তেইশ দিনের অর্ন্তধ্যান এবং কৈফিয়ত.....
লিখেছেন লিখেছেন মু নূরনবী ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৬:৪১:২৬ সন্ধ্যা
তেইশ দিনের অন্তর্ধ্যান নিয়ে অনেকের অভিযোগ দেখে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবান মনে করছি। আগের কমন নাম্বারটা আপা:তত বন্ধ রেখেছি। তবুও এক কান দু কান হতে হতে নতুন নাম্বারটাও অনেকের জানা হয়ে গেছে। অনেকেই ফোন করে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। সহানুভূতি জানাচ্ছেন। মাঝে মাঝে স্কাইপিতে ঢুঁ মারতাম। দু একজনকে স্কাইপের মাধ্যমে জানিয়েছি এই যা!
অন্যদিনের মত সেই দিনও অফিসের কাজেই ডুবে আছি। হঠাত পাশের বাসার ফারুক ভাইয়ের ফোন। সালাম দেওয়ার পরই অপরপ্রান্ত থেকে ফারুক ভাই বলছে, তোমার বাসায় ডিবি ঢুকেছে, তোমার নাম্বার বন্ধ করে ফেল এবং অফিস থেকে নিরাপদে কোথাও সরে যাও।
কিন্তু আমি না হয় নিরাপদে সরে যাব, মোবাইল বন্ধ করে ফেলব। কিন্তু বাসায় যে ছোট্র ভাইটার অবস্থা কি তাতো জানা হলো না!
ফারুক ভাই'র কথায় কান না দিয়ে সোহেলের নাম্বারে কয়েকবার ট্রাই করলাম। শেষে মনির ভাইয়ের নাম্বারে। অনবরত রিং হচ্ছে কেহই ফোন তুলছে না!
সোহেল হচ্ছে আমার ছোট ভাই, এবার অষ্টম শ্রেণীতে উঠল। আর মনির ভাই হচ্ছে আমার প্রায় নয় বছরের পরিচিত দায়িত্বশীল। ইবনে সীনায় এডমিনে জব করেন। ছাত্রজীবন শেষ করার পর মনির ভাইয়ের সাথে একসাথে থাকি। ঢাকায় আসার পরও কিছুদিন ওনার সাথে ছিলাম। তিনজনের আমাদের ছোট্র ফ্ল্যাটে সব কিছু সাজানো গোছানো। একটু অগোছালো কিছু দেখলেই আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম। এ নিয়ে সোহেল এবং মনির ভাই আমার উপর বেজায় বিরক্ত! মনির ভাইয়ের আচরণে কখনো দূরের লোক মনে হয়নি। যেন তিন ভাইয়ের ছোট্র নীড়!
যাই হোক.... কিছুক্ষণ পর ফোন করলেন আমাদের বাড়ীর মালিক আন্টি। ফোন করে বললেন, তোমার মোবাইল এখনো অন কেন? ওরা মোবাইল ট্র্যাকিং করছে। অলরেডী একজনকে ধরেছে!
মোবাইল অপ করতেই বুকটা হুহু করে উঠলো। পাষাণগুলো আমার অবুঝ ছোট্র ভাইকে কোন টর্চার করছে নাতো!! মোবাইল অপ করে শাহবাগ গিয়ে এক ফ্রেন্ডের হেল্প নিলাম। সম্ভ্যাব্য সব জায়গায় খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কোন ক্লু পেলাম না। ঘরহীন হণ্যে হয়ে খুঁজেই চলেছি। দুদিন দু রাত পার হয়ে গেল কোন হদিস নাই! আম্মার সাথে যথাসম্ভব স্বাভাবিক কথাবর্তা বলার চেষ্টা করতাম। খুব বেশী সময় নিয়ে কথা বলতাম না। আম্মু ফোন না করলে আমি নিজ থেকে ফোন করতাম না! আম্মু বলতো, তুই দেখি ইদানিং বেশী ব্যস্ত!
তৃতীয় দিন মনির ভাইকে অর্ধপঙ্গু করে কোর্টে হাজির করলো। কিন্তু সোহেলের কোন খবর নাই! ঐ দিন রাত বারোটার দিকে অসমর্থিত একটি সূত্রে খবর পেলাম সোহেল এখনো মিরপুর থানায়। সেই সাথে আমাকে সাবধানে চলাফেরা করার অনুরোধ করেছেন মনির ভাই।
কয়েকজন দু:সম্পর্কের বড় ভাইকে ফোন দিলাম। তারা বললেন, এখনতো অনেক রাত। কাল সকালে যাবো। তুমি চিন্তা কইরো না।
হ্যাঁ পরদিন সকাল আটটায় থানার আশেপাশে থেকে একজনকে থানায় পাঠালাম তিনি ফোন করে জানালেন সোহলেকে অলরেডি মামলা দিয়ে দিয়েছে এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কোর্টে চালান করে দিচ্ছে।
মতিন ভাইয়ের মটর সাইকেলের পিছনে বসে ছুটলাম পুরান ঢাকার কোর্টের দিকে! একজন ল ইয়ার ধরলাম। ভগ্নিপতিকে আগেই ফোন করে দিয়েছি যেন কোর্টের সামনে চলে আসে। তার বাসা পুরান ঢাকায়। তিনি গিয়ে সোহেলের সাথে দেখা করেছেন। সোহেল বারবার নিষেধ করে দিয়ে বলেছে, ভাইয়া যেন এ দিকে না আসে। তারা আমাকে আটকে রেখে বলেছে তোর ভাই আসুক, তোকে ছেড়ে দেব। ওরা সোহেলকে দিয়ে আমার মোবাইলে কয়েকবার ট্রাই করেছিল, কিন্তু বন্ধ পেয়েছে। ল ইয়ার, ভগ্নিপতি, ফ্রেন্ডরা সোহেলের সাথে দেখা করেছে অথচ কোর্ট থেকে পাঁচশ গজ দূরে ল ইয়ারের চেম্বারে বসে চোখের জল ফেলেছি আর আল্লাহর কাছে বলেছি, হে আল্লাহ কোন অন্যায় করলে আমি করেছি। আমার শাস্তি তুমি আমার নিষ্পাপ ভাইকে দিওনা! তবে, মানসিকভাবে শক্ত থেকেছি এ জন্য যে আগামী দিনে বাংলাদেশে থাকতে হলে এমন একটা ট্রেনিং এর দরকার আছে বৈকি!
সোহেলকে গোলাবরুদ বহনের সন্দেহভাজন দেখিয়ে মামলা দিয়েছে। মামলায় তার বয়স দেখানো হয়েছে ১৮ বছর। অথচ জন্ম নিবন্ধন কার্ড অনুযায়ী তার বর্তমান বয়স ১২ বছর ৪ মাস! কোর্টে তার জন্ম নিবন্ধন, স্কুলের মার্কসীট, বিভিন্ন স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশপত্র, সরকারী বিজ্ঞান স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হওয়ার তালিকা দেওয়ার পরও বিজ্ঞ (!) আদালত তাকে জামিন না দিয়ে হাজতে পাঠিয়ে দিয়েছে।
পরদিন সকালে সেন্ট্রাল জেলে গিয়ে দেখা করলাম সোহলের সাথে। ধাক্কাধাক্কির মধ্যেও দেখলাম সালাম দিল। সালামের উত্তর নিতে গিয়ে চোখে পানি এসে গেল। হঠাত মনে হলো, আমি যদি ভেঙ্গে পড়ি ও আরো কষ্ট পাবে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে ওর সাথে কিছুক্ষণ ঠাট্রা করলাম। বললাম, তোমার স্কুল থেকে না এক সপ্তাহরে জন্য স্কাউট জাম্বুরীতে যাওয়ার কথা ছিলো? এটা হচ্ছে সেই ট্রেনিং। সেই দিন কিছু খাবার আর প্রয়োজনীয় কিছু জামা কাপড় কিনে দিয়ে আসলাম।
এক সপ্তাহ বিগত হয়ে গেল। ওর জামিনের ফুট আউট দিলে কোর্ট সেটা আমলে না নিয়ে বলে পরের সপ্তাহে ওকে কোর্টে নিয়ে আসেন। বললে উকিল বললো, এই সপ্তাহে বিষ্পোরক ও হরতালের মামলায় কোন জামিন হয় নাই। একটু ধ্যের্য ধরেন। নেক্সট উইকের প্রথমেই হয়ে যাবে।
পরের সপ্তাহের রোববার ওকে কোর্টে উঠানো হলো। সাথে সাবেক সিপি ডা. ফখরুদ্দীন মানিক ভাই। মানিক ভাইয়ের সময়ে আমি বিদায় নিই। ওর কাগজ পত্র দেখে আদালত বললো, বিকালে ডিসিশন দেবো। আদালতের কার্যক্রম শেষ হলে পুলিশকে ম্যানেজ করে ওর সাথে বসে অনেকক্ষণ কথা বললাম। আম্মুর সাথে বোনদের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিলাম। ততদিনে বোনেরা জানতো বাট আম্মুর সাথে শেয়ার করে নাই!
আমাদের পাশাপাশি দেখলাম মানিক ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য ভাবী, ওনার শশুর, শাশুড়ী, আম্মা এসেছেন। সেই সাথে এক বছরের কন্যাও! বাবার কোলে উঠে কি লাফালাফি!! এই ফাঁকে ভগ্নিপতিকে দিয়ে মানিক ভাই এবং সোহেলের জন্য খাবার আনলাম। মানিক ভাই, পানির বোতলটা নিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে খাবার ফিরিয়ে দিলেন।
অবশেষে বিকেলে ল ইয়ার জানালো সোহেলের জামিন হয়েছে এবং জেলগেটে কন্ট্রাক করার জন্য যাতে না আটকায়। এক আংকেলের মাধ্যমে চার হাজার টাকার বিনিময়ে দপারপা হলো। যথারীতি ভগ্নিপতিকে পরদিন পাঠালাম জেলগেটে। মুক্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় নাম থাকলেও দুপুর নাগাদ যখন সে বের হচ্ছিল না তখন দু:শ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পরে একজন কারারক্ষী এসে জানাল পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে না হলে সংশ্লিস্ট থানার পুলিশ জেলগেটে আছে, অন্য মামলায় আটক দেখিয়ে মামলা দিয়ে দিবে! বাধ্য হয়েই সেটাও পরিশোধ করা হলো।
ঐ রাতে ভগ্নিপতির বাসায় থেকে সকালে চলে গেলাম গ্রামের বাড়ী। বার্ষিক পরীক্ষার শেষ হওয়ার পর অনেকবার আবদার করেছে বাড়ী যাওয়ার জন্য কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা থাকায় যেতে দিইনি। অন্যদিকে হরতাল-অবরোধে আমিও যেতে পারিনি। তাই অনেকটা মুক্ত বিহঙ্গের মতো ছুটে গেলাম মায়ের কোলে। থাকলাম টানা দশদিন।
বাড়ীতে গিয়েও শান্তিতে ছিলাম না। আমাদের স্থানীয় বাজারে গত দু মাস ধরে বিএনপির লোকজনকে অঘোষিত অবাঞ্চিত করে রেখেছে আওয়ামীলীগ। বিএনপির যে ই বাজারে গিয়ে আওয়ামীলীগের হাতে বেদম মার খেয়েছে। তবে জামায়াতের লোকজন উঠলেও খুব বেশীক্ষণ অবস্থান করে না। আমি বাড়ী যাওয়ার পর শুনলাম একদিন বিএনপির রোকজন দলবলে বাজারে উঠেছে এবং পুলিশকে বেদম মাইর দিয়েছে। ব্যস! এবার কি দিন কি রাত বাড়ী বাড়ী পুলিশের তল্লাশি..
বাড়ী যাওয়ার পর রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে আম্মা যখন জানলো তখন হাউমাউ করে কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছে। আম্মাকে শান্তনা দিলাম, কত মায়ের বুক খালি হয়েছে তোমার ছেলে তো তোমার বুকে ফিরে এসেছে, তোমার শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
এবার আম্মার নিষেধাজ্ঞা! অপ্রয়োজনের বাড়ীর বাহিরে যাওয়া যাবে না। বাজারে শত জরুরী কাজ থাকলেও যাওয়া যাবে না। অপরিচিত ফোন রিসিভ করা যাবে না...ইত্যাদি, ইত্যাদি। তবুও আম্মাকে ফাঁকি দিয়ে কয়েকবার গিয়েছি...
এরই মধ্যে বাসা পরিবর্তন করেছি। যে আমি আউলা জাউলা চলা পছন্দ করতাম না সেই আমি এখন পর্যন্ত জামাগুলো ভাল ভাবে রাখার স্পেস বের করতে পারিনি! আগের বাসার পাশেই মসজিদ ছিলো, এখন অনেক দূরে! সোহেলেরও মন খারাপ! আস্তে আস্তে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
তবুও আশারাখি আবার সবকিছু ঠিক হবে...ইনশাল্লাহ।
বিষয়: বিবিধ
১৭২৭ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনি তো কাছের মানুষ!
কাছে পেলে চোখের পানিতে ধুয়ে দিতাম সব কষ্ট..
আল্লাহতায়ালার আদালতে আপনাদের পক্ষের ম্বাক্ষী হবার আবেদন করে রাখলাম
দুষ্টু ছেলেরা এভাবে তাকায় না!
ব্লগের সেই সোনালী দিন আর মনে হয়ে ফিরে আসবে না!
মন্তব্য করতে লগইন করুন