অবেলায় অনিশ্চিতে

লিখেছেন লিখেছেন শরীফ নজমুল ০৩ মার্চ, ২০১৩, ০৩:০১:২৯ দুপুর

ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হন মিসেস রোকেয়া। পুরো ফ্লাটের দিকে তাকান একবার। কত দিনের স্মৃতির পরিসমাপ্তি আজ! অজান্তেই অশ্রুরা এসে ভীড় করে চোখে। শাড়ির এক কোনা দিয়ে চোখ মুছে নেন।

একটি সুটকেসেই তার প্রয়োজনীয় জিনিশ পত্র ধরে যায়। অবশ্য প্রয়োজনটাই যে ফুরিয়ে আসছে। তাকে যেমন পৃথিবীর আর প্রয়োজন নেই, তেমনি তথাকথিত পৃথিবীর জিনিশপত্রের প্রয়োজনও তার ফুরিয়ে গেছে। কত জিনিষ আজ অবলীলায় ফেলে যাচ্ছেন অথচ একেকটা জিনিষ কত আগ্রহ নিয়ে জমিয়েছেন তিনি! একটা রান্নার কড়াই হয়ত কিনেছেন দুই-তিন মার্কেট ঘুরে ঘুরে, সংসারের একটি ছোট জিনিশ পাবার জন্য কত পেরেশানী ছিল তার। এটা নিয়ে তার স্বামী হাসতেন, কি যে পাগলামি কর রোকেয়া। তিনি কপট রাগ করতেন, বলতেন এসব সংসারের জিনিশের মায়া বোঝা তোমাদের কর্ম নয়। আজ তিনি নিজের মনেই হাসেন, হায় তার পুরো সংসার ফেলে রেখে তিনি আজ চলে যাচ্ছেন, চিরতরে!

মুকুলের মা এসে টুপ করে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। আম্মাগো, দোয়া কইরেন। তিনি তার হাতে হাজার দশেক টাকা গুঁজে দেন, এগুলো রাখ, লুকায়ে রাখবে, বিপদে আপদে কাজে লাগবে। মুকুলের মা চোখ মোছে, বলে নিজের শইল্লের যত্ন নিয়েন গো আম্মা। মুকুলের মা গত পাচ বছর তার বাড়িতে কাজ করত। তাঁর স্বামী গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন তাকে, বিধবা মুকুলের মা মমতা আর ভালবাসা দিয়ে আগলে রেখেছিল এই সংসার, হয়ে উঠেছিলেন তাদের সুখ দুখের সাথী। আজ মুকুলের মাও চলে যাবে তার ছেলের বাড়িতে। মুকুল কে খবর দিয়ে আনা হয়েছে।

মিসেস রোকেয়া এবার মুকুল কে ডেকে বলে, শোন, মায়ের দিকে খেয়াল রাখবে। আমি যেখানে যাচ্ছি, আর তোমাদের কোন খোজ রাখতে পারব না। আর যে টাকা তোমাকে পাঠিয়েছি তা দিয়ে একটা অটো রিক্সা কিনবে।

“খালাম্মা, আপনি চিন্তা নিয়েন না, আমরা গরীব-অশিক্ষিত মানুষ কিন্তু মারে ফালায়ে দিব না” মুকুলের কথাটা যেন শেলের মত এসে বিধে মিসেস রোকেয়ার বুকে। তিনি আর কথা বাড়ান না। মুকুল তার মায়ের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে স্মৃতির রাজ্য হাতড়ে বেড়ান মিসেস রোকেয়া। প্রায় চল্লিশ বছর আগে এই ফ্লাটে ওঠেন তিনি। ফ্লাটে ওঠার আগে সে কি উত্তেজনা, টাইলস পছন্দ করা, দেয়ালের রঙ কি হবে, আসবাব পছন্দ করা আরো কত কি? ওঠার পর কত যত্ন... সকালে বুয়া ঘর মুছে যাবার পরো বিকালে তিনি নিজের হাতে আরেক বার ঘর মুছতেন। বাচ্চারা রংগীন পেন্সিল হাতে নিলেই ছুটে যেতেন এই দেয়ালে লিখবে না, নিজেদের বাড়ি। হায় নিজেদের বাড়ি......তিল তিল করে গড়ে তোলা এই সংসার ছেড়ে আজ অনিশ্চিতের পথে যাত্রা! টেলিফোনের শব্দে ধ্যান ভাংগে, নীচ থেকে সিকিরিউটি ফোন দিয়েছে।

ম্যাডাম, আপনার জন্য একটা গাড়ি এসেছে।

ঠিক আছে, ড্রাইভার কে উপরে পাঠিয়ে দাও। আমার ব্যাগ টা নামিয়ে দিবে।

দরজা খোলাই ছিল। কোম্পানীর পোষাক পরা অল্প বয়স্ক একজন ড্রাইভার দরজায় এসে দাঁড়ায়।

“ম্যডাম, আপনি আমাদের কোম্পানী থেকে গাড়ি ভাড়া করেছেন, গাজীপুর যাবেন বলে। আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি।“

“আপনি কি আমার ব্যাগটা নামাতে সাহায্য করবেন?” অনুরোধ করেন মিসেস রোকেয়া।

“ঠিক আছে, আমি ব্যাগটা গাড়িতে রেখে আসছি, তারপর আপনাকে নামতে সাহায্য করব। আর, ম্যাডাম আমাকে তুমি বললে আমার খুব ভাল লাগবে, আপনি আমার মায়ের মত”। ছেলেটির ব্যাবহারে মুগধ হন মিসেস রোকেয়া।

ছেলেটি চটপট ব্যাগ নামিয়ে আবার উঠে আসে, “ম্যাডাম, চলেন”। তার হাতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে নামেন মিসেস রোকেয়া আর বার বার তাকে ধন্যবাদ দেন।

এভাবে বার বার ধন্যবাদ দেবার প্রয়োজন নেই, ম্যাডাম। আপনি আমার মায়ের মত। ম্যাডাম, আমার নাম হাবিব। নিজে থেকেই পরিচয় দেয় ড্রাইভার ছেলেটি। আপনি আমাকে আপনার ছেলের মতই মনে করবেন আর নাম ধরে ডাকবেন। কোন সমস্যা মনে করলে নির্দিধায় বলবেন। আমি চেষ্টা করব যেন আপনি আরামে আপনার গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন।

হাবিব যত্নের সাথে মিসেস রোকেয়া কে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। ম্যাডাম, আপনি গাজীপুর কোথায় যাবেন? জানতে চায় সে।

সেটা না হয় যেয়েই দেখবে। তবে গাজীপুর যাবার আগে আমি শহরের কিছু জায়গায় ঘুরতে চাই, আশা করি তোমার কোন সমস্যা হবে না।

ঠিক আছে ম্যাডাম, এই গাড়ি আজ সারাদিনের জন্য আপনার, আপনি যেখানে বলবেন, সেখানেই নিয়ে যাব। কোন সমস্যা নেই।

ছেলেটিকে ভাল লেগে গেছে মিসেস রোকেয়ার। ভাড়া করা গাড়ির এমন নম্র-ভদ্র ড্রাইভার পাবেন ভাবেন নি। তার ছেলে দুটি বিদেশে বড় পদে অধিষ্ঠিত, মায়ের খবর নেবার সময় তাদের হয় না। ড্রাইভার ছেলেটির সন্তান-সম ব্যাবহারে তার তৃষ্ণার্ত মাতৃহৃদয় হাহাকার করে ওঠে। দোদুল্যমনতা কাটিয়ে অনেকটা লোভীর মতই বলে বসেন, বাবা তুমি

আমাকে ম্যাডাম ম্যাডাম বলবে না কিন্তু। খালাম্মা বলতে পার, চাইলে মা-ও বলতে পার।

ঠিক আছে, মা বলুন প্রথমে আপনাকে কোথায় নিয়ে যাব?

ম্যাডামের ইচ্ছায় প্রথমে মতিঝিল যায় হাবিব, এক বিশাল বিল্ডিং এর সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে বলেন তিনি।

তুমি কি জান এটা কার অফিস? হাবিব কে জজ্ঞেস করেন তিনি।

হ্যা, এটা তো শাপলা গ্রুপের অফিস, দেশের অন্যতম বড় ব্যাবসা প্রতিসঠান। হাবিব বলে। আমি কয়েকবার এখানে আমাদের অফিস থেকে ডিউটি করতে এসেছি।

আমি এই অফিসে পাচ বছর চাকরি করেছি। বিজনেস প্রমোশন অফিসার হিসাবে জয়েন করেছিলাম। আমার দ্বিতীয় সন্তানের জন্মানোর পর বাচ্চাদের মানুষ করার জন্য চাকরি ছেড়ে দেই। অবশ্য আমার ম্যানেজার আমাকে বার বার নিষেধ করেছিল।

মা, আপনার কি মনে হয় যে আপনি ভুল করেছিলেন? হাবিব জানতে চায়।

না বাবা, আমি অবশ্যই ভুল করিনি। আমি বাচ্চাদের মানুষ করেছি। আমার দুই ছেলেই বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। আজ তারা দুজনই আমিরিকায় থাকে, ওখানে কত বড় চাকরি করে, তা তো তুমি জান না।

আরো কিছুক্ষন গাড়ি থেকে অফিসের দিকে তাকিয়ে থাকেন মিসেস রোকেয়া। যেন অতীতের দিনগুলি হাতড়ে বেড়ান স্মৃতির মনিকোঠায়। তারপর হাবিব কে বলেন, চলো যাই।

হাবিব গাড়ি চালিয়ে এবার বুয়েটে আসে। গাড়ি পার্ক করে ম্যাডাম নেমে যান। হেটে হেটে বেড়ান ক্যাম্পাস জুড়ে। হলেও যান। হাবিব অপেক্ষা করে। ফিরে এসে হাবিব কে ছেলেদের গল্প বলেন।

আমার দুই ছেলেই এখানে পড়েছে। বেশিরভাগ সময় তারা বাসায় থাকত। তবে পরীক্ষার সময় এসে হলে থাকত। দুই-একদিন পার হলেই আমি অস্থির হয়ে যেতাম তাদের দেখার জন্য। বিভিন্ন রকম খাবার রান্না করে নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় হলে চলে আসতাম। ওদের রুমমেট সহ সবাইকে খাইয়ে ছেলে কে দেখে যেতাম।

আপনি এখন ছেলেদের কাছে যান না কেন? আমিরিকায় চলে গেলেই তো পারেন। সরল মনেই জানতে চায় হাবিব।

সে প্রশ্নের উত্তর আমি তোমাকে দিতে পারব না। বিব্রত ভাবে বলেন মিসেস রোকেয়া।

ছেলেরা দেশে আসে না?

বড় ছেলে এসেছিল পাচ বছর আগে। ছোট টি ছয় বছর আগে। এরপর তাদের আর সময় হয় নি। অনেক বড় চাকরি করে তো। তবে ফোন করে মাঝে মাঝে। আসবার সময় পায় না। ছয়মাস আগে ওদের বাবা মারা যান, তখনো তারা আসতে পারেনি। মা-বাবার চেয়ে চাকরি, সন্তানের পড়াশুনা ইত্যাদি তাদের কাছে অনেক গুরুত্বপুর্ন। মার চোখে এবার পানি।

মা আমি দু;খিত, মনে হয় আপনাকে কষ্ট দিলাম ছেলেদের কথা জিজ্ঞেস করে।

না বাবা, তুমি কষ্ট দিবে কেন? আমি নিজেই যে কষ্টের সাগরে সাতার কাটছি প্রতিনিয়ত, তাতে এসব আর গায়ে লাগে না।

দুপুর হয়ে গেছে। হাবিবকে নিয়ে মিসেস রোকেয়া এবার যান শেরাটন হোটেলে। হাবিব গাড়ি পার্ক করে আসলে তাকে নিয়ে খেতে বসেন রেস্টুরেন্টে, খেতে খেতে নিজের জীবনের গল্প শুনান তিনি হাবিব কে।

এই হোটেলে আমি অনেকবার এসেছি। আমার স্বামী একটা বিদেশী কোম্পানীতে চাকরি করত। তার অফিসের অনুসঠান হত প্রত্যেক বছর এই হোটেলে। প্রথম দিকে আমি গানও করেছি সেই অনুসঠান গুলোতে। পরে অবশ্য আর গান করতাম না, তবে আসতাম প্রত্যেকবারই। সন্তানদের মানুষ করাই ছিল আমার ধ্যান। মানুষ করে তাদের পর করে দিয়েছি।

আজ মায়ের খবর নেবার মত বিলাসিতা ওরা আর করে না। স্বামীকে নিয়ে তবুও ভালই ছিলাম। ছয়মাস আগে হঠাত করে তিনিও চলে গেলেন আমাকে একলা ফেলে। ফ্লাট টা আমার নামেই ছিল, কিন্তু একা সেই ফ্লাটে বাস করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তাই ওটা বিক্রি করে দিলাম। পুরো টাকাটা দিয়ে দিয়েছি “নিজের ঘর” বৃদ্ধাশ্রমে, এটা দিয়ে ওরা অনেক আশ্রয়হীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জায়গা হবে। আমিও বাকী জীবন ওখানেই থাকব। নিজের ছেলে-মেয়ের সাথে থাকার কপাল যাদের নাই এমন কিছু দুর্ভাগা-অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাথে একাত্ম হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলি নিরিবিলিতে কাটিয়ে দেয়াই এখন আমার ব্রত।

মিসেস রোকেয়া কথা শেষ করেন। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে হাবিব কে বলেন, চলো যাই। নিজের ঘর নামের সেই বৃদ্ধাশ্রমে আজ তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। করেছে বৃদ্ধাশ্রম, নাম দিয়েছে “নিজের ঘর”। ওখানে যাবার জন্যই আমি গাড়ি ভাড়া করেছি।

হাবিব বলে, মা, আপনার দুই ছেলে আজ বিদেশে, কিন্তু আজ থেকে জানবেন আমিও আপনার এক ছেলে। যদি কখনও প্রয়োজন মনে করেন অবশ্যই খবর দিবেন। বলে হাবিব তার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার লিখে মিসেস রোকেয়ার হাতে দেন।

হাবিব গাড়ি নিয়ে রওয়ানা করেন গাজীপুরের দিকে। পথে আর কেউ কোন কথা বলে না।

হাবিব ঠিকানা খুজে পৌছে যায় “নিজের ঘর” নামক বৃদ্ধাশ্রমে, গাজীপুর থেকে প্রায় ১৫ কিমি. দূরে, বেশ সুন্দর আধুনিক ডিজাইনের বাংলো টাইপের বাড়ি। গাড়ি থেকে নামেন মিসেস রোকেয়া, দুজন এটেন্ডেন্ট এগিয়ে আসে। মিসেস রোকয়া ঘুরে হাবিবের হাত ধরে কান্নারুদ্ধ কন্ঠে বলেন, “বাবা আমার একটা কথা রাখতেই হবে তোমাকে। আমি এদের কাছে তোমার নাম-ঠিকানা দিতে চাই। আমি মারা গেলে তুমি আমার জানাযায় আসবে, আমার খাটিয়া ধরবে এবং আমাকে কবরে নামিয়ে দিবে। তবুও জানব যে আমার এক ছেলে আমাকে শেষ বিদায় দিয়েছে”।

বলে তিনি এটেন্ডেন্টদের সাথে রওয়ানা করেন বৃদ্ধাশ্রমের ভিতরে।

হাবিব দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর চলে যাওয়া দেখে। চেষ্টা করেও চোখের অশ্রুকে বাধা দিতে পারে না হাবিব, তার চোখ ভরে যায় অবাধ্য অশ্রুতে।

বিষয়: বিবিধ

১৭৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File