হল ভাকান্ট, শহরে কারফিউঃ যাবি কই? এরশাদ ভ্যাকাশনে এক স্মরণীয় ভ্রমন
লিখেছেন লিখেছেন শরীফ নজমুল ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৭:২১:০০ সন্ধ্যা
১৯৯০ সালের নভেম্বর মাস। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুংগে। আর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে, ঢাকায় আত্মীয়-স্বজন নাই, এমন কি হল ছাড়া শহরটাও ঠিক মত চিনি না।
এমন সময় একদিন বিকেলে বিশবিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনা করা হল (এটা কে আমরা তখন এরশাদ ভাকেশন বলতাম), হল ছাড়তে বলা হল, সাথে সাথে শহরে কারফিউ জারি করা হল। (সম্ভবত এটা ২৭শে নভেম্বর, ডাক্তার মিলন শহীদ হবার বিকেলে)। তো আমরা যাই কোথায়? হল কতৃপক্ষ অবশ্য বললনে পরবর্তী কারফিউ শিথিল না হওয়া পর্যন্ত আমরা হলে থাকতে পারব। অদ্ভুত অনিশ্চয়তায় থম থমে পরিবেশে রাত পার করে দিলাম।
পরদিন সকাল দশটায় দুই ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হলো। আর আমাদের বের হয়ে যেতে হল এক অনিশ্চিত ভ্রমনের উদ্দেশে।
ব্যাগ ঘাড়ে ঝুলিয়ে হাজির হলাম কমলাপুর রেল স্টেশনে। শুনলাম রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যাবে পদ্মা এক্সপ্রেস। লাইন ধরে টিকেট কেটে প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে উঠে পড়লাম আল্লাহর নাম নিয়ে। ট্রেন ছাড়বার পর সহযাত্রীদের কাছে শুনলাম এই ট্রেন দিনাজপুর যাবে, তখন আমার আত্মারাম খাচা ছাড়া। দিনাজপুর যেয়ে কি করব? ওখান কার কোন কিছুই তো আমি চিনিনা! কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, তেজগাও বা বনানী স্টেশনে নেমে যাব তাও সম্ভব নয় কারন বাইরে কারফিউ, তাছাড়া ঢাকাতে থাকবার জায়গা নেই, তো আর উপায় কি? ভাবলাম, আপাতত ট্রেনে বসে থাকি, দেখা যাক কি হয়।
ট্রেন মোটামোটি ভালই চলল। ময়মনসিংহের আগে একটা স্টেশন ছিল সুতিয়াখালী নামে। সে স্টেশনে ট্রেন থামল। দেখা গেল সম্প্রতি সময়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে উমেদখালী রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই খানে রওশন এরশাদের বাড়ি। সম্ভবত তার বাবার নামে স্টেশনের নাম করা হয়েছে উমেদখালী। ট্রেনে যাত্রীদের বেশীরভাগই ছিল বিভিন্ন ভার্সিটি-কলেজের ছাত্র। স্টেশনের নতুন নাম করন তাদের মধ্যে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের আগুন জ্বালিয়ে দিল। তারা স্টেশনে নেমে মিছিল শুরু করল এবং স্টেশন টি ভাংচুরের চেষ্টা শুরু করল। আমি ট্রেনে দাঁড়িয়ে এসব দেখছি। ছাত্রদের মিছিল শুরুর অল্প সময়ের মধ্যে স্থানীয় লোকজন বিভিন্ন অস্ত্র যেমন বড় বড় হাসিয়া, রামদা, ছুরি-চাকু নিয়ে স্টেশনে এসে উপস্থিত। তাদের রণভংগী দেখে বীরপুংগবেরা ট্রেনে উঠে পড়েছে। আর স্থানীয় লোকজন প্লাটফর্ম জুড়ে টহল দিচ্ছে আর যারা স্টেশন ভাঙ্গার জন্য চেষ্টা করছিল তাদের হুংকার দিয়ে ট্রেন থেকে নামতে বলছিল।
আমি ট্রেনে বসে এসব দেখছি আর নভেম্বরের শীতেও ঘামছি। এমনিতে দিনাজপুর যেয়ে কি করব সেটা এক চিন্তা, তার উপর যদি এই লোকজন মারামারি শুরু করে তাহলে কি হবে সেটা ভেবে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই আশার আলো দেখতে পেলাম। হঠাত দেখি আমার ভার্সিটির বড় ভাই প্লাটফরমে নেমে উত্তেজিত জনতার মাঝ থেকে নেতা গোছের একজন কে শান্ত করবার চেষ্টা করছেন। এই বড় ভাইয়ের সাথে কিছুদিন আগেই পরিচয় হয়েছিল। উনার গ্রামের বাড়ি আমার জেলায়। সুতরাং একজন হলেও আমার এলাকার লোক আছে ভেবে আশ্বস্ত হলাম, দিনাজপুর যেয়ে উনাকে ফলো করলেই হবে!!
যাহোক, শেষ পর্যন্ত ওই বড় ভাই তাদের শান্ত করে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হলেন। প্রায় ৫-৬ ঘন্টা নষ্ট করে ওখান থেকে ট্রেন ছাড়ল। দেওয়ানগঞ্জ ঘাটে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় মধ্যরাত। পেটে হাজার ছুচোর লাফালাফি। ট্রেন থেকে নেমেই দৌড় দিলাম খাবার হোটেলে। পেট ঠান্ডা করেই আবার দৌড় ফেরীর উদ্দেশ্যে। এখানে প্রথম বর্ষের আরেক বন্ধুর সাথে দেখা, যার বাড়ি আমার জেলায়। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাচি, বললাম দোস্ত আমি তো একা একা ভয়ে মরছি, আমাকে তোমাদের সাথে নিও। ও আমাকে জানালো রাজশাহীর আরো অনেকেই আছে। আমি ফেরীতে উঠ তাদের গ্রুপের সাথে মিশে গেলাম। পেটও ঠান্ডা আর যথেষ্ট সংখ্যক সঙ্গী পাবার ফলে অনিশ্চয়তাও কেটে গেল। এবার শুরু হলো আনন্দের পালা।
ফেরী পার হয়ে নতুন ট্রেনে উঠতে হবে। আমার ১৫-২০ জন একটা ছোট বগীতে উঠলাম। চলল গল্প, হেড়ে গলার গান আর অবিরাম গ্যাজানো।
ভোর সাত টায় পৌছলাম পার্বতীপুর স্টেশনে। নেমেই দেখি রাজশাহি গামী উত্তরা এক্সপ্রেস প্লাটফরমে দাঁড়ানো, যাকে বলে “জাস্ট ইন টাইম”।আমরা উঠলাম আর ট্রেন ছেড়ে দিল। এবার মোটামোটি নিস্তেজ টিম, একদিন-এক রাত নির্ঘুম অনিশ্চিত যাত্রার পর সবার চোখ ঢুলু ঢুলু...আড়াই টার সময় রাজশাহি তে......বিকেল তিনটা থেকে আবারো কারফিউ শুরু হবে রাজশাহীতে। এরমধ্যে চাপাই নবাবগঞ্জের বাস ধরে বাড়ির উদ্দেশে।
সন্ধ্যা ৬ টায় বাড়িতে, মায়ের কোলে, ঢাকা টু চাপাই নবাবগঞ্জ, মাত্র ৩০ ঘন্টা!!
ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা।
বিষয়: বিবিধ
১২৭৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন