কোটি প্রবাসীর ভীড়ে এক প্রবাসীর সংগ্রামী জীবনালেখ্য.....
লিখেছেন লিখেছেন মু নূরনবী ১৭ এপ্রিল, ২০১৪, ১০:১১:৩৫ রাত
কৃষি নির্ভর পরিবার হওয়ায় আব্বার পড়াশোনা বেশীদূর আগায়নি। স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার আগেই শুরু হয় সংসারের ঘানি টানা! বড় সংসার হওয়াতে দাদার ইনকামে যখন কুলোয় উঠতে পারছিল না, তখন আদমজী জুট মিলে শুরু হলো জীবনযুদ্ধ।
৮৮ সাল! ভিসা ঠিক হলো। দাদা জমি বিক্রি করে দিয়ে বড় ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন সংসারের উন্নতির জন্য। দুই ফুফুর বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু মেঝ কাকা এবং সেজ কাকা প্রায় বেকার। ছোট কাকা সিক্সে পড়ে।
বিদেশ বিভূঁইয়ে গিয়ে নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর নেশায় যখন বিভোর ঠিক তখনই ছন্দ পতন। স্ট্রোক করে দাদী মারা গেলেন! সেই শোক সইতে না সইতে কুয়েত-ইরাক যুদ্ধ! অনেকটা নি:স্ব হয়ে বাড়ী ফেরা!
শুরু হলো দাদার সাথে নিজেদের জায়গা জমিন দেখা, গা-গেরস্থের কাজ করা। এরই মধ্যে মেঝ কাকা লিবিয়া গেলেন। কিন্তু খুব বেশী সুবিধা করতে পারলেন না! দুই বছর হয়ে গেলেও বাড়ীতে টাকা পাঠানোর নামগন্ধ নেই! নানা দু:শ্চিন্তায় অসুখ এসে দানা বাঁধলো আব্বার শরীরে!
অনেকটা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলেন। এরই মধ্যে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলো। তার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই কুয়েত থেকে পূর্বের কোম্পানী তাঁর পরিশ্রম প্রিয়তা দেখে ভিসা পাঠিয়ে দিলো আমাদের গ্রামের ঠিকানায়। আমার মনে আছে যে দিন ভিসা নিয়ে ট্রাভেল এজন্সির প্রতিনিধি আমাদের বাড়ী এসেছিল সে দিন বিয়ে বাড়ীর মত উতসব বিরাজ করেছিল।
সদ্য রোগমুক্ত; অনেকটা জীর্ণ শরীর নিয়ে দুই মাসের মাথায় আব্বা আবার বিদেশ চলে গেলেন। একে একে ছোট তিন কাকাকেও কুয়েত নিয়ে গেলেন। অল্প দিনের মধ্যেই আমাদের সংসারের আর্থিক স্বচ্চলতা দেখা দিল। নতুন বাড়ী তৈরি করা হলো। নতুন বাড়ীতে উঠার আগেই দাদা চলে গেলেন ওপারে।
৯৮ সালে আব্বা বাড়ী আসলেন। সেজে কাকাকে বিয়ে দিলেন। এরই মধ্যে আমরা চার ভাই বোন। সবাই বেড়ে উঠছি। স্বাভাবিকভাবে সংসারে আমাদের খরচ বেশী। আব্বার ইনকামে নাকি আমাদের হয় না!
বড় সংসারে চাচীরা ঠিক মত খেতে পারেন না! নিজের মত করে চলতে পারেন না। আমাদের ভাই বোনদের ডিসুম ডুসুমে তাদের ডিস্টার্ব! শুরু হয়ে গেল ভাঙ্গনের সুর! কিন্তু আব্বার এক কথা আমি আমার ভাইদের সাথে আলাদা খেতে পারবো না। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, আব্বা কখনো আম্মার জন্য আলাদা ভাবে এক টুকরো কাপড় কিনেন নাই। পাছে, ছোট ভাই বা তাদের বউরা যাতে কিছু মনে করে! একান্নবর্তী পরিবার হওয়াতে দাদাই কিনতেন এবং অন্য চাচীদের পছন্দেরটা নেওয়া শেষ হলে যেটা থাকতো সেটাই আম্মার কপালে জুটতো! এটা শুধু কাপড় নয়, সব কিছুতেই! আব্বা আম্মাকে বলতো, তোমার খরচ বেশী তাই একটু মানিয়ে নাও, শুকরিয়া আদায় করো! দেখবে তোমারও একদিন সময় আসবে।
তবুও তারা সন্তুষ্ট নন! তাড়াতাড়ি আলাদা হতে পারলে নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য পুঁজি করতে পারবেন। একান্নবর্তী সংসারে থেকে বরং তাদের লস। পরে চাচারাই নিজ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন।
সালটা ৯৯। আমি নবম শ্রেণীতে পড়ি। সংসারের অন্যান্য বিষয়াদি ভাগ-ভাটোয়ারার ক্ষেত্রেও আমাদের সাথে জুলুম করা হলো! নতুন ঘর এবং সেমিপাকা ঘর দুই চাচার আর আমাদের জন্য বরাদ্দ ত্রিশ বছরের পুরনো ঘর!
শুরু হয় আব্বার নতুন যাত্রা! এরই মধ্যে আমাদের পরিবারে যোগ হয় নতুন সদস্য। দুই ছেলে তিন মেয়ে নিয়ে আব্বার নতুন সংগ্রাম!
২০০০ সালে আব্বা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স পায়। তার দুই মাস পরেই বড় কোম্পানীতে কাজ পায়। বেতন দুই অংকের ঘর থেকে তিন অংকের ঘরে গিয়ে দাঁড়ায়। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে! পুরনো বাড়ীর সাথে আরো চুয়াল্লিশ শতাংশ জায়গা কিনে নতুন বাড়ী করেছেন। শহরে সত্তর লক্ষ টাকা দিয়ে জায়গা কিনেছেন। আমি নিজে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি, বড় বোন এসএসসি কমপ্লিট করার পর তার বিয়ে হয়ে যায়। মেঝটা ডিগ্রী সেকেন্ড ইয়ার, ছোটটা এপ্লিক্যান্ট। ছোট ভাই সামনে জেএসসি দিবে। অন্যদিকে চাচীরা খুব বেশী ভাল নেই! তবুও চেষ্টা করি তাদের সেই দিনের হীনম্মন্যতাকে ভুলে মিলে যাই। কিন্তু যতবারই চেষ্টা করেছি বরং তারা দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঝামেলা পাকনোর চেষ্টা করেছে!
আব্বার সেই পরিশ্রমের ফলেই আমাদের পরিবার সমাজে প্রতিষ্ঠিত। যে সমাজে অনেকের কোটি কোটি টাকা আছে কিন্তু শিক্ষার দিকে থেকে পিছিয়ে। হ্যাঁ, আম্মার অবদানও অনস্বীকার্য! আমি দেখেছি সংসারের চরম বিপদের মুহুর্তেও ধৈর্য্য ধারণ করতে। প্রবাসী স্বামীর সংসারে নিজের সুখগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলতে। সারাদিন সংসারের ধকল নিয়ে সন্ধ্যায় আমাদের ছোট ভাই বোনদের নিয়ে পড়তে বসতে। ঢুলু চোখ নিয়ে আমাদের পাশে বসে থাকতে! ফজরের পর নামাজ পড়ার জন্য তাগিদ দিয়ে কাজ না হলে, কখনো বেত নিয়ে তেড়ে আসতেন। ফজরের নামাজ পড়ার পর কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে শুরু হতো নিত্যকার কাজ। শুরু হতো হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। এখনো আম্মা বদলাননি!
সর্বশেষ ২০১০ সালে যখন বাড়ী এসেছেন তখন আমার সাথে প্রথম আব্বার একটি বিষয় নিয়ে মনোমালিণ্য হয়! গ্রামের বাড়ীতে ফাউন্ডেশন দিয়ে ঘর করা নিয়ে। আব্বাকে অনেক করে বুঝালাম, আমাদের আর এককালীন গ্রামের বাড়ী এসে থাকা হবে না! সুতরাং সেমি পাকা ঘর করলেই যথেষ্ঠ! শেষ মেষ আমাকে মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তোমরা শহরে থেকো...বাবা। আমি গ্রামেই থাকব। আমার মৃত্যুর পর আমাকে গ্রামেই মাটি দিও! আব্বাকে আর বাধা দিলাম না!
প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা খরচ করে দুই ইউনিটের বাড়ী করলেন। ওনার যুক্তি হচ্ছে, শহর থেকে একদিনের জন্য আসলেও যেন কষ্ট না হয়। থাকার সমস্যা নিয়ে আমার ছেলে মেয়ে কষ্ট করেছে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন কষ্ট না করে! আমার দুই ছেলের জন্যই আমি দুই ইউনিট দিয়ে বাড়ী করবো।
গত কিছুদিন আগে আব্বা স্ট্রোক করেছেন। এখন সুস্থ আছেন। বাড়ী আসার জন্য তাগাদা দেওয়া সত্বেও তিনি আসবেন না! ছোট মেয়েকে, বড় ছেলেকে বিয়ে দিয়ে বাড়ী আসবেন। আম্মাকে নিয়ে হজ্জ্বে যাবেন।
তার প্রচেষ্টায় আজ আমাদের সাজানো ঘোছানো সংসার। অথচ নিজের জন্য কিছুই চিন্তা করেন না। কাজ পাগল এই লোকটা।
তবু ভয় হয়! এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি, সুখের দেখা পেলে সেই মানুষ চলে যায় না ফেরার দেশে।
জানি না আল্লাহ তাঁর জন্য আমাদের কিছু করার সুযোগ করে দিবেন কি না!
বিষয়: Contest_father
১৯৩০ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তাই ভয় হয়।
দোয়া কইরেন।
অনেক দিন পর লিখলাম...
কি ছাইপাশ লিখেছি....জানি না।
আপনার দোয়া যেন আল্লাহ কবুল করেন, আমিন।
অনেক দিন লিখব লিখব করে লিখা হচ্ছিল না!
সে দিন লিখতে গিয়ে কতবার যে এডিট করেছি!
...এভাবে মেয়েদের দিকে তাকায় না..বাবু!
অনেক শুভ কামনা রইল পিতা পুত্রের জন্য।
সত্যিই যারা বিদেশ থাকে তাদের অনেক কষ্ট!
তাদের আদর থেকে ছেলে মেয়েরা বঞ্চিত...
তাই সব কিছু ঠিক থাকার পরও সিদ্ধান্ত নিয়েছি...বিদেশে যাব না!
শুধু মুখেই বললে হয় ভালবাসি?...
এটা তো অনুভূতির, অনুধাবন করার বিষয়।
আপনাকে ধন্যবাদ।
এখনো পৃথিবীতে এমন পবিত্র সম্পর্কগুলো থাকাতেই ধরা টিকে আছে...
আল্লাহ আপনাকেও ভাল রাখুক।
জামাল ভাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন