লুঙ্গি ও বাঙালীর টনটনে আত্মসম্মানবোধ

লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ১৫ এপ্রিল, ২০১৩, ০৩:৩২:২৮ রাত

ভূমিকাঃ বারিধারার সাম্প্রতিক লুঙ্গি বিষয়ক সমস্যা দেখে আজ থেকে ৬ বছর আগে সামুতে নিজের লিখা লুঙ্গি বিষয়ক পোস্টটা মনে পড়ে যাওয়ায় এখানে নতুন পোস্ট করলাম।

=======

আজ [১৪ জুলাই, ২০০৭] আসছিলাম আমার মেয়ে দুটোকে (সামীহাহ্ ও সুহায়লাহ্] নিয়ে ‘জামায়কা বে ওয়াইল্ড লাইফ রিফিউজ’ ভ্রমন শেষে। মাঝখানে ট্রেন পরিবর্তন করার জন্য ফ্রাঙ্কলিন এভেন্যূ স্টেশনে নামতেই পেছন থেকে সালাম শুনে তাকাতেই দেখি এক আফ্রিকান-আমেরিকান (কালো) মুসলিম ভাই। আমার মাথায় টুপি আর দেখেই তিনি ধরে নিয়েছিলেন আমি মুসলিম। আমি ভাল করে তাকিয়ে দেখি তাঁর লম্বা জামার নীচে বাংলাদেশী লুঙ্গী। যদিও লুঙ্গী অনেক দেশের লোকেরাই পরে তবুও আমার মনে হলো ঐ ভাইটির পরনেরটি বাংলাদেশী। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওটা কি বাংলাদেশী ইজার [লুঙ্গী]? তিনি লাজুক হেসে বললেন, হ্যাঁ।

আরেকটা ঘটনা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের [IIUM] এক অধ্যাপকের কাছে শোনা। ইনি হলেন রাস্ট্রবিজ্ঞানের ডঃ সাইয়েদ সিরাজুল ইসলাম, বর্তমানে কানাডার লেইকহেড বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত । উনি একসময় ম্যাকগিলেও পড়াতেন। সে সময় তিনি তাঁর এক কানাডিয়ান (সাদা) সহকর্মীকে একটা লুঙ্গী উপহার দিয়েছিলেন। ঐ অধ্যাপক ভদ্রলোক পরেরদিন লুঙ্গী পরেই ডিপার্টমেন্টে হাজির। ডঃ ইসলামকে তিনি বললেন, “দেখো, তোমাদের পোষাকটা বেশ আরামদায়ক।”

আমাদের বিশ্বাবিদ্যালয়ে [International Islamic University Malaysia] আরবী ভাষায় মাস্টার্স পড়তেন বাংলাদেশী এক বড় ভাই, যিনি পরে অন্য আরেকটা বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্বে পি-এইচ, ডি, করে এখন দারুল ইহসান বিশ্বাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি মাঝে মাঝে সাফারী স্যুট পরতেন। অবশ্য বেশীরভাগ সময়ে পড়তেন লম্বা আরবী জামা। ঐ লম্বা জামার নীচে দিব্যি লুঙ্গী পরে তিনি ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতেন। ক্যাম্পাসের সব বাংলাদেশী ছাত্ররাও ব্যাপারটা জানতনা। আমরা কয়েকজন মাত্র জানতাম ব্যাপারটা।

ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত ১১৫টি দেশের মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী। তাদের অনেকেই লুঙ্গীর সাথে পরিচিত হন সেখানে এসে। অবশ্য ওদেশে লুঙ্গী "সারোং" নামে পরিচিত। আমাদের বসনিয়ান এক বন্ধু হারুনতো লুঙ্গী পেয়ে ভীষণ খুশী। তাঁর মতে দুনিয়ার সবচেয়ে আরামদায়ক পোষাক হলো লুঙ্গী। হারুনের মতো আরো অনেকে মালয়েশিয়া এসে লুঙ্গী পরা শিখেছিল।

নামকরা বাঙালীদের মধ্যে জনসমক্ষে লুঙ্গী পরতেন মাওলানা ভাসানী। এরশাদের সময়ে একবার বাংলাদেশের জাতিসংঘে নিযুক্ত রাস্ট্রদুত লুঙ্গী-পাঞ্জাবি পরে মহাসচিবের কাছে তাঁর পরিচয়পত্র পেশ করেছিলেন বলে খবর বেরিয়েছিল। আর কোন প্রখ্যাত বাঙালী জনসমক্ষে লুঙ্গী পরতেন কিনা আমি জানিনা।

অনেক বাঙালীর মধ্যে লুঙ্গী পরার প্রতি রয়েছে এক ধরনের হীনমন্যতা। তারা কাউকে লুঙ্গী পরতে দেখলে মনে করে লোকটা গেঁয়ো। প্যান্ট-শার্ট পরাকে তারা মনে করেন ভদ্রলোকি কাজ। লুঙ্গী কাউকে পরতে দেখলে নাক সিটকান। অথচ ইংরেজ প্রভুরা আসার আগে তাদের পুর্বপুরুষরা কিন্তু প্যান্ট-শার্ট পরতেন না। কেউ আবার ভাববেন না আমি প্যান্ট-শার্ট পরাকে ঘৃণা করি। আমার শুধু কথা হলো কেনো সাধারণের নৈমিত্তিক ব্যবহারের পোশাকটাকে অফিস-আদালতের পোশাকের অযোগ্য মনে করা হয়। প্যান্ট-শার্ট পরাতো শিখেছি আমরা পরাধীন হওয়ার পর। আর লুঙ্গী-কোর্তা/পাঞ্জাবী হলো আমাদের স্বাধীন পূর্ব পুরুষের পোষাক। আমাদের স্বাধীন পূর্বপুরুষের এ পোষাকের প্রতি উন্নাসিকতা মোটেই কাম্য নয়।

পোশাক মানুষ পরে থাকে লজ্জা নিবারণ, পরিবেশের ক্ষতিকারক উপাদান থেকে রক্ষা এবং সৌন্দর্য উপকরণ হিসেবে। যে পোষাক এ কাজগুলো ঠিকঠাক মতো করে তা অবশ্যই ভালো পোষাক। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন, “ওহে আদম সন্তানেরা! তোমাদের শরীরের লজ্জাস্থানগুলো ঢাকার এবং তোমাদের দেহের সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বিধানের উদ্দেশ্যে আমি তোমাদের জন্য পোশাক নাজিল করেছি। আর খোদাভীতির পোশাক হচ্ছে সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম, আশা করা যায় লোকেরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।” [আল-কুরআন; ৭/২৬]

লুঙ্গী পোশাকের উপরে বর্ণিত উদ্দেশ্যগুলো ভালভাবেই পালন করে। তাই একে খাটো করে দেখার উপায় নেই। ভিন দেশীরা যদি এ পোশাককে ভালো বলে গ্রহণ করতে পারে তাহলে আমরা কেন এর পরিধানকারী খাটো করে দেখব। আজ ভাষানীর মতো আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন বাঙালীর দরকার অনেক। দরকার পরের পোশাকের চেয়ে নিজেরটাকে মূল্য দিতে শিখার মানুষের।

নিউ ইয়র্ক (জুলাই ১৪, ২০০৭)

পুনশ্চঃ বারিধারাতে হঠাৎ জাতে উঠা ঐ লোকগুলোর কিছু একটা বিহিত করা দরকার। মুশকিল হচ্ছে এখন বাংলাদেশে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিরোধী সবকিছু লালনের সময়; আর সময় হচ্ছে নিজেদের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশ প্রেমের ফাঁকা বুলি ছাড়ার।

বিষয়: বিবিধ

২৬৭৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

303577
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ১১:১৯
মনসুর লিখেছেন : মাশাআল্লাহ, সুন্দর লিখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ, জাজাকাল্লাহু খাইরান। শুভেচ্ছান্তে ধন্যবাদ।
লুঙ্গী আমারও পছন্দের পোশাক।
মহান আল্লাহ আমাদর সবাইকে হেদায়েত দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে নেক কামিয়াবী দান করুন, আমীন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File