূ ইসহাক আল-হারবী (রঃ) উল্লেখ করেছেন, রসূলুল্লাহর (সঃ) ইসরা ও মি’রাজ রজবের ২৭ তারিখে হয়নি বরং হয়েছে রবি‘ আল-আউয়াল এর ২৭ তারিখে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে কথা হচ্ছে এই রাতে বিশেষ নামাজ ও পরেরদিন রোজা রাখার কোন শরয়ী ভিত্তি নেই।
মিরাজের উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে যদি উদ্দেশ্য হয় বিষয়টাকে অধ্যয়ন ও এ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা এবং রসূলুল্লাহ্ (সঃ) এর জীবনে এর প্রভাব অনুধাবন করা।
এ সংক্রান্ত কুর'আনের বর্ণনা ও হাদীসের উদ্ধৃতিঃ
আগেই উল্লেখ করেছি যে কুরআনের সূরা ইসরা (বনী ইসরাঈল) এর এক নং আয়াতে শুধু ইসরার কথা আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া মি‘রাজের রাতে কিছু দেখা সংক্রান্ত কথা এসেছে সূরা আন-নজমে। ইসরা ও মি‘রাজের বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে হাদীসে। নীচে ইমাম মুসলিমের সহীহতে আনাস ইবন মালিক (রাঃ) এর বর্ণনা করা একটা হাদীসের উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ
রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “আমার কাছে বুরাক আনা হল; এটা ছিল একটা সাদা জন্তু যা গাধার চেয়ে বড় কিন্তু খচ্চরের চেয়ে ছোট। এক একটি পদক্ষেপে এটি চোখ যতদূর যায় তত দূরত্ব অতিক্রম করছিল। আমি এটিতে চড়লাম এবং এটি আমাকে বায়তুল মাক্বদিস [জেরুসালেম]] নিয়ে গেল। সেখানে আমি এটিকে নবীদের জন্য নির্ধারিত বাহন রাখার জাযগায় বেঁধে রাখলাম। এরপর আমি মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নামাজ পড়ে বেরিয়ে আসলাম। জিব্রীল একটি পাত্রে আমার জন্য মদ ও অন্য একটি পাত্রে দুধ আনলেন এবং আমি দুধ গ্রহন করলাম। তিনি বললেন, “আপনি মানুষের স্বভাবধর্মজাত [[ফিতরাত]] বিষয়টি গ্রহন করেছেন।”
তারপর আমাকে প্রথম আসমানে নিয়ে আসা হল এবং জিব্রীল এটি খোলার জন্য বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, “আপনি কে?” তিনি বললেন, “জিব্রীল।” বলা হল, “আপনার সাথে কে?” তিনি বললেন, “মুহাম্মদ।” জিজ্ঞেস করা হল, “তাঁর মিশন কি শুরূ হয়েছে?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, তাঁর মিশন শুরূ হয়েছে।” এরপর দরজা খোলা হল এবং আমি সেখানে আদমকে (আঃ) দেখলাম। তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন।
তারপর আমাকে দ্বীতিয় আসমানে নিয়ে আসা হল এবং জিব্রীল এটি খোলার জন্য বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, “আপনি কে?” তিনি বললেন, “জিব্রীল।” বলা হল, “আপনার সাথে কে?” তিনি বললেন, “মুহাম্মদ।” জিজ্ঞেস করা হল, “তাঁর মিশন কি শুরূ হয়েছে?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, তাঁর মিশন শুরূ হয়েছে।” এরপর আমাদের জন্য এটা খোলা হল এবং সেখানে আমি দুই খালাত ভাই ইহাহয়া (আঃ) ও ঈসা (আঃ) কে দেখলাম। তাঁরা আমাকে স্বাগত জানালেন এবং আমার ভালর জন্য দু’আ করলেন।
তারপর আমাকে তৃতীয় আসমানে নিয়ে আসা হল এবং জিব্রীল এটি খোলার জন্য বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, “আপনি কে?” তিনি বললেন, “জিব্রীল।” বলা হল, “আপনার সাথে কে?” তিনি বললেন, “মুহাম্মদ।” জিজ্ঞেস করা হল, “তাঁর মিশন কি শুরূ হয়েছে?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, তাঁর মিশন শুরূ হয়েছে।” এরপর এটা খোলা হল এবং আমি ইউসূফকে (আঃ) দেখলাম যাকে সমস্ত সৌন্দর্যের অর্ধেক দেয়া হয়েছে। তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন।
তারপর আমাকে চতুর্থ আসমানে নিয়ে আসা হল এবং জিব্রীল এটি খোলার জন্য বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, “আপনি কে?” তিনি বললেন, “জিব্রীল।” বলা হল, “আপনার সাথে কে?” তিনি বললেন, “মুহাম্মদ।” জিজ্ঞেস করা হল, “তাঁর মিশন কি শুরূ হয়েছে?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, তাঁর মিশন শুরূ হয়েছে।” এরপর এটা খোলা হল এবং আমি ইদ্রীসকে (আঃ) দেখলাম। তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রসূলুল্লাহ (সঃ) পাঠ করলেনঃ وَرَفَعْنَاهُ مَكَانًا عَلِيًّا “আমরা তাকে একটি উচ্চ স্থানে উঠিয়ে নিয়েছি।” [১৯/৫৭]।
[এরপর তিনি আবার ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলেন] তারপর আমাকে পঞ্চম আসমানে নিয়ে আসা হল এবং জিব্রীল এটি খোলার জন্য বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, “আপনি কে?” তিনি বললেন, “জিব্রীল।” বলা হল, “আপনার সাথে কে?” তিনি বললেন, “মুহাম্মদ।” জিজ্ঞেস করা হল, “তাঁর মিশন কি শুরূ হয়েছে?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, তাঁর মিশন শুরূ হয়েছে।” এরপর এটা খোলা হল এবং আমি হারুনকে (আঃ) দেখলাম।তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন।
তারপর আমাকে ষষ্ঠ আসমানে নিয়ে আসা হল এবং জিব্রীল এটি খোলার জন্য বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, “আপনি কে?” তিনি বললেন, “জিব্রীল।” বলা হল, “আপনার সাথে কে?” তিনি বললেন, “মুহাম্মদ।” জিজ্ঞেস করা হল, “তাঁর মিশন কি শুরূ হয়েছে?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, তাঁর মিশন শুরূ হয়েছে।” এরপর এটা খোলা হল এবং আমি মূসাকে (আঃ) দেখলাম। তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন।
তারপর আমাকে সপ্তম আসমানে নিয়ে আসা হল এবং জিব্রীল এটি খোলার জন্য বললেন। জিজ্ঞেস করা হল, “আপনি কে?” তিনি বললেন, “জিব্রীল।” বলা হল, “আপনার সাথে কে?” তিনি বললেন, “মুহাম্মদ।” জিজ্ঞেস করা হল, “তাঁর মিশন কি শুরূ হয়েছে।” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, তাঁর মিশন শুরূ হয়েছে।” এরপর এটা খোলা হল এবং আমি ইব্রাহীমকে (আঃ) দেখলাম তিনি বায়তুল মা’মূরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বায়তুল মা’মূরে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশ্তা প্রবেশ করেন। একবার বেরিয়ে তারা এতে আর পুনর্বার প্রবেশ করেননা।
তারপর আমাকে সিদরাতুল মুনতাহার [বরই গাছ, যা পেরিয়ে কোন সৃষ্টজীব সামনে বাড়তে পারেনা] নিকট আনা হল। এর পাতাগুলো ছিল হাতির কানের মত; এর ফলগুলো ছিল জগের আকৃতির; আর গাছটা আল্লাহর নির্দেশে যা দিয়ে আচ্ছাদিত হবার দরকার তা দিয়ে আচ্ছাদিত হয়ে গিয়েছিল। এটা এমন সৌন্দর্যে আচ্ছাদিত হয়ে গিয়েছিল যে আল্লাহর সৃষ্টির কেউই এ সৌন্দর্য বর্ণনা করতে পারবেনা।
তারপর আল্লাহ আমার প্রতি যা নাজিল করার তা তিনি নাজ়িল করলেন। তিনি আমার প্রতি দিনে রাতে ৫০ ওয়াক্ত নামাজের নির্দেশ দিলেন। এরপর আমি নেমে আসলাম এবং মূসা (আঃ) পর্যন্ত পৌঁছুলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার রব্ব তোমার উম্মতের জন্য কী ফরজ করেছেন?” আমি বললাম, “দিনে রাতে ৫০ ওয়াক্ত নামাজ।” তিনি বললেন তুমি তোমার রব্বের কাছে ফিরে যাও এবং তোমার উম্মতের জন্য [বোঝা] হালকা করে দিতে বল, কারণ তোমার উম্মত এটা পারবেনা। আমি বনী ইসরাঈলকে পরীক্ষা করেছি এবং তারা কীরূপ তা দেখেছি।” সুতরাং আমি আমার রব্বের কাছে ফিরে গেলাম এবং বললাম, “আমার রব্ব, আমার উম্মতের জন্য কমিয়ে দাও, কারণ তারা কখনও এটা পালন করতে পারবেনা।” তিনি তখন পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন। আমি নেমে আসলাম এবং মূসা (আঃ) সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কী করেছ?” আমি বললাম, “[আমার রব্ব] পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দিয়েছেন।” তিনি বললেন, “তোমার রব্বের কাছে ফিরে যাও এবং তোমার উম্মতের বোঝা কমিয়ে দিতে বল।” আমি মূসা (আঃ) এবং আমার রব্বের মাঝে আসা যাওয়া করতে থাকলাম এবং তিনি পাঁচ ওয়াক্ত করে কমিয়ে দিলেন প্রত্যেকবার। অবশেষে তিনি বললেন, “হে মুহাম্মদ! এখন দিনে রাতে এই পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ [তোমার উম্মতের জন্য]। আর প্রত্যেক ওয়াক্তের জন্য রয়েছে ১০ গুন সওয়াব, অর্থাৎ এগুলো ৫০ ওয়াক্তের মতই। যে কেউ একটা ভাল কাজ করতে ইচ্ছে করে তা করবেনা, তার জন্য একটি সওয়াব লিখা হবে। আর যদি সে তা করে তবে তার জন্য ১০টি সওয়াব লিখা হবে। কেউ যদি কোন মন্দ কাজের ইচ্ছে করে তা না করে, তবে তার জন্য কোন গোনাহ লিখা হবেনা। আর যদি সে তা করে তবে শুধু একটি গোনাহই তার জন্য লিখা হবে।”
এরপর আমি নেমে আসলাম এবং মূসার (আঃ) কাছে পৌঁছলাম এবং তাঁর কাছে এ ব্যাপারে বললাম। তিনি বললেন, “তুমি ফিরে যাও এবং তোমার রব্বকে তোমার উম্মতের বোঝা লাঘব করে দিতে বল, কারণ তারা কখনোই এটা পালন করতে পারবেনা।” রসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, আমি আমার রব্বের কাছে বারবার ফিরে যেতে লজ্জাবোধ করেছি।”
আরো অনেকগুলো হাদীস আনাস বিন মালিক (রাঃ), মালিক বিন সা’সা (রাঃ), জাবির বিন আব্দুল্লাহ ও আবূ জার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। সবগুলো মোটামুটি একই অর্থের হাদীস। কিছু কিছু হাদীসে আরো কিছু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
কুর’আনের সূরা আন-নাজমের ১ থেকে ১৮ আয়াতে নীচের কথাগুলো বলেছেন আল্লাহ –সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাঃ
“তারকার কসম, যখন তা অস্তমিত হয়। তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হন নি এবং ভূলও করেননি। আর তিনি বাসনার অনুসরণ করে কথা বলেননা। বরং ওটা একটা ওয়াহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে। তাঁকে শিক্ষা দান করেন এক মহা শক্তিশালী [[ফিরিশ্তা]। যিনি সহজাত শক্তিসম্পন্ন, [দেহ মনের অক্ষমতা থেকে মুক্ত], আর সে উর্ধ্বে উঠল ও স্থির হল| সে ছিল উর্ধ দিগন্তে, সে নিকটবর্তী হল এবং ঝুলে গেল। তখন দূরত্ব ছিল দুই ধনুকের বা তারও কম। এরপর [আল্লাহ] তাঁর বান্দার প্রতি যা ওয়াহী করার তা করলেন। তিনি [রাসূলুল্লাহ]] যা দেখেছেন সে ব্যাপারে তাঁর অন্তর মিথ্যা বলেনি। তিনি যা দেখেছেন সে ব্যাপারে তোমরা কি তাঁর সাথে বিতর্ক করবে? নিশ্চয়ই তিনি তাঁকে আরেকবার দেখেছিলেন, সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে, যার কাছে রয়েছে বসবাসের জান্নাত। যখন বরই গাছটি আচ্ছাদিত হয়ে গিয়েছিল তা দিয়ে যা দিয়ে একে আচ্ছন্ন করা হয়েছিল। তাঁর দৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়নি এবং সীমালংঘনও করেনি। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর রব্বের বিরাট নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন।”
কিছু বিভ্রান্তি যার অপনোদন হওয়া দরকারঃ
রসুলুল্লাহ (সঃ) কতদূর উর্ধ্বে আরোহণ করেছিলেন?
এব্যাপারে বড় রকমের বিভ্রান্তি দেখা যায়। কিছু লোকেরা বলে থাকে যে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছার পর জিব্রীল (আঃ) রসূলুল্লাহকে (সঃ) সামনে বাড়িয়ে দিয়ে নিজে আর অগ্রসর হননি। কারণ এতে নাকি তাঁর ডানা ও পালকগুলো সব পুড়ে ছাঁই হয়ে যাবে। কিছু লোক বলে যে এরপর রসূলুল্লাহকে নেবার জন্য রফরফ পাঠানো হয়েছে, যা নাকি আব্দুল কাদির জিলানীর (রঃ) রূহ। এবং যাতে চড়ে তিনি আরশে আজীমে আল্লাহর কাছে গিয়ে পৌঁছেন। [আয়্যাজুবিল্লাহ]
প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে সিদরাতুল মুনতাহা পার হয়ে কোন সৃষ্টিই সামনে বাড়তে পারেনা। আর মুহাম্মদ (সঃ) ও এর বাইরে যাননি। উপরে উল্লেখিত আনাস বিন মালিক (রাঃ) বর্ণিত হাদীসেও আমরা তা দেখতে পাই। সিদ্রাতুল মুনতাহার কাছেই আল্লাহ তাঁর সাথে কথা বলেছেন এবং ওয়াহী করেছেন।
তিনি রফরফে চড়ে আরশে গিয়েছেন কিনা?
রফরফ সংক্রান্ত বিভ্রান্তি আমি আগেই উল্লেখ করেছি। প্রকৃত সত্য হচ্ছে তিনি “রফরফে” চড়েননি। বরং তিনি “রফরফ” দেখেছেন। আর রফরফ আব্দুল কাদির জিলানীর (রঃ) রূহ হওয়ার ধারণা বিরাট একটা মারাত্বক আক্বীদাগত বিভ্রান্তি।
সূরা আন-নাজমে যে বলা হয়েছে তিনি তাঁর রব্বের বিরাট নিদর্শন দেখেছেন এবং তিনি যা দেখেছেন সে ব্যাপারে তাঁর হৃদয় মিথ্যা প্রতিপন্ন করেনি এবং সীমাও লংঘন করেনি, সে ব্যাপারে প্রকৃত কথা হল রফরফ একটা সবুজ মখমলের চাদর যাতে মণিমুক্তার কাজ করা ছিল যাতে জিব্রীল আরোহন করে ছিলেন। সহীহ হাদীসে আমরা তাই দেখতে পাই। ইমাম বুখারী তাঁর সহীহতে –ওয়া লাক্বাদ রআ মিন আয়াতি রব্বিহিল-কুবরা – আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি সবুজ রফরফ দেখেন যা দিগন্ত ব্যাপী বিস্তৃত ছিল।
حَدَّثَنَا قَبِيصَةُ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ عَنْ الْأَعْمَشِ عَنْ إِبْرَاهِيمَ عَنْ عَلْقَمَةَ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: (لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى) قَالَ رَأَى رَفْرَفًا أَخْضَرَ قَدْ سَدَّ الْأُفُقَ (البخاري)
তিনি আল্লাহকে দেখেছিলেন কিনা?
সূরা নজমের আয়াতগুলোকে কিছু লোকেরা নিজের মনমত ব্যাখ্যা করে বলেছে যে তিনি (সঃ) তাঁর রব্বকে দেখেছেন। প্রকৃত ব্যাপার হল রসূলুল্লাহ (সঃ) আল্লাহকে দেখেননি মি‘রাজের রাতে। আবূ জার (রাঃ) যখন মি‘রাজের হাদীস বর্ণনা করছিলেন তখন তাঁর ছাত্র প্রখ্যাত তাবেয়ী আব্দুল্লাহ ইবন শাক্বীক (রঃ) বললেন, “আমি আবূজরকে বললামঃ আমি যদি রসূলুল্লাহকে (সঃ) দেখতাম তবে তাঁকে একটা বিষয়ে জিজ্ঞেস করতাম। আবূজার (রাঃ) বললেনঃ তুমি কী জিজ্ঞেস করতে? আমি বললামঃ তিনি তাঁর রব্বকে দেখেছেন কিনা? তিনি বললেনঃ আমি তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি। তিনি (সঃ) বলেছেন - আমি নূর দেখেছি; আমি কীভাবে তাঁকে দেখতে পারি?” [মুসনাদ ইমাম আহমদ]
সূরা নজমের আয়াতগুলোতে যে দেখার কথা বলা হয়েছে তাহলে তা কী? এ ব্যাপারে বুখারীর কিতাবুত তাফসীরে এবং মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ থেকে পরিষ্কার বর্ণনা এসেছে যে তিনি জিব্রীলকে (আঃ) দেখেছেন। নীচে কয়েকটা হাদীস উল্লেখ করা হলঃ
عَنْ الشَّيْبَانِيِّ عَنْ زِرٍّ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ: قَالَ (مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى ) قَالَ رَأَى جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلَام لَهُ سِتُّ مِائَةِ جَنَاحٍ (مسلم)
“মা কাজাবাল ফুয়াদু মা র’আ” সম্পর্কে তিনি বলেন, “তিনি (সঃ) জিব্রীলকে দেখেছেন আর তাঁর ছিল ছয়শত ডানা।” [মুসলিম]
حَدَّثَنَا أَبُو إِسْحَاقَ الشَّيْبَانِيُّ قَالَ سَأَلْتُ زِرَّ بْنَ حُبَيْشٍ: عَنْ قَوْلِ اللَّهِ تَعَالَى (فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى ) قَالَ حَدَّثَنَا ابْنُ مَسْعُودٍ أَنَّهُ رَأَى جِبْرِيلَ لَهُ سِتُّ مِائَةِ جَنَاحٍ (البخاري)
যিরর ইবন হুবায়শ (রঃ) বলেন, আল্লাহর কথা “ফাকানা ক্বাবা ক্বাওসাইনে আও আদনা , ফা আওহা ইলা আব্দিহি মা আওহা” সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন যে রসুলুল্লাহ (সঃ) জিব্রীলকে ছয়শত ডানা বিশিষ্ট অবস্থায় দেখেছেন। [আল-বুখারী]
পুরো ব্যাপারটা আরো বেশী পরিষ্কার করেছেন আয়িশা (রাঃ) তাঁর থেকে প্রখ্যাত তাবিয়ী মাসরূক (রঃ) এর বর্ণনা করা এক হাদীসে। হাদীসটি নিম্নরূপঃ
মাসরূক বলেনঃ আমি আয়িশার (রাঃ) কাছে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। তিনি বললেন, “হে আবূ আয়িশা [মাসরূকের কুনিয়াত], তিনটি বিষয় এমন যেগুলোর একটাও কেউ যদি বলে তবে সে আল্লাহর ব্যাপারে বড় ধরণের মিথ্যা আরোপ করেছে।” আমি বললাম, “সেগুলো কী কী?” তিনি বললেন, “যে মনে করে যে মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর রব্বকে দেখেছেন সে আল্লাহর ব্যাপারে বড় রকমের মিথ্যা আরোপ করেছে।” আমি হেলান দেয়া ছিলাম কিন্তু তখন আমি সোজা হয়ে বসলাম এবং বললাম, “হে বিশ্বাসীদের মা, আমাকে একটু সময় দিন, আর তাড়াহুড়ো করবেননা। মহামহিম আল্লাহ কি বলেননি – তিনি তাঁকে সুস্পষ্ট দিগন্তে দেখেছেন [ওয়া লাক্বাদ র’আহু বিল-উফুক্বিল-মূবীন] / তিনি তাঁকে পুনর্বার দেখেছেন অবতরণের সময় [ওয়া লাক্বাদ র’আহু নাজলাতান উখরা]?” তিনি বললেন, “আমি এই উম্মতের প্রথম সদস্য যে রসূলুল্লাহকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছে। তিনি (সঃ) বলেছেনঃ সেটাতো জিব্রীল ছিল। আমি তাঁকে আল্লাহ যেরূপে সৃষ্টি করেছেন সে রূপে এই দুবারের বেশী কখনো দেখিনি। আমি তাঁকে দেখেছি আকাশ থেকে ঝুলে পড়তে আর তাঁর বিশাল অবয়ব আসমান থেকে জমীন পর্যন্ত আড়াল করে রেখেছিল। এরপর তিনি [আয়িশা] বললেন, “তুমি কি শোননি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন (কোন দৃষ্টি তাঁকে আয়ত্ব করতে পারেনা, সব দৃষ্টিই তাঁর আয়ত্বাধীন। আর তিনি সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয়ে খবর রাখেন। ৬/১০৩)? তুমি কি শোননি যে আল্লাহ বলেছেন, (কোন মানুষের পক্ষেই এটা শোভা পায়না যে আল্লাহ সরাসরি তার সাথে কথা বলবেন, শুধু ওয়াহী ছাড়া, অথবা কোন পর্দার আড়াল ছাড়া অথবা কোন ফিরিশতা পাঠাবেন তিনি আল্লাহর অনুমতিক্রমে আল্লাহ যা চান তা প্রত্যাদেশ করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সুউচ্চ ও পরম প্রজ্ঞাময়। ৪২/৫১)?” তিনি (আয়িশা) বললেন, “যে মনে করে যে রসূলুল্লাহ (সঃ) আল্লাহর কিতাব থেকে কিছু অংশ গোপন করেছেন, সে আল্লাহর ব্যাপারে বড় ধরণের মিথ্যা আরোপ করেছে। অথচ আল্লাহ বলেছেনঃ (হে রসূল, পৌছে দিন যা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনিতো তাঁর পয়গাম কিছুই পৌছালেন না। ৫/৬৭)” তিনি (আয়িশা) আরো বললেন, “যে মনে করে যে আগামীকাল কী ঘটবে তা রসূলুল্লাহ (সঃ) জানতেন তাহলে সেও আল্লাহর নামে বড় রকমের মিথ্যা আরোপ করেছে। অথচ আল্লাহ বলেছেনঃ (বলুন, আল্লাহ ব্যতীত নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে কেউ গায়বের খবর জানে না এবং তারা জানে না যে, তারা কখন পুনরুজ্জীবিত হবে। ২৭/৬৫)” [হাদীসটি বুখারী, মুসলিম, আহমদ, ও তিরমিজীতে এসেছে বিভিন্নভাবে]
আল্লাহকে দেখা ও রফরফে চড়ে সিদরাতুল মুনতাহা পার হয়ে কোন সৃষ্টির আল্লাহর আরশে পৌঁছানো সংক্রান্ত সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর আশা করি এতে অপনোদন হবে। মি‘রাজ হয়েছে রসূলুল্লাহর (সঃ); আর তাঁকে মি‘রাজে নিয়ে গিয়েছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা। সুতরাং এ সংক্রান্ত বিষয়ে আল্লাহ ও রসূল যা বলেছেন তার চেয়ে বাড়িয়ে কিছু বলা মারাত্বক রকমের বাড়াবাড়ি। কিন্তু কিছু মানুষ সব সময় এসমস্ত ব্যাপারে কোন তোয়াক্কাই করেনা। আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেনঃ “হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আগে বেড়ে যেওনা। আর আল্লাহর ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব শোনেন ও জানেন।” [৪৯/১] আল্লাহ আমাদেরকে এধরণের আক্বীদাগত বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন।
===
আগে অন্য ব্লগে প্রকাশিত
বিষয়: বিবিধ
৩৬৮৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন