মা,মমতা, নিশ্চয়তা আর ভালবাসা.......
লিখেছেন লিখেছেন মু নূরনবী ১১ নভেম্বর, ২০১৩, ১২:৫২:৫৭ রাত
আমার ভয় লাগছে। তুই আমার পাশে বস।
এতে ভয়ের কি আছে? একটা ইনজেকশান ই তো! জাস্ট একটা পিঁপড়া কামড় দিলে যতটুকু ব্যাথা যতটুকু ব্যাথা লাগে তার চাইতে বেশী ব্যাথা পাইবা না। তুমি টেরই পাইবা না!
না, বাবা... তবু তুই আমার পাশে বস।
আন্টি আপনি ব্যাথা পাবেন না। আপনার ছেলে কয়জন?
ল্যাব এইড হাসপাতালে পিজি'র ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের ডাক্তার সৈয়দ মোজাফফর আহমদ অনেকটা কথাচ্ছলে মিস জাহানের হাতে ইনজেকশনটা পুশ করে দিল।
ক্লাস থ্রিতে থাকতে জনি সাইকেল চালাতে গিয়ে মারাত্নক এক্সিডেন্টের সম্মুখীন হয়েছিল। তখন ডাক্তার অনেকগুলো ইনজেকশন হাঁড়ে পুশ করেছিল। সপ্তাহের যেই দিন ইনজেকশন দেওয়ার তারিখ ছিল সে দিন ভয়ে পাশে ফুফুর বাড়ী পালিয়ে যেত। মিস জাহান তখন তাকে অভয় দেওয়ার জন্য বলতো, ছোট একটা পিঁপড়া কামড়ালে যে ব্যাথা লাগে তার চেয়ে ব্যাথা লাগবে না, বাবা। আজ সেই ছোট্র ব্যাথা টুকুকে মিস জাহান এত ভয় পাচ্ছে!!!
কতই বা হবে মিসেস জাহানের বয়স? সর্বোচ্চ পঞ্চাশ। প্রত্যেকটি কাজে তাঁর দৃঢ়তা, চেষ্টা আর সহ্য করার ক্ষমতা অন্য আর দশটা মহিলার চাইতে আলাদা। জনির জন্মের তিন বছর থেকেই মিস্টার বাসার প্রবাসে আছেন। প্রত্যেক ২/৩ বছরান্তে বাড়ী আসেন। ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করার পেছনে মিসেস বাসারের অমানসিক পরিশ্রম কি বোর্ডে লিখে বোঝানো যাবে না।
একান্নবতী সংসারের দায়িত্ব পালনে কখনো পিছু হঠেননি। দেবরের বউরা যখন মার্কেটিং এ ব্যস্ত তখন তিনি রান্ন ঘর সামলাতে ব্যস্ত। রাতে সবাই যখন টিভি নাটক দেখতে সিরিয়াল ধরে বসে গেছে তখন তিনি ছোট্র ছেলে মেয়েগুলোকে পড়াতে বসেছেন। ভোরে সবাই যখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন তখন তিনি জায়নামাজে।
বিয়ের প্রায় ত্রিশ বছর সংসারের গ্লানি টানতে গিয়ে গত পাঁচ বছর থেকে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। একান্নবতী সংসার ভেঙ্গেছে আজ প্রায় চৌদ্দ বছর। নিজের সংসারে এসে দায়িত্বটা যেন আরো বেড়ে গেছে তাঁর। স্বামীর অবর্তমানে নিজের সংসারের হাল নিজেই ধরেছেন। তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন নিজের সংসার। চুয়ান্ন শতাংশের বাড়ীটা যেন আপন মমতায় গড়ে তোলা সবুজের লীলাভূমি।
ভালই যাচ্ছে সংসার। বড় মেয়েটার বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় সাত বছর। মেঝেটার কথা বার্তা পাকা। এর পরই বড় ছেলেকে বিয়ে দিতে হবে। কত কাজ কত দায়িত্ব ..এখনো বাকি।
বর্ষার শেষে শীতের আগমনী বার্তা। সে দিন দুপুর বেলা মৃদু বৃষ্টি হয়েছিল। মিস জাহান উঠোন দিয়ে পুকুর পাড়ে যাচ্ছিলেন। হঠাত পা পিছলে পড়ে গিয়ে মিনিট পনের বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। মেঝে মেয়েটা নামাজ, খাওয়া দাওয়া শেষে মাত্র ঘুমিয়েছে। ছোট মেয়েটা নিজের রুমে কি যেন করছে। পাশের বাড়ীর পিচ্চি মেয়েটা দেখে চিতকার দিয়ে ওঠে বড্ডা মা মরে গেছে। মুহুর্তেই সোর পড়ে গেল। কয়েকজন ধরাধরি করে বেড রুমে নিয়ে শুইয়ে দিল। একজন গেল ডাক্তার আনতে। মেঝে মেয়েটা চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে মা মা বলে ডাকছে। খানিক পর জ্ঞান ফিরে মিসেস জাহান বললো, কাঁদছিস কেন? আমি ভাল আছি। ডাক্তার সাজেস্ট করলো পেইন স্পেশালিস্ট দেখানোর জন্য।
মায়ের এই অবস্থা জেনে জনি কালক্ষেপন না করে পরের দিনই মাকে ঢাকায় নিয়ে এল। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে ল্যাব এইডে ডাক্তার দেখাল। পরীক্ষা নিরিক্ষার পর ডাক্তার জানাল কোমরের হাঁড় ক্ষয় হয়ে এসেছে, দুই হাতের জয়েন্টেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। দুইটি ইনজেকশন দেওয়ার পর যদি ব্যাথা কমে আসে, তাহলে অপারেশন করতে হবে না। তবে ডাক্তার ইয়া বড় একটা লিস্ট ধরিয়ে দিল। যাতে লেখা রয়েছে প্রাত্যহিক জীবনে কি করা যাবে... কি করা যাবে না।
ঢাকায় মিস জাহানের একটুও ভাল লাগে না। ঘরকুনো হয়ে থাকাটা তার মতে স্বেচ্ছা কারাবাসের মত। হরতালের কবলে পড়ে বড় ছেলের কাছে ছিলেন টানা ছয়দিন। জনি দুষ্টুমি করে বলে,মা বিয়ে করার পর তো তোমার সাথে সূক্ষ একটা বিচ্যুতি ঘটবে! তাই মা ছেলে একটু খোশ গল্প করি! মিস জাহান, হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলে, বিচ্যুতি ঘটবে কেন? বউয়েরও তো অধিকার আছে! কারো অধিকার খর্ব করলে এক সময়তো তা বিষ্পোরণ আকার ধারণ করে। আর এতকিছু চিন্তা করলেতো বিয়ে করতে পারবা না!!!
মেঝে মেয়েকে দেখতে ছেলে পক্ষ আজ আসবে। মিসেস জাহান সকাল থেকেই ব্যস্ত। কোন কোন আইটেম রান্না হবে, ঘরদোর ঘোচঘাচ আছে কিনা, ছোট ছেলেটা বাড়ী আসলে খেতেই চায় না-তাকে ধমক দিয়ে খাওয়ানো---সব সবই যেন তাকে দেখতে হবে।
এখানে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অচল।
হরতালের আগাম খবরে রাতেই চিন্তিত হয়ে পড়েন মিসেস বাসার। ছেলে দুটো যখন পরদিন সকালে ঢাকায় ফেরার অগ্রিম টিকেট কনফার্ম করলো তখন মশারি খাটিয়ে দিয়ে এক রকম বাধ্য করলো তাদেরকে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর জন্য।
ভোর ঠিক পাঁচটায় ছেলেদেরকে উঠিয়ে নামাজ পড়ার তাগিদ দিয়ে নাস্তা তৈরিতে লেগে গেল একাই। নাস্তা সেরে যখন বাস স্ট্যান্ড আসার জন্য জনি সিএনজিতে উঠবে এমন সময় একটি ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হন মিসেস জাহান। নিজেই সিএনজিতে ব্যাগটা তুলে দেয়। খানিকটা বিরক্তির সাথে আম্মাকে বকা দেয় জনি। বকা গায়ে না মাখিয়ে উল্টো বকা দিয়ে বলে, ঢাকায় কি খাস না খাস...
গাড়ী যখন দ্রুত গতিতে ছুটে চললো জনি তাকিয়ে দেখে মা তখনো দাঁড়িয়ে আছে বাড়ীর গেটের পাশে। যতদূর সিএনজি থেকে বাড়ীর গেট দেখা যায়..জনি দেখে মা দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে এসে জনি যখন ব্যাগটা খোলে তখন দেখে পরম যত্নে মা এক বাটি রান্না মাংস, নিজেদের গাছের বড় বড় চারটা পেঁপে, ১০/১৫ টা মাল্টা এবং ১৫/২০ টা আপেল মা ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
কৃতজ্ঞচিত্তে জনি যখন মায়ের কথা মনে করছে, সাথে সাথেই ফোন। বাবা, কতদূর গিয়েছিস...
মা বাসায় পৌঁছলাম-জনির পাল্টা উত্তর।
আমি কত টেনশানে আছি। আমাকে জানাস নাই কেন....
সরি...মা! সত্যিই তুমি মা। আই লাভ ইউ ...ভেরি ভেরি মাচ।......জনির অশ্রু মিশ্রিত প্রতি উত্তর।
উতসর্গ: আমার 'মা' কে...
কৃতজ্ঞতা: শুকনো পাতা কে। তার লেখা স্টিকি পোস্ট মায়ায় জড়ানো অনুভুতিগুলো.. পড়ে ছায়া পোস্টটি লিখতে উতসাহিত হলাম।
বিষয়: বিবিধ
৩০৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন