পণ্যের মোড়কে মানুষ, কাফনের মোড়কে মানবতা
লিখেছেন লিখেছেন শরীফ নজমুল ১৭ মার্চ, ২০১৫, ১০:১০:৩৫ রাত
যা আশা করেছিল তার চে ভাল দামে গরুগুলি বিক্রি হয়ে যায়। হোসেন আলী টাকা নিয়ে খুশি মনে রওয়ানা হন, কোন গাড়ি পেলে বাড়ি চলে যাবেন। হাটের মধ্যেই একজন সাথী হয় তার, চলেন চাচা, আমিও গাবতলী যাব। একসাথে যাই। ছেলেটি তাকে নিয়ে একটা সিএনজিতে ওঠে।। কিছুক্ষন পরেই এক সিগন্যালে ওঠে আরো দুইজন। সিএনজিতে চলতে শুরু করলেই একজন অস্ত্র বের করে, যা আছে দিয়ে দে, না হলে জানে মেরে ফেলব। হোসেন আলি বিপদ টের পায়। তাদের হাতে পায়ে ধরে, বলে বাবা এই টাকা দিয়ে দিলে সারা বছর পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকা লাগবে। কিন্তু তারাই বা তার কথা শুনবে কেন? এ তাদের বিরাট প্রজেক্ট ওয়ার্কের সাফল্য।
আসলে তাদের কাছে হোসেন আলি কোন মানুষ নয়, একটি পন্য, সম্ভাব্য টাকার থলি মাত্র। হোসেন আলির সারা বছরের পুজি আর পরিশ্রমের ঊপার্জন তারা উন্নত তর কৌশল খাটিয়ে নিমিষে হাতিয়ে নেয়। পুজিবাদের দুনিয়ায় টাকায় আসল, মানবতা নয়। তাদের সাহস বেশী, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনীকে ম্যানেজ করবার যোগ্যতা আছে, তাই তাদের সারা বছর হাড়ভাংগা খাটুনি খেটে গরু পালতে হয়না, বরং এ রকম প্রজেক্ট ওয়ার্ক করে কয়েকজন হোসেন আলির ঊপার্জন কেড়ে নিয়ে আরামে দিন কাটায়। তারা সমাজে সম্মান পায় আর হোসেন আলিরা পদে পদে নিগৃহীত হয়।
আসলাম সাহেব স্কুল শিক্ষক ছিলেন।পাচ পাচ জন ছেলে-মেয়ে কে যত্ন করে নিজে খেয়ে না খেয়ে মানুষ করেছেন। আজ বৃদ্ধ বয়সে তার ঠায় হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। ছেলে-মেয়েরা ব্যাস্ত তাদের চাকরি-সংসার নিয়ে। এই সংসারের বৃদ্ধ পিতার জায়গা হয় না। ছেলেরা তাদের যুক্তি নিয়ে আছে। বাবার থাকার জায়গা দরকার,খাবার দরকার,সেবা দরকার, চিকিতসা দরকার আমরা বিভিন্ন ব্যস্তাতায় এবং ঝামেলায় তা করতে পারব না, বরং খরচ দিয়ে দিচ্ছি ওর সব করবে, আমাদের চেয়ে ভাল ভাবে করবে। সবই তো ওখানে আছে।
তাদের চোখে বাবা-মা কোন মানুষ নয়, বরং সেবা প্রত্যাশী (service hungry)এক যন্ত্র, সার্ভিস পেলেই হলো। মানুশ হিসাবে তাদের আর কোন মুল্য নাই। যারা নিজেরা আয় করে না, তারা অনুতপাদনশীল পণ্যের বেশি কিছু নয়, তার জন্য গুদাম ভাড়াও যেন বেশী!!তাই কত নির্দিধায় আমরা বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছি।
মিস্টার রাশেদ একজন বড় ব্যাবসায়ী। সমাজ সেবা করেন, ক্লাবে যান। দেশ-বিদেশে ঘোরেন প্রতিনিয়ত। সুযোগ পেলেই তিনি যান দেশ -বিদেশের রেড-লাইট যোনে। টাকার বিনিময়ে কিনেন নারীর সংগ। কিন্তু তার বিবেক কখনও বাধা দেয় না।
এই নারীরা তার দৃষ্টিতে কোন মানুষ নয়, তারা দেহের পসরা সাজিয়ে বসা ভোগযন্ত্র মাত্র। তার টাকা আছে আর তাদের টাকা দরকার। অর্থনীতির চাহিদা-যোগানের সুত্রে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, যেন ঠেকানোর কিছু নেই। এই মেয়ে গুলির মানুষ হিসাবে বেচে থাকবার আকুতি, চাপা দুঃখবোধ গুলো কোন আধুনিকতার বিচারে কোন বিবেচনা যোগ্য কিছু নয়।
এই প্রসঙ্গে কথা সাহিত্যিক হুমায়ন আহমেদ এর ভ্রমন কাহিণি “দেখা না-দেখা” বই থেকে একটি অভিজ্ঞতা ও উনার মন্তব্য উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। লেখকরা বেশ কয়েকজন পারিবারিক বন্ধু বেড়াতে গেছেন থাইল্যান্ডে, দুঃখজনকভাবে দলে একজন ছিলেন পরিবার ছাড়া যার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তা তিনি একদিন এক থাই তরূনী জুটিয়ে আনলেন, রাত প্রতি ৫০০ বাথে। এক সন্ধ্যায় দলের একজন তার বাচ্চার জন্য ৫০০ বাথ দিয়ে কিনে আনলেন একটি রিমোট কন্ট্রোল খেলনা গাড়ি। বাচ্চাটি যখন খেলনা চালাচ্ছে, সবাই দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। থাই মেয়েটি যখন জানলো যে খেলনার দাম ৫০০ বাথ, সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী তে বলল, “me and toy same same 500 baht”. এরপর লেখকের নিজস্ব উক্তিঃ “মানবজীবনের কি করূন পরাজয়”। এখানেও আমরা দেখছি যে থাই মেয়েটি নিজকে মানুষ ভাবতে পারছে না, সেও মোড়ক দেয়া একটা পণ্য, এক বুড়োর খেলনা। এই খেলনার লোভেই থাইল্যান্ডে সভ্য মানুষদের উপচে পড়া ভীড়!
ফারুক একজন কর্পোরেট কর্মকর্তা। বেতন পেয়ে বেশ ভালো ভাবে দিন যাচ্ছিল। সহজ-সরল জীবন ছিল তার। ভালো একটা চাকরি পেয়ে সে নিজেই বিভিন্ন কোম্পানীর বিভিন্ন জিনিষ বিক্রির টার্গেটে পরিণত হয়। আজ এই ব্যাংক থেকে ফোন আসে তো কাল ঐ ব্যাংক থেকে। আজ ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানী থেকে তো কাল গাড়ি কোম্পানী থেকে। জীবন টা দ্রুত বদলে যেতে থাকে। ব্যাংক লোন-ক্রেডিট কার্ড নিয়ে বিলাস বহুল জীবন ঢুকে যায় সে। এক পর্যায়ে কোম্পানীতে জনবল ছাটাই শুরু হয়, কিছু বুঝবার আগেই অল্প কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে চাকরি চলে যায় ফারুকের।
ব্যাংকের কিস্তি, কিস্তিতে কিনা জিনিশের জন্য ফোন করে খিস্তি খেওর করতে থাকে কোম্পানীর লোকজন। ফারুক একজন মানুষ থেকে পরিণত হয় ঋণ খেলাপীতে। যেই কোম্পানীর প্রতিনিধি স্যার স্যার করে মুখে ফেনা তুলে ফেলত তারা এখন ধমক দিয়ে কথা বলে। নতুন একটি চাকরি যোগাড় করতে না পেরে সে পরিণত হয় ডেট এক্সপায়ার হওয়া পচা পণ্যে। এই বিপদে কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনা, তার সুদিনের বন্ধুরা দূরে সরে যায়। কোম্পানীর প্রতিনিধিরা নতুন কাস্টমার খুজে, যারা এই সমাজের সচল পণ্য।
সময়ের বিবর্তনে আমরা নিজেদের সভ্য দাবী করি। বর্তমান সভ্যতার মুল্যায়ণ শুধু টাকা দিয়েই মাপা হয়। আমরা আগে শিখছিলাম টাকায় বাঘের দুধও মিলে কিন্তু তখনও মনে হয় আমরা জানতাম/মানতাম টাকা দিয়ে কিছু জিনিষ কেনা যায় না যেমন আইন, সম্মান, শিক্ষা ইত্যাদি। এখন এমন কোন জিনিশ আছে কি যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না? গরীবের মেধাবী সন্তান ঝরে যাচ্ছে টাকার অভাবে আর বিত্তবানের মাঝারী মেধার সন্তান বাইরে থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসছে। যেমন চিকিতসা বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে তেমনি পাচ তারকা মানের হাসপাতাল হয়েছে। কিন্তু গরীব মানুষ এখনো মারা যাচ্ছে কুকুর-বিড়ালের মত বিনা চিকিতসায় কিন্ত্ টাকা থাকলে দেশ-বিদেশে হচ্ছে চিকিতসার ব্যাবস্থা। যার টাকা আছে সেই সম্মানিত, কিভাবে টাকা আয় করল, সেই টাকায় কত মানুষের কান্না কিম্বা অধিকার মিশে আছে সেটা আমরা দেখি না। রাস্তার পাশে ছোট শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে দেখে কিম্বা অসহায় মানুষ কে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে আমাদের দুঃখবোধ হয় না, কারণ ওদের তো টাকা নাই, তাই ওরা মানুষ নয়। আইন চলে ক্ষমতাবানদের দেখানো পথে, ক্ষমতাবান দের সমর্থনপুষ্ট ছেলেরা পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষকে গুলি চালায় আবার থানায় গিয়ে পুলিশে সাথে মিটিং করে। কারন প্রতিপক্ষের আইন কিনবার মত টাকা বা ক্ষমতা নাই, তাই ওরা মানুষ নয়, ওদের অধিকার হরণে মানবতা কাদে না।
মানুষ ঢুকে গেছে টাকার মোড়কের মধ্যে, যার যত টাকা, সে তত দামী পণ্য, তার অন্যায় দাবীও মানবতা রক্ষার মত জরূরী। আর যার টাকা নাই সে যেন বাতিল হয়ে যাওয়া পণ্য, তার কোন দাম নাই, কোন অধিকার নাই। আর ক্রমেই মারা যাচ্ছে মানবতা, মানবাধিকার! মানবতা ঢুকে গেছে কাফনের কাপড়ের মধ্যে।
বিষয়: বিবিধ
১৫৬৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন